somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

যুদ্ধশিশু ও আমাদের হিপোক্রেসি

১৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ ভোর ৫:০৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এই বছরের শুরুর দিকে নিজের ব্যাক্তিগত কাজে পুরাণ ঢাকায় মাদার তেরেসা হোমসে গিয়েছিলাম; ওখানকার সিনিয়ার নান (সন্যাসিনী) আর কিছু অবুঝ শিশুর সাথে বেশ কিছু সময় কাটিয়েছিলাম। যুদ্ধশিশুদের নিয়ে লিখা এই ফিচারটা (Click This Link) পড়তে পড়তে নানের মুখে শোনা গল্পগুলো আরও বেশি উপলব্ধি করতে পারছি। ১৯৭১ এ স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমার মায়ের বয়স পাঁচ-সাড়ে পাঁচ বছর; আমি জন্মেছি তারও ১৩ বছর পরে। তাই যুদ্ধশিশু রায়ান বাদল গুড, রাণী বা তাঁদের মায়েদের থেকে আমার মা ও আমি অনেক বেশি সৌভাগ্যবান। আমি আমার মায়ের কোলে, মায়ের আদরে, পারিবারিক পরিচয়ে ‘সামাজিক সবটুকু সম্মান’ নিয়ে বড় হয়েছি যা রায়ানরা পারে নি, আসলে পারতে দেয়া হয়নি। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশটা আমার থেকে অনেক বেশি আপন হবার কথা ছিল রায়ান বা রাণী’র। কিন্তু সমাজের নিয়মে আজকের সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশে স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরও ওঁরা ভিনদেশি, ওঁরা অপাংক্তেয়

‘বীরশ্রেষ্ঠ’, ‘বীরউত্তম’, ‘বীরপ্রতীক’ উপাধিগুলো যত সম্মানের সাথে আমরা বারবার উচ্চারণ করি, ‘বীরঙ্গণা’ শব্দটিকে অর্ধেক সম্মানও দিই না আমরা। আর বাস্তব জীবনে বীরঙ্গণা’রা এর চেয়েও অনেক বেশি বিস্মৃত, এর চেয়ে অনেক বেশি নিগ্রিহীত। এমনকি ছোটবেলায় ‘১৯৭১-এর বীরঙ্গণা’ বলতে ঠিক কি বোঝায় তাও আমাদের কাছে সযত্নে লুকিয়ে রাখা হত যেন পাছে নোংরা, অশ্লীল কিছু উন্মোচিত হয়ে পড়ে। আহা, এমনই ‘শ্লীল’ আমাদের এই সমাজ! পাকিস্তানী নোংরা শুয়োরদের আজকের বংশধরেরা আমাদের কাছে কত সহজেই আদৃত হন, কিন্তু রায়ান-রাণীরা হন না, তাঁদের মায়েরা হন না। কারণ, সমাজের চোখে এই মায়েরা শুধুই ধর্ষিতা, অত্যাচারিতা।

