আজকে হরতাল কেমন হল?
হরতাল যে হয়েছে এ নিয়ে কারো সন্দেহ নেই। বাম দলগুলোর শক্তিসামর্থ নিয়ে যারা ভুরু কুঁচকে রাখতেন তারা হতবাক হয়েছেন। হরতাল হয়ে গেল, স্কুল,কলেজ,বিশ্ববিদ্যালয়,দোকানপাট বন্ধ থাকল..গাড়ি চলল না..কীভাবে? আগের দিন তো কোন বাস পোড়ে নি..হরতালের দিনও কোন বিশ্বজিতকে প্রাণ হারাতে হয় নি..এমনকী যারা গাড়ি নিয়ে হরতালকারীদের সামনে পড়েছেন, তাদের গাড়িও ভাঙা হয়নি..বরং তাদেরকে হরতাল সম্পর্কে বুঝিয়ে বলা হয়েছে..এ কী সম্ভব?
এই হরতালের ইস্যুগুলো কোন দেশপ্রেমিক মানবতাবাদী মানুষ নিজের না মনে করে পারে না। জাতীয় ইস্যু এবং শ্রেণি ইস্যুর চমৎকার সম্মিলন হয়েছে এই হরতালে। একদিকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও সামপ্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি, অন্যদিকে তাজরীনে শ্রমিক হত্যার বিচারের দাবি। সাথে ছিল বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি,জাতীয় সম্পদ রক্ষাসহ জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যু।
যাদের মানসিকতা এখনও দ্বিদলীয় রাজনীতির বৃত্তের বাইরে যেতে পারে না..তারা এখানে নানা গন্ধ শুঁকছেন..সরকারের সমর্থন আছে কীনা..পুলিশ হরতাল করলো কিনা..
পুলিশ আজ কী করেছে? কিছু জায়গায় ব্যারিকেড দিয়েছে..যানবাহন ঘুরিয়ে দিয়েছে..মহাজোট অথবা ১৮দলীয় জোটের সমাবেশের সময় কী রাস্তা বন্ধ হয় না? পুলিশ গাড়ি ঘুরিয়ে দেয় না? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন বিক্ষোভ হলে যেসব রাস্তা আজ বন্ধ ছিলো, সেইসব রাস্তা তখনও পুলিশ বন্ধ করে দেয়..
সরকার কী করতে পারতো? রাস্তায় অবস্থাণকারী হরতাল সমর্থকদের মারতে পারতো..যা তারা আগেও করেছে বামপন্থীদের অন্যান্য হরতালে..জোর করে উঠিয়ে দিতে পারতো..যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ইস্যুকে সামনে এনে যারা ভোটে বিজয়ী হয়েছেন..তারা যদি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবী, সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবী, তাজরীন হত্যাকান্ডের বিচারের জনপ্রিয় দাবীর বিপরীতে গিয়ে তারা নিজের সব্বনাশ করবে?পঞ্চদশ সংশোধনীতে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করতে দেওয়ার অধিকার দেনেওেয়ালাদের মুখোশ তখন উন্মোচিত হয়ে যাবে না? এই বোকামি করে তথাকথিত ভোটব্যাংক তারা হারাতে চাইবে নাকি? বরং একটা সমর্থন সমর্থন নাটক করে বামপন্থীদের ক্রেডিটটা নিজের পকেটে নেওয়া গেলে তাদের তো ক্ষতি নাই..এতে তাজরীনের ঘটনাও আড়ালে পড়ে যাবে, বিএনপি জামাতকে ‘ভালো’ হরতাল বিষয়ক উপদেশও দেয়া যাবে.. আর মানুষকেও আশ্বস্ত করা যাবে যে, আমরা তো ভাই অসাম্প্রদায়িকই আছি..বামদলগুলোর যৌক্তিক দাবির প্রতি আমাদেরও সহানুভূতি আছে..কিন্তু ‘বাস্তব’ অবস্থাণের কারণে সেগুলো মানতে পারছি না..এই রকম কাজ আগেও আওয়ামী লীগ করেছে..জাহানারা ইমামের আন্দোলনের শুরুতে সাথে থেকেছে..পরে এই গণজাগরণকে কাজে লাগিয়ে যেমন ৯৬-তে ভোট পেয়েছে, সাথে সাথে গোপনে নিজামীদের সাথেও আঁতাত করেছে..‘আন্দোলনের স্বার্থে(!)’
