আবু মকসুদ
অনিবার্য যিসাস
‘সাকিনা আমার বোন এজিদের দুশমনী এখনও সতেজ’ এই আপ্তবাক্য উচ্চারণে চারিদিকে এক নীল বেদনা ছড়িয়ে পড়ে। এই বেদনা চাতক পাখির আর্তনাদ হয়ে অতঃপর মরুভূমির তপ্ত বালু চিরে হিমালয়ের পাদদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত হতে থাকলে ‘যিসাসের আগমন অনিবার্য’ কাব্য গ্রন্থটি পাঠের অপরিহার্যতা ঘোষণা করে। আমরা সেই পথ ধরে হাঁটতে থাকি আর একজন কবির চোখের ভেতর ঝুলে থাকা হিংস্র পৃথিবীকে অবলোকন করি। আমাদের অগ্রজ কবি আল মাহমুদের ভাষায়Ñ কবিতা কালের অক্ষর। অন্তত নিজের কবিতার ক্ষেত্রে সেই স্পর্ধিত উচ্চারণটি তিনি রেখেছেন। সত্তর দশকের কবি ফরীদ আহমদ রেজা Ñ ‘যিসাসের আগমন অনিবার্য’ গ্রন্থের লেখক। আমরা এই কবিকে চিনি কোলাহলের বাইরে নিবৃত্তচারী হিসেবে। তার লেখা নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা নেই বললেই চলে। নতুন কবিতাও তেমন চোখে পড়ে না। তবে সম্প্রতি এই কবি একটি কবিতাবিষয়ক ‘কবিতা’ পত্র সম্পাদনা করছেন। সেই কবিতাপত্র নিয়ে এক আড্ডায় তিনি চিন্তক মন্তব্য ছুঁড়ে দেনÑ ‘কখনো মনে হয় সব কটি কবিতাই একটি কবিতা।’ তাঁর কবিতা আলোচনা করতে গিয়ে এই বিষয়টি মাথায় রাখার চেষ্টা করবো।
ফরীদ আহমদ রেজার কবিতায় আল মাহমুদের সেই কালকে ধারণ করার চিহ্নগুলো স্পষ্ট দেখতে পাই। সেই অনুপাতে বিচার করলে গত দু’দশকে বাংলা কবিতা থেকে ‘যিসাসের আগমন অনিবার্য’ গ্রন্থের কবিতাগুলো সহজেই চিহ্নায়ন করা যায়। অনেক বিষয়ে তিনি প্রচলিত ধারায় আমাদের অব্যস্ত দৃষ্টিকে ঘুরিয়ে দেখতে বাধ্য করেন। অনেকের চেয়ে আলাদা এ জন্য যে তিনি কেবল ‘মৃতমিথ্’ দিয়ে কবিতার ভেতর অহেতুক আঁধার সৃষ্টি করে সন্তুষ্ট থাকতে চাননি। তার কবিতায় সমকাল ও অতীত বিশ্বের আতঙ্কজনক চরিত্রের ভয়ঙ্কর দন্তগুলো বের হয়ে এসেছে। আমরা দেখতে পাই, অনাকাঙ্খিত সংঘাতময় পৃথিবী তাকে হতাশ করেনি বরং জাগিয়ে তোলার, সামনের দিকে অগ্রসর হবার চেতনা শব্দের শরীর বেয়ে শাখা পল্লব বিস্তার করেছে। নারকীয় দৃশ্যাবলি তাকে হতাশ করে না বলেই যিসাসের আগমন বার্তাটি আমাদের ভেতরকার বিশ্বাসের দেয়াল বেয়ে, আমাদের গুন্ঠিত স্বপ্নের ধূসর চাঁদর সরিয়ে বেড়ে ওঠতে থাকে। এই গ্লোবাল বিশ্বাস-মিথ দিয়ে কবি একটা ঐক্যের সন্ধান খোঁজে আনেন। আমাদের কৌতুহল থাক বা না থাক