রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর কাদম্বরী ঘটনার অন্তরালে ২
ছাদের উপর কাদম্বরীর সাজানো বাগানে সন্ধ্যাবেলা বসত পরিপাটী গানের আসর। মাদুরের ওপর তাকিয়া, রুপোর রেকাবে ভিজে রুমালের ওপর বেলীফুলের গোড়ের মালা, গ্লাসভর্তি বরফপানি, বাটা ভর্তি ছাচি পান সাজানো থাকতো সবার জন্য। কাদম্বরী সেজে গুজে বসতেন সেখানে, জ্যোতিরিন্দ্র বাজাতেন বেহালা, রবীন্দ্রনাথ ধরতেন গান, যার আবেশ হয়তো সে ছাদকে অতিক্রম করে আরো চারধার ছুয়ে যেতো, “ফুলের বনে যার পাশে যাই, তারেই লাগে ভালো .........”। কিশোর রবীন্দ্রনাথের রোমান্টিক সৌন্দর্য চেতনাকে জাগিয়ে তুলতে এই পরিবেশ, এই সৌন্দর্য দৃষ্টি কল্পনার একান্ত প্রয়োজন ছিল, যা আমরা পরে রবীন্দ্রনাথের লেখায় ফিরে ফিরে দেখতে পাই। কাদম্বরী নিজেও ভালো গায়িকা ছিলেন, বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ জগন্মোহন গঙ্গোপাধ্যায়ের পৌত্রী তিনি, গান ছিল তার রক্তে। তিনি আসার সাথে সাথে তিনতলায় শুধু পিয়ানো আসেনি, জ্যোতিরিন্দ্রের আর রবীন্দ্রনাথের অনুশীলনও শুরু হয়ে গিয়েছিল। শুধু গানই ছিলো না, সেখানে বসত রীতিমতো সাহিত্যপাঠের আসর। আসরে যোগ দিতেন বাড়ীর অনেকে, বাইরে থেকে আসতেন অক্ষয় চৌধুরী ও তার স্ত্রী শরৎকুমারী, জানকীনাথ, আর মাঝে মাঝে আসতেন কবি বিহারীলাল চক্রবর্তী। জ্যোতিরিন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ ও স্বর্নকুমারী ছিলেন এই সভার স্থায়ী সদস্য। কবি বিহারীলাল চক্রবর্তী’র কবিতা কাদম্বরী খুব ভালোবাসতেন। তাকে প্রায়ই দাওয়াত করে নিজ হাতে রান্না করে খাওয়াতেন তিনি, কবির নিজের কবিতার কয়েকটি লাইন লিখে, আসন বুনে কবিকে উপহার দেন কাদম্বরী দেবী।
কাদম্বরী একজন সুঅভিনেত্রীও ছিলেন। নাট্যরসিক জ্যোতিরিন্দ্রের মন আরো উজ্জীবিত হয়ে উঠেছিল গুনবতী স্ত্রীকে পেয়ে। একেবারে ঘরোয়া পরিবেশে মাটির উঠোনে জ্যোতিরিন্দ্রের লেখা প্রহসন “এমন কর্ম আর করব না”তে প্রথম অভিনয় করলেন কাদম্বরী। রবীন্দ্রনাথ নায়কের ভূমিকায় ছিলেন, রবীন্দ্রনাথের প্রথম বিলেত যাত্রার আগে এই প্রহসনটি সফলভাবে অভিনীত হয়। এরপরে “বসন্ত উৎসব” , “মানময়ী”তেও কাদম্বরী ভাল অভিনয় করেছিলেন। কাদম্বরীর প্রধান পরিচয় তিনি অসাধারন একজন সাহিত্য প্রেমিক ছিলেন। তিনি শুধু সময় কাটাবার জন্য বই পড়তেন না, তিনি এক কথায় সেগুলোকে উপভোগ করতেন। তবে নিজে পড়ার চেয়ে শুনতে ভালোবাসতেন বেশী। দুপুরে রবীন্দ্রনাথ পড়ে শোনাতেন তাকে, হাত পাখা নিয়ে হাওয়া করতেন কাদম্বরী। “ভারতী” পত্রিকা নিয়েও তার ভাবনা ছিল। ছাপার হরফে “ভারতী”তে কোথাও তার নাম নেই সত্যিই কিন্তু তিনিই ছিলেন ওই পত্রিকার প্রান। তিনি মারা যাওয়ার পর সেটা আরো প্রকট হয়ে সকলের কাছে ধরা পড়ে। দ্বিজেন্দ্রনাথ সম্পাদক, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ দেখাশোনা করতেন, রবীন্দ্রনাথ লিখতেন তাহলে কাদম্বরী কি করতেন? শরৎকুমারীর ভাষায়, তিনি ছিলেন “ফুলের তোড়ার বাধন”। সবাইকে একসঙ্গে তিনি বেধে রাখতেন, সবার অলক্ষ্যে। বাধন যেদিন ছিড়ল, সেদিনই সবাই সেটি অনুভব করল।
