মেসির ডায়েরী থেকেঃ
প্লেন থেকে নামার পরই মেজাজ খারাপ। ‘এখনি দিয়ে দিব’- বলে আগুয়েরো আমার সাধের সানগ্লাসটা নিয়ে লাপাত্তা। এদিকে ওটা খুঁজতেও যেতে পারছি না। কারণ, বাফুফে সভাপতি সালাউদ্দিন সেই যে আমার হাত ধরেছে... আর ছাড়ার নাম নাই! ওদিকে ভি,আই,পি লাউঞ্জ দেখি শত শত সাংবাদিকে গিজগিজ করছে। এত সাংবাদিক! ক্যামেরার ফ্ল্যাশের চোটে চোখ অন্ধ হওয়ার জোগাড়। মনে মনে আরেকবার আগুয়েরোর পিন্ডি চটকাইলাম। সালাউদ্দিনকে জিজ্ঞাসা করলাম, এতো সাংবাদিক কেন? উনি যা বললেন তাতে যতটুকু বুঝলাম, এখানে কিছু সাংবাদিক, আর বাকিরা তাদের আত্মীয়-স্বজন। নিয়ম না থাকলেও আর্জেন্টিনা দল বিশেষ করে আমাকে দেখার জন্য সবাই নাকি কিছু ‘মাল’ খরচা করে এসেছে।
আমি অবাক হলাম। মাল?! এর মানে আবার কি? মালদিনি বলে একজন খেলোয়ার ছিলো বলে জানতাম। কিন্তু শুধু মাল বলতে বাংলাদেশে কি বোঝায় কে জানে! যাই হোক, প্রায় ৪ ঘন্টার সংবাদ সম্মেলনে বিষয়টা প্রায় ভুলেই গেসিলাম। কিন্তু এয়ারপোর্ট থেকে বের হতেই ঝামেলাটা নতুন করে দানা বাঁধলো। হাজার হাজার সমর্থকদের প্ল্যাকার্ডের মধ্যে একটাতে চোখ আটকে গেলো। লেখা-- Messi! U r a Mal! ভারী যন্ত্রণা তো! পাশে বাফুফের এক কর্মকর্তাকে ছিলো। নাম হেলাল। ইনিও প্লেন থেকে নামার পর পরই আমার ছায়াসঙ্গী হয়েছেন। মাঝে শুধু একবার বাথরুম গেসিলাম, তখনও দরজার বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিলো! ইশারায় ডাকতেই উড়ে এলো। জিজ্ঞাসা করলাম, মাল মানে কি? বেচারা কেমন ভেবড়ে গেলো! ইতস্তত করে বললো একটু পরই নাকি বুঝা যাবে।
বিমানবন্দর ছাড়তেই হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। গাড়িতে আমার পাশে হিগুয়েন মন খারাপ করে বসে আছে। ভি, আই, পি লাউঞ্জে কোন এক মেয়ে সাংবাদিক (আমার মতে সাংবাদিকের আত্মীয়) ওকে ধরে চুমু দিয়ে দিয়েছে! হিগু পালটা কিছু করার আগেই ওই মেয়েকে পুলিশে (কালো পোশাক পড়া) ধরে নিয়ে গেছে। আমি স্বান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বললাম- ভেবো না, সম্ভবত তুমিও একটা মাল! হিগু চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকালো। আমি শুধু হাসলাম।
বাফুফে ভবনটা বেশ ভালোই। সালাউদ্দিনের রুমে স্যান্ডউইচ খাওয়ার পর ভেবেছিলাম এবার হয়তো বিশ্রাম নেওয়া যাবে। কিন্তু তাকে বিশ্রামের বিষয়টা বলার আগেই শুরু হলো নতুন ঝামেলা। এদেশে মনে হয় সব জায়গায় পরিবারতন্ত্র চালু আছে। প্রথমেই সালাউদ্দিনের পরিবার আসলো। এরা আবার আমার হ্যান্ডশেকে সন্তুষ্ট না। সবাই কোলাকুলি চায়। প্রায় প্রত্যেকের কাঁধে হাত রেখে ছবি তুলতে হলো।এরপর অন্যান্য কর্মকর্তাদের পরিবার। ছেলে-বুড়ো যা এসেছে সবারই গায়ে আর্জেন্টিনার জার্সি। পুলাপানদের মাথায় হাত দিয়ে বলতে হলো- জীবনে আমার মত হও! (অবশ্য না বলে উপায়ও ছিলো না। সালাউদ্দিনের বিশেষ অনুরোধ- সবাই-ই নাকি মাল খরচা করে এসেছে, তাই দোয়া দিতে হবে!) মালের বিষয়টা নতুন করে মাথায় আসতেই হেলালকে খুঁজতে লাগলাম। ইতিউতি তাকাতেই চোখ পড়লো আগুয়েরোর উপর। হারামজাদা আমার সানগ্লাস পড়ে মেয়েদের সাথে ভাব নিচ্ছে! সানগ্লাসটা ফেরত নিতে যেই উঠতে যাবো, অম্নি সোফায় আটকে গেলাম!
