somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নূপুর

১৪ ই জানুয়ারি, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:৩৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

নূপুর
অভিনু কিবরিয়া ইসলাম

খোঁজ মিলল অবশেষে...
অফিসে কাজ করছিলাম। হঠাৎ একটা ফোন এল। আনোয়ারের ভাই সবুজের। আনোয়ারকে পাওয়া গেছে।
আট মাস হলো আনোয়ারকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। অবশেষে পাওয়া গেলো। সামরিক বাহিনীর সদস্যরা, এত এত মিডিয়া, স্বজনের উৎসুক চোখ যাকে খুঁজে পায় নি, তাকে খুঁজে পেল সুরুজ মিয়া নামের এক টোকাই! তবু তো তার সন্ধান পাওয়া গেলো, এও বা কম কী! এদেশে কত শত মানুষ হারিয়ে যায়, সবার কি আর খোঁজ মেলে?
কেন জানি একটা দীর্ঘশ্বাস বের হলো। সবুজকে বললাম, আনোয়ারকে বাড়িতে নিয়ে যেতে টাকাপয়সা লাগবে কি না, লাগলে অফিসে এসে নিয়ে যেতে। ও বলল, দরকার নেই। আমি ফোনটা রেখে দিলাম। মাথা ধরেছে। কলবেল চাপলাম। বছরখানেক আগেও এই বেল চাপলে আনোয়ার এসে হাজির হতো। এখন এল রফিক। বললাম এক কাপ কফি দিতে। আনোয়ারের কথা মনে পড়ছে। আনোয়ার খুব ভালো কফি বানাতো।

আমাদের আনোয়ার..
আমি একটা এনজিওতে কাজ করি। গরীব মানুষদের নিয়ে আমাদের অনেক প্রজেক্ট। গরীবদের ল্যাট্রিনের ব্যবস্থা, জন্মনিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে পনের পার্সেন্ট সুদে সহজলভ্য ক্ষুদ্রঋণসুবিধা দেওয়া আমাদের কাজ। গরীব দেখিয়ে আমরা বিদেশ থেকে টাকা আনি আর সেই টাকার একটা বড় অংশ দিয়ে গরীবের সাহায্যে আমরা যেসব দেবদূত অফিসের এসিরুমে বসে দিনের পর দিন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করা মাথাটা খাটাই, তাদের বেতন হয়। এই অফিসেই আমার বেতনের পনের ভাগের একভাগেরও কম বেতনে পিওন-টাইপের একটা পোস্টে চাকরি করতো এইট পাশ আনোয়ার। আনোয়ারের বাড়ি আমাদের পাশের গ্রামে, এই তথ্যটি আবিষ্কার হবার পর অফিসের ডেকোরাম এবং কর্পোরেট কালচারকে একটু অবজ্ঞা করেই ওর সাথে আমার কিছুটা সখ্যতা হয়। এ কারণে অফিসের লোকজনের টিটকারীও শুনতে হতো আমাকে। কলিগরা বলতো, আরাফাতসাহেব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া অবস্থা থেকেই একটু বাম-ঘেঁষা তো, তাই আনোয়ারের সাথে অমন খাতির। আনোয়ারের সাথে আমার সখ্যতার পেছনে গ্রামের বাড়ির স্থাণিক নৈকট্য বা তথাকথিত বাম-ঘেঁষা মনোভাব যতটা না প্রণোদনা যোগাত তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিলো আনোয়ার আমার একজন বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য ইনফর্মার ছিলো। অফিস পলিটিক্সে আনোয়ারের এই স্পাইগিরি আমার বেশ কাজেও আসত। অফিসে বিদেশি ডেলিগেট আসলে মদ ও মেয়েমানুষ জোগাড় করার অপ্রিয় কাজগুলিতেও আনোয়ার বেশ দক্ষ হয়ে উঠছিলো এর এজন্য বেশ ভালো উপরিও মিলতো তার। আমাকে সে কোন কারনে বিশেষ ভক্তি করতো, তাই অনেক সময়ে আমার বাসার বাজার, মেয়েকে স্কুল থেকে নিয়ে আসার দায়িত্বও হাসিমুখে পালন করতো সে। হঠাৎ অফিসের দু’টো বিদেশি ফান্ড বন্ধ হয়ে যাওয়া কোপ পড়ে যে ক’জনের চাকরির ওপর, তার মধ্যে আনোয়ারও ছিলো। আমি চেষ্টা করেও তখন ওর চাকরিটা বাঁচাতে পারি নি। আমার সাথে সখ্যতাই কাল হয়েছিলো ওর। পরে ও একটা গার্মেন্টসে চাকরি নেয় এবং নিখোঁজ হবার আগে শেষ যে দিন ওকে সবাই দেখেছিল, সেদিনও সে ঐ গার্মেন্টসে কাজ করতে গিয়েছিলো।

