বারুদ জমা হয়েই ছিল। ৪২ বছরের অপ্রাপ্তির গ্লানিগুলো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে সঞ্চারিত হয়েছে অনেকটা নীরবেই। ইতিহাস বিকৃতির নানা অপচেষ্টা স্বত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম তার পরবর্তী প্রজন্মকে জানিয়ে গেছে গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। বাবা-মার কাছ থেকে যে সন্তানটি মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনেছে, সেই সন্তান বুকে ধারণ করেছে সেই চেতনাকে। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং মিডিয়াও যে জনমত সৃষ্টি করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, তা অস্বীকার করা যায় না। তথ্যপ্রযুক্তির যুগে, ইন্টারনেট ও সোস্যাল মিডিয়ায় তথ্যের আদানপ্রদান সহজতর হয়ে যাওয়ায়, প্রকৃত ইতিহাস শিক্ষিত তরুণ প্রজন্মের কাছে আর গোপন নেই। এই প্রজন্ম দেখেছে যুদ্ধাপরাধীদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা এবং তাদের সদম্ভ উচ্চারণ,‘এদেশে কোন যুদ্ধাপরাধী নেই’। এই সকল ঘটনার প্রতিক্রিয়া শিক্ষিত মধ্যবিত্ত তরুণ প্রজন্মের মানসচেতনায় এক ধরণের নীরব বিপ্লব সংঘটিত করেছে। তারই ফলাফল শাহবাগের প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা তরুণদের সৃষ্ট এই নতুন ইতিহাস।
শাহবাগ আন্দোলন শুরু হবার পর দুই মাস অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও শাহবাগের চেতনা এখনও তার ঔজ্জ্বল্য নিয়ে দেদীপ্যমান। শাহবাগ নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা, সমালোচনা, বিভ্রান্তি, অপপ্রচার চালানো হয়েছে, কিন্তু শাহবাগের যৌবনজলতরঙ্গকে রোখা যায় নি। শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নতুন বাংলাদেশ গড়ার যে অগ্নিস্পর্ধা দেখিয়েছে তরুণ প্রজন্ম, তার তেজ ও দ্যুতিময় আহ্বান ছড়িয়ে পড়েছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। ‘সীমানা চিনি না আছি শাহবাগে’সুমনের এই গর্বিত উচ্চারণ প্রমাণ করেছে শুধু দেশে নয়, দেশের বাইরেও বাঙালিদের উদ্দীপ্ত করে চলেছে এই শাহবাগ আন্দোলন।
তারুণ্যের এই আন্দোলনের কিছু সাফল্য অর্জিত হলেও এখনো চূড়ান্ত বিজয়ের অনেকটা পথ বাকি রয়ে গেছে। এই আন্দোলনকে ঘিরে নানারকম মিথ্যার বেসাতি সাজিয়ে অপপ্রচার চালিয়েছে জামাত-শিবির চক্র ও তার দোসরেরা। আন্দোলনের সমর্থকদের হত্যা করা হয়েছে, হত্যা করা হয়েছে রাষ্ট্রের আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের। আন্দোলনকারীদের নানারকম হুমকি দেয়া অব্যাহত রয়েছে। ধর্মপ্রাণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে নানাভাবে সহিংস পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে এই সাম্প্রদায়িক অপশক্তি। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপরে নির্মম আক্রমণ পরিচালিত হয়েছে, পবিত্র মসজিদে আগুন দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এমনকী আমাদের প্রাণের জাতীয় পতাকা পুড়িয়ে, শহীদ মিনার ভেঙে আমাদের মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতার বিরুদ্ধে তারা আবারো তাদের অবস্থান পরিষ্কার করেছে।
