সিরিয়াল তৈরির উপকরণ
সিরিয়াল তৈরির উপকরণ
একটা নায়িকা। নায়িকা চরিত্রের জন্য হাবাগোবা বা নিতান্ত সহজ সরল চেহারার নারীরা অধিক প্রাধান্য পাবে। একশ ঘা খেয়েও যে হাসিমুখে থাকতে পারবে, সেই আসল নায়িকা।
একটা নায়ক। (দুইজন হলে আরও ভাল। নায়িকা কনফিউজড হয়ে যাবে, কাকে বিয়ে করা উচিত। সঙ্কট তৈরি করতে দুই নায়ক ভালো একটি আইডিয়া। তবে নায়িকা যেহেতু সতী সাধ্বী নারী, তাই বেশি কিছু দেখানো যাবে না।) নায়ক চরিত্রের জন্য বিশেষ কোন যোগ্যতার দরকার নেই। ২৫/৩০ বছর বয়স্ক পুরুষ হলেই হবে। অভিনয় দক্ষতা না থাকলেও চলবে। সিরিয়ালে পুরুষদের পুতুল সাজিয়ে রাখার নিয়ম)
দুই জোড়া বয়স্ক অভিনেতা অভিনেত্রী (মা বাবা ও শ্বশুর শাশুড়ি চরিত্রের জন্য)
একজন বা দুইজন বুড়ো অভিনেতা অভিনেত্রী (দাদা দাদি চরিত্রের জন্য। একজন দাদি থাকা আবশ্যক। বিশেষ করে নায়কের একজন দাদি থাকলে ভাল হয়। পারিবারিক অশান্তি তৈরি ও নির্মূলের জন্য, উভয় কাজেই দাদি সমানভাবে কার্যকর।)
নায়িকার শ্বশুর বাড়িতে সঙ্কট তৈরির জন্য ইচ্ছামত ননদ, জা রাখা যেতে পারে। তবে দেবর, কিংবা ভাই জাতীয় চরিত্র সৃষ্টি করে লাভ নাই, তারা নিতান্তই পুতুল থাকবে।
এছাড়া আরও কয়েকটি ইচ্ছামত চরিত্র যেমন কাজের মেয়ে, কাজের বুয়া, নায়িকার ভাই, নায়কের ভাই থাকতে পারে।
একটা ডুপ্লেক্স বাড়ি। নায়কদের বাড়ি অবশ্যই ডুপ্লেক্স হতে হবে। এক্ষেত্রে রান্নাঘর, ড্রয়িং রুম, ডাইনিং রুমের দিকে বেশি নজর দিতে হবে। টিভিতে যা দেখানো হবে, তার ৯০ শতাংশ হয় রান্নাঘর বা ড্রয়িং ডাইনিং রুমের মধ্যেই ঘটবে। তাই এই অংশগুলো সুন্দর করে তৈরি করতে হবে।
এছাড়া কাহিনীর জন্য অবশ্যই নায়ক নায়িকাদের মোটামুটি অবস্থাসম্পন্ন ঘরের হতে হবে। নায়কদের যে কোন বিজনেস থাকবে, প্রতিদিন ১০০ কোটি টাকার লাভ লোকসান হতে হবে। মনে রাখবেন, লাভ হলেও ১০০, লস হলেও ১০০।
এই উপকরণগুলো নিয়ে একটি মিশ্রণ তৈরি করুন, পরিমাণ মত সঙ্কট বা ঝামেলা মেশান, তৈরি হয়ে গেল মজাদার একটি হিন্দি সিরিয়াল। বছরের পর বছর পাবলিককে খাওয়ানো যাবে। নষ্ট হওয়ার কোন উপায় নেই।
কীভাবে মিশ্রণ তৈরি করবেন? এটাও বলে দিতে হবে? আচ্ছা একটা নমুনা বলে দিচ্ছি। এই পথে আগালে ১০০% সফলতার সম্ভাবনা। বিফলে মূল্য ফেরত।
(কাহিনী)
১ম অংশ (শুরু)
আইন যেমন নিজের গতিতে চলে, তেমনি হিন্দি সিরিয়ালও নিজের গতিতে চলে। তাই যেভাবে হোক, একটা কাহিনী শুরু করুন। এর ডাল পালা গজিয়ে অবশ্যই একটা সিরিয়াল হয়ে যাবে।
শুরু করুন এইভাবে, সবচেয়ে সহজ উপায়ে,
শুরুতে নায়িকা কলেজ ছাত্রী থাকবে। নায়িকা ভাল ছাত্রী, পরীক্ষা হোক না হোক, ফার্স্ট সেকেন্ড হয় এই রকম ছাত্রী।