একটি উপহার...
গতবছর বিজয় দিবসের খুব সম্ভবত দু’দিন আগে, মানে ওর চাকরি যাওয়ার প্রায় মাসখানেক আগে হবে-সন্ধ্যেবেলায় আনোয়ার আমার বাসায় বাজার করে দিয়ে চলে যাচ্ছিল। হঠাৎ কি মনে করে যেন আমার সাথে দেখা করতে এল। স্পষ্ট মনে পড়ছে, আমি ড্রয়িংরুমের সোফায় হেলান দিয়ে বসে টিভিতে খবর দেখছিলাম। মুখটা কাঁচুমাচু কওে আনোয়ার বলল ওর হাজারখানেক টাকা দরকার। ধার। সামনের মাসের বেতন পেলেই শোধ করে দেবে। আমি একটু অবাকই হয়েছিলাম। সাধারণত ও আমার কাছে টাকা চায় না। আমি জিজ্ঞেস করলাম বাসায় কোন সমস্যা কি না। ও মুখ নিচু করে বলল, না। তাহলে টাকা কেন লাগবে এই প্রশ্ন করতেই দেখলাম ওর ফর্সা মুখটা কেমন লাল হয়ে গেছে। আমি মজা পেয়ে চেপে ধরলাম। আমি খবর পেয়েছিলাম, গার্মেন্টেসের কোন এক মেয়ের সাথে ওর খাতির হয়েছে। বুঝতে পারছিলাম বোধহয় ঐ মেয়েকেই কিছু কিনে টিনে দিতে চায় ও। চাপাচাপিতে ও স্বীকার করলো, ওর যে মেয়েটার সাথে ভাব হয়েছে তাকে ও একজোড়া রূপার নূপুর কিনে দিতে চায়। মেয়েটার সাথে ক’দিন আগে মার্কেটে ঘোরার সময় মেয়েটার নূপুরটা পছন্দ হয়েছিল। টাকা না থাকায় সেদিন ওটা ওরা কিনতে পারে নি। আনোয়ার যা বেতন পায় তা দিয়ে মাসের প্রথমেই মেসভাড়া, মিলের টাকা শোধ করে বাকি টাকার অধিকাংশই বাড়িতে পাঠায়। তাই প্রেমিকার শখ মেটানোর মত টাকা তার হাতে থাকে না। বিজয় দিবসে ও তার সেই প্রেমিকাকে ঐ নূপুরজোড়া কিনে উপহার দিতে চায়।
বিজয় দিবস নিয়ে আনোয়ারের আবেগ সম্পর্কে অবশ্য আমি আগে থেকেই পরিচিত। আনোয়ারের বাবা শরাফত আলী ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা। কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা অঞ্চলে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করেছিলেন তিনি, যার প্রমাণ হিসেবে আজও তিনি বাম পায়ে বহন করে চলেছেন বুলেটের ক্ষতচিহ্ন। মুক্তিযুদ্ধ যে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে সঞ্চারিত হয় তা আনোয়ারকে দেখেই আমি বুঝেছিলাম। এখনো মনে আছে, যেদিন সাঈদীর ফাঁসির রায় হলো তখন আনোয়ার আমাদের অফিসে আর নেই, সেসময়েও কী উচ্ছাসে সে আমাকে ফোন করেছিল! যাই হোক, আনোয়ারকে সেদিন আমি টাকাটা দিয়েছিলাম। কৃতজ্ঞতাবশত পরদিন অফিসে লাজুক লাজুক চেহারা নিয়ে আমাকে নূপুরটি দেখিয়েছিল আনোয়ার। নূপুরটি দেখতে বেশ সুন্দর ছিল। চুলের বেণীর মত কাজ করা।