আওয়ামী লীগ বামপন্থীদের এই সফলতাকে পুঁজি করতে চাইবে, এটা স্বাভাবিক..এই প্রচেষ্টায় বামেদের সফলতা আড়াল হয়ে যায় না। এই হরতাল সফল করতে তারা শ্রমিক ও তরুণসমাজকে উদ্বুদ্ধ করতে পেরেছে। শ্রমিক সংগঠনগুলোর সাথে তারা লুকিয়ে আঁতাত করে নি, বরং সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েই তাদের সাথে বৈঠক করেছে, তাদেরকে হরতালের দিন গাড়ি না বের করার অনুরোধ করা হয়েছে, তাদেরকে হরতালের যৌক্তিকতা বোঝানো হয়েছে..আমি পরিবহনশ্রমিকদের ঐ বৈঠকে উপস্থিত নেতাদের কাছ থেকে শুনেছি..শ্রমিকরা বলেছে..এর আগে কোন দল হরতাল করার জন্য এভাবে আমাদের সাথে বসে নাই।(উল্লেখ্য, পরিবহন সংগঠনে নানা রাজনৈতিক দলের লোক থাকে) আজকে বিআরটিসি কেন বন্ধ ছিল,সে ব্যাপারে অনেক কথা হয়েছে..কিন্তু কতৃপক্ষ কী বলেছে, তা অনলাইন নিউজমিডিয়ায় আমরা দেখেছি..বলেছে, গাড়ি বের করতে চাইলে শ্রমিকেরা বলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিপক্ষে তো আমরা নই, তবে কেন হরতালে গাড়ি চালাব?(সূত্র:বাংলানিউজ২৪.কম)এদিকে গার্মেন্টস শ্রমিকদের ত্রিশটি সংগঠনের হরতালের প্রতি সমর্থন জানানোর কথা মিডিয়াতে এসেছে। গাজীপুরে আমরা দেখেছি, শ্রমিকেরা কীভাবে স্বত:স্ফুর্ত ভাবে মাঠে নেমেছে..ঢাবি, রাবি সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রগতিশীল ছাত্ররা মাঠে নেমেছে। তারা জাতীয় পতাকা হাতে. গণসংগীত গেয়ে রাজপথ দখলে রেখেছে।টাকা খরচ করে কর্মী ভাড়া না করে, সীমিত কর্মী নিয়েও বামদলগুলো দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পিকেটিং করেছে..অথচ, জনগণ তাদের নীরব সমর্থন দিয়েছেন।বিভিন্ন জেলায় ছাত্রলীগ ও পুলিশ বাধা দিয়েছে, গ্রেপ্তার হয়েছে, আহত হয়েছে বামদলের কর্মীরা..আমি নিজেও খানিকটা অবাক হয়েছি, বেশ বেলা পর্যন্তও দোকানপাট বন্ধ রেখেছে মালিকেরা। কোন ধরণের ভাঙচুর ছাড়াই এত বড় কর্মসূচী পালন হয়ে গেলে, বিচ্ছিন্নভাবে কেউ ভাঙচুর করল না..এটাতো বামদের সাংগঠনিক শৃংখলারও উদাহরণ। সুযোগসন্ধানী জামাত-শিবির চক্র সাবোটাজ করার পরিকল্পনা করেনি ভেবেছেন? তারা পারেনি..কারণ মানুষের সমর্থন ছিলো এই হরতালের প্রতি।
আওয়ামী লীগ এই হরতালের ক্রেডিট নিয়ে নিচ্ছে, এই ভেবে বিএনপিও মনে করেছে.. এই হরতালকে আসলে বিরোধীতা করতে হবে। জামাত নিষিদ্ধ হয়ে গেলে তাদের ভোটের হিসেবে গোলমাল হয়ে যেতে পারে.. এই ভাবনাও ভেবেছে নিশ্চয়ই তারা।সুতরাং হরতালের ক্রেডিট তারাও সরকারকে দিতে উঠে পড়ে লেগেছে। খারাপ না, এতদিন আওয়ামী লীগ বিএনপির কর্মসূচি নিয়ে বিশ্লেষণ ও মতামত দিতে হত বামদের..এবার নাহয় তারাই মাথা ঘামাক বামদের কর্মসূচি নিয়ে!
