(১)
কাকডাকা ভোরে ঘুম ভাঙ্গার পরই যখন আমাদের আধপাকা ঘরের দু’পাল্লার দরজাটা খুলে দেই তখন বাইরের স্নিগ্ধ বাতাসটুকু আমার চোখ-মুখে এক ভিন্নরকম অনুভুতি মিশিয়ে দেয়। সারা রাতের বদ্ধ ঘরের গোমট বাতাস আমার পিছন থেকে পালিয়ে গিয়ে মিশে যেতে চায় স্ব-জাতি অথচ খোলা, মুক্ত বাতাসের মাঝে। আমার ঘুমকাতুরে চোখ জোড়া বারান্দায় ফোটে থাকা গোলাপের কাছে জানতে চায়- ওরা কেমন আছে, সারা রাত কেমন কেটেছে। উঠানের এক কোনে টগবগে জবা ফুলের গাছের নিচে সারা রাত ঘেউঘেউ করা কুকুরটি তার উপর অর্পিত দায়িত্ব শেষে আপন মনে ঘুমাচ্ছে। এ যে সুখের ঘুম! চিন্তাহীন ঘুম।
এমন মায়াবী ভোর কখনই দেখা হয়না আমার। কীভাবে দেখবো! আমার মতো এক আলসে মেয়ের পক্ষে এই রকম স্নিগ্ধ, মায়াবী ভোর দেখা সত্যিই কঠিন কাজ। কাক ডাকার সাথে সাথে মায়ের রাতে জমানো বাসন ধোয়ার শব্দ, তার সাথে আবার উচ্চ কন্ঠে আমার নাম ধরে চেচামেচি, সব কিছুই আমার কাছে ‘অতিরিক্ত’ মনেহত। তাই প্রথম ভোরের প্রথম দরজা খোলা, আমার দ্বারা কখনই হয়ে উঠেনি।
গতরাতে মা আমাকে জানিয়ে রেখেছিলেন পাশের বাড়ীর রঞ্জু কাকুর বাগানে শিউলি ফুল ফোটেছে। মায়ের শিউলি ফুল খুবই পছন্দ। আমাকে জানালেন, ঠাকুর পূঁজোয় শিউলি ফুল নাকি এক অন্যরকম আবহ সৃষ্টি করে। গতবছর মা নিজেই শিউলি ফুল কুড়িয়েছেন। এই হেমন্তে দায়িত্বটা পড়েছে আমার ঘাড়ে। তাই আজ আমার শিউলির জন্য প্রথম ভোরের প্রথম স্বাদ নেওয়া।
রঞ্জুকাকুর বাড়ীর উঠানের এক কোনায় দাড়িয়ে আছে ধূসর বর্ণের শিউলিফুলের গাছটি। কতশত বার গাছটিকে দেখেছি, কত রকমের খেলা খেলেছি এই গাছটির নিচে। তবে ফুল কুড়াতে এসে গাছটি যেন নতুন মোড়কে, নতুন রুপে ধরা পড়লো আমার চোখে। এ যেন নব যৌবনের ষোড়শী কোন কিশোরী। সবুজ ঘাসের উপর আলতো ভাবে পড়ে আছে সাদা আর লালচে-কমলা রঙ্গের শত শত শিউলি ফুল। টান টান সবুজ বিছানায় শিউলি ফুলের নরম আবরন। প্রথম দেখাতেই শিউলির প্রতি আমার ভাললাগা জন্মে গেল। আজ আমি অনুভব করলাম, আমার মনের কোনে কেন জানি চির ধরেছে। শিউলি ফুলকে আমার খুব ভালবাসতে ইচ্ছা করলো। আজ তার সুবাস নিতে ভাল লাগছে, তার নরম ছোঁয়া নিতে ভাল লাগছে।
আমি শিউলি ফুলের সুবাস নিচ্ছি, ছোঁয়া নিচ্ছি, আদর করছি। আমি যেন আমিতে নেই। পৃথিবীর সকল মুগ্ধতা এই শিউলি ফুলে ভর করেছে। আমি খেলছি এক অজানা খেলার নিয়মে। তবে সব খেলারই সমাপ্তি আছে। থামতে হয়। তাই আমিও থামলাম, আমাকে থামিয়ে দিতে বাধ্য করা হয়। যখন আমার চঞ্চল চোখ জোড়া রঞ্জু কাকুর বড় দেয়ালের এক জানালায় স্থির হলো তখন আমার শিউলি ফুল নিয়ে অজানা খেলা কিছু সময়ের জন্য থেমে গেল। আমি নিরব, নিস্তব্ধ, যেন হাজার বছরের পুরানো শেওলা পড়া পাথর খন্ড। উত্তাল সমুদ্র হঠাৎ যেন বদ্ধ পুকুর। জানালার ওপাশ থেকে এক জোড়া গুপ্ত চোখ আমাকে গিলে খাচ্ছে, আমি খেয়াল করিনি।