যিসাস অনিবার্য হয়ে ওঠেন পৃথিবীর বিভিন্ন জনপদে। এক্ষেত্রে এই গ্রন্থের নামকরণ অনেক দীর্ধমেয়াদী তাৎপর্য বহন করে। গ্লোবাল বললাম এ জন্য যে, বর্তমান পৃথিবীর প্রধান তিনটি ধর্মাবলম্বী মানুষই তার প্রতি এক বা অন্যভাবে বিশ্বাস রাখেন, অর্ঘ্য দেন, মান্য করেন। ‘যিসাস’ না হয়ে ‘মুসা’ হতে পারতো, ‘যিশু’ হতে পারতো। হয়নি যে কারণে সেখানে আমরা কবি চিন্তার ধারণ ক্ষমতা আবিষ্কার করি এবং ঔদার্য্য মনেবৃত্তিও সেখানে লক্ষ্যণীয়। কবির শব্দবারান্দায় যে উপযুক্ত ধ্বনি-গুঞ্জন বেজে ওঠে, সেই গুঞ্জনকে কবি আপন করে নেন সকলের জন্য। ‘যিসাস’ শব্দকে তিনি এভাবেই আমাদের জন্য ধ্বনিগুচ্ছে তুলে দিয়েছেন যা শাশ্বত ব্যঞ্জনাকে জাগ্রত করে, তাড়িত করে। শান্তির জন্য যার আগমন, স্বভাবগত কবি শান্তির সেই প্রতীককেই কবিতার উপজিব্য বিষয় হিসেবে গ্রহণ করেছেন।
ফরীদ আহমদ রেজার কবিতার স্বভাব ও ভাষার রূপ কেমন? এক সঙ্গে সেই বিষয়টি তুলে ধরলে দেখা যাবে তাঁর কবিতা পাঠককে পোড়ায় না। কোথাও দহন নেই যা সারাক্ষণ বিষন্নতা এনে দেয়, ব্যথা-বেদনা আছে কিন্তু অগ্নিখরা তৈরি করে না। বিপ্লব আছে, দাবানল নেই। প্রেম আছে অশ্লীল নয়, স্নিগ্ধ। যাতনা আছে, হতাশা নয়। যৌবন আছে, ভাসিয়ে নেয় না Ñ দৃঢ় হতে বলে। মায়া আছে, ভোলায় না Ñ উজ্জীবিত করে। ক্রোধ আছে, হিংসা বা হিংস্রমতবাদ নেই। এই বিষয়গুলো তার কবিতার স্বভাব-চরিত্র, ভাষা ও রূপ। এ সমস্ত তাঁর কবিতার ভেতর কীভাবে সমান্তরাল হয়ে ব্যবহৃত হয়েছে, কয়েকটি চরণে চোখ রেখে খোঁজার চেষ্টা করবোÑ
আদম ঈভের প্রভু শোন শোন অšে¦ষণার বাণী
আদম ঈভের প্রভু শোন শোন প্রার্থণার গান
সোনাদানা বালাখানা সুন্দরীর বিদ্যুৎ চমক
পৃথিবী জঠর তুলে নাও দাও শুধু মাটির মানুষ
মানুষের জন্মদানে দূর হোক পৃথিবীর অপয়া লানত।
(প্রভু আমায় মানুষ দাও)
মানুষের জন্মদান পৃথিবীতে সবচে গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ। কবি এর মাধ্যমে পৃথিবীর অপয়া লানত দূর করতে চান। কবির প্রার্থীত চিন্তায় কবি হয়ে ওঠেন শান্তির অšে¦ষক। অপয়া পৃথিবীর ধ্বংশ কামনা করে কেবল মানুষের জন্য একটি শান্তির ডেরা কামান করেছেন। পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে তিনিও বিপ্লব চেয়েছেন। প্রেম ও প্রার্থনায় সে বিপ্লব সঙ্গীত হয়ে বেজেছে।
... ... ...
