স্বৈরশাসক আইয়ুব খান ক্ষমতা দখলের মাত্র ২ মাস পর ১৯৫৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর তৎকালীন শিক্ষা সচিব এসএম শরিফকে চেয়ারম্যান করে ১১ সদস্যবিশিষ্ট একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। ওই কমিশন পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর লক্ষ্য ও স্বার্থের প্রতিফলন ঘটিয়ে একটি গণবিরোধী শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে। "শরীফ কমিশন" যে প্রতিবেদন পেশ করে তাতে শিক্ষা বিষয়ে যেসব প্রস্তাবনা ছিল তা প্রকারান্তরে শিক্ষা সংকোচনের পক্ষে গিয়েছিল।
এই তথাকথিত শিক্ষানীতিতে যে সকল বিষয়ে সুপারিশ করা হয়েছিল তার মধ্যে ছিল- উচ্চশিক্ষা শুধুমাত্র ধনিক শ্রেণীর জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে শিক্ষাকে ব্যয়বহুল পণ্যের কাতারে নামিয়ে আনা এবং শিক্ষার্থীদের ওপর তা চাপিয়ে দেয়া। সাধারণের জন্য উচ্চ শিক্ষার সুযোগ একেবারেই সঙ্কুচিত করা। শিক্ষা ব্যয়কে পুঁজি বিনিয়োগ হিসেবে দেখা অর্থাৎ যে অভিভাবক বেশি বিনিয়োগ করবেন তিনি বেশি লাভবান হবেন। অবৈতনিক শিক্ষার ধারণাকে- ‘অবাস্তব কল্পনা’ বলে উল্লেখ করা। ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে ডিগ্রী পর্যন্ত ইংরেজী পাঠ বাধ্যতামূলক। উর্দুকে জনগণের ভাষায় পরিণত করা। সাম্প্রদায়িকতাকে কৌশলে জিঁইয়ে রাখার চেষ্টা। ডিগ্রী কোর্সকে তিন বছর মেয়াদী করা ইত্যাদি।
শরীফ কমিশন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বায়ত্তশাসনের পরিবর্তে পূর্ণ সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে রাজনীতি নিষিদ্ধ করা, ছাত্র-শিক্ষকদের কার্যকলাপের ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখার প্রস্তাব করে। শিক্ষকদের কঠোর পরিশ্রম করাতে ১৫ ঘণ্টা কাজের বিধান রাখা হয়েছিল। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা ক্ষেত্রে ছাত্র বেতন বর্ধিত করার প্রস্তাব ছিল। রিপোর্টের শেষ পর্যায়ে বর্ণমালা সংস্কারেরও প্রস্তাব ছিল।
২৭ অধ্যায়ে বিভক্ত শরীফ কমিশনের ওই প্রতিবেদনে প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চতর স্তর পর্যন্ত সাধারণ, পেশামূলক শিক্ষা, শিক্ষক প্রসঙ্গ, শিক্ষার মাধ্যম, পাঠ্যপুস্তক, হরফ সমস্যা, প্রশাসন, অর্থবরাদ্দ, শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বিষয়ে বিস্তারিত সুপারিশ উপস্থাপন করা হয়। আইয়ুব সরকার এই রিপোর্টের সুপারিশ গ্রহণ এবং তা ১৯৬২ সাল থেকে বাস্তবায়ন করতে শুরু করে।
ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নসহ বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা আইয়ুব খানের চাপিয়ে দেয়া এই অগণতান্ত্রিক ও ছাত্র স্বার্থবিরোধী শিক্ষা নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে তীব্র আন্দোলন ও সংগ্রাম গড়ে তোলেন।
১৯৬২ সালে এ আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা, শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য-বঞ্চনা নিরসন, গণমুখী বিজ্ঞানমনস্ক অসাম্প্রদায়িক শিক্ষা প্রসার, সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের স্বার্থ সংরক্ষণের লক্ষ্যে।
পাকিস্তান সরকারের গণবিরোধী, শিক্ষা সংকোচনমূলক শিক্ষানীতি বাতিল করে সকলের জন্য শিক্ষার অধিকার ও সুযোগ প্রতিষ্ঠা এবং একটি গণতান্ত্রিক আধুনিক শিক্ষানীতি ও শিক্ষা ব্যবস্থা অর্জনের লক্ষ্যে ছাত্র সমাজ আন্দোলন জোরদার করে। এক পর্যায়ে আন্দোলন কর্মসূচিতে আইয়ুব খানের সামরিক শাসনবিরোধী সক্রিয় উপাদান যুক্ত হয় ও তা পৌঁছে যায় বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে।
ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনের পটভূমিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা কলেজসহ বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘটসহ আইয়ুবের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে জুলাই-আগস্ট মাস জুড়ে আন্দোলন চলতে থাকে। বিক্ষোভ ও আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ার পাশাপাশি ছাত্র সমাজের আন্দোলনের প্রতি সাধারণ জনগণের সহানুভূতি ও সমর্থন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। এ আন্দোলন কর্মসূচির ধারাবাহিকতায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে ১৭ সেপ্টেম্বর দেশব্যাপী হরতাল কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেয়। ওইদিন সকাল ১০টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজার হাজার মানুষ সমাবেশে উপস্থিত হন। সমাবেশ শেষে ছাত্ররা শিক্ষাকে পণ্য করার ওই শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে মিছিল বের হয়। জগন্নাথ কলেজে গুলি হয়েছে- এ গুজব শুনে মিছিল দ্রুত নবাবপুরের দিকে যাত্রা শুরু করে। কিন্তু হাইকোর্টের সামনে পুলিশ এতে বাধা দেয়। তবে মিছিলকারীরা সংঘাতে না গিয়ে আবদুল গনি রোডে অগ্রসর হয়। তখন পুলিশ মিছিলের পেছন থেকে লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস ও গুলিবর্ষণ করে। এতে শহীদ হন ওয়াজিউল্লাহ, গোলাম মোস্তফা, বাবুলসহ নাম-না-জানা অনেকেই। ওই দিন সারা দেশে মিছিলে পুলিশ গুলি করে। টঙ্গীতে ছাত্র-শ্রমিক মিছিলে পুলিশের গুলিতে সুন্দর আলী নামে এক শ্রমিকেরও শদীদ হবার খবর পাওয়া যায়। এছাড়া দিন ৫৯ জন গ্রেফতার ও ৭৩ জন আহত হন।
সেই থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও ছাত্র সংগঠন প্রতিবছর ১৭ সেপ্টেম্বর দিনটিকে মহান শিক্ষা দিবস হিসেবে পালন করে আসছে।
১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ছাত্র-জনতার ব্যাপক গণ-আন্দোলনের রক্তাক্ত স্মৃতিবিজড়িত দিন এই শিক্ষা দিবস।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ রাত ২:৪৯