somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বিপ্লবী বাদল গুপ্ত;প্রতিকূল সময়ে প্রেরণার উৎসধারা

২৪ শে অক্টোবর, ২০১২ রাত ১১:২৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


বিপ্লবী বাদল গুপ্ত;প্রতিকূল সময়ে প্রেরণার উৎসধারা
অভিনু কিবরিয়া ইসলাম
(গত ২ অক্টোবর মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে বিপ্লবীদের কথার তৃতীয় বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে পঠিত প্রবন্ধ)

ফকির বিদ্রোহ, সন্যাস বিদ্রোহ, সাঁওতাল বিদ্রোহ, ১৮৫৭ সালের প্রথম ভারতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধের ধারাবাহিকতায় পরবর্তীকালে ভারতজুড়ে স্বরাজের জন্য নানামাত্রিক আন্দোলন-সংগ্রাম, অনুশীলন, যুগান্তরের মত সশস্ত্র গ্রুপসমূহের বিপ্লবী প্রয়াস বাংলাকে পরিণ
ত করেছিল অগ্নিগর্ভে। শত বছরেরও বেশি সময় ধরে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রাম যে মুক্তিচেতনার উন্মেষ ঘটিয়েছিল, তার মাঝেই বিকশিত হয়েছে বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রাম ও প্রগতিশীল রাজনীতি।

সেই ধারাতেই বাঙালি তরুণেরা জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজেকে উৎসর্গ করেছিল স্বাধীনতা সংগ্রাম ও উপনিবেশবিরোধী সংগ্রামে। জনগণের মুক্তির আকাক্সক্ষাকে ধারণ করা ও তাদের সাথে সংগ্রামে শরীক হওয়া, বিপ্লবী সশস্ত্র সংগ্রামে অংশগ্রহণ ও বিভিন্ন রাজনৈতিক ও মতাদর্শিক দ্বন্দ্বকে মোকাবেলা করার মধ্য দিয়ে এদেশের তরুণেরা শাণিত হয়ে উঠেছিল ও নিজেদের বিলিয়ে দিয়েছিল দেশের প্রয়োজনে।

বাঙালি তরুণদের কাছে বিপ্লববাদী রাজনীতি গান্ধিবাদী অহিংস আন্দোলনের চেয়ে জনপ্রিয় ছিলো। ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকীরা ছিলেন তাদের হিরো। ১৯০৬-০৭ সাল থেকে বাংলায় যে বিপ্লববাদী আন্দোলনের সূচনা, তার ধারাবাহিকতা ছিল ১৯৩০ সাল পর্যন্ত। এ সময়কালে অনুশীলন, যুগান্তরের মত বিপ্লবী দল গড়ে উঠেছিল। এ সময়কালে পুরনো বিপ্লববাদী আন্দোলনে সাম্যবাদী আন্তর্জাতিকের প্রভাবও পড়তে শুরু করেছিল। এ কথা বলা যায় যে, বিংশ শতাব্দীর প্রথম তিন-চার দশকে এ অঞ্চলের তরুণ রাজনৈতিক কর্মীদের হাতেখড়ি হয়েছিল সশস্ত্র বিপ্লবী সংগঠনগুলিতে। আধুনিক পাশ্চাত্যশিক্ষা ও দেশ-বিদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রামের ঘটনাবলীর সংস্পর্শ এদেশের তরুণদের মধ্যে সচেতনতার বীজ বপন করে দেয়। এ সময়কালের উজ্জীবনী গণসংগীত, নাটক, উপন্যাস, দেশি-বিদেশি বিপ্লবীদের জীবনী, বিভিন্ন দেশের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস তরুণদের মনোজগতে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, নজরুলদের রচনা শিক্ষিত তরুণদের ব্যাপকভাবে উদ্বুদ্ধ করে জাতীয়তাবাদী ও উপনিবেশবিরোধী সংগ্রামে। এর পাশাপাশি মার্কসবাদী সাহিত্য ও তত্ত্ব প্রগতিশীল তরুণদের শ্রমিক-কৃষকের রাজনীতির প্রতিও আগ্রহী করে তোলে।