সম্প্রতি হেফাজতে ইসলাম নামে একটি সংগঠন জামাত-শিবিরের প্ররোচনায় মধ্যযুগীয় ১৩ দফা দাবি নিয়ে মাঠে নেমেছে। ত্রিধাবিভক্ত শিক্ষাব্যবস্থা, আধুনিক শিক্ষার অভাব এবং গ্রাম ও শহরের বিচ্ছিন্নতাকে কাজে লাগিয়ে হেফাজতে ইসলাম গ্রামের মাদ্রাসা ছাত্রদের ব্যবহার করেছে ও গ্রামীণ মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। আমরা লক্ষ্য করেছি সরকার চট্টগ্রামে গণজাগরণ মঞ্চের সমাবেশে ১৪৪ ধারা জারি করলেও হেফাজতে ইসলামের ঢাকা অভিমুখে লংমার্চ করার অনুমতি প্রদান করে। আমরা দেখছি হেফাজতের দাবির মুখে আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্ট চার জন ব্লগারকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নেয় সরকার। অথচ শাহবাগে হামলার চেষ্টা এবং নারী সাংবাদিকদের শারীরিকভাবে আঘাত করার পরও হেফাজতের কোন নেতাকে আটক করেনি সরকার উপরন্তু হেফাজতকে ‘শান্তিপূর্ণ’ কর্মসূচি পালনের জন্য ধন্যবাদ দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। গণজাগরণ মঞ্চের প্রতি সরকারি দলের অসন্তোষের কথাও পত্রপত্রিকায় এসেছে। এই অবস্থার মধ্য দিয়েই তারুণ্যের দুর্বার প্রাণশক্তিতে এগুচ্ছে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন।
গণজাগরণ মঞ্চ মৌলবাদী অপশক্তির বিরুদ্ধে একটি গণতান্ত্রিক অহিংস আন্দোলন পরিচালনা করছে। কিন্তু আক্রমণ এলে তা প্রতিহত করার শক্তিও দেখিয়েছে গণজাগরণ মঞ্চ। আমরা দেখেছি গত ৬ই এপ্রিল, হেফাজতের সমাবেশ শেষে জনগণের সম্মিলিত প্রতিরোধের মুখে শাহবাগে আক্রমণকারী জামাত-শিবিরের কর্মীরা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল। সেদিন লাঠি হাতে স্বতস্ফুর্তভাবে নেমে এসেছিল নারী-পুরুষ-ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি-পেশা নির্বিশেষে সাধারণ মানুষ। সেই প্রতিরোধের শক্তি নিশ্চয়ই ছড়িয়ে যাবে গোটা দেশে।
তবে শুধুমাত্র লাঠির ব্যবহার করে এদেশ থেকে মৌলবাদী শক্তিকে নির্মূল করা সম্ভব নয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠার এই লড়াইয়ে আমাদের এই ভূখণ্ডের অসাম্প্রদায়িক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আমাদের একটি শক্তিশালী হাতিয়ার, যা কিনা যেকোন সমরাস্ত্রেও চেয়েও অনেক শক্তিশালী। ইতিমধ্যেই এই আন্দোলনকে ঘিরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে এক সাংস্কৃতিক জাগরণ শুরু হয়ে গেছে। এই আন্দোলনকে ঘিরে রচিত হয়েছে অসংখ্য গান, কবিতা, নাটক, স্বল্পদৈর্ঘ্য ডকুমেন্টারি। এই সাংস্কৃতিক জাগরণকে দেশের প্রতিটি প্রান্তে নিয়ে যাবার মধ্য দিয়েই আন্দোলনকে বিস্তৃত ও শক্তিশালী করা সম্ভব এবং প্রতিক্রিয়াশীল মুক্তিযুদ্ধবিরোধী চক্রকে প্রতিহত করা সম্ভব। জনগণের চেতনার স্ফুরণ ঘটিয়ে সম্মিলিত সামাজিক প্রতিরোধের মাধ্যমেই মুিক্তযুদ্ধবিরোধী শক্তিকে সম্পূর্ণরূপে পরাজিত করা সম্ভব।
এ কথা সত্যি যে এই সাংস্কৃতিক আন্দোলন অনেকটাই আটকে আছে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির বৃত্তে। এর বাইরে গণমানুষকে এই আন্দোলনে সম্পৃক্ত করতে সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের বিকল্প নেই। এই সাংস্কৃতিক আন্দোলনের গ-িকেও শহর ছাড়িয়ে নিয়ে যেতে হবে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর ‘অর্গানিক ইন্টেলেকচুয়াল’দের কাছে। সকলের সম্মিলিত উদ্যোগ ও সংগঠিত লড়াইয়ের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের এই নবজাগরণকে একটি রেনেসাঁয় রূপান্তরিত করা সম্ভব। শিক্ষিত মধ্যবিত্তের পাষাপাশি নি¤œবর্গের সামাজিক পরিম-লে মৌলবাদবিরোধী চেতনার হেজিমনিক অবস্থান তৈরি করতে হলে এ অঞ্চলের বাঙালি সংস্কৃতির ভাষাটিই হতে পারে যোগসূত্রের মাধ্যম।
