ছুটির ফাঁদে :: যুথিকা বড়ুয়া
সঞ্জয় আর মালবিকা, ওরা নিঃসন্তান। দুজনেই অর্থ উপার্জন করে। স্ত্রী ও বৃদ্ধা মাকে নিয়ে ছোট্ট ছিমছাম নির্ঝঞ্ঝাট সুখী পরিবার সঞ্জয়ের। পেশায় একজন মেডিক্যাল ডাক্তার! চাইল্ড্ স্পেশালিষ্ট! আর স্ত্রী মালবিকা, হাইস্কুলের শিক্ষয়িত্রী। শহরের নিড়িবিলি রেসিডেন্সি এলাকায় অট্টালিকার মতো শ্বেতপাথরের মোজাইক করা বিশাল বাড়ি তাদের! বাড়ির সদর দরজার ওপরে নেইম প্লেটে বড় বড় অক্ষরে খোদাই করে লেখা, “শান্তি কুটির।”
কর্মজীবনে মানব সেবাতেই দিন আর রাত পোহায় সঞ্জয়ের! দিনের শেষে ক্লান্ত সূর্য্যমিামা কখন যে অস্তাচলে ঢলে পড়ে, সন্ধ্যে পেরিয়ে বাইরের পৃথিবীটা অন্ধকারে ছেয়ে যায়, মালুমই হয়না! অবিরাম রুগীর সেবা-শুশ্রূষা করতে করতে নিজের ব্যক্তিগত জীবনের আনন্দ-উচ্ছাসে একেবারে ভাটাই পড়ে গিয়েছিল সঞ্জয়ের!
সেবার সামার ভেকেশনে মনস্থির করে, রুটিনমাফিক কর্মজীবন থেকে কিছুদিনের জন্য বিরতি নিয়ে সমুদ্র-সৈকতে যাবে। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয়, তার বৃদ্ধা মাকে নিয়ে! তিনি বাতের ব্যথায় নড়তেই পারেন না কোথাও! সকাল সন্ধ্যে দুইবেলা পালা করে লোক আসে ওনাকে মাসাজ করতে। সারাদিন বেশীর ভাগ সময়ই তিনি শুয়ে বসে কাটান! তার দেখভালের জন্যও একজন বিশ্বস্থ কাউকে দরকার! কিন্তু স্বেচ্ছায় সঞ্জয়ের এতবড় একটা দায়িত্ব নেবে কে! তা’হলে!
শুনে সঞ্জয়ের বাল্যবন্ধু ভাস্কর বলল, -‘আরে এয়ার, ডোন্ট ওরি! ম্যায় হুঁ না!’
প্রভুভক্তের মতো আনুগত্য হয়ে মাথাটা সামনে ঝুঁকিয়ে দিয়ে বলে, -‘বান্দা হাজির দোস্ত! বিপদের সময়ই বন্ধুর পরীক্ষা হয়! মাসিমাকে নিয়েই যতো ভাবনা তো, নিশ্চিন্তে থাক্! ওনার দেখাশোনা আমিই করবো! তুই শুধু বাড়ির চাবিটা আমায় সঁপে দিয়ে যা ব্যস, কেল্লাফতে!’
অপ্রত্যাশিত বন্ধুর আশ্বাস পেয়ে সানন্দে খানিকটা উৎফুল্ল হয়ে উঠল সঞ্জয়। চোখের তারাদু’টি চক্ চক্্ করে উঠল ওর। দীর্ঘদিন পর ঠোঁটের কোণে মালবিকার মুচকি হাসির ঝিলিকটাও আরো উদ্ধত করে করলো ওকে। স্বহাস্যে ভাস্করের পিঠে আলতোভাবে একটা চড় মেরে বলে,-‘ইয়ে হুই না বাত! সত্যি মাইরি, আমায় বাঁচালি তুই!’