সালেহাদের গল্প...
এরপর আনোয়ারের কাছ থেকে তার প্রেমিকা সালেহার কথা অনেক শুনেছি। সালেহার বাড়ি গাইবান্ধায়। বয়সে আনোয়ারের চেয়ে বছরদুয়েকের বড় হবে। ওর একবার বিয়ে হয়েছিল ১৭-১৮ বছর বয়সে। ফুলছড়িতে ছিলো ওর শ্বশুরবাড়ি। বছর সাতেক আগে যখন ওর শ্বশুরবাড়িটি নদীর পেটে চলে যায় তখন ওর স্বামী ওকে ওর বাবার বাসায় রেখে আসে। এরপর ওর স্বামী আর ফিরে আসেনি। পরে শুনেছে ওর স্বামী ঢাকায় রিকশা চালাতে এসে সেখানে আর একটা বিয়ে করেছে। বাপের বাড়িতে সালেহার ছোট তিনটি ভাইবোন আছে। বুড়ো বাবা-মা আর ভাইবোনদের দিকে তাকিয়ে ছোটবেলার বান্ধবীর সাথে চলে আসে সাভারে। গার্মেন্টসে কাজ নেয়। আনোয়ারের মেসের সামনেই কতগুলো বস্তির মতো বেড়া দেওয়া ঘরে একটাতে সালেহা আর তার বান্ধবী থাকে। রাতে ওভারটাইম শেষ করে যখন তারা দল বেঁধে বাড়ি ফিরত, তখনই আনোয়ারের সাথে প্রায় দেখা হত সালেহার। সেখান থেকেই পরিচয়, প্রেম।
সালেহার মত নারী গার্মেন্টস শ্রমিকদের নিয়েও আমাদের বেশ কিছ চটকদার প্রজেক্ট আছে! এসব প্রজেক্টে মাথা ঘামাতে গিয়ে দেখছিলাম, গার্মেন্টসে কাজ করতে গিয়ে মেয়েরা এখন অনেকটা সাহসী হয়ে উঠেছে। এরা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ায় ওদের হাঁটাচলাতে একধরণের আত্মবিশ্বাস খেয়াল করলে বোঝা যায়। গার্মেন্টসের মেয়েদের মধ্যে পরিবারের বাঁধনটুকুও কিছুটা আলগা হয়ে গেছে। এই মেয়েরা আর স্বামীর প্রতি নির্ভরশীল নেই। নিজের স্বকীয় স্বাধীন অস্তিত্ব সম্পর্কে ওদের কিছুটা ধারণা জাগ্রত হয়েছে। প্রায়ই দেখা যায় এই মেয়েরাই অকর্মন্য, দুশ্চরিত্র স্বামীকে ফেলে রেখে এসে একলা, স্বাধীন জীবনযাপন করতে পছন্দ করছে। হয়তো অন্য কোনো পুরুষের সাথে ঘনিষ্টও হচ্ছে। এরকম এক পরিবেশে সালেহাও হয়তো কিছুটা বদলে গিয়েছিল। আগের স্বামী-শ্বশুরবাড়ির পিছুটান ছুঁড়ে ফেলে তার থেকে বছর দুয়েকের ছোট আনোয়ারের সাথে ঘনিষ্ট হবার সাহসটুকুর পেছনে জ্বালানি জুগিয়েছে হয়তো গার্মেন্টসের ঐ যৎসামান্য মজুরিই। আমি খবর পেতাম, সালেহার বান্ধবী না থাকলে আনোয়ার নাকি প্রায়ই সালেহার সাথে ওই বেড়ার ঘরে রাত কাটায়। আনোয়ারের মেসে থাকা আমার অফিসের এক কর্মচারী এই অভিযোগ করেছিলো আমার কাছে। আমি খুব একটা পাত্তা দেই নি।
সালেহাকে কখনো আমি সামনা-সামনি দেখিনি। আনোয়ার একদিন তার মানিব্যাগ থেকে বের করে সালেহার ছবি দেখিয়েছিলো। শ্যামলা রংয়ের গোলগাল মুখ। নাকটা একটু চ্যাপ্টা তবে চোখদুটি বড় বড়, কাজল দেয়ায় আরো বড় লাগছিল। আমি বলেছিলাম, ‘বেশ তো তোর লাভারটা! বিয়ে করে ফেল তাড়াতাড়ি।’ আনোয়ার মৃদু হেসেছিলো সলজ্জ ভঙ্গিতে। অফিসের চাকরিটা চলে যাবার পর সালেহা যে গার্মেন্টসে চাকরি করতো সেই গার্মেন্টসেই কেমন করে জানি চাকরি জুটিয়ে নিয়েছিলো আনোয়ার।