ভেঙেছে গড়েছে কত কল্পণায় তোমার আদল
অজস্র কুন্তলরাশি তিল টোল চিবুক কপোল।
তোমাকে দেখেছি আমি চেতনার বিরান সড়কে
মড়ক জোয়ার তুমি প্রাণ দিয়ে রুখে দিতে পার
হতাশার বাঁকে বাঁকে সমস্যার পরতে পারতে
তোমার পরশ দিবে সুখময় সাহস আশ্বাস।
বিশ্বাসে আস্থায় তুমি পূন্যময় আত্মার বৈভব
অঢেল ফলন দিয়ে ভরে দিবে হৃদয় পৃথিবী।
(নীলুর জন্য কবিতা-৩)
‘বিরন সড়ক’ তার আগে যোগ হয়েছে ‘চেতনার’। কেবল বিরান সড়ক আমাদেরকে একটি চিত্রকল্প দেয়মাত্র। তেমন কোনো সংবাদ বহন করে না। এ শুধু নির্মোহ সংবাদ ছাড়া আর কিছু নয়। এর সঙ্গে সংযুক্ত ‘চেতনার বিরান সড়ক’ প্রতিজ্ঞা তৈরি করে যার অর্থ অনেক গুরুত্ববহ বলে নির্মোহ থাকার অবকাশ থাকে না। একইভাবে পরবর্তী চরণে Ñ ‘মড়ক জোয়ার’ ব্যবহৃত হয়েছে যা কাব্যে একই দ্যোতনা ও অর্থবহন করে।
কবির প্রিয়সী নারীর মুখ যখন প্রতীকি রূপে আসে, সেই মুখ আরাধ্যচেতনা তৈরি করে। সেই মুখ কবির একার থাকে না, হয়ে ওঠে সকলের। আমাদের যাপিত জীবনের ভেতর দিয়ে এ ধরণের একটি আদল প্রতিদিন প্রকাশ পেতে থাকে। যারা একে আবিষ্কার করেন তারাই কবি, তারাই কবিতার বাতাবরণ নমস্যমানব।
কবি তো রাজনীতিক নন। রাজনীতি কবির বিষয় হতে পারে। সে বিষয়ও আবার শিল্প-সত্ত্বা থেকে বড় করে তুলতে নারাজ Ñ এখানেই বিষয়ে ফরীদ আহমদ রেজা স্বভাবকবি হয়ে ওঠেন। সত্তর দশকের অনেক বাংলা কবিতা রাজনৈতিক শ্লোগানসর্বস্ব হয়ে উঠেছিল। ৯০ বা শূন্য দশকে এসে অনেকেই আবার অতিমাত্রায় রাজনীতি বিমূখ। এ দু’য়ের কোনোটাই ফরীদ আহমদ রেজার কবিতাকে গ্রাস করতে পারেনি। পৃথিবীর অনেক বড় মাপের কবি/লেখক/দার্শিনিককে আমরা পাই যারা রাজনীতিক ছিলেন না। কিন্তু রাজনীতি তাদের বিষয় ছিল। রাজনীতির দুষ্ট ক্ষত তাদের গিলতে পারেনি। বিষয়ে-চিন্তায় তারা তা পরিপুষ্ট করেছিলেন/করছেন। দার্শনিক জ্য পল সার্ত্র দর্শনগতভাবে কমিউনিস্ট ছিলেন কিন্তু কমিউনিস্ট রাজনীতির সদস্য ছিলেন না। ম্যাক্সিম গোর্কিকে পৃথিবীর পাঠকদের কাছে কমিউনিস্ট লেখকরা ইজমের সার্থে একজন ‘কমরেড’ হিসেবেই পরিচয় করিয়েছিলেন। লেখক গোর্কিকে মানুষ ঠিকই আবিষ্কার করতে পেরেছে যার জন্য তার রাজনৈতিক পরিচয় দরকার ছিল না। তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্যও ছিলেন না। দর্শনগতভাবে তিনিও ছিলেন মানবকল্যাণ চিন্তার ধারক। লেখকের কাছে যখন রাজনীতি বিষয় হয়ে ওঠে রাজনীতি সুস্থ ধারায় বিকশিত হতে থাকে। লেখক যখন রাজনীতির জন্য ওয়ে ওঠেন তখন লেখকের চিন্তা-চেতনায় মুক্তভাবনা বাধাগ্রস্থ হয়। ফরীদ আহমদ রেজার লেখক সত্ত্বার ভেতর এই কারিগরী চিন্তাটি কাজ করেছে যা শিল্প-সাহিত্যের জন্য নিয়ামক। তাঁর কবিতার ভেতর দলীয় রাজনীতি কাজ করেনি কিন্তু রাজনীতি আছে। সে রাজনীতিটা কি? Ñ প্রতিনিয়ত মানুষের লাগি কল্যাণকর পৃথিবীর জন্য প্রার্থনা।
হলুদ পাতাগুলো ঝরে পড়ে সবুজের কান্না বুকে নিয়ে
পৃথিবীটা এখনো বন্ধ্যা হয়ে যায়নি
তোমাদের আঙ্গিনা জুড়ে সেই সৈনিকদের গুটানো তাবু
যারা নিজ হাতে নিজেদের সবগুলো আকাঙ্খার নৌকোয় আগুন দিয়েছে
পালাবার কোনো পথ খোলা রাখেনি।
(অঙ্গীকার)
অথবা
পৃথিবীর দীর্ঘশ্বাস ঢেউ তুলে পতেঙ্গা বন্দরে
অযুত কোরবানী বুকে সুনীল সাগর আজো জীবন্ত উদ্দাম
আহত আত্মার মুখে বিশ্বাসের গান
আমাকে দিয়েছে এক অগ্নিঝরা অঙ্গীকার
চট্টলার সমুদ্র সৈকত ...
