সৃষ্টিতত্ত্বের গালগপ্প বনাম বিবর্তনের শিক্ষা-২
মেহুল কামদার
অনুবাদক: তানবীরা তালুকদার
পূর্ববর্তী পর্বের পর ...
সারা বিশ্ব জুড়ে আমাদের পূর্ব পুরুষদের করা আপ্রান চেষ্টা থেকে এটা স্পষ্টতঃই বোঝা যায় যে, জীবনের সৃষ্টি কিংবা এই বিশ্বজগৎ সৃষ্টি কি করে হলো সেটা বুঝতে এবং জানতে তারাও খুবই আগ্রহী ছিলেন এবং এ নিয়ে তারা বিস্তর চিন্তা ভাবনাও করেছেন। আদিম যুগের মানুষেরা বিজ্ঞান কিংবা শিক্ষার জ্ঞান ছাড়া বাধাহীন কল্পনা শক্তির দ্বারা উদ্ধুদ্ধ হয়ে আশে পাশের পরিবেশ বা পারিপার্শ্বিক জগৎ থেকে যা তাদের কাছে যুক্তিযুক্ত মনে হতো তারা সেভাবেই তার একটা ব্যাখা দাড় করাতো। যখন তারা মাটির ঘরে বসবাস করতো, পশু দিয়ে টানা বাহন ব্যবহার করতো, সেই সময়ের মানুষদের পক্ষে আজকে আমাদের কাছে যা খুবই নৈমিত্তিক বা সহজ কাজ তা তাদের কল্পনায়ও অসাধ্য ঘটনা ছিল। পাখির মত উড়ে বেড়ানো নিয়ে মানুষেরা কল্পণাপ্রবন ছিল প্রথম থেকেই- আদিম মানুষদের কল্পনায় প্রথমে উড়ন্ত দেবতা তৈরী হতো তারপর তাদের উপকথায় প্রবশ করত তাকে উড়ানোর কৌশলগত রঙ বেরঙ-এর গল্প । বর্বর যুগে নানা জরা ব্যাধি এবং যুদ্ধ বিগ্রহের কারনে মানুষের জীবন স্বল্পস্থায়ী হতো, প্রতি দিনের জীবন যুদ্ধের যন্ত্রনাগুলো ভুলে থাকার উপায় ছিল পরকালের সু্খ শান্তির গল্প শোনা। এবং যখন এই প্রশ্নটি আসতো কিভাবে মানুষের এবং অন্যান্য প্রানীর সৃষ্টি হলো তখন মানুষের একজন স্বর্গীয় সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি করতে হতো যিনি এই বিদ্যমান সমস্ত কিছুই সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টিকর্তার স্বরূপ কিরকম হবে এতো দূর মানুষ কল্পনা করতে পারেনি তাই সে তার নিজের পছন্দের সৃষ্টিকর্তার অবয়ব তৈরী করে নিয়েছে। আরবীয় ধর্মগুলোতে পরিস্কারভাবে সৃষ্টিকর্তার অবয়বের ইঙ্গিত আছে, যেখানে হিন্দু ধর্ম, প্রাচীন মিশরীয় ধর্ম, গ্রীস এবং রোমের ধর্মগুলো এতো প্রাঞ্জলভাবে এনিয়ে কিছু বলেনি, কিন্তু আছে তাদের পরিপূর্ন নিজস্ব আদলে যুদ্ধরত রাজার মতো দেবতা, আদালতের গল্পসহ পৌরনিক কাহিনী, উপপত্নী, ক্রীতদাস, বিদূষক এবং তাদের সময়ে মানুষকে শোষন করার অন্যান্য সকল ফাকিবাজী গল্প।