এরকম এক অগ্নিসময়ে জন্মেছিলেন বিপ্লবী বাদল গুপ্ত। বাদল গুপ্তের জন্ম ১৯১২ সালে, ঢাকার বিক্রমপুর এলাকার পূর্ব শিমুলিয়া গ্রামে। তার আসল নাম সুধীর গুপ্ত। ডাক নাম ছিল বাদল।তার বাবার নাম অবনী গুপ্ত। পারিবারিকভাবেই বাদল গুপ্ত বিপ্লবী চেতনার উত্তরাধিকার বহন করতেন। তার পিতৃব্য নরেন্দ্র গুপ্ত ও ধরণী গুপ্ত মুরারীপুকুর বোমা মামলায় দ-িত হয়েছিলেন। সেসময় ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকী, বাঘা যতীনদের সশস্ত্র বিপ্লবী কর্মকা- ব্রিটিশ সরকারের ভিতকে কাঁপিয়ে দিচ্ছিল, আর তাঁদের সাহসিকতার গল্পও লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ছিল। ছোটবেলা থেকেই বাদল হয়তো শুনে আসছিলেন সেসকল বিপ্লবীদের বীরত্বগাঁথা।

বাদল গুপ্তের পড়াশুনার হাতেখড়ি পিতা-মাতার কাছে। প্রাথমিক পড়াশুনা শেষ হলে তাকে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয় বানারিপাড়া স্কুলে। ছোটবেলা থেকেই বাদল গুপ্ত ছিলেন অসীম সাহসী ও দুরন্ত স্বভাবের। পড়াশুনার পাশাপাশি খেলাধুলায়ও তার বেশ মনোযোগ ছিল। কিছুটা রাগী মানসিকতারও ছিলেন। তবে সহজে কাউকে কিছু বলতেন না। একটু বড় হওয়ার পর বাদলের রাগী মানসিকতা হ্রাস পায়। স্কুলে পড়াশুনাকালীন সময় থেকেই বাদল গুপ্ত স্বদেশপ্রেম ও রাজনীতির নানাবিষয়ে সচেতন হয়ে উঠেন। সেসময় বিপ্লবীদের জীবনকাহিনী নিয়ে নানা ধরনের বই-পুস্তকের সংস্পর্শে আসেন তিনি। দেশমাতৃকাকে মুক্ত করার লক্ষ্যে নিজেকে উৎসর্গ করার স্পৃহাও জেগে ওঠে তাঁর মাঝে।

বাদল গুপ্ত বানারিপাড়া স্কুলে পড়াশুনাকালে সেখানকার শিক্ষক নিকুঞ্জ সেনের সংস্পর্শে আসেন। তার সান্নিধ্যেই বাদল গুপ্ত স্বদেশি রাজনীতির হাতেখড়ি নেন। বানারিপাড়া স্কুলের শিক্ষক নিকুঞ্জ সেন ছিলেন বিপ্লববাদী দলের সদস্য। এই শিক্ষকের মাধ্যমে খুব সম্ভবত ৯ম বা ১০ম শ্রেণিতে পড়াশুনাকালীন সময়ে বাদল গুপ্ত বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স (বিভি) নামে একটি গুপ্ত বিপ্লবী সংগঠনের সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন। আরো অসংখ্য তরুণের মত বাদলও সেই সময়ের অগ্নিচ্ছটায় স্পর্ধিত হয়ে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের পথ বেছে নেন। আন্তরিক নিষ্ঠা ও কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে অল্পদিনেই বাদল বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের একজন দক্ষ সংগঠক হয়ে উঠেন। অতঃপর নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও ব্রিটিশরাজের ভিতকে নাড়িয়ে দিতে ১৯৩০ সালের ৮ ডিসেম্বর আরো দুজন সহযোদ্ধার সাথে ‘রাইটার্স বিল্ডিং’ আক্রমণ করে তিনি হয়ে ওঠেন এদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের একটি উজ্জ্বল রক্তকণিকা।