ভাই, স্লামালিকুম...
আনোয়াররা যে ভবনে কাজ করতো তা ছিলো একটা মার্কেট। সেই ভবনটার নাম এখন অনেকেই জানেন পত্রপত্রিকার বদৌলতেÑ সোহেল প্লাজা। এক সোহেল প্লাজায়ই ছিলো চারটা গার্মেন্টস যেখানে কাজ করতো আনোয়ার ও সালেহার মত হাজার দশেক শ্রমিক। এই সোহেল প্লাজার মালিক সোহেল খান আমার পরিচিত। তিনি স্থানীয় এমপি সাহেবের খুব কাছের লোক। আমার বসের সাথেও তার বেশ খাতির, সেই সূত্রে তার সাথে আমার পরিচয়। স্বাস্থ্য ভালো, ফর্সা গোলগাল মুখ, মুখে হালকা ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি। আমাদের অফিসেই তার সাথে আমার বেশ ক’বার দেখা হয়েছে। যতবার দেখা হয়েছে, প্রতিবারই তাকে আমি বসের রুমে বসে স্বভাবসুলভ নির্লিপ্ত মুখভঙ্গিতে সিগারেট ফুঁকতে দেখেছি । দেখামাত্র প্রতিবারই আমি তাকে সালাম দিতাম ‘ভাই স্লামালিকুম’ বলে। উনি গর্বিত ভঙ্গিতে কোন কথা না বলেই মাথা ঝাঁকিয়ে আমার সালাম গ্রহণ করতেন এবং আমি যথাসম্ভব বিনয়ের হাসি মুখে ফুটিয়ে রেখে, বসের সাথে প্রয়োজনীয় আলাপ সেরে বসের রুম থেকে পালিয়ে বাঁচতাম। যে বিজয় দিবসে আনোয়ার সালেহাকে নূপুর উপহার দিয়েছিলোÑ সেই বিজয় দিবসে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ওহী নিয়ে আসা একজন ফেরেশতারূপে সোহেল সাহেবকে তার ছাদখোলা গাড়িতে বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে তার অনুগত চ্যালাদের মোটরসাইকেল শোভাযাত্রার নেতৃত্ব দিতে আমরা সবাই দেখেছি। সেই রাতে, সোহেল প্লাজার নিচতলায় তার অফিসে বিলেতি মদের আসর বসেছিলো বিজয় সেলিব্রেশনে, সৌভাগ্য কিংবা দুর্ভাগ্যক্রমে বসের সাথে সেই পার্টিতে আমিও অতিথি ছিলাম এবং দু’পেগ টাকিলাও গলাধঃকরণ করেছিলাম ভদ্রতা রক্ষার্থে।
এই সোহেল সাহেবই যে তার সাধের ‘সোহেল প্লাজা’ বানিয়েছেন জোরপূর্বক দখল করা একটি মজা পুকুরের উপরে আলাদীনের চেরাগের মাধ্যমে প্রাপ্ত টাকায় নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা না করেÑ তা আমরা জেনেও না জানার ভান করতাম। গত এপ্রিলে সেই সোহেল প্লাজায় ফাটল দেখা দিলো। তালা পড়লো তার সাধের সোহেল প্লাজায়। সোহেল সাহেব আমার বসকে ফোন দিলেন। আমার বস তার পরিচিত ক’জন ইঞ্জিনিয়ারকে জোগাড় করে দিলেন যারা রিপোর্ট দিলেন এই প্লাজা ভূমিকম্পেও ধ্বসে পড়বে কি না সন্দেহ। অতঃপর সোহেল সাহেব বৈঠক করলেন তার প্লাজায় যে সকল গার্মেন্টস রয়েছে তার মালিকদের সাথে। ফলপ্রসূ মিটিং-এর পর একটি রিকশায় একটানা বেশকিছুক্ষণ মাইকিং হলো সালেহা-আনোয়ারদের বাসার সামনে দিয়ে। সোহেল-প্লাজার শাটার উঠলো। আনোয়ার-সালেহাদের কাজে যোগ দিতে বলা হলো।