ফুলের ডালাটাকে এত ভারী মনে হচ্ছে কেন ? আমার কী হাত কাঁপছে ? ডালাটা ফেলে শুধু হাতের মুঠে যে কয়টা ফুল ধরে তা নিয়েই বাড়ির দিকে দৌড়ি আমি। বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবি- কে সে ? রঞ্জু কাকুর বাড়ীতে অনেকবার গিয়েছি, কিন্তুু ঐ চোখ জোড়া কখনও দেখিনি তো। আমার দিকে সে কেন অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল ? ষোল বছরের আমার দিকে অনেকেই তো তাকায়। কই, আমার তো হাত কাপেনি। মনে হাজার প্রশ্ন, উত্তর জানা নেই। মায়ের চিৎকারে আমার ভাবনাটা ভেঙ্গে গেল।
- শ্যামা, ফুল এনেছিস ?
- হ্যাঁ, মা।
(২)
আজ ভোরে আমাকে আর ডাকতে হয়নি। শিউলির প্রতি একধরনের টান মনের মধ্যে বাসা বেঁধেছে। তাছাড়া জানালায় দেখা ঐ চোখ জোড়া আমাকে এত বিদ্ধ করেছে, যা মুছে ফেলা রীতিমত দুঃসাধ্য। ঘুমকাতুরে চোখ নিয়ে একটা দু’টা করে ফুল কুড়াচ্ছি আমি। কিছুটা অজানা ভয়ে, আতংকে, জানালার দিকে চোখ নিলাম। আবার সেই চোখ জোড়া ! হ্যাঁ, গতকালের চোখ জোড়া ! আমার মাথাটা নত হতে থাকে। যেন লজ্জাবতী। এই মাত্র কিছু একটা আমাকে স্পর্শ করেছে যেন। কুড়িয়ে তোলা শিউলিগুলো আমাকে না জানিয়ে হাত থেকে পড়তে শুরু করেছে। নিজেকে পালাতে প্রস্তুত করছি আমি। আমার পা ঠিক মত চলবে তো ? হঠাৎ শুনিÑ শ্যামা, দাঁড়ান।
আমার পা কাঁপছে, এক অজানা ভয়ে। আমার নামটা তো অনেকের মুখেই শুনি। আমার মা তো শ্যামা শ্যামা বলে সারাটা বাড়ি মাতিয়ে রাখেন। বান্ধবীরা একবার বলে শেমা, আরেকবার বলে শামা। কিন্তু এত গম্ভীর ভাবে ‘শ্যামা’ কখনও শুনা হয়নি। আমার নামটা যে এত শ্রতিমধুর তা আজ আবিষ্কার করলাম আমি। কান দিয়ে যেন রিমঝিম ছন্দে হৃদয়ে প্রবেশ করলো শব্দটা। তবে, সে আমার নামটা জানলো কী করে! জানতেই পারে। বাবা বলতেন -ইচ্ছে থাকলেই নাকি সবকিছু জানা সম্ভব।
আমি নিয়ম মানা বাধ্য মেয়ের মত দাড়িয়ে রইলাম। এ যেন কোন রাজপুত্রের আদেশ অথবা বিনয়ের সুরে আকুতি। এই ধরাতে অমান্য করা সাধ্য কার। আমিতো এক ষোড়শী মাত্র। খেয়াল করলাম, পাশের দরজা খুলে এক পা দু’পা করে আমার কাছে আসছে সে। গায়ে শ্বেত-শুভ্র পাঞ্জাবী, যেন পুরো গায়ে শিউলি ফুলের পাপড়ি জড়ানো। আচ্ছা, এই সাতসকালে কেউ পাঞ্জাবী পড়ে কী ? যাক্ , কেউ না পড়–ক। তাকে কিন্তু মন্দ লাগছে না। সকালের সোনালী রোদ তাঁর গায়ে পড়ায় এক মোহনীয় আভা ছড়িয়ে পড়েছে। দিদিমার কাছে রাজপুত্রের অনেক গল্প শুনেছি। তখন কল্পনায় রাজপুত্রের ছবি একেছিলাম। এ কী সেই রাজপুত্র !