পড়াশুনা করতে করতে হঠাৎ যে কোন কারণে নায়িকার বিয়ে হয়ে যাবে অপরিচিত কোন যুবকের সাথে, যেমন, নায়িকার বাপকে মেরে ফেলা যেতে পারে, হার্ট এটাক বা ডায়রিয়া যে কোন রোগে মেরে ফেলা যেতে পারে। এতে পুরো সংসার ওলটপালট হয়ে যাবে, তারপর নিতান্তই অনুপায় হয়ে মা বিয়ে দিয়ে দিবে নায়িকাকে নায়কের সাথে। নায়িকার পড়াশুনার অধ্যায় এইখানেই সমাপ্তি। এর পর কোনদিন নায়িকার পড়াশুনার কোন বালাই থাকবে না কাহিনিতে।
নায়িকার পিতাকে হত্যা না করে এই ক্ষেত্রে আপনার ইচ্ছামত একটা কাহিনীও তৈরি করতে পারেন যাতে নায়িকার বিয়ে করা ছাড়া কোন উপায় না থাকে। নায়িকার বেশি পড়াশুনা করার দরকার নেই। শেষ পর্যন্ত ভাত ডাল মাংস রান্না আর কান্নাকাটি করা ছাড়া নায়িকার তেমন কোন কাজও থাকবে না। তো বিয়ে হয়ে গেলে প্রথম পর্যায় সমাপ্ত।
২য় পর্যায়(শ্বশুর বাড়ির লোকজনের সাথে মানিয়ে নেয়া)
বলাবাহুল্য, নায়িকার সাথে যার বিয়ে হবে সেই নায়ক। ঐ ছেলের চরিত্র যে রকমই হোক না কেন, নায়ক সেই। নায়ক স্বাভাবিকভাবেই নির্মল নিপাট ভাল ছেলে হবে। আর চরিত্রে কোন দোষ থাকলেও নায়িকা ধীরে ধীরে নায়ককে নিজের মত করে গড়ে নিবে!
নিজের অনিচ্ছায় বিয়ে হওয়াতে নায়িকা এম্নিতেই থাকবে “চ্যাতা” বাসর রাতে স্বামী বেচারা চুমু খেতে এসে উল্টো নায়িকার ধাওয়া খেয়ে বাসর ঘর থেকে পালাবে। বাসর রাতে সঙ্গমের পরিবর্তে নায়ক নায়িকার মধ্যে চুক্তি হতে হবে। নায়িকা বলবে “আমাদের মধ্যে কখনই স্বামী স্ত্রীর কোন সম্পর্ক হবে না যদিও সবাই জানবে আমরা স্বামী স্ত্রী”
নায়ক বেচারা এই চুক্তির কারণে কিছু করতেও পারবে না সইতে ও পারবে না। তার আপাতত আর কোন কাজ নাই।
অতঃপর শুরু হবে শ্বশুর বাড়ির অত্যাচার। ননদ শাশুড়ি উভয়ই বা তাদের যে কোন একজন নায়িকার বিপক্ষে সারাদিন লেগে থাকবে। শাশুড়ি ননদ না থাকলে অন্য কোন চরিত্র নায়িকার পিছনে লেগে থাকার কাজ করবে। নায়িকাকে বিভিন্ন ঝামেলায় ফেলতে তারা সদা তৎপর। ঝামেলা গুলোও বিরাট আকারের ঝামেলা। ছোট আকারের কোন ঝামেলা করা যাবে না। যেমনঃ খাবারে লবণ বেশি দিয়ে নায়িকাকে নাকানি চুবানি খাওয়ানো । একদিন লবণ বেশি দিলে ঐ দিন রাতের খাবার সারতেই ৩ পর্ব যাতে চলে যায় সেইদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
কোনদিন খাবারে লবণ কম হলে বা নায়কের পছন্দের কই মাছের ঝোলের সাথে বিরিয়ানি না থাকলে ডাইনিং টেবিলে সবার মুখের দিকে একবার করে ক্যামেরা তাক করা হবে এবং টেলিভিশন পর্দা বারবার ঝাকি খাবে বা সবার চেহারা সাদাকালো হয়ে যাবে। যেই কোন সঙ্কট বোঝাতে পর্দা সাদাকালো করে দেয়া খুবই কার্যকর একটা উপায়।