নিকষ অন্ধকার...
পরদিন সকালে আমি অফিসে বসেই একটা বিকট শব্দ শুনলাম। শুনলাম ধ্বসে পড়েছে সোহেল প্লাজা। টিভিতে ব্রেকিং নিউজ দেখানো হচ্ছিলো। মিডিয়ার লোকজনদের দৌড়াদৌড়ি শুরু হলো। উদ্ধারে নিয়োজিত হলো সেনাসদস্যেরা। আমি জানালা দিয়ে দেখছিলাম অফিসের পাশের হাসপাতালটিতে একের পর এক অ্যাম্বুলেন্স ঢুকছে আর বের হচ্ছে। তখনো কেউ বুঝে উঠতে পারি নি, কত মানুষ ছিলো তার ভেতর। আমি আনোয়ারকে ফোন দিলাম, ফোন রিং হচ্ছিল। কেউ ধরলো না।
সোহেল সাহেবও সোহেল প্লাজার গ্রাউন্ড ফ্লোরে আটকা পড়ে ছিলেন। সোহেল প্লাজা ধ্বসে পড়ার পরপরই অজস্র শ্রমিকের আহাজারি চিরতরে থেমে যাওয়ার আগেই মাননীয় সাংসদ তার বীরযোদ্ধা সোহেলকে নিরাপদে উদ্ধার করতে সশরীরে চলে এলেন। তখনো অনেক শ্রমিক হয়তো মরে নি, নিকষ অন্ধকারে তীব্র ব্যথা এবং বুকের ছাতি ফেটে যাওয়ার মত তৃষ্ণার বোধটুকু যখন আস্তে আস্তে স্তিমিত হয়ে আসছে কেবলÑতখন দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও পরাক্রমশালী সোহেল সাহেবের দোষ চাপিয়ে দিলেন বিরোধীদলের ঘাড়ে। বললেন, বিরোধী দলের সমর্থকরা পিলার টানাটানি করায় ঘটেছে এই দুর্ঘটনা। সোহেলসাহেব তখন ফেনসিডিলের ক’বোতল জোগাড় করে পার্শ্ববর্তী দেশের উদ্দেশ্যে পালাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিলেন, সোহেল তার দলের কেউ নন।