(ওরা একদল যুবক)
কিংবা
কৃষকের মনগুলো চৈত্র উদাস
নায়ের বাদাম তুলে ভাটিয়ালী নেই
এ কেমন বাংলাদেশে তুমি গান গাও
কোথায় পেয়েছো তুমি এমন প্রত্যয়?
তোমার গানের সুরে ঘুমন্ত সহিস
জাতীয় সঙ্গীত মুখে চোখ তুলে চায়।
(নীলুর জন্য কবিতা-১)
‘... ঘুমন্ত সহিস/ জাতীয় সঙ্গীত মুখে চোখ তুলে চায়।’ অসম্ভব ঘন-আবেগময় কবিতাটি সকল গ্লানি ধুয়ে-মুছে দিয়ে যায়। কখন কবি হয়ে ওঠেন হরিয়াল কৃষকের স্থাবর-অস্থাবর। ‘তোমার গানের সুরে ঘুমন্ত সহিস/ জাতীয় সঙ্গীত মুখে চোখ তুলে চায়’ Ñ কান সতর্ক করে শুনি অন্য এক মুরলিয়া বাঁশি। এ বাঁশি অর্ফিয়্যুসের বিষের বাঁশি নয়। বালুকা প্রান্তরে কিংবা চৈত্রের রৌদ্রখরায় ফেটে পড়া পলিমাটির রাখালিয়া সজনের মিঠা সুর ভেসে আসে। আর মুহূর্তে দুপুরের অপেক্ষমান একগুচ্ছ পলক হাওয়া মধুর এক দোলনচালে জাগিয়ে দিয়ে যায়। এ উপলব্ধি কবির নয়, পাঠকের। ধ্র“পদি কবিতা এমনই বহুমাত্রিক ভাবনাকে সংজ্ঞায়িত করে। এর পূর্বেউচ্চারণরণ Ñ ‘এ কেমন বাংলাদেশে তুমি গান গাও/ কোথায় পেয়েছো তুমি এমন প্রত্যয়?’ আমরা প্রত্যক্ষ করি যে, এমন প্রত্যয় না হলে ঘুমন্ত সহিস কী করে চোখ তুলবে আগামীর জন্য? কবি এই বোনেদী কবিতার নাম দিয়েছেন ‘নীলুর জন্য কবিতা’। শেষ পর্যন্ত একজন নারীই কবির জন্য হয়ে ওঠেন গোপন চাবি অথবা চালিকা শক্তি।
বিশ্বাস হলো এক ধরনের প্রত্যয়-দৃঢ়তার নাম। সকল অমঙ্গল-অসুস্থতার বিরুদ্ধে বুক চেতিয়ে দাঁড়িয়ে যাবার যে প্রেরণা তারই পরিপূর্ণ অর্থ Ñ বিশ্বাস। একজন বিশ্বাসী মানুষই পূর্ণ আস্থা তৈরি করতে পারেন। কবি ও কবিতার চরিত্রে এই সামঞ্জস্য না থাকলে আমরা কী করে তাকে পরিপূর্ণ কবি বলবো? এই বোধ নিয়েই একজন ফরীদ আহমদ রেজা অগ্রসর হয়েছেন, কবিতার শরীরে হাত রেখেছেন। ভাষা ও চিন্তায় যা তিনি প্রকাশ করেন ব্যক্তিচরিত্রেও তা তিনি লালন করার কথা বলেন। সাধারণত এই সামঞ্জস্যতার প্রয়োজন মনে করেন না অনেক কবি। কেন করবেন না? কবিতা তো কেবল পূন্যবানদের জন্য, নিষ্পাপ মানুষের জন্য। এ ক্ষেত্রে প্রাবন্ধিক সালেহা চৌধুরীর মন্তব্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণÑ ‘মন নিষ্পাপ না রেখে কবিতা লেখা যায় না। কবিতা সত্য বলে, মিথ্যা নয়।’ হ্যাঁ, কবি তো শেষ পর্যন্ত সত্য-সন্ধানে ব্রতী থাকেন। অতএব আজকের কবি কী করে লালন করবেন অন্ধকার কিংবা নিজের বৈপরিত্যের অসঙ্গতি জীবন। বরং অন্ধকার জগৎ টেনেহিঁচড়ে ছুঁড়ে দেবেন জনসম্মুখে। অন্তত আমাদের শাশ্বত কবিতা সে শিক্ষাই দেয়। তাঁর কবিতার ধরণ এবং ব্যক্তিত্বের ঋজু এই ইঙ্গিতই বহন করে। আরও যে সব বিষয়ে ফরীদ আহমদ রেজার কবিতাকে আলাদাভাবে চেনা যায় Ñ তাঁর কবিতার ভেতর তথাকথিত জাতীয়তাবাদী মনেবৃত্তি কাজ করেনি। অন্য এক মানবিক সত্ত্বার পরিভ্রাজক হন তিনি যা বিশ্বায়ন হতে উদ্বুদ্ধ করে। বৈচিত্র কৃষ্টির ভেতর নিজেকে আবিষ্কার করতে শিখায়। আরও চমৎকার বিষয় হলো যে এই কবির কবিতায় তৈলচিত্র নেই, বরং অঙ্কন, রেখাচিহ্ন, বয়াতীর উপলব্ধি, সুস্থ্য সংস্কারের বন্ধনগীত চিত্রায়িত হয়েছে দানাবাঁধা গদ্যে। একটি অলৌকিক চশমা দিয়ে তিনি জগৎটাকে আবিষ্কার করার চেষ্টা করেছেন। তথাকথিত আধুনিক বা ভদ্র-শিক্ষিতদের ভেতর ঘাপটি মেরে বসে থাকা বর্ণবাদ কিংবা উপনেবেষিক মনোবৃত্তি মানুষকে কতো ছোট করে রেখেছে এসব বিষয় হয়ে ওঠে তার দীর্ঘ কবিতা ‘অলৌকিক চশমায়’। অংশ বিশেষ হলোÑ
ইদানীং এক জোড়া চশমা নিয়ে আমি খুব বিব্রত
এ যেন আমার কাছে এক কাশ্মীর সমস্যা
চশমাখানা আমার দাদার
এ চশমা চোখে দিলে পৃথিবীর রূপ বদলে যায়
মনে হয় আফ্রিকার কোনো এক গভীর অরণ্যে চলে এসেছি
হিংস্র পশুদের সাথে বসবাস করছি
এবং মাৎসন্যায় নীতিই যেখানে আইন ...
.....
আব্বার ইন্তেকালের সময় আমার চোখে ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন এক ধরণের চশমা
ওফদে ফিলিস্তিনের হাইয়া আলাল জিহাদ আমার রক্তে তখন স্পন্দন তুলছে
জাবালুততারিকে পৌঁছে যাওয়ার বজ্র শপথে উজ্জীবিত
আবু আয়ূব আনসারীর স্মৃতিধন্য সুপ্রাচীন নগরীর তরুণদের সাথে
আমি রাখিবন্ধনে আবদ্ধ
দাদার চশমার কথা আমার মোটেই মনে ছিল না
এমনকি পাঠশালার সে মেয়েটির কথাও আমি ভুলে গিয়েছিলাম
আমার নাদান সহপাঠিরা যাকে চশমা নামের কারণে অযথাই উত্যক্ত করতো
ফার্সিতে চশমা মানে প্রস্রবন একথা আমার জানা ছিল বলে কি না জানিনা
আমি তার সকল নিষ্পাপ চোখে
সবসময় ঝর্ণার উচ্ছলতা স্বচ্ছলতা এবং প্রবাহ প্রত্যক্ষ করেছি
কিন্তু কোনোদিন তার পক্ষ হয়ে
ছেলেদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার সাহস দেখাতে পারিনি
কথাটামনে হলে আজো আমার পৌরুষ এবং তারুণ্যের সকল সাহসী সমাচার
লজ্জাবতী লতার মতো হাত পা ছেড়ে দিয়ে মাটির সাথে মিশে যেতে চায়
সেনি আব্বার ব্যবহৃত জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করতে গিয়ে
একখানা পুরানো চশমা আমার নজরে পড়ে
নিতান্তই কৌতুহল বশে চশমাখানা চোখে দিয়ে আমি অবাক
এই তো সেই অলৌকিক চশমা
যা চোখে দিলে মানুষের মনের ভাষা তার চেহারায় ভেসে ওঠে
কাউকে কিছু না বলে চশমাখানা বুক পকেটে রেখে দিলাম
তখন হঠাৎ করে নিজেকে খুব দামী লোক বলে মনে হয়েছে ...