- শিউলি ফুল ভাললাগে আপনার ?
আমি শুধু ‘হুম’ বলতে পারলাম।
- এত ফুল দিয়ে কী করেন আপনি ?
- মা পূঁজো দিবে।
- তাই!
- হুম।
- আপনি কী এই মায়াবী ফুলের করুন কাহিনী জানেন ?
তার এমন প্রশ্নের জন্য আমি অপ্রস্তুুত ছিলাম। ভাবছি, সে কি গায়ে পড়ে একটু বেশি কথাই বলছে। আবার ভাবছি, বলুক না। এই সময়টাতে কথা বলতে তো খারাপ লাগছে না আমার। তাছাড়া সব কিছুই যে নিয়মমাফিক চলবে তা তো নয়। নিয়ম ভাঙ্গে নতুন নিয়মের জন্যই।
- কিছু ভাবছেন ?
- হুম, না।
- বলছিলাম কি, আপনি যদি কাহিনীটা না জানেন তবে ......
- কী ? আমাকে শুনাবেন ?
- হুম, চাইলে শুনাবো।
- তবে চাইলাম।
একটু হেসে বললাম আমি। যেন আমি নিজেকেই পশ্রয় দিচ্ছি। ধরা পড়ছি এক অদৃশ্য মায়ার জালে।
- তাহলে শুনুন। এই যে মায়াবী রঙ্গিন ফুলগুলো দেখছেন, তার কিন্তুু অনেক কষ্ট, তার মনে জমা আছে শত অদৃশ্যায়মান হাহাকার।
- ফুলের মনে হাহাকার, কষ্ট ! কী বলছেন এসব!
- হ্যাঁ। এটা এক রাজকুমারীর গল্প। রাজকুমারী সূর্যদেবতাকে ভালবেসে না পেয়ে সে ফুলগাছে পরিণত হয়। তাই সূর্য দেবতাকে যেন আর তাঁর না দেখতে হয়, সেজন্য সূর্য উঠার আগেই ফুলগুলো ঝরে পড়ে গাছ থেকে। এই রাজকুমারীর নাম কী জানেন ? পারিজাতিকা। তাই এই শিউলির অন্য নাম পারিজাত!
- তাই ! আপনি এত্ত জানেন।
- হুম, জানতে হয়। এই যে দেখুন, আমি আপনার এত সুন্দর নামটা জেনে গেছি ।
- তাই!
বাড়ী ফিরতে একটু দেরি হওয়ায় মা কখন যে রঞ্জু কাকুর বাড়ীর উঠানে দাড়িয়ে আমাদের দেখছিলেন খেয়াল করিনি। বাড়ী এসে আমাকে শুধু এইটুকুই বললেন, তোকে ফুল কুড়াতে পাঠিয়ে ছিলাম, কারো সাথে কথা বলতে নয়।
দিনটা একটু আবোল তাবোল ভাবেই কাটিয়েছি। কোথায় যেন কী হয়ে গেল ! সবই ঠিক আছে, তবুও কোখায় যেন একটু অস্থিরতা। যে গানটা ভাল্লাগেনা বলে শুনিনা আর, তাই শুনছি আজ; বারে বার। শিউলি ফুল শিউলি ফুল কেমন ভুল এমন ভুল.....