এইরকম চলতে থাকবে এক বছর।
এই সময় দাদি চরিত্র নায়িকাকে সাহায্য করবে। তাকে সান্ত্বনা দিয়ে রাখবে। দাদি না থাকলে অন্য কারো নায়িকাকে সান্ত্বনা দেয়ার ভার নিতে হবে।
পড়াশুনা বাদ দিয়ে নায়িকা মন দিবে শ্বশুর বাড়ির সবার মন জয় করতে। এমনকি তার ননদ বা শাশুড়ি যারা তার বিপক্ষে তাদেরও সে কিছু বলবে না। বরং তাদের মন জয় করবে সার্বক্ষণিক সেবার মাধ্যমে।
কাঁহাতক আর এত ভাল একটা সতী মেয়ের সাথে খারাপ আচরণ করা যায়। তারপর একদিন শ্বশুর শাশুড়ি সবাই নায়িকার ভক্ত হয়ে যাবে। নায়িকা তার ভালমানুষি দিয়ে সবার মন জয় করবে।
একজন একজন করে সবার মন জয় করতে আরও ছয় মাস
৩য় পর্যায় (স্বামীর সাথে কৃত চুক্তি বাতিল অর্থাৎ সঙ্গম )
শ্বশুর বাড়ির সবার সাথে সম্পর্ক ভালো হয়ে গেলেও বাদ থাকবে তখনো তার স্বামী। স্বামী বেচারা তখন পর্যন্ত নায়িকাকে একটা চুমু পর্যন্ত খেতে পারেনি। চুক্তির কারণে স্বামী নায়িকার কাছে আসতেও পারে না। শুধুমাত্র মাঝে মধ্যে টাই বেঁধে দেয়ার সময় বা খাবার খাওয়ার সময় নায়কের হাতের ছোঁওয়া লেগে যাবে নায়িকার হাতে। তখনই শুরু হবে “লা লা লা লা” টাইপের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক। কখনো কখনো আবার নায়িকা ব্লাউজ পরতে বা গলার হার পরতে সমস্যা হলে তখন নায়ক এসে সাহায্য করবে। তখনও ঐ “লা লা লা লা” বাজতে থাকবে।
সিরিয়ালের জন্য কয়েকটা আজেবাজে সুর আগে থেকে তৈরি রাখতে হবে। নায়ক নায়িকা কাছে এলে “লা লা আলা” আবার দুর্ঘটনা ঘটলে “ক্র ক্র ক্র” ইত্যাদি ররাখতে হবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানুষ বুঝতে পারবে না আসলে কী হচ্ছে। তখন এই ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকই মানুষকে বুঝিয়ে দিবে আসলে প্রেম ভালবাসা হচ্ছে না খারাপ কিছু হচ্ছে।
যাই হোক, হঠাৎ একদিন রাতে শরীর জেগে উঠবে নায়কের। নায়িকাকে জড়িয়ে ধরবে সে। কোনমতে নায়ক জরিয়ে ধরলেই নায়িকা চুক্তির কথা ভুলে যাবে।নায়কের সাথে সম্পন্ন হবে তাদের মিলন। বীর্যপাতের সাথে সাথেই তারা ঘুমিয়ে পড়বে। জামা কাপড় পরে নেয়ারও সময় পাবে না। সকালে ঘুম থেকে উঠে দুইজনই আবিষ্কার করবে তারা ন্যাংটা। তবে ভাগ্য ভালো বলতে হবে তাদের উভয়ের গায়েই চাদর জড়ানো থাকবে।
একবার সঙ্গম হয়ে গেলে আর তাদের আটকে রাখা যাবে না। প্রেম ভালোবাসা শুরু হয়ে যাবে, মনে রাখতে হবে একবার সঙ্গমই প্রেম সৃষ্টির জন্য যথেষ্ট।
৪র্থ পর্যায় (গর্ভধারণ)
একমাস পর নায়িকা আবিষ্কার করবে সে গর্ভবতী। মাত্র একবারের ধাক্কায় গর্ভবতী না হলে সে আবার কিসের নায়িকা? তাই নায়িকাকে গর্ভবতী হতেই হবে।