...
দানবীর হাতেমতায়ী জনদরদী রাজনীবিদি এবং আলখেল্লা পরা ধার্মিক
এ চশমা চোখে এঁটে আমি এদের কারো মুখোমুখি হতে পারি না
কারণ তখন তাদের মুখাবয়ব শৃগাল কুকুর নেকড়ে অথবা অন্যকোনো শ্বাপদ বা সরীসৃপের আকৃতি ধারণ করে
সেদিন গিয়েছিলাম এক ইন্টারভিউ দিতে
শেষ প্রশ্ন ছিল ইকুয়াল অপরচুনিটিজ বলতে আমি কি বুঝি
প্রশ্নের জবাব দেয়ার আগে কি ভেবে চশমাখানা চোখে লাগিয়ে নিলাম
বিস্ময়ে চেয়ে দেখি আমার সামনে ক্ষুধার্ত এক নেকড়ে বসে আছে
সাথে সাথে আমার ঈশপের নেকড়ে ও মেষ শাবকের গল্পটি মনে পড়ে গেল
চোখ থেকে চশমা নামিয়ে রেখে বললাম
ঘড়ির কাঁটাকে যদি দু’শ বছর পিছিয়ে দিতে পার তা হলেই আমি
ইকুয়াল অপরচুনিটিজ এবং এর নামে পরিচালিত সকল ভণ্ডামীর স্বরূপ
তোমাকে বুঝিয়ে দিতে সক্ষম হব ...
...
বন্ধুর জবাবে আমার চোখের সামনে ভেসে উঠলো গোটা পৃথিবীর মানচিত্র
স্পষ্ট হয়ে ওঠলো পলাশী থেকে এজিয়ান সমুদ্রসৈকত পর্যন্ত সকল রক্তপাতের ব্যাকরণ
জরু আর জমির দখল নিয়ে আদিম সমাজের যুদ্ধ
এবং আধুনিক সভ্যতার ইতিহাস একই সমতলে এসে দাঁড়ালো
মানবিক আচরণ শুধু মানুষের নিকটই আশা করা যায়
জানোয়ার চাটবে জানোয়ারের রক্ত এ খবর কোনো সংবাদ শিরোনাম হতে পারে না ...
...
বন্ধুর ঘর থেকে বের হয়ে দেখি সামনেই কালের সাক্ষী টেমস নদী
সুবোধ বালিকার মতো ধীর শান্ত
লন্ডন শহরে এখন বাস আর নদীর গতি সমান
আমাকে আরো দ্রুতগতিতে সামনে যেতে হবে
দাদার চশমাখানা পকেট থেকে বের করে মাঝ গাঙ লক্ষ্য করে ছুড়ে মারলাম
তারপর বৃটিশ পার্লামেন্ট বাঁয়ে রেখে নিকটবর্তী টিউব স্টেশনের দিকে আস্তে আস্তে পা বাড়ালাম।
গল্পের ভেতর দিয়ে কবিতাটি অংগ্রসর হয়েছে। সঙ্গত কারণেই দীর্ঘ কবিতার অংশবিশেষ উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করতে গিয়ে অনেক অংশ বাদি দিয়েও দীর্ঘ হয়ে গেছে।
আমরা দেখতে পাই জনদরদী রাজনীতিবিদ এবং আলখেল্লা পরা ধার্মিকদের কীভাবে চিনিয়ে দেয় একটি প্রতীকি চশমা। এই চশমার অন্য নাম যুক্তি-জ্ঞান-বিবেক-বুদ্ধি-বিচক্ষণতা। এসব থাকলে বস্তুগত চশমাটির খুব একটা প্রয়োজন পড়ে না।