পঁঞ্চাশের উর্দ্ধেঃ বয়স সঞ্জয়ের। মুশকিল আসান হতেই শুরু হয় অবকাশ যাপনের প্রস্তুতিপর্ব। ঘুম ভাঙ্গতেই চোখ মেলে দ্যাখে, ঊষার প্রথম সূর্য্যরে নির্মল হাস্যেৎজ্জ্বল একটি আনন্দময় সকাল। যেন সমস্ত মানুষগুলিকে অকুন্ঠভাবে আহ্বান করছে, স্বতঃস্ফূর্ত মনে উল্কার মতো দ্রুত কক্ষচ্যুত হয়ে আনন্দময় কোনো এক প্রান্তরে চলে আসার জন্য।
সবুর সয়না সঞ্জয়ের। সেদিন সকালেই উৎসাহে-উদ্দীপণায় দায়িত্বের বোঝা ভাস্করকে প্রগাঢ় বিশ্বাসে সঁপে দিয়ে বেরিয়ে আসে বাইরের পৃথিবীতে! সাময়িক অবসর নিয়েই স্বস্ত্রীক রওনা হয়ে গেল সমুদ্র-সৈকতে! কিন্তু মঞ্জুর হলো না বিধাতার! মাঝপথে গিয়ে তাদের বিশাল যাত্রীবাহী টুরিষ্ট বাসটা হঠাৎ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ছিকটে পড়ে একটি নোংরা কর্দমাক্ত খাঁদের গভীরে! আর পড়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় আত্মচিৎকার। কাঁন্নার রোল। প্রাণ হারায় অনেকে! কেউ গুরুতরোভাবে ঘায়েল হয়ে অর্ধমৃত অবস্থা! আর কেউ প্রাণে বেঁচে গেলেও মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে বিকলাঙ্গ অবস্থায় প্রায় নমাস চিকিৎসাধিনে পড়েছিল, স্থানীয় হাসপাতালে! সেখানেই এ্যাড্মিটেড ছিল মিষ্টার এ্যান্ড মিসেস সঞ্জয় রায় চৌধুরী! তাদের সঙ্গে কোনপ্রকার আইডেন্টিটি কার্ড কিংবা বাড়ির ঠিকানা ছিলনা যে, এতবড় একটা মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনার সংবাদটা তাদের আত্মীয়-পরিজনের কাছে গিয়ে পৌঁছাবে।
একেই বলে নিয়তির নিমর্ম পরিহাস! ওদের সুখের সংসারে কার যে নজর পড়েছিল, একদিন সম্পূর্ণ সুস্থ্য হয়ে ফিরে এসে নিজের বাড়িই আর খুঁজে পায়না সঞ্জয়! সারাপাড়া পরিক্রমা করে ও’ বারবার একই জায়গায় এসে দাঁড়ায়! আর মনে মনে ভাবে, এ কি, আমাদের ‘শান্তি কুটির’ গেল কোথায়! এ তো দেখছি, ‘ভবানী ভবন’ লেখা! কি আশ্চর্য্য, বাড়ির নক্সাটাও সম্পূর্ণ বদলে গিয়েছে যে! কিন্তু তাই বা সম্ভব হয় কি করে!
ইতিপূর্বে এক বয়স্ক ভদ্রলোক ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে বললেন, -‘কাকে চাই?’
অপ্রত্যাশিত হঠাৎ অচেনা লোকের মুখদর্শণে হকচকিয়ে যায় সঞ্জয়। ভবানী ভবনের উপর থেকে নীচ পর্যন্ত চোখ বুলিয়ে বলে, -‘আপনি, আপনাকে তো চিনতে পারলাম না! আপনি কে হে মশাই!’
ঠোঁট চিবিয়ে চিবিয়ে ভবানিচরণ বললেন,-‘আজ্ঞে আমি হইলাম ভবানীচরণ দাস। এ বাড়ির মালিক। নুতন কিনছি!’
আঁতকে ওঠে সঞ্জয়। -‘বলেন কি মশাই, আপনি এ বাড়ির মালিক! এ চত্তরে আগে তো কোনদিন দেখিনি! মশাই আপনার মস্তিস্ক, শরীরের তাপমাত্রা সব ঠিক আছে তো!’