এইসব পৌরনিক গল্পগুলোতে পরিবর্তন আসতে অনেক সময় লেগেছে, ঐশীগ্রন্থ গুলো পরিবর্তন হতে পারেনি কারন তাদের ধর্মে পরিবর্তনের কোন সুযোগ নেই। তাদেরকে পরিপূর্ন বলে ধরে নেয়া হয় সেখানে কোন প্রশ্ন করার এমনকি কিছু কিছু জায়গায় ভাষার ব্যাখা নিয়েও কথা বলার সুযোগ নেই, আগের শতাব্দীগুলো থেকে এ ধরনের বেশ কয়েকটি উৎপথগামী ঘটনার কথা জানা যায়। আর এখন, মানুষের জ্ঞানের উৎকর্ষতা সীমাহীন। বিজ্ঞানী জেমস হাটনের ভূতাত্ত্বিক গবেষনা এবং চার্লস ডারউইনের বিবর্তনের উপর গবেষনা শীঘ্রই সবাইকে যথাযথ বিবরনের সাথে জানাবে, কিভাবে প্রথমে জীবনের উদ্ভব হলো এবং তাদের নিখূত গবেষনার সেই পদ্ধতি যার দ্বারা বিজ্ঞানীরা সমস্ত ঘটনাগুলোকে এক সাথে যৌক্তিকভাবে সারিবদ্ধ করে সবার সামনে আনেন, যদিও তারা ধর্মের লোকজনের কারনে আতংকিত থাকেন, বিশেষ করে গীর্জার অনুসারীদের দ্বারা। ইশ্বর তার কল্পনা থেকে মানুষের সৃষ্টি করেননি, বরং মানুষ পৃথিবীতে এসেছে বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় - এ ধরনের সত্য কথায় চার্চের গুরুত্ব কমে যায়। যারা ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে মানুষকে শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্রীতদাস বানিয়ে রেখে শোসন করে চলেছে যুগ যুগ ধরে আর জোর করে পয়সা কড়ি হাটিয়ে নিচ্ছে - মানুষের কাছে তাদের আসল রুপও প্রকাশ পেয়ে যায়। মোটামুটি পরিস্কার করেই, এরা জনগনকে বোঝায় যে ধর্ম বইতে যা লেখা আছে, তাই সত্য। পৃথিবীর বেশীরভাগ লোকই আগে ক্রিশ্চিয়ান বাইবেলের অনুসারী ছিলেন, তারা একটি বাস্তব দৃষ্টিকোন থেকে সকলেই ভুল ছিলেন। অনেক আগে ক্রিশ্চিয়ান সমাজ বিজ্ঞানী গ্যালিলিওকে তার সৌরজগত সম্পর্কে দেয়া মতামত প্রত্যাহার করার জন্য জোরপূর্বক ধরে নিয়ে যায়। কিন্তু পরে ইংল্যান্ড রোম, স্পেনকে এ নিয়ে প্রকাশ্যে বিতর্কের আহ্ববান জানিয়েছে এবং পরে ফ্রান্সকে বাধ্য করেছে নতুন বৈজ্ঞানিক তত্ত্বকে সমাধান হিসেবে নিতে, তখন কোন চার্চের সাহস হয়নি এ নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য করতে। তবে এক্কেবারে প্রথম দিকে, ইংল্যান্ডের সরকারী প্রটেষ্টান্ট চার্চ এর তরফ থেকে বাধা দেয়ার জন্য প্রচন্ড চেষ্টা করা হয়েছিল, বিশপ্ স্যাম উইলবিফোর্স চেষ্টা করেছিল ডারউইনের এবং তার অনুসারী বিজ্ঞানীদেরকে টমাস হাক্সলি’র মুখোমুখী করতে , যেখানে হাক্সলিকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল সে কি উত্তরাধিকার সুত্রে তার মায়ের বংশের নাকি বাবার বংশের বানরকুল থেকে জন্মগ্রহন করেছে। হাক্সলের জবাব ছিল খুবই নেতিবাচক, তিনি বললেন, আমি এমন একজন শিক্ষিত ব্যক্তি যিনি তার প্রাকৃতিক শক্তি, বাগপটুতাকে, পক্ষপাতদুষ্ট, মিথ্যাকথন এর কাজে ব্যবহার করে তার ঔরসথেকে জন্ম নেয়ার পরিবর্তে