পরিবারে খুশির জোয়ার। আবার নতুন ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক, “হু হু হু হা হা হা, লা লা লা লা”।
শাশুড়ি ননদ সবাই নায়িকার পিছনে লেগে যাবে। ভারি কিছু উঠানো যাবে না, রান্নাঘরে আসতে দিবে না, সারাদিন শুইয়ে রাখার চেষ্টা করবে। নায়িকাও কম যায় না, যতটুক পারে, সে করতে থাকবে।
মাঝে মাঝে ডাক্তারএর কাছে যেতে হবে, তখনও ছোট খাট ঝামেলা লাগবে। অন্য একজনের রিপোর্ট নায়িকার কাছে চলে আসবে। দেখা যাবে নায়িকা প্রেগন্যান্টই না! তখন নায়িকার নামে আবার কুৎসা ছড়িয়ে পড়বে। পরে আবার ডাক্তার নায়ককে কনফার্ম করবে, “না তোমার বউ প্রেগন্যান্ট” এই সংক্রান্ত জটিলতা চলবে প্রায় ২ মাস।
৬ষ্ঠ পর্যায় (গর্ভপাত)
মনে রাখবেন, কখনোই এক চান্সে বাচ্চা হওয়া যাবে না। তাই যে কোন
উপায়েই হোক, নায়িকার বাচ্চা হওয়া থামাতে হবে।
এজন্য প্রেগন্যান্সির ৫/৬ মাসের দিকে হঠাৎ একদিন নায়িকা দোতলার সিঁড়ি থেকে নিচতলায় পড়ে যাবে। বলা বাহুল্য, নায়িকার শ্বশুর বাড়ি ডুপ্লেক্স হতেই হবে, তা না হলে নায়িকা পড়বেও না, আর বাচ্চাও মিসক্যারিজ হবে না।
দরকার হলে বাথরুমে বা রান্নাঘরে নায়িকাকে পড়তেই হবে। তা না হলে মিস্ক্যারিজ হবে না। নাটকও আগাবে না। মনে রাখতে হবে বাচ্চা হয়ে গেলেই কাহিনীর মোটামুটি একটা পর্যায় শেষ। তাই যথাসম্ভব চেষ্টা করতে হবে যাতে বাচ্চা না হয়।
প্রথম বাচ্চা মিসক্যারিজ হওয়ার পরে সবার মন খারাপ থাকবে। নায়িকা পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়বে। তখন নায়ক এসে আদর সোহাগ দিয়ে নায়িকাকে শান্ত করবে।
৭ম পর্যায় (পুনরায় গর্ভধারণ)
আদর সোহাগ দিয়ে শান্ত করার একমাস পরে দেখা যাবে নায়িকা আবার প্রেগন্যান্ট! এইবার অবশ্য সবাই অনেক সতর্ক থাকবে। ফলে ১০ মাসের মধ্যে বাচ্চা হয়ে যাবে। তবে কাহিনীর স্বার্থে এই দশ মাসকে ছোট করে আপনার ৫/৬ মাসে দেখাতে হবে। আর চাইলে আরেকবার মিসক্যারিজ করানো যেতে পারে। কাহিনী আরেকটু বাড়বে ।
১০ মাস পরে নায়িকার ফুটফুটে একটা মেয়ে হবে। মনে রাখবেন, ছেলে হলে সমস্যা। ছেলে হওয়া যাবে না, অবশ্যই মেয়ে হতে হবে। এই মেয়ে বাংলা সিনেমার মত হঠাৎ একদিন বড় হয়ে যাবে।
আবার প্রথম পর্যায়
কাহিনী মোটামুটি এখানেই শেষ। তারপর নায়িকার মেয়ে বড় হলে একই কাহিনী আবার ঘটবে। তারপর তার মেয়ের মেয়ের সাথেও (মানে নায়িকার নাতনি) একই কাহিনী ঘটবে...(এভাবে চলতে থাকবে)
তৈরি হয়ে গেল মজাদার হিন্দি সিরিয়াল। এবার বাসার নারী সদস্যদের নিয়ে উপভোগ করুন সুস্বাদু, মজাদার হিন্দি সিরিয়াল।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে ডিসেম্বর, ২০১২ রাত ৩:০১