কংক্রীটের স্তুপে একটি প্রশ্নবোধক...
সোহেল প্লাজা ধ্বসে পড়ার দু’দিন পরে আনোয়ারের ছোট ভাই সবুজ কাঁদতে কাঁদতে এসেছিলো আমার বাসায়। বলল, তার ভাইকে পাওয়া যাচ্ছে না। দুর্ঘটনার পর আনোয়ারের মোবাইলটা চালু ছিলো প্রায় ৩০ ঘন্টা, এরপর বন্ধ পাওয়া যায়। সবুজ দু’সপ্তাহ অপেক্ষা করে ছিলো আনোয়ারের লাশের আশায়। তা না পেয়ে ফিরে গিয়েছিলো গ্রামের।
আট মাস পর। সেদিন ছিল সোমবার। শীতের সূর্য ডুবি ডুবি করছিল আর আরেকদিকে পূর্ণ চাঁদ সবটুকু আলো নিয়ে জোছনা ঢেলে দেওয়ার মহড়া দিচ্ছিল। নদীর পাড়ে ফেলে রাখা ধ্বংসস্তুপে টোকাইরা খেলছিল আর কুড়োচ্ছিল সেই সব উচ্ছিস্ট যা বিকোবে বাজারে। হঠাৎ একটা মাথার খুলি দেখে চিৎকার করে ওঠে সুরুয মিয়া নামের এক কিশোর, যাকে আমরা টোকাই বলে ডাকি। বাকি সবাই এসে দেখে কংক্রীটের স্তুপে প্রশ্নবোধক চিহ্নের মত সেঁটে আছে একটি খুলি। স্থানীয় জনতার ভিড় লেগে যায়। উদ্ধার হয় খুলিটি। আরো উদ্ধার করে দশহাত দূরে একদা খুলির সাথে লেগে থাকা শরীরের অবশিষ্ট হাড়গোড় যার সাথে মাংসের বদলে আটকে ছিলো শতচ্ছিন্ন ধূলি-কাদামাখা শার্ট ও প্যান্টের অংশবিশেষ। প্যান্টের পকেটে মানিব্যাগটা ছিল প্রায় অক্ষত। মানিব্যাগে আইডি কার্ড ছিল যেটা ছিলো কঙ্কালটিকে শনাক্ত করার একমাত্র প্রাথমিক সূত্র। নাম, আনোয়ার আলী, বয়স-২৫, সুইং সহকারী, নিউ ওয়েভ বটমস। আইডি কার্ডের প্লাস্টিকের ভেতর যতœ করে রাখা ছিল একটি পাসপোর্ট সাইজের ছবি। ছবিটি একটি ২৭-২৮ বছরের তরুণীর। মেয়েটিকে আমি চিনি। ওর নাম সালেহা।
আনোয়ারের বাবা শরাফত আলী খবর পেয়ে মঙ্গলবারেই চলে এসেছিলেন। আমি অবশ্য জানতাম না। ছেলের খুলি ও হাড়গোড়ের দখল পেতে তাকে পাঁচদিন অপেক্ষা করতে হয়। জেনেটিক পরীক্ষা শেষে নিশ্চিত হয়েই তার হাতে খুলি ও হাড়গোড় তুলে দেন দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ। উপরি হিসেবে কয়েকহাজার টাকা তাৎক্ষণিক সাহায্য, আরো কিছু ক্ষতিপূরণ পাওয়ার আশ্বাস মেলে তার। যত্ন করে সাদা কাপড়ের একটা পোঁটলা বানিয়ে মুক্তিযোদ্ধা শরাফত আলী তার বড় ছেলের খুলি ও হাড়গোড় নিয়ে রওনা হন গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে যেখানে ইতোমধ্যেই একটা কবর খোঁড়া হয়েছে বাড়ির পাশের পুকুরপাড়ে। দাফন সম্পন্ন হবার পরই আনোয়ারের ছোটভাই সবুজের ফোনটা পেয়েছিলাম আমি। শুনেছি ওর কবরের পাশে একটা বকুলগাছ রোপণ করা হয়েছে।