বরং একটি শিম্পাঞ্জী থেকে জন্মগ্রহন করতে পছন্দ করব। সেই সময়ের সংবাদপত্রগুলো এ নিয়ে বিশাল বিশাল কার্টুন ছাপে সে সময় এই বলে যে, হাক্সলি বলেছেন, তিনি বিশপ হয়ে জন্ম নেয়ার পরিবর্তে একটি শিম্পাঞ্জী হয়ে জন্মগ্রহন করতে চেয়েছিলেন। এরপর আর কোন চার্চ বিবর্তনবাদীদের বিরক্ত করার কোন স্পর্ধা দেখায়নি। তারা বরং বিবর্তনবাদকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার জন্য অনেক ধরনের প্যাচানো ঘোরালো পদ্ধতি অবলম্বন করেছে। প্রথমে তারা, মৃত্যুশয্যায় ডারউইনের ক্রিশ্চিয়ান হয়ে যাওয়ার মিথ্যে গুজব রটিয়েছেন, তারপর তারা বিবর্তনবাদ পড়ানোর উপরে বিভিন্নভাবে নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগের চেষ্টা চালিয়েছেন, এবং অবশেষে তারা পরিপূর্ন প্রতারনামূলক ধর্ম তত্ব “ইন্টিলেজেন্স ডিজাইন” নিয়ে এসেছেন, এবং আবারো চেষ্টা চালাচ্ছেন এ্যামেরিকার উচ্চ বিদ্যালয়গুলোতে বিবর্তনবাদের পরিবর্তে এটিকে বাধ্যতামূলক বিষয় হিসেবে পড়ানোর জন্য। এবং কিছু কিছু আরব দেশ সহ বিভিন্ন জায়গায় বিবর্তনবাদ পড়ানো বন্ধ করার ব্যাপারে চার্চগুলো সফলও হয়েছে বিশেষ করে আরবের উপসাগরের পরামর্শ দাতা দেশগুলো তাদের দেশের স্কুলগুলোতে বিবর্তনবাদ পড়ানো নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন।
যদিও শেষ পোপ দ্বিতীয় জন পল স্বীকার করেছেন যে, বিবর্তনবাদ ছিল বিজ্ঞানের সঠিক তত্ব, এবং তার উত্তরসূরী বেনডিক্ট তার সাথে একমত, তারপরো দুজনে মিলে সৃষ্টি তত্বের গল্পের “নৈতিকতা” প্রচার করে বিরাট হৈ চৈ ফেলে দিয়েছেন চারধারে। যেনো লক্ষ লক্ষ মানুষের উপর হওয়া অত্যাচারের ইতিহাস, অতীতে চলা গীর্জার স্বৈরতন্ত্র বাইবেলের ব্যখ্যা যার পর নাই 'নৈতিক', আর অন্যদিকে জীববিজ্ঞানীদের সতর্ক এবং শ্রমসাধ্য বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান, যারা ডারউইনের বিবর্তনের তত্বকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আরো গবেষনা করে চলছেন এবং মুল উৎসের দিকে ক্রমস ধাবিত হয়ে অন্তিম রহস্যের সমাধানের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন - তাদের সবকিছুই কোন না কোনভাবে অনৈতিক। যেনো বিজ্ঞানের বাস্তব শিক্ষা, কিংবা বিবর্তনবাদ সত্য হলেও বাইবেল ছাড়া কোন না কোনভাবে “অনৈতিক”। এই হলো পরোক্ষ ভাবে বিবর্তনবাদকে গ্রহন করার সেই নমুনা যেখানে তারা সারাক্ষন বোঝাতে চাইছেন বিবর্তনবাদকে ধর্মের সাথে মিশিয়ে পড়াতে হবে, রাজনৈতিকভাবে এদেরকে দুমুখো সাপ বলা ই বোধ হয় সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত হবে।