আমি খুব সুস্পষ্টভাবেই বিশ্বাস করি, যুদ্ধশিশুদের প্রকৃত খতিয়ান আমাদের দেশে সংরক্ষিত হয়নি দুটো কারণে – ১) আমাদের এই ‘শ্লীল’ সমাজ বীরঙ্গণা বা তাঁদের শিশুদের বোঝা মনে করেছে, অসম্মানজনক মনে করেছে, ২) দেশের বাইরে যেসব শিশুকে চলে যেতে হয়েছিল, তাদের জীবনের থেকে তাদের বড় হবার ধর্ম পরিচয় মুখ্য ছিল আমাদের কাছে। এইখানে আবার শুরুর কথায় ফিরে যাই – মাদার তেরেসা হোমসে নানের কাছে জানতে পেরেছিলাম, আমাদের সরকার এখন আর ভিনদেশী কারো কাছে বাংলাদেশী কোন শিশু দত্তক নিতে দেয় না। কারণটা অনুমান করতে পারেন? কারণটা ধর্ম। ভিনদেশে গিয়ে শিশুগুলো যদি অন্য ধর্মের পরিচয়ে বড় হয় সেটা যে রাষ্ট্র হিসাবে আমাদের ব্যর্থ করে দিবে। যে রাষ্ট্র কলঙ্ক (!) –মুক্ত হবার তাগিদে ১৯৭১ এর শত শত যুদ্ধশিশুকে সানন্দে ভিনদেশে সরিয়ে দিয়েছিল, যে রাষ্ট্র মাদার তেরেসা হোমসে আশ্রয় পাওয়া বা রাস্তায় পড়ে থাকা অজস্র শিশুর বেড়ে উঠার দায়িত্ব নিতে পারে না আজও, যে রাষ্ট্রে প্রতিবছর ধর্মীয় সহিংসতায় কেউ না কেউ আক্রান্ত হন, সেই রাষ্ট্রের ধর্ম রক্ষার প্রাণান্ত হিপোক্রেসি দেখলে অসহ্য রাগ হয়, মনের ভিতর অসহ্য যন্ত্রণা হয়।

আমি-আপনি-আমরা দু-চার জন চাইলেই সমাজের বা রাষ্ট্রের এই হিপোক্রেসির গায়ে উদারতা বা মানবিকতার প্রলেপ লাগিয়ে দিতে পারব না নিশ্চয়; এইসব অচলায়তনের দেয়াল একদিনে ভাঙবেও না। কিন্তু, আমরা যারা বাংলাদেশের মাটি-হাওয়ায় নিশ্বাস নিয়ে বেড়ে উঠেছি, বেঁচে আছি আমাদের উচিত রায়ান-রাণীসহ সকল যুদ্ধশিশু ও তাদের মায়েদের কাছে ক্ষমা চেয়ে স্যালুট জানানো। আমাদের স্বাধীনতার মাঝে ওঁদের চিতকার, আর্তনাদ আর কষ্টগুলো যে মিলে-মিশে একাকার হয়ে আছে।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ ভোর ৫:০৪
১১টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আত্মপোলব্ধি......

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:৫১

আত্মপোলব্ধি......

একটা বয়স পর্যন্ত অনিশ্চয়তার পর মানুষ তার জীবন সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়। এই বয়সটা হল পঁয়ত্রিশ এর আশেপাশে। মানব জন্মের সবকিছু যে অর্থহীন এবং সস্তা সেটা বোঝার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি !

লিখেছেন হাসানুর, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৩২



হঠাৎ ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছে হল । সাথে সাথে জিভে ..জল... চলে এল । তার জন্য একটু সময়ের প্রয়োজন, এই ফাঁকে আমার জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প ক্ষমতায় আসছে এটা ১০০% নিশ্চিত। আমেরিকায় ইতিহাসে মহিলা প্রেসিডেন্ট হয়নি আর হবেও না।

লিখেছেন তানভির জুমার, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৩৩

আর এস এস সহ উগ্র হিন্দুদের লিখে দেওয়া কথা টুইট করেছে ট্রাম্প। হিন্দুদের ভোট-আর ইন্ডিয়ান লবিংএর জন্য ট্রাম্পের এই টুইট। যার সাথে সত্যতার কোন মিল নেই। ট্রাম্প আগেরবার ক্ষমতায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প জিতলে কঠোর মূল্য দিতে হবে ইউসুফ সরকারকে?

লিখেছেন রাজীব, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৪২

ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক মন্তব্যে বাংলাদেশের মিডিয়ায় ঝড় উঠেছে। ৫ তারিখের নির্বাচনে ট্রাম্প জিতলে আরেকবার বাংলাদেশের মিষ্টির দোকান খালি হবে।

আমি এর পক্ষে বিপক্ষে কিছু না বললেও ডায়বেটিসের রুগী হিসেবে আমি সবসময়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×