দুইটা বাচ্চা কোথা থেকে ঊড়ে এসে আমার পায়ে পড়েছে (পড়ে জেনেছি, এগুলা হলো বাফুফের দারোয়ানের বাচ্চা-কাচ্চা)। পাশে দাড়ানো খাকি ড্রেস পড়া এক লোক বলছে- চুমা খা, চুমা খা। আমি ব্যস্ত হয়ে পিচ্চিগুলা সরানোর আগেই দেখি এরা আমার পা চেটে অস্থির! যাই হোক, এই উপদ্রব থেকে আমায় বাঁচালো সালাউদ্দিন। আমাকে উদ্ধার করে নিয়ে চললো অন্য এক রুমে। সেখানে নাকি দুইজন ভি,ভি,আই পি আমার জন্য অপেক্ষা করছে!
দুটি মেয়ে। প্রায় সমবয়েসীই হবে। এরা দুইজনেই নাকি বৈদেশ থেকে চলে এসেছে শুধুমাত্র আমাকে দেখার জন্য! হালকা পুলকিত হইলেও অল্পক্ষণেই তা উবে গেলো। অটোগ্রাফ দেওয়ার পর ছবিতে গিয়েই বিপত্তি। ছবি তুলতে গিয়ে দুইজনেই প্রায় আমার কোলে ঊঠে যেতে চায়! কে আগে কোলে উঠবে সেই নিয়ে ঝগড়া। অতঃপর থাপড়া থাপড়ি। শেষে চুলাচুলি! আমি ঘাবড়ে গিয়ে সালাউদ্দিনকে জিজ্ঞাসা করলাম, এরা কারা? বিব্রত সালাউদ্দিন বললো, এরা নাকি দেশের দুই নেত্রীর নাতনী! এই দেশে দুই নেত্রীতে নাকি খুব ঝগড়া। এদের পরিবারও তার ব্যতিক্রম না!! পরে কর্মকর্তারা জোর করে ওদের ধরে নিয়ে গেলো। আমিও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
পরের কাহিনী বেশ সংক্ষেপ। নাইজেরিয়ার সাথে প্রীতি ম্যাচ, স্টেডিয়ামে হাজার হাজার সমর্থকের মেসি মেসি ধবনি, আবার সেই সংবাদ সম্মেলন পর্ব এবং ক্লান্তির চূড়ান্ত। প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনেও পদধূলি দিতে হয়েছে। মাঝে অবশ্য রোমেরো আর ডি মারিয়া রিক্সা ভ্রমণ করতে গেসিলো। পথে কয়েক হাজার সমর্থকের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে এখন ওরস্যালাইন-এন খাচ্ছে!
বিদায়বেলায় কিছুটা খারাপই লাগলো। এতো সমর্থনতো আমি আমার শহরেও পাই না! আনুষ্ঠানিকতা শেষে প্লেনে উঠার ঠিক আগ মূহুর্তে হঠাত সেই পুরাতন রোগটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। সালাউদ্দিনকে সুধালাম সেই পুরাতন প্রশ্ন- ব্রাদার, মাল মানে কি? সালাউদ্দিনের চোখ মুখ কিরাম যেন হয়ে গেলো। আস্তে করে বললো- মাল মানে খাবার! আমি সরল হেসে বলে দিলাম-- বাংলাদেশের মালগুলা সত্যিই খুব ভালো! তবে মালে ঝাল একটু বেশি আরকি!! অতঃপর সালাউদ্দিনের হা হয়ে যাওয়া মুখ পেছনে ফেলে প্লেনের দিকে পা বাড়ালাম।.........