ফরীদ আহমদ রেজার কবিতায় মুক্তযুদ্ধ-দেশপ্রেম এসেছে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে। ‘একটি হৃদয়ের জন্যে’ কবিতার শুরুটা এভাবেÑ ‘উচুঁতে উঠলেই পৃথিবীর সব কিছু ছোট হয়ে আসে/ অনেকের চোখে পথচারী হাভাতের দল যেমন/ কথাটা প্লেনের জানালা দিয়ে ভেসে আসে/ বলিনি কখনো Ñ কেমন জানি লজ্জাবোধ জাগেÑ ...’ অতঃপর বিভিন্ন উপমা-উৎপ্রের্ক্ষা ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের ভূ-গোল ও মানুষ ওঠে আসে কবিতার শরীর বেয়ে। ডিসেম্বর মাস, বাঙালির বিজয়-আনন্দ-বেদনার মাস। এ মাসে বাঙালি অনেক কিছু হারিয়ে সত্ত্বার পরিচয় প্রতিষ্ঠা করেছিল। এই দিনের ১৯৮২ সালে কবিতাটি রচিত হয়। এই কবিতার মাধ্যমে একটি পরিবার, আমাদের সকলের পরিবার হয়ে যায়। আমরা কোনোভাবে এর দুঃখ-বেদনা থেকে আলাদা হতে পারি না। সমস্ত বাংলাদেশে কবি একজন জননীর মাতৃহৃদয়, উদার মন কুচি কুচি করে ছড়িয়ে দিতে অঙ্গীকারাবদ্ধ। দুই প্রতিপক্ষ সন্তানের জন্য তিনি সমান প্রার্থনা করেন অথচ যুদ্ধক্ষেত্রে তারা দু’জনই একে অন্যের হন্তারক। কবি আবিষ্কার করেন, একজন মা যা পারেন আর কেউ তা পারে না Ñ এই চিরসত্য চরিত্রের উপখ্যান গেঁথে আছে এই একটি মাত্র কবিতার অঙ্গে অঙ্গে।
... একজন মামা নিখোঁজ এগারো বছর
বড় ভাই ওপারে জীবন দিয়েছে
মা পরের বাড়িতে কাজ করে
একদিন মিলিটারীদের জন্য চা তৈরি করেছেন
এবং
দেবরের হাতে গলার হার তুলে দিয়ে যুদ্ধে পাঠিয়েছেন।
মা তুমি এক হৃদয় দিয়ে এতো কিছু ধারণ করলে কী করে?
দুই প্রতিপক্ষের জন্যে এক সাথে প্রার্থনা করতে তুমি কোথায় শিখেছো?
তোমার হৃদয়খানা আমাকে একটু ধার দিবে মা?
আমি রূপসার তীরে তীরে কর্ণফুলী সুরমা ঘুরে
পৃথিবীর সকল দুখী আর পাপীদের জন্যে
তোমার ভালোবাসা প্রার্থনা পূর্ণ করে দেবো কথা দিলাম মা!
(একটি হৃদয়ের জন্যে)
দুয়েকটি কবিতা বাদে এই কবির ভাষা আজকের শূন্য দশকের নয় Ñ ষাটের নাগরিক ভাষা। এ ভাষায় রয়েছে নাটকীয় কথন। শামসুর রাহমানীয় ঘরণায় যে ভাষা বেড়ে ওঠেছে ফরীদ আহমদ রেজা ভাষাগতভাবে তাদের সমগোত্রীয়। সঙ্গত কারণে তার ভাষা আমাদের তাঁতায় না Ñ ড্রয়িং রুমের কথন হয়ে ফুলদানী, চায়ের পেয়ালায় ওম-তাপ দিয়ে ঘুরে বেড়ায়।
ফরীদ আহমদ রেজার উল্লেখযোগ্য কবিতার অংশ বিশেষ :
সূর্যমুখী ফুলগুলো ভোর রাতে আমাকে এখানে ডেকে এনেছে
সকাল বিকাল ওরা আমাকে প্রলুব্ধ করে
আঘাত করে আমার চোখে আমার বুকে
তুমি কবাট খুলে দেখেছো এক জোড়া চোখে তৃষ্ণার্ত দীপ্তি।
... ...