এবং একটি বেয়াড়া পা...
সালেহাও যে সোহেল প্লাজাতেই কাজ করতো তা আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। ও বেঁচে আছে কি না জানতে পারি নি বহুদিন। জানতে যে খুব একটা চেষ্টা করেছি তাও নয়। ধ্বসের ৭ দিন পর খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম, সালেহা আর সালেহার বান্ধবী ভবন ধ্বসের পর আর ফেরে নি। এরপর আর খোঁজ নেয়া হয় নি। আনোয়ারের খোঁজ পাওয়ার কথা শুনে সালেহার কথা মনে পড়লো। এবং কাকতালীয় এবং অপ্রত্যাশিতভাবে, আনোয়ারের লাশ দাফন হবার পরদিনই সালেহার খোঁজ পেয়ে গেলাম।
আনোয়ারের লাশ ধ্বংসস্তুপে খুঁজে পাওয়ার পর ফেসবুকে আবার এই ইস্যু নিয়ে গরম গরম বক্তব্য দেওয়া শুরু হলো। অনেকে দাবি করলেন, এখনো ধ্বংসস্তুপে হাজারো লাশের অবশেষ খুঁজে পাওয়া যাবে। আমার এক ফেসবুক বন্ধু ভবন ধ্বসের পরপরই তোলা একটি আলোকচিত্র সহকারে দুর্ঘটনাটি নিয়ে আট মাস আগে লেখা তার পুরনো কবিতাটি পুনরায় শেয়ার দিলেন। এই আলোকচিত্রটি এতদিন পর আমার চোখে পড়ল। আলোকচিত্রটির জন্য আলোকচিত্রী কোন ভালো পুরষ্কারও পেয়ে যেতে পারেন।
সোহেল সাহেব সেই আলোকচিত্রটি দেখেছেন কী না জানি না-ছবিটি দেখে আমার মনে হলো সোহেল খানদের প্রতি তীব্র ঘৃণা দেখাতেই যেন ধ্বংসস্তুপ থেকে বের হয়ে আছে একটা প্রতিবাদী পা। পুরো শরীরটিই ধ্বংসস্তুপে কংক্রীট আর পাথরে চাপা, তবু ঐ বেয়াড়া বিদ্রোহী পা’কেই চাপা দিতে পারে নি কেউ- গোড়ালির সামান্য উপর থেকে বের হয়ে আছে তা। পা’টি যে একজন নারীর তা বোঝা যায় কেননা পায়ের সাথে বাঁধা একটি রূপার নূপুর অক্ষত ঝুলে আছে। নূপুরটি দেখতে সুন্দর। চুলের বেণীর মত কাজ করা।

(গল্পটির সব চরিত্র কাল্পনিক। বাস্তবের সাথে এর কোন অংশ মিলে গেলে তা অনভিপ্রেত কাকতালমাত্র!)
৭টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ট্রাম্পকে শুভেচ্ছা জানালেন ড. ইউনূস

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:১০





যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় ডোনাল্ড ট্রাম্পকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।শুভেচ্ছা বার্তায় ড. ইউনূস বলেন, ‘মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ের জন্য আপনাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শীঘ্রই হাসিনার ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৩৮


পেক্ষার প্রহর শেষ। আর দুই থেকে তিন মাস বাকি। বিশ্ব মানবতার কন্যা, বিশ্ব নেত্রী, মমতাময়ী জননী, শেখ মুজিবের সুয়োগ্য কন্যা, আপোসহীন নেত্রী হযরত শেখ হাসিনা শীগ্রই ক্ষমতার নরম তুলতুলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কাছে থেকে আমির হোসেন আমুকে দেখা একদিন....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:৪৬

আমির হোসেন আমুকে দেখা একদিন....

২০০১ সালের কথা। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একটা আন্তর্জাতিক দরপত্রে অংশ গ্রহণ করে আমার কোম্পানি টেকনিক্যাল অফারে উত্তীর্ণ হয়ে কমার্শিয়াল অফারেও লোয়েস্ট হয়েছে। সেকেন্ড লোয়েস্টের সাথে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

=নারী বুকের খাতায় লিখে রাখে তার জয়ী হওয়ার গল্প (জীবন গদ্য)=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৩২



বুকে উচ্ছাস নিয়ে বাঁচতে গিয়ে দেখি! চারদিকে কাঁটায় ঘেরা পথ, হাঁটতে গেলেই বাঁধা, চলতে গেলেই হোঁচট, নারীদের ইচ্ছেগুলো ডিমের ভিতর কুসুম যেমন! কেউ ভেঙ্গে দিয়ে স্বপ্ন, মন ঢেলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিশ্রী ও কুশ্রী পদাবলির ব্লগারদের টার্গেট আমি

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:০৫



আমাকে জেনারেল করা হয়েছে ১টি কমেন্টের জন্য; আমার ষ্টেটাস অনুযায়ী, আমি কমেন্ট করতে পারার কথা; সেটাও বন্ধ করে রাখা হয়েছে; এখন বসে বসে ব্লগের গার্বেজ পড়ছি।

সম্প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×