মহান ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমাদের স্বকীয় সাংস্কৃতিক চেতনার যে বিকাশ ঘটেছে, তারই ধারাবাহিকতায় মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে লাখো শহীদের আত্মদানে আমরা পেয়েছি বাংলাদেশ। আমাদের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে অসংখ্য সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে উঠেছে, সংস্কৃতি কর্মী গড়ে উঠেছে। এই আন্দোলনকে সম্পূর্ণরূপে বিজয়ী করতে হলে প্রতিটি পাড়া মহল্লা, গ্রাম, ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা পর্যায়ের সাংস্কৃতিক সংগঠন ও সংস্কৃতিকর্মীদের সংগঠিত করে ঐক্যবদ্ধভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার স্বপক্ষে ধারাবাহিক সাংস্কৃতিক কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত করতে হবে। আমাদের বাউলশিল্পী, লোকসঙ্গীতশিল্পীদেও সংগঠিত করে গ্রামে গঞ্জে ছড়িয়ে গিয়ে গানের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আন্দোলনের দাবিকে তুলে ধরতে হবে। নাট্যশিল্পীদের পাড়ায় মহল্লায় তাদের নাটক মঞ্চস্থ করার মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের চেতনাকে শাণিত করতে হবে।
আমরা দেখেছি এই আন্দোলন ধরে অসংখ্য গান-কবিতা-গল্প রচিত হয়েছে। আমরা কবি-সাহিত্যিক-কথাশিল্পীদের লেখনীর মাধ্যমে এই আন্দোলনকে অনুপ্রাণিত করার শুভ উদ্যোগগুলিকে অব্যাহত রাখতে হবে। আন্দোলনের স্বপক্ষে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় অসংখ্য প্রকাশনা ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে, সেই প্রকাশনার ধারাকেও অব্যাহত রাখতে হবে। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে জহির রায়হানসহ অনেক ক্যামেরাযোদ্ধা তাদের ছবিতে মুক্তিযুদ্ধকে ফুটিয়ে তোলার মাধ্যমে পালন করেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। চলচ্চিত্র সংগঠনগুলোকে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রগুলো শহর-গ্রামে-পাড়ায়-মহল্লায় প্রদর্শন করার উদ্যোগ নিতে হবে। শিশু-কিশোর সংগঠনগুলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছড়িয়ে দেবার উদ্দেশ্যে স্কুলে স্কুলে মুক্তিযুদ্ধের ছবি আঁকা, গল্প, কবিতা লেখা প্রতিযোগিতা আয়োজন করতে পারে।
গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের সূচনায় শিক্ষিত মধ্যবিত্তের প্রাধাণ্য থাকলেও এই আন্দোলন ছুঁয়ে যাক বাংলাদেশের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষকে। এই আন্দোলনকে বেগবান ও বিজয়ী করতে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের প্রতিটি মানুষকেই তার নিজ নিজ জায়গা থেকে সংগঠকের ভূমিকা পালন করার কোন বিকল্প নেই। আসছে নববর্ষে বাঙালির নব রেনেসাঁ পরাজিত করুক সকল অপশক্তিকে- ‘মুছে যাক গ্লানি, মুছে যাক জরা/ অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা’।