বিংশ শতাব্দীর ত্রিশের দশকের শেষের দিকে, সারা ভারতের বিপ্লবীদের উপর ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী নির্মম-নিষ্ঠুরভাবে অত্যাচার-নির্যাতন চালাতে শুরু করে। একের পর এক বিপ্লবীকে ধরে নিয়ে বিনা বিচারে জেলখানায় আটক রাখে, বন্দীদের উপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে চল্লিশের দশক পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকার সশস্ত্র বিপ্লবী ও কমিউনিস্টদের হয় ফাঁসিতে ঝোলায় নতুবা আন্দামানে নির্বাসনে পাঠায়। এই অবর্ণনীয় অচ্যাচার নির্যাতনের পরিপ্রেক্ষিতে ব্রিটিশদের চরম শিক্ষা দেওয়ার জন্য সুভাষ চন্দ্র বসু তখন ‘বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স’কে এ্যাকশনধর্মী বিপ্লবী প্লাটফর্মে রূপান্তর করেন বিপ্লবীদের রক্তঋণ শুধবার তাগিদে এবং ভারত থেকে ব্রিটিশদের উচ্ছেদ করার অভিপ্রায়ে। এক পর্যায়ে সুভাষ চন্দ্র বসু’র নেতৃত্বে এই ভলান্টিয়ার্সদের বিপ্লবীরা কুখ্যাত ব্রিটিশ পুলিশ অফিসারদেও উপযুক্ত শিক্ষা দেবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন । ১৯২৯-৩০ সালের মধ্যে দিনেশ গুপ্তের প্রশিক্ষিত বিপ্লবীরা ডগলা, বার্জ এবং পেডি-কে হত্যা করে। এরা ছিল কুখ্যাত অত্যাচারী ব্রিটিশ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট।

এভাবে বাংলার বিপ্লবীরা যখন একের পর এক তাদের সহযোদ্ধা হত্যার প্রতিশোধ নিতে থাকে তখন ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যবাদ আরো বেশি স্বৈরাচারী হয়ে উঠে এবং স্বাধীনতাকামী বিপ্লবীদের উপর অত্যাচার-নির্যাতনের মাত্রা বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। ওই সময় ব্রিটিশ পুলিশ সুভাষচন্দ্র বসু, যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত এবং সত্য বকসীর মত নেতৃবৃন্দসহ অসংখ্য স্বাধীনতা-সংগ্রামী নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার করে আলিপুর সেন্ট্রাল জেল ভরিয়ে ফেলা হচ্ছিল। এই সমস্ত বন্দীদের মধ্যে ছিলেন সশস্ত্র বিপ্লবী দলের সদস্য এবং অহিংস আন্দোলনের স্বেচ্ছাসেবকরা। এই বাস্তবতা ও পরিস্থিতির ফলে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে নতুন বন্দীদের জায়গা দেওয়া মুশকিল হয়ে পড়ে। এ সমস্যা ছিল প্রতিটি ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে। জেলের মধ্যে সৃষ্টি হল এক অরাজক ও অসহনীয় অবস্থা। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য রাজবন্দীরা ঐক্যবদ্ধ হয়। তারা নানা বিষয়ে প্রতিবাদ শুরু করে। রাজবন্দীরা জেলকোড অনুযায়ী প্রাপ্য অধিকার আদায়ের দাবিতে জেলের মধ্যে আন্দোলন শুরু করে। এই আন্দোলন দমানোর জন্য ব্রিটিশ পুলিশ নির্মমভাবে লাঠিচার্জের উন্মত্ততায় মেতে উঠে। জেলের পাগলাঘন্টি বাজিয়ে সশস্ত্র পুলিশ নিরস্ত্র রাজবন্দীদের উপর নির্মম-নিষ্ঠুর অত্যাচার শুরু করলো। সুভাসচন্দ্র, যতীনন্দ্রমোহন এবং সত্য বকসীরাও বাদ গেলেন না নির্মম-নিষ্ঠুর অত্যাচার থেকে।