রবীন্দ্রমানস গঠনে এই নারীর দান চিরস্মরনীয়। তার কবি হয়ে ওঠার মূলে আন্তরিক চেষ্টায় ছিলেন কাদম্বরী। কাদম্বরী সব সময় রবীন্দ্রনাথকে উসকে দিতেন, “ রবি সবচেয়ে কালো দেখতে, গলার যে কি অবস্থা, ওর চেয়ে সত্য ভালো গায়, ও কোনদিন গাইতেই পারবে না”। আরো বলতেন, “কোনকালে বিহারী চক্রবর্তীর মতো লিখতেও পারবে না”। রবীন্দ্রনাথের তখন শুধু চেষ্টা থাকতো কি করে এমন হবেন যে, বউদিদি আর কোন দোষ খুজে পাবেন না তার মধ্যে। রবীন্দ্রনাথ তখন বুঝতে পারতেন না, সেই সাধনাটিই করছে কাদম্বরী, যাতে কেউ কোনদিন রবীন্দ্রনাথের দোষ খুজে না পায়। যখন রবীন্দ্রনাথ এটি উপলব্ধি করলেন তখন চিরতরে হারিয়ে গেছেন বউদিদি। রবীন্দ্রনাথের প্রতিভার প্রদীপে তেল সলতে লাগিয়ে আলো জ্বালাবার কাজ তখন সারা। কিন্তু প্রিয় বউদিদি তখন চির অন্ধকারে, হয়তো তাই কবির কন্ঠে বাজে,
নয়ন সমুখে তুমি নাই
নয়নেরই মাঝখানে নিয়েছো যে ঠাই
রবীন্দ্রনাথের বিয়ের কয়েক মাসের মধ্যেই তার অকাল মৃত্যু হয়। ঘটনাটা আকস্মিক হলেও অভাবনীয় নয়। তীব্র অভিমানীনি কাদম্বরী এর আগেও আত্মহত্যার চেষ্টা চালিয়ে ছিলেন। তিনি প্রচন্ড ইন্ট্রোভার্ট, সেন্টিমেন্টাল ও স্কিজোফ্রেনিক ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের বিয়ে হয়তো তার মন বেদনার একটা কারন ছিল কিন্তু সেটার কারন বালিকা মৃনালিনী ছিলেন না। রবীন্দ্রনাথের বিয়ের জন্য মেয়ে দেখতে কাদম্বরীর বিপুল উৎসাহ ছিল। কিন্তু তারপর আকস্মিকভাবেই তিনি চুপ করে গেলেন, কেনো? তাহলে কি পাত্রী নির্বাচন নিয়ে মতান্তর হয়েছিল তার কারো সাথে? ভবতারিণীকে মৃনালিনী করে তোলার ভার নীপময়ী মতান্তরে জ্ঞানদানন্দিনী পেলেন কেনো? প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, “কাদম্বরীর আকস্মিক মৃত্যুর কারন হচ্ছে, মহিলাদের মধ্যে দ্বন্দ্বের পরিনাম”। সম্ভবত জ্ঞানদানন্দিনীর সাথেই তার মতান্তর হয়। হয়তো আরো কারন ছিল। কিন্তু বহিঃপ্রকাশ ঘটল এই সামান্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে। এই সুরসিকা, রুচিশীলা, প্রতিভাময়ী নারীর জীবনেও শান্তির অভাব ছিল। সন্তানহীনতার ব্যাথা তার এই অভিমানকে হয়তো আরো তীব্র করে তুলেছিল। সেকালে বন্ধ্যা নারী ছিলেন উপেক্ষার পাত্রী। সমাজে সংসারে কোথাও তার তেমন কোন কদর ছিল না। কাদম্বরীও ঠাকুরবাড়ীর বৃহৎ সংসারে তার নিজের যথার্থ স্থানটি কখনও পাননি। নিজের এই মর্মজ্বালার কথা তিনি কাউকে প্রকাশ করে বলতেও পারেন নি। এই জন্য কাদম্বরীর মৃত্যুর পর সমসাময়িক অনেক লেখক কবিই তাদের লেখায় জ্যোতিরিন্দ্রকে দায়ী করেছিল। নিঃসন্তান স্ত্রীর শুন্যতা ভরিয়ে দেয়ার জন্য স্বামীর যতোখানি মনোযোগের প্রয়োজন ছিল তিনি হয়তো তা ছিলেন না।
(চলবে)
০৪.০৭.০৮