শুনে রেগে লাল ভবানীচরণ। চোখমুখ রাঙিয়ে একেবারে তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠেন। তোতলাতে শুরু করেন। সঞ্জয়ও নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। থানা পুলিশের হুমকি দিতেই লেগে যায় তুমুল ঝগড়া। অথচ তখনও কল্পনাই করতে পারেনি, যে নিজের ভাইয়ের চেয়েও বেশী, সেই ছোট্ট বয়স থেকে একসাথে বেড়ে ওঠা বাল্যবন্ধু ভাস্কর মিত্র, যার উপর বাড়ির সমস্ত দায়-দায়িত্ব সঁপে দিয়ে গিয়েছিল, সে-ই বিশ্বাসঘাতকতা করেছে! ভাবতে পারেনি, জীবনের সাঁঝবেলায় এসে ওরই বিশ্বস্থ বন্ধু ভাস্কর, নিষ্ঠুরের মতো এতবড় কঠিন আঘাত হেনে প্রৌঢ়ত্বে নিঃশ্ব করে দিয়ে ওকে একেবারে পথে বসিয়ে দিয়েছে!
দুই দুটো জলজ্যান্ত প্রাণী হঠাৎ নিখোঁজ হবার পর সারা পাড়ায় যখন হৈচৈ পড়ে গেল, আত্মীয়-স্বজনরাও যখন অনুসন্ধানে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে, ঠিক তখনি সঞ্জয়ের হৃদয়-প্রাণ ‘শান্তি কুটির’ সবার অলক্ষ্যে বেনামে বেচে দিয়ে, সঞ্জয়কে বেঘর, নিরাশ্রয় করে দিয়ে, পলাতক দাগী আসামীর মতো রাতারাতি শহর ছেড়ে অন্যত্রে গিয়ে আত্মগোপন করে তারই বিশ্বস্থ বন্ধু ভাস্কর মিত্র! যা ঘূণাক্ষরেও পাড়ার কেউ টের পায়নি!
ততদিনে সঞ্জয়ের গর্ভধারিনী বৃদ্ধা মায়ের বুঝতে আর বাকি থাকেনা। তার একমাত্র পুত্র সন্তানকে হারানোর শোকে কাতরতায় তিনি মুহ্যমান হয়ে পড়েন। তার শূন্য বুক দুইহাতে চাপড়াতে চাপড়াতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে কোথায় যে চলে যায়, আর ফিরে আসেনি। হয়তো পথেঘাটে কোথাও মৃত্যুবরণ করেছে, কে জানে!
বিকৃতি চেহারা আর বিকলাঙ্গ শরীর নিয়ে উচ্ছাসহীন, আবেগহীন মালবিকা নিথর নির্জীব প্রাণীর মতো অন্যমনস্ক হয়ে উইলচেয়ারে বসেছিল। একেই আচমকা জীবনে অনাকাঙ্খিত বিপদের সম্মুখীন হয়ে পঙ্গুত্বের গ্লানিতে মানসিকভাবে একেবারেই ভেঙ্গে পড়েছে! তন্মধ্যে দুঃস্বপ্নের মতো অবিশ্বাস্য এবং সর্বস্বান্ত নিঃশ্ব হয়ে যাওয়ার দুঃসংবাদ শুনে মাথায় যেন বজ্রাঘাত পড়ে। এ কি সর্বণাশ হলো তাদের! আনন্দমুখরিত চঞ্চল প্রবাহিত জীবনটা ওদের হঠাৎ কেন বিনা নোটিশে থেমে গেল!
অবসন্ন ব্যাথাতুর দেহটা বহন করবার মতোও শক্তি নেই মালবিকার। বুকের ভিতরের সমস্ত ব্যাথা, কষ্টগুলি বুক ফেটে দু’চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় ঝড়তে থাকে! পারেনি সম্বরণ করতে! ক্ষোভে দুঃখে শোকে বিহ্বলে হঠাৎ সঞ্জয়কে জড়িয়ে ধরে মুখ গুঁজে হু হু কেঁদে ওঠে!