আলো দেখে যারা মুখ লুকিয়ে চলে
গাহসী উচ্চারণ শুনে যারা কেঁপে উঠে চুপসে যায়
ঘরমুখো বৈরাগীদের পাশাপাশি পৃথিবীর পণ্যশালায়
দিগন্তজোড়া প্রসারিত দৃষ্টি নিয়ে
সূর্যমুখী ফুলের তীর্যক দৃষ্টি দারুন এক বিস্ময়।
(উদ্যত বিস্ময়)
আমাকে দিয়েছে এক অগ্নিঝরা অঙ্গীকার
চট্টলার সমুদ্র সৈকত
বাকলিয়া ... আলকরম ... শুলক বহর।
(ওরা একদল যুবক)
অথচ এখানে
গজারের চোখগুলো যুদ্ধক্লান্ত সৈনিকের মতো
ধুতরা ফুলের ঘ্রাণে তন্দ্রাতুর সোনালী মাগুর
নীল সাদা কপোতেরা দল বেঁধে উড়ে
পার হয় গম্বুজ ... কীনব্রিজ ... শহর ... নগর
ম্রিয়মান ঝর্ণার স্বর
চারপাশে বাউল ... মস্তান ... স্মৃতিফলক
গোবিন্দের দালানের খসে পড়া ইট থেকে
নতুন প্রাসাদ জাগে ...
উঁচু ... আরো উঁচু হয়।
সমস্ত নগর জুড়ে শুয়ে আছেন পিতা-পিতামহ
স্মৃতিসৌধে চারাগাছ গজিয়েছে সবুজাভ পাখা মেলে
উদার নীল আকাশের নিচে।
... ...
শেখ ঘাটের পথ ধরে যুবকেরা উঠে এসো
খেয়াতরীর অপেক্ষায় নয়
হাতছানি দিয়ে ডাকে সুউচ্চ মিনার।
(উত্তর পুরুষ)
যে ঘরে রমণী নেই সে ঘর বিরান বসতি
নারীর পরশহীন বাসগৃহ অপয়া অশুচি
রমণী বিহীন ঘর অনুর্ভর তাই সেথা প্রবেশ নিষেধ।
(নারী)
রূƒপসা এবং তার বোনদের কাছে ভালোবাসা জমা আছে
উজান পথে বাংলাদেশ-ভারত-মানস সরোবর পৌঁছে যেতে পারি
যদি তুমি কথা দাও সারথি হবে।
(রূপসা এবং তার বোনেরা)
আমার বিশ্বাস
নিভৃতে কথা বলে আমার পাপের পথে
ওরাইতো দাঁড়াবে একদিন।
(স্বজন)
একজন পক্ককেশী বৃদ্ধার কাছে গেলে অথবা না গেলে
বুকটা আমার খা খা করে
বেদনা আমাকে তার কাছে টেনে নিয়ে যায়
বেদনার ভার নিয়ে ফিরে আসি বার বার
কেননা তার ইয়াকুতকে ফিরিয়ে আনা যাবে না
এবং কেননা তার ইয়াকুতের সাথে আমার সখ্যতা ছিল
... ...
কিন্তু পৃথিবীটা হঠাৎ বদলে গেল
কলমা জিজ্ঞেস করে যারা মুসলমান বাছাই করতো
সেই জালিমরা তাকে পাঠিয়ে দিল আরেক পৃথিবীতে
যেখানে যাওয়ার পাথেয় সংগ্রহে
তার উদ্যম ছিল অন্যদের কাছে ঈর্ষার বিষয়।
... ...
আমাকে তার কথা বলতে হবে
কারণ তার স্বজনেরা তাকে ভুলে গেছে
তার কোনো ঔরসজাত নেই
এবং আমি যখন নতুন পৃথিবী গড়ার কথা বলি
তার কণ্ঠ আমার কানে বাজে
(আম্মা আমি ফিরে এসেছি)
দোলনা থেকে শিশুরা ইরানী যুবক হয়ে মাঠে নামে
সকল শাহদের সিংহাসনে ধ্বস নামে
গৌড়গোবিন্দের দালানের মতো
এবং ওমর
একজন ফাতিমার কাছে বিপ্লবের মেনিফেস্টো পেয়েছিল।
(একটি মেহদী রাঙা হাত)
পুশচেয়ার থেকে শিশুরা
লাফিয়ে নামছে যেন আফগান শার্দুল
এবং থর থর করে কাঁপছে গোটা পুঁজিবাদী সভ্যতা।
(যিসাসের আগমন অনিবার্য)
এক জোড়া চোখ চাই এমন সতেজ
ভষ্ম হবে মানুষের পশু
পৃথিবীর পুনর্জন্ম উপহার দিবে
জ্যোতিহীন চোখগুলো সূঁচবিদ্ধ হোক।
(চোখ)