সরকারের হত্যা-গুম-খুনের বিচার, দুর্নীতির, আর্থিক কেলেংকারির বিচার বামদের চেয়ে সাচ্চাভাবে কেউ চায় না। এই কথাগুলো আওয়ামী লীগ, বিএনপি বলে পরেরবার ক্ষমতায় যাওয়ার হাতিয়ার হিসেবে, আর লঙ্কায় গেলে তারা যে সবাই রাবণ, সেকথা দেশবাসী ভালোমতই বুঝেছে।সরকারের দুর্নীতি, হত্যা-গুম-খুন নিয়ে সবার আগে মিছিল বামেরাই করেছে..একটু কষ্ট করে পত্রিকাগুলো ঘাটলেই জানা যাবে। কষ্ট হবে এ জন্য, অনেক ‘সুশীলের’ দশজনের গোলটেবিল বৈঠকের খবর পত্রিকার প্রথম পাতায় আসলেও, শত-শত কর্মী নিয়ে প্রেসক্লাবের সামনে বামদের প্রোগ্রামের খবর ছাপা হয় ভেতরের পৃষ্ঠায়। হরতালের মত কর্মসূচি হলে তাও যদিবা একটু প্রথম পাতায় জায়গা পাওয়া যায়, তাও ১ কলামের বেশি নয়। তবে এবারের হরতালে জনগণের সমর্থন বিবেচনায় মিডিয়াগুলো মোটামুটি ভালোই কভারেজ দিয়েছে..তবে আগামীকালের পত্রিকায় কতটুকু থাকবে তা জানি না।
এদিকে মহাজোটের মধ্যেকার আওয়ামী লীগ তো দূরের কথা, বাম দলগুলোও হরতালকে ন্যুনতম নৈতিক সমর্থনও দেয়নি। বরং আমি জানি, এই হরতালকে নিরুৎসাহিত করার অনেক প্রচেষ্টাই তারা করেছে। বলেছে, হরতালের দরকার কী? সব দল মিলে মিছিল করলেই হয়। আজ নিশ্চয়ই বুঝেছেন, হরতাল না করলে জনগণের এই ব্যাপক সমর্থন এইভাবে প্রকাশিত করা যেত না।
আর জামাতসহ জঙ্গিগোষ্ঠীর কথা কী বলব! তারাই মনে হয় বামপন্থীদের শক্তির কথা সবচে বেশি জানে ও বোঝে। একারণেই সবার আগে বোমা হামলা হয় উদীচির অনুষ্ঠানে, সিপিবির সমাবেশে। জামাত শিবির বামদলের কত নেতাকর্মীকে হত্যা করেছে সে কথা আর নাইবা বললাম। এই হরতালের বিরুদ্ধেও তারা নানারকম অপপ্রচার চালিয়েছে। ইসলামী ১২ দলের নামে তারা হরতাল ডেকেছে ‘কমিউনিস্টদের প্রতিহত’ করার দাবিতে। ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে ইসলামকে। এ অবশ্য নতুন কিছু নয়। মুক্তিযুদ্ধের সময়েও ইসলামের ধুয়া তুলে তারা লাখ লাখ মানুষ হত্যা করেছে। ১৯৭১-এ পাকিস্তানী সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে..কিন্ত তাদের সাহায্যকারী ব্যাটেলিয়ন জামাত এখনও টিকে আছে। এদের নির্মূল না করা পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধ তো অসমাপ্তই থেকে যাবে।
তবে এই সফল হরতালেই থেমে গেলে চলবে না। সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে নিষিদ্ধ করার দাবি নিয়ে যেমন মাঠে থাকতে হবে, তেমনি জনগণের সমস্যা ও সংকট নিয়েও গড়ে তুলতে হবে আন্দোলন। দ্বিদলীয় অসুস্থ লুটেরা রাজনীতির বিপরীতে দাঁড় করতে হবে বাম-গণতান্ত্রিক বিকল্প শক্তি। যাত্রা কেবল শুরু।এখনো প্রমাণ করার আছে অনেক কিছুই।