ধর্মের যুক্তিনুসারে এদের কথাগুলো প্রশ্নের অতীত, এর বিরুদ্ধে যেকোন ধরনের সমালোচনা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বেশীরভাগ ঐশী গ্রন্থগুলোতেই যারা এর বিরুদ্ধাচারণ করবে তাদেরকে ভয়ানক হুশিয়ারী দেয়া আছে, প্রায়শই দেখা যায় ধার্মিকগন এসব কল্পকাহিনীতে এতোটাই জড়িয়ে যান যে যারা তাদের এই মৌলবাদী মতের সাথে একমত পোষন করে না, তাদেরকে খুন, অত্যাচার এমনকি পঙ্গু করে দিতেও দ্বিধা বোধ করেন না। যেসব পরিস্থিতিতে তারা এধরনের কিছু করতে অপারগ হয়, যেমন এ্যামেরিকার কিছু উচ্চ শিক্ষিত ভদ্র এলাকায় সেখানে তারা আইনের আশ্রয় নিয়ে আইনের মুগুর দিয়ে বিজ্ঞানকে থামানোর চেষ্টা করে। কিন্তু সত্যি হলো বিজ্ঞানের গবেষনা কোন স্থির হয়ে থাকা জড় বিষয় নয়, আর বিজ্ঞানীদেরকে তাদের গবেষনার পক্ষে যুক্তি প্রমান দাড় করাতে প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়, যেখান থেকে নতুন সম্ভাবনার উদয় হবে। বিজ্ঞানীদের শিক্ষা, গবেষনা ও তথ্যের প্রতি যে উদ্দীপনা দেখা যায় ঠিক সেই রকম উদ্দীপনা মৌলবাদীদের মধ্যেও দেখা যায় লোককে বিশৃংখল, বিভ্রান্ত ও মিথ্যের দিকে নিয়ে যেতে। আমরা একটা চলমান এলোপাতাড়ি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পৃথিবীতে এসেছি এই তথ্যটি জানার পর পৃথিবীর প্রতি আমাদের দ্বায়িত্ব আরো বেড়ে যায়। দীর্ঘ জৈব-রাসায়নিক ক্রিয়া বিক্রিয়ার ফলে এক সময় প্রানের সৃষ্টি হয়েছে। যে কোন ধরনের অবিমৃশ্যকারীতা আবার এটাকে শেষও করে দিতে পারে। বিবর্তনের এই জ্ঞানই আমাদেরকে পৃথিবী, পরিবেশ কিংবা জীবনকে সম্মান করতে শিখায়। বিজ্ঞানীদের কিংবা মানবতাবাদীদের পরকালের নরকের ভয়ে কিংবা স্বর্গলাভের আশায় “নৈতিক” জীবন যাপনের দরকার নেই। যেহেতু কোন সৃষ্টিকর্তাই নেই, তাই সাধারন মানুষের নৈতিক জীবন যাপনের ভার তার নিজের উপর। স্বর্গ বলতে যেহেতু কিছু নেই, তাই জীবনের সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য আনন্দ উচ্ছাসে জীবন ভরিয়ে তোলার খুবই দরকার আছে, এবং যখন আমরা জানব কিভাবে আমরা এই সুন্দর জীবন পেয়েছি সেটাকে আরো বেশী করে উপভোগ করব। ডারউইন দিবস সেই জন্যই সমস্ত পৃথিবী জুড়ে উৎসব করার মতো একটি সেক্যুলার দিবস কারন এই দিনের মাধ্যমেই সমস্ত কুসংস্কার, বর্বরতা এবং মাথার উপর জোর করে চেপে থাকা অজ্ঞতার অবসান জানানো হয়েছে।
তানবীরা তালুকদার
০৩.০৬.০৮