(৩)
গত রাতে বৃষ্টির এমন রূপ দেখে ভয় পাইয়েছিলাম। ভোরে শিউলিতলায় যেতে পারবো তো ? না , রাতের বৃষ্টির রেশ এই ভোরে আর নেই। হয়তো ভগবান আমার মুখ ফোটে না বলা প্রার্থনাটুকু গ্রহন করেছেন। রাতের বৃষ্টি আর শীতের আগাম কুয়াশা আজ ভোরের দৃশ্য পুরোটাই পাল্টে দিয়েছে। একটু তাড়াহুড়ো করেই শিউলি বাগানে ছুটলাম আমি। আজ শিউলির গায়ে কাদার চিহ্ন লেগে আছে, তাই তাদের জন্য একটু খারাপই লাগছে আমার।
গোপন দৃষ্টিতে জানালার দিকে তাকাই। জানালাটা আজ পাষানের মতো বদ্ধ। আবার দীর্ঘ দৃষ্টিতে তাকাই। না, এবারও বদ্ধ। আমার হৃদয়টা ধুরধুর করে উঠল। হঠাৎ যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত, আর তা শুধু আমার হৃদয়েই। কাঠের জানালাটাকে আজ এমন দেখাচ্ছে কেন ? গতকালও এটি ছিল সতেজ, রঙ্গিন। আজ কেন বিবর্ণ, ভাবলেশহীন? জানালাটায় একটু ধাক্কা দিব আমি? ভেঙ্গে চুরমার করে দিব! না, রঞ্জু কাকু কী ভাববেন। সব কিছু এলোমেলো লাগছে কেন আমার? কোথায় সে ? কোথায় তাঁর চঞ্চল চোখ জোড়া ?
সকালের আলো ফোটতে শুরু করেছে। সোনালি আলোর পরশ পেয়ে শিউলি ফুলের গাছটা আরো আলো ছড়াচ্ছে। কিন্তুু আমার ভেতরটা ? সূর্যকে আজ আমার ভয় লাগছে কেন! আমি তো প্রাচীন কালের কোন এক পারিজাতিকা নয়। আমি এযুগের শ্যামা। আমার তো সুর্যকে ভয় পাওয়ার কথা নয়। তাহলে....
তারপর রঞ্জু কাকুর ছোট মেয়ের কাছ থেকে পাওয়া একটা চিঠি ......
শ্যামা,
কোন সম্বোদন ছাড়াই শুরু করছি।
ক’দিন হলো এই বাড়ীতে আছি আমি। সেদিন রাতে কেন জানি কিছুতেই আমার ঘুম আসছিল না । কাকডাকা ভোরে যখন জানালাটা খুলে দেই তখনই আপনার ফুল কুড়ানোর দৃশ্য আমার নজরে আসে। হাতে ফুলের ডালা নিয়ে আপনি এমন আনমনে ফুল কুড়াচ্ছিলেন, যেন ফুলের একটি পাপড়িও আঘাত না পায়। এই দৃশ্য দেখে আমি আমার ছেলেবেলায় ফিরে গিয়েছিলাম। আমার মায়ের জন্য কত ফুল কুড়িয়েছি আমি !
এরই মধ্যে আপনার সাথে অকারনে শিউলি ফুল নিয়ে প্রলাপ বকেছি । আপনিও তখন মুগ্ধ ছাত্রীর মত আমার প্রলাপ ইচ্ছা অথবা অনিচ্ছায় শুনেছেন।
তবে আজ আমাকে যেতে হচ্ছে। আবার পুরানো ক্লাস, বন্ধু, আড্ডা, সবই নতুন করে শুরু হবে আবার। আমি আবার ইট পাথরের শহরে পুরোদমে ব্যস্ত সময় কাটাবো। হয়তো আবারও ফিরব এই শিউলিতলায়।
এদিকে, আপনার জীবনে আবার নতুন ভোর আসবে। নতুন শিউলি ফোটবে। তা হবে আরো রঙ্গিন, আরো সতেজ। আপনি ঠাকুর পূঁজো দিবেন, শিউলির মত সাদা আর লালচে-কমলা রঙ্গের শাড়ী পড়ে। চন্দনের মনমাতানো সুবাস পুরো বাড়ী মাতিয়ে রাখবে। আপনার মা লতার মত বেড়ে উঠা আপনাকে খেয়াল করবেন গোপনে। সবই চলবে আপন নিয়মে।
তাই এত কিছুর ফাঁকে, মনে থাকবে কী এই ক’দিনের আমাকে ?
চিঠির এপর্যন্ত এসেই আমি মনের অজান্তে বলে উঠি- হুম, কেন নয় ।
চিঠির শেষ প্রান্তে আর পৌছতে পারিনি। যখন নিচের লেখাগুলো ঝাপসা লাগছিল, তখন খেয়াল করলাম চোখের নরম পর্দায় এক স্তর নোনা পানি জমে আছে। বৃষ্টির পানি যেভাবে রাস্তায় পড়ে থাকা কোন পলিথিনে অনাদর অবহেলায় জমে থাকে, সেভাবে।