Fallacy বা ফ্যালাসির মানে হচ্ছে ভ্রান্ত বা মিথ্যা ধারণা। এর একটা গালভরা অর্থও আছে- 'হেত্বাভাস'। যাইহোক, এই মিথ্যা ধারণার উপর ভিত্তি করে কোন যুক্তি দেয়াকে বলা যায় logical fallacy. সাধারণত এই ধরণের লজিক্যাল ফ্যালাসিকারীরা আপনার সত্যিকারের লজিককে এমন ভাবে নষ্ট করতে সিদ্ধহস্ত থাকে যে হয় আপনি মানতে বাধ্য হবেন যে, না, ঐ মিথ্যা ধারণাই সঠিক। অথবা যদি আপনি আপনার সঠিক যুক্তির উপরই অটল থাকেন, তবুও অবধারিতভাবে অন্তত আপনার মাথা গরম করিয়ে আপনাকে তার সামনে 'খারাপ' বা 'ভুল' প্রমাণ করে ছাড়বে। আমাদের, বিশেষ করে বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে ধর্ম, এমন কি সাধারণ গসিপেও জেনে বুঝে অথবা না জেনেই এইসব ফ্যালাসিপূর্ণ লজিক দিয়ে থাকি। বেশ কিছুদিন যাবত আমার সাথে চেনা-অচেনা মানুষদের এইসব হিপোক্রেসি নিয়ে কনফ্লিক্ট হচ্ছেই। কাজেই, আমি আমাদের বহুল ব্যবহৃত কিছু লজিক্যাল ফ্যালাসির উদাহরণ এবং ব্যাখ্যা দিতে ইচ্