আমাদের বন্ধু পিয়াল। কৃষ্ণবর্ণ হলেও আমাদের মধ্যে সবচেয়ে স্মার্ট সে-ই। ক্লাস সিক্স থেকে একসাথে পড়ছি আমরা। তখন থেকেই সে শাহরুখ খানের ভক্ত। বলা যেতে পারে অন্ধ ভক্ত। শাহরুখ খানের বউকে নিয়েও কিছু বলা যেত না তার সামনে। আরিফ একদিন বলেছিল, ‘শাহরুখ এইটা কী করল? বিয়া করল কারে? গৌরি তো কালো’ পিয়াল তেলে বেগুনে জ্বলে বলল, ‘তোর দাঁতের চেয়ে সাদা আছে, ছাগল’
পিয়াল বড় হয়ে কিং খান হতে চায় আমরা জানতাম। তাই আমরা ওকে কীভাবে শাহরুখের মত হওয়া যায় তার টিপস দিতাম। সাথে থাকত কিছু তেল মাখন “দোস্ত, তুই তো পুরাই কিং খান” এসবের পিছনে খুব মহৎ উদ্দেশ্য ছিল বলা যাবে না। এই সামান্য তেল মাখনের বিনিময়ে আমরা পেতাম কোক পেপসির স্বাদ।
কিন্তু পিয়ালের চোখ খুলল ক্লাস এইটে উঠে। ও বুঝতে পারল আসলে শাহরুখ হয় লাভ নেই। ওকে হতে হবে স্মার্ট। আমরাও বুঝতে পারলাম পিয়ালের মত প্রতিভাবান একটা ছেলেকে শুধুমাত্র কিং খানের মধ্যে বন্দি করে রাখা উচিত হবে না। আমরা সব বিখ্যাত গায়ক নায়কের সাথে ওর সাদৃশ্য খুজে পেতে লাগলাম। সে ফুটবল খেলে বেকহামের মত, গান গায় ব্রায়ান অ্যাডামসের মত আর সব কিছু মিলিয়ে সে তো ‘পুরাই কিং খান’ আর এত বড় সেলেব্রিটি হওয়ায় বাকি সবাই পিয়ালের বন্ধু। আমরা ওকে স্মার্ট হওয়ার উপায়ও বাতলে দিতাম। আপাতত চুলে স্পাইক করতে হবে। আর ইংলিশ কপচাতে হবে। পিয়ালও আমাদের কথা মত প্রতিদিন স্পাইক করে আসত চুলে আর স্যারদের বেতের বারি খেত পাছায়। ততদিনে কোক পেপসি পর্যায় পার করে আমরা ফাস্টফুডে চলে এসেছি।
মাঝে কেটে গেছে পাঁচ বছর। কিং খানের ভাব বাড়তে বাড়তে আকাশ ছুঁয়েছে। কলেজে ওঠার পর থেকেই যদিও আমাদের এড়িয়ে চলা শুরু করেছিলেন তিনি, ইদানিং আর আমাদের আড্ডায় আসতেনই না। কারণ, প্রতিদিনই তার সি এস ই ল্যাব থাকে। আর ভার্সিটিতেও তার অনেক কাজ। অটোগ্রাফ দিতে দিতেই তো প্রতিদিন তার ২/৩ ঘণ্টা সময় নষ্ট হয়। যাই হোক, আড্ডায় না আসায় মধ্যে কিং খানের উপর আমরা মোটামুটি বিরক্তই ছিলাম।
হঠাৎ গত মাসে আমাদের কথা মনে পড়ায় সি এস ই ল্যাব বাঙ্ক দিয়ে আমাদের আড্ডায় চলে এলেন কিং খান। আমরাও ভাব করলাম মহা খুশি তাকে পেয়ে। “ছবি তোল, ছবি তোল” রব পড়ে গেল সব দিকে।
‘আপনি তো পুরা বেকহামের মত হয়া গেসেন, তো আপনার বাচ্চারা কেমন আছেন?’ রাতুল জানতে চাইল কিং খানের কাছে।
‘কী যে বলস না রাতুল। আমি বেকহাম হইতে যামু ক্যান? বেকহামের চুল কি আমার মত লম্বা?’ পিয়াল এমনভাবে কথাটা বলল যেন চুল বড় হলে বেকহামকে দেখতে পিয়ালের মত লাগত।
হঠাৎ নিবিড় বলে উঠল, ‘দোস্ত, মাইকেল জ্যাকসনের কী হইল? তুই থাকতে ওর ডাক্তার ওরে মারল ক্যামনে?’
‘কি জানি। আমার সাথে তো ওর সম্পর্ক ছিল না খুব ভাল’
‘কী কস, তুই না মাইকেল জ্যাকসনের কত ক্লোজ ফ্রেন্ড ছিলি? তুই না থাকলে তো ও তো সারাজীবন কালোই থেকে যেত ’
‘মানে?’ পিয়াল বুঝল না।
তারপর আমরা নিবিড়ের মুখে শুনলাম পুরো গল্প,
মাইকেল জ্যাকসন আর পিয়াল খুব ভাল বন্ধু। বেচারা জ্যাকসন এত কনসার্ট ফনসার্ট করে, গান টান গায়, কিন্তু কালো বলে কেউ ওকে পাত্তা দেয় না। তো জ্যাকসনের এই অবস্থা দেখে পিয়ালের মায়া হল। পিয়াল একদিন জ্যাকসনকে ওর বাসায় ডেকে নিয়ে বলল, ‘তুই আমার চামড়া নিয়া নে। আর তোরটা আমাকে দে। তোর সাদা চামড়া দরকার’
জ্যাকসন ফরসা হল। আর পিয়াল জ্যাকসনের চামড়া নিয়ে হয়ে গেল কালো। এম্নিতে পিয়াল আগে ফরসা ছিল।
আমরা পিয়ালের এই মহান আত্মত্যাগের কাহিনী শুনে অভিভূত হয়ে গেলাম। আর অজানা কারণে পিয়াল গেল খেপে। আমরা বুঝতে পারলাম না অকারণে কিং খান কেন আমাদের উপর এত রাগ করলেন।
কিং খান আর আসেনি আমাদের আড্ডায়। হয়ত তার সি এস ই ল্যাব থাকে। তবে আমরা মাইকেল জ্যাকসনের চামড়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়ানো ছেলেটাকে আজো মিস করি।