বেদনাহত বিমূঢ়-ম্লান সঞ্জয়, পাথরের মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে! স্ত্রীকে শান্তনা দেবার মতো একটা শব্দও উচ্চারিত হলোনা ওর! কি বলে শান্তনা দেবে! কখনো কি ভেবেছিল, জীবন জোয়ারে সুখের তরীতে ভাসতে ভাসতে একদিন আচমকা অতল তলে তলিয়ে যাবে! যেখানে কূল নেই! কিনারা নেই! বেঁচে থাকারও কোনো অবলম্বণ নেই! জীবন নদীর খেয়া পুনরায় বাইতে শুরু করলেও উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো প্রাণবন্ত মালবিকার চোখের তারাদু’টিতে কখনো আর খুশীর ঝিলিক দেখা যাবেনা। কিছুই আর ফিরিয়ে দিতে পারবে না। ফিরেও আসবে না কোনদিন! শুধু নীরব নির্বিকারে বুকের মাঝে জমে থাকবে না বলা কিছু কথা। কথার আলাপন। আর অহরহ কানে বাজবে, খুশীর বন্যায় প্লাবিত করে ভ্রমরের মতো ভেসে বেড়ানো মালবিকার গুনগুন গুঞ্জরণে অপূর্ব সুরের মূছর্ণা।
স্ত্রীর অলক্ষ্যে পলকমাত্র দৃষ্টিপাতে সঞ্জয় দেখল, বিষন্নতায় ছেয়ে গিয়েছে মালবিকার শরীর ও মন! ক’মাসেই অনেক বুড়িয়ে গিয়েছে। চোখমুখও শুকিয়ে মলিন হয়ে পুতুলের মতো দেখাচ্ছে ওকে! কি যেন ভাবছে মালবিকা!
সঞ্জয় তক্ষুণি বিড় বিড় করে ওঠে মনে মনে,-‘কিচ্ছু ভেবো না মালবিকা, আমি অঙ্গীকার বদ্ধ! আমার অকুণ্ঠ হৃদয়ের উজার করা নীরব ভালোবাসায় প্রিয়তমার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের দৃঢ় অঙ্গীকারে আমার বুকের সমস্ত কষ্টগুলি লুকিয়ে থাকবে, ক্ষণিকের একফালি অনিন্দ্য সুন্দর হাসির আড়ালে।’
হঠাৎ মালবিকার গভীর সংবেদনশীল দৃষ্টি বিনিময় হতেই বুকটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠল সঞ্জয়ের। ওর ভারাক্রন্ত হৃদয়ে ক্ষণপূর্বের সেই যন্ত্রণাদায়ক গহীন বেদানুভূতির তীব্র দংশণে মস্তিস্কের সমস্তস্নায়ূকোষগুলিকে যেন কুরে কুরে খেতে লাগল! অত্যন্ত পীড়া দিলো মুমূর্ষ্য হৃদয়কে! হতাশায় বিশুস্ক বুকটা খাঁ খাঁ করে উঠল। অনুতাপ আর অনুশোচনার অন্ত নেই। হারিয়ে ফেলেছে মনের সমস্ত শক্তি! বুকের পাঁজরখানাও ভেঙ্গে গুঁড়ো হয়ে গিয়েছে ওর! মালবিকার মুখপানে চোখ তুলেও আর তাকাতে পারেনা! ওর প্রিয়তমা ওর প্রিয়তমা পত্নী, অর্ধাঙ্গিনী মালবিকাই ছিল, চির অম্লান, চির সজীব, স্নিগ্ধ শান্ত কোমনীয় এক উদ্বিগ্ন যৌবনা অনন্যা! প্রেমের মহিমায় দ্বীপ্ত মমতাময়ী বিদূষী রমণী। ওর হৃদয়হরিনী। সঞ্জয়ের নিবেদিত প্রাণ, শক্তির উত্স! ওর প্রেরণা, ভাই-বন্ধু-প্রেয়সী, সব!
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জুন, ২০০৮ দুপুর ১২:৪০