এই বছরের শুরুর দিকে নিজের ব্যাক্তিগত কাজে পুরাণ ঢাকায় মাদার তেরেসা হোমসে গিয়েছিলাম; ওখানকার সিনিয়ার নান (সন্যাসিনী) আর কিছু অবুঝ শিশুর সাথে বেশ কিছু সময় কাটিয়েছিলাম। যুদ্ধশিশুদের নিয়ে লিখা এই ফিচারটা (Click This Link) পড়তে পড়তে নানের মুখে শোনা গল্পগুলো আরও বেশি উপলব্ধি করতে পারছি। ১৯৭১ এ স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমার মায়ের বয়স পাঁচ-সাড়ে পাঁচ বছর; আমি জন্মেছি তারও ১৩ বছর পরে। তাই যুদ্ধশিশু রায়ান বাদল গুড, রাণী বা তাঁদের মায়েদের থেকে আমার মা ও আমি অনেক বেশি সৌভাগ্যবান। আমি আমার মায়ের কোলে, মায়ের আদরে, পারিবারিক পরিচয়ে ‘সামাজিক সবটুকু সম্মান’ নিয়ে বড় হয়েছি যা রায়ানরা পারে নি, আসলে পারতে দেয়া হয়নি। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশটা আমার থেকে অনেক বেশি আপন হবার কথা ছিল রায়ান বা রাণী’র। কিন্তু সমাজের নিয়মে আজকের সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশে স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরও ওঁরা ভিনদেশি, ওঁরা অপাংক্তেয়
‘বীরশ্রেষ্ঠ’, ‘বীরউত্তম’, ‘বীরপ্রতীক’ উপাধিগুলো যত সম্মানের সাথে আমরা বারবার উচ্চারণ করি, ‘বীরঙ্গণা’ শব্দটিকে অর্ধেক সম্মানও দিই না আমরা। আর বাস্তব জীবনে বীরঙ্গণা’রা এর চেয়েও অনেক বেশি বিস্মৃত, এর চেয়ে অনেক বেশি নিগ্রিহীত। এমনকি ছোটবেলায় ‘১৯৭১-এর বীরঙ্গণা’ বলতে ঠিক কি বোঝায় তাও আমাদের কাছে সযত্নে লুকিয়ে রাখা হত যেন পাছে নোংরা, অশ্লীল কিছু উন্মোচিত হয়ে পড়ে। আহা, এমনই ‘শ্লীল’ আমাদের এই সমাজ! পাকিস্তানী নোংরা শুয়োরদের আজকের বংশধরেরা আমাদের কাছে কত সহজেই আদৃত হন, কিন্তু রায়ান-রাণীরা হন না, তাঁদের মায়েরা হন না। কারণ, সমাজের চোখে এই মায়েরা শুধুই ধর্ষিতা, অত্যাচারিতা।
আমি খুব সুস্পষ্টভাবেই বিশ্বাস করি, যুদ্ধশিশুদের প্রকৃত খতিয়ান আমাদের দেশে সংরক্ষিত হয়নি দুটো কারণে – ১) আমাদের এই ‘শ্লীল’ সমাজ বীরঙ্গণা বা তাঁদের শিশুদের বোঝা মনে করেছে, অসম্মানজনক মনে করেছে, ২) দেশের বাইরে যেসব শিশুকে চলে যেতে হয়েছিল, তাদের জীবনের থেকে তাদের বড় হবার ধর্ম পরিচয় মুখ্য ছিল আমাদের কাছে। এইখানে আবার শুরুর কথায় ফিরে যাই – মাদার তেরেসা হোমসে নানের কাছে জানতে পেরেছিলাম, আমাদের সরকার এখন আর ভিনদেশী কারো কাছে বাংলাদেশী কোন শিশু দত্তক নিতে দেয় না। কারণটা অনুমান করতে পারেন? কারণটা ধর্ম। ভিনদেশে গিয়ে শিশুগুলো যদি অন্য ধর্মের পরিচয়ে বড় হয় সেটা যে রাষ্ট্র হিসাবে আমাদের ব্যর্থ করে দিবে। যে রাষ্ট্র কলঙ্ক (!) –মুক্ত হবার তাগিদে ১৯৭১ এর শত শত যুদ্ধশিশুকে সানন্দে ভিনদেশে সরিয়ে দিয়েছিল, যে রাষ্ট্র মাদার তেরেসা হোমসে আশ্রয় পাওয়া বা রাস্তায় পড়ে থাকা অজস্র শিশুর বেড়ে উঠার দায়িত্ব নিতে পারে না আজও, যে রাষ্ট্রে প্রতিবছর ধর্মীয় সহিংসতায় কেউ না কেউ আক্রান্ত হন, সেই রাষ্ট্রের ধর্ম রক্ষার প্রাণান্ত হিপোক্রেসি দেখলে অসহ্য রাগ হয়, মনের ভিতর অসহ্য যন্ত্রণা হয়।
আমি-আপনি-আমরা দু-চার জন চাইলেই সমাজের বা রাষ্ট্রের এই হিপোক্রেসির গায়ে উদারতা বা মানবিকতার প্রলেপ লাগিয়ে দিতে পারব না নিশ্চয়; এইসব অচলায়তনের দেয়াল একদিনে ভাঙবেও না। কিন্তু, আমরা যারা বাংলাদেশের মাটি-হাওয়ায় নিশ্বাস নিয়ে বেড়ে উঠেছি, বেঁচে আছি আমাদের উচিত রায়ান-রাণীসহ সকল যুদ্ধশিশু ও তাদের মায়েদের কাছে ক্ষমা চেয়ে স্যালুট জানানো। আমাদের স্বাধীনতার মাঝে ওঁদের চিতকার, আর্তনাদ আর কষ্টগুলো যে মিলে-মিশে একাকার হয়ে আছে।