এ ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়ল জেলের ভিতরের সমস্ত ওয়ার্ডে। জানা গেল এই নির্মম-নিষ্ঠুর অত্যাচারের পিছনে রয়েছে ইন্সপেক্টর জেনারেল কর্নেল এন. এস সিম্পসন সাহেব যার বিরুদ্ধে আগেও বন্দী বিপ্লবীদের উপর অমানুষিক অত্যাচারের অভিযোগ আছে। জেলের বাহিরের ভলান্টিয়ার্সের বিপ্লবীরা সেই কুখ্যাত ইন্সপেক্টর জেনারেল কর্নেল এন. এস সিম্পসনকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। তৎকালীন সময়ে কলকাতার ডালহৌসি স্কোয়ারে অবস্থিত ছিল ব্রিটিশ শাসকদের সচিবালয়। যার নাম রাখা হয়েছিল রাইটার্স ভবন। সেই ভবনেই উচ্চপদস্থ ব্রিটিশ আমলারা নিয়মিত অফিস করতেন। ‘রাইটার্স বিল্ডিং’ আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হল ভলান্টিয়ার্সের বিপ্লবীদের পক্ষ থেকে।

বাদলসহ আরো দুজন বিপ্লবী, বিনয় ও দীনেশকে দেয়া হল রাইটার্স বিল্ডিং আক্রমণের ভার। ১৯৩০ সালের ৮ ডিসেম্বর দুপুর ১২টায় তারা শুরু করলেন অ্যাকশন। প্রথমেই তারা সিম্পসনকে হত্যা করে সহযোদ্ধাদের হত্যার প্রতিশোধ নিলেন। তাদের আক্রমণের মুখে আহত হল অত্যাচারী ব্রিটিশ শাসনের প্রতিনিধিত্বকারী আমলা, অফিসারেরা। তৎক্ষণাৎ ডেকে আনা হল গুর্খাবাহিনীকে। শুরু হল ঐতিহাসিক ‘বারান্দা বেটল’ বা অলিন্দ যুদ্ধ। একদিকে রিভলবার হাতে তিনজন স্বাধীনতাকামী বিপ্লবী, অন্যদিকে ব্রিটিশদের প্রশিক্ষিত সশস্ত্র বাহিনী।

মৃত্যু নিশ্চিত, তবু আত্মসমর্পণ করেন নি বাংলার তিন বীর যোদ্ধা। তারা একটি শূন্য কক্ষে প্রবেশ করে সঙ্গে আনা ‘সায়ানাইড’-বিষের পুরিয়াগুলি মুখে দেন। বিষক্রিয়ায় অতি দ্রুত জীবনপ্রদীপ না নিভে যাওয়ার আশংকায় এবং মৃত্যুকে নিশ্চিত করার জন্য প্রত্যেকেই নিজ নিজ মাথা টার্গেট করে রিভলবারে রাখা শেষ গুলিটি ছুঁড়ে দিলেন। বাদল গুপ্ত তৎক্ষণাৎ মৃত্যুবরণ করেন। যুদ্ধের ময়দানে শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে দেশমাতৃকার জন্য লড়াই করে শহীদ হলেন তিনি।

বাদলের সাথী বিনয় ও দীনেশ সাংঘাতিক আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মেঝের উপর পড়ে রইলেন। ভীষণভাবে আহত বিনয় ও দীনেশকে একটু সুস্থ করে ব্রিটিশ পুলিশ তাদের উপর প্রচ- অত্যাচার চালাতে আরম্ভ করে। বিনয় ছিলেন মেডিকেলের ছাত্র। তিনি জানতেন কিভাবে মরতে হয়। হাসপাতালে অবস্থানকালে তিনি ১৪ ডিসেম্বর রাত্রে মৃত্যুকে বরণ করার জন্য মস্তিস্কের ‘ব্যান্ডেজে’র ভিতর আঙুল ঢুকিয়ে দিয়ে নিজের মস্তিষ্ক বের করে আনেন এবং মৃত্যুকে বরণ করে নেন। অন্যদিকে ডাক্তার ও নার্সদের আপ্রাণ চেষ্টায় দীনেশ একটু সুস্থ হয়ে উঠেন। সুস্থ হওয়ার পর তাকে হাসপাতাল থেকে ‘কনডেমনড’ সেলে নেয় হয়। অতঃপর দীনেশের বিচারের জন্য আলীপুরের সেসন জজ মি. গার্লিকের সভাপতিত্বে ব্রিটিশ সরকার এক ট্রাইবুনেল গঠন করে ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়। ১৯৩১ সালের ৭ জুলাই দীনেশের ফাঁসি কার্যকর করা হয়।

বিনয়-বাদল-দীনেশের মত আরো অনেকের আত্মত্যাগের বিনিময়ে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হয়েছি আমরা বহু আগেই। পাকিস্তানী শাসনের যাঁতাকল থেকেও লাখো শহীদের আত্মদানে পেয়েছি স্বদেশ। শুধু আমরাই নই, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষও জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের মধ্য দিয়ে ঔপনিবেশিক শাসকের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে স্বাধীনতা। কিন্তু, বাদল গুপ্তের জন্মশতবর্ষের এই সময়কালে দাঁড়িয়ে আমরা দেখছি, সা¤্রাজ্যবাদ এখন সারা বিশ্বকে শাসন করছে ভিন্নতর কৌশলে। ৯০-পরবর্তীতে একমেরু বিশ্বের একক অধিপতি হয়ে ওঠা সা¤্রাজ্যবাদী শক্তি তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে যেন নয়া উপনিবেশে পরিণত করেছে। ‘গণতন্ত্র’, ‘বিশ্বায়ন’, ‘মুক্তবাজার’, ‘মানবাধিকার’-এর ফাঁকা বুলি কপচিয়ে, বন্ধুর মুখোশ পরে তারা শোষণ চালিয়ে যাচ্ছে। তারা খুব সহজেই আধিপত্য বিস্তার করে চলেছে আমাদের দেশের লুটেরা শাসকগোষ্ঠীর ওপর। সামান্য ঋণের বিনিময়ে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ এর নির্দেশ মেনে চলছে এদেশের নতজানু শাসকগোষ্ঠী। আমাদের জাতীয় সম্পদ তুলে দেয়া হচ্ছে বিদেশি প্রভুদের হাতে। ‘সুশীল সমাজ’ নামের অভিজাত বুদ্ধিজীবীদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে, যারা গাইছে মুক্তবাজারের গুণগান, রক্ষা করছে সা¤্রাজ্যবাদীদের স্বার্থ। সা¤্রাজ্যবাদের স্বাের্থ কর্পোরেট-বহুজাতিক কোম্পানীগুলো এদেশে বিস্তার লাভ করেছে। এমনকী. মুক্তিযুদ্ধের সময় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ যে সপ্তম নৌবহর পাঠিয়ে ধুলিস্যাৎ করতে চেয়েছিল আমাদের স্বাধীনতাকে, আমাদের সমুদ্রে আবারো সেই নৌবহরের আগমনের কথা শোনা যাচ্ছে।

কিন্তু প্রতিরোধ কোথায়? কোথায় আজ বাদল গুপ্তের উত্তরসূরিরা? সাম্রাজ্যবাদ ও তার এদেশীয় দোসরদের পরাজিত করতে এদেশের তরুণেরা সেভাবে জ্বলে উঠছে না?

প্রযুক্তির অভাবনীয় বিকাশের এই যুগে এসময়ের বাদল গুপ্তরা হয়ে পড়ছে বিচ্ছিন্ন ও আত্মকেন্দ্রিক। তরুণ প্রজন্মরা জানছে না আমাদের গৌরবের ইতিহাস, জানছে না বিনয়-বাদল-দীনেশদের কথা। এ সমাজ ও শিক্ষাব্যবস্থা যে ক্যারিয়ারমুখী-ভোগবাদী সংস্কৃতি প্রবেশ করাচ্ছে তরুণদের মনোজগতে তা তাদের পরিবর্তনের আকাক্সক্ষাকে গ্রাস করছে। নিত্য-নতুন চাহিদা তৈরি হচ্ছে বিজ্ঞাপনের প্রলোভনে। এমনকী গানে-নাটকে-সিনেমায়-সাহিত্যে সামাজিক বাস্তবতাকে ফুটে উঠতে খুব কমই দেখা যাচ্ছে। সমাজ-সময়টাকে বদলাবার উপযোগি সাহিত্য কিংবা তত্ত্বের প্রতি তরুণদের আর আগ্রহ সেভাবে দেখা যাচ্ছে না, সস্তা সুখপাঠ্য সাহিত্য দখল করে রাখছে তাদের মনোজগত। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ভাষায়, প্রচলিত মূল্যবোধ কিংবা সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে কোনো ধরনের জিজ্ঞাসার সম্মুখীন করতে সাম্প্রতিক কথাসাহিত্য ব্যর্থ, কবিতা জীবনের স্পন্দন ও প্রেরণা থেকে বঞ্চিত। প্রিন্ট ও ইলেকট্রণিক মিডিয়া খোলাবাজার ও পুঁজিবাদের স্বার্থরক্ষায় ব্যস্ত। বিনয়-বাদল-দীনেশের মত ত্যাগী, সাহসী, প্রতিবাদী, দেশপ্রেমিক তরুণরা যাতে আর তৈরি না হতে পারেÑ সেধরণের সব ব্যবস্থাই যেন পাকাপোক্ত করা হয়েছে!

তবুও বাদল গুপ্তের মত বিপ্লবীরা যুগে যুগে তৈরি হবেই। আর প্রতিকূল এ কাল¯্রােতে তো আরো অনেক বিনয়-বাদল-দীনেশকে প্রয়োজন। তাই, তরুণদের প্রগতিশীল আন্দোলনে সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে গড়ে তুলতে হবে প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলন। শিল্পী-সাহিত্যিকদের পাল্টা আধিপত্য তৈরি করতে হবে বিদ্যমান বিচ্ছিন্নতার, স্বার্থপরতার, ভোগবাদী দর্শনের বিপরীতে। নির্মাণ করতে হবে গণমানুষের পক্ষে আগামীর গান-কবিতা-কথাসাহিত্য-নাটক-চলচ্চিত্র। বিনয়-বাদল-দীনেশদের মত বিপ্লবীদের জীবন ও কর্মকে নিয়ে যেতে হবে তরুণদের কাছে। বাদল গুপ্তের মত বিপ্লবীরা অনুপ্রাণিত ও স্পর্ধিত করুক তরুণ প্রজন্মের চেতনাকে_ সেই প্রত্যাশা রইলো।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শীঘ্রই হাসিনার ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৩৮


পেক্ষার প্রহর শেষ। আর দুই থেকে তিন মাস বাকি। বিশ্ব মানবতার কন্যা, বিশ্ব নেত্রী, মমতাময়ী জননী, শেখ মুজিবের সুয়োগ্য কন্যা, আপোসহীন নেত্রী হযরত শেখ হাসিনা শীগ্রই ক্ষমতার নরম তুলতুলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কাছে থেকে আমির হোসেন আমুকে দেখা একদিন....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:৪৬

আমির হোসেন আমুকে দেখা একদিন....

২০০১ সালের কথা। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একটা আন্তর্জাতিক দরপত্রে অংশ গ্রহণ করে আমার কোম্পানি টেকনিক্যাল অফারে উত্তীর্ণ হয়ে কমার্শিয়াল অফারেও লোয়েস্ট হয়েছে। সেকেন্ড লোয়েস্টের সাথে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সংস্কারের জন্য টাকার অভাব হবে না, ড. ইউনূসকে ইইউ

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:২৪



বুধবার (৬ নভেম্বর) দুপুরে ঢাকার তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ঢাকায় নিযুক্ত ইইউর রাষ্ট্রদূত মাইকেল মিলার এবং সফররত এক্সটার্নাল অ্যাকশন সার্ভিসের এশিয়া ও প্যাসিফিক বিভাগের পরিচালক পাওলা... ...বাকিটুকু পড়ুন

=নারী বুকের খাতায় লিখে রাখে তার জয়ী হওয়ার গল্প (জীবন গদ্য)=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৩২



বুকে উচ্ছাস নিয়ে বাঁচতে গিয়ে দেখি! চারদিকে কাঁটায় ঘেরা পথ, হাঁটতে গেলেই বাঁধা, চলতে গেলেই হোঁচট, নারীদের ইচ্ছেগুলো ডিমের ভিতর কুসুম যেমন! কেউ ভেঙ্গে দিয়ে স্বপ্ন, মন ঢেলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিশ্রী ও কুশ্রী পদাবলির ব্লগারদের টার্গেট আমি

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:০৫



আমাকে জেনারেল করা হয়েছে ১টি কমেন্টের জন্য; আমার ষ্টেটাস অনুযায়ী, আমি কমেন্ট করতে পারার কথা; সেটাও বন্ধ করে রাখা হয়েছে; এখন বসে বসে ব্লগের গার্বেজ পড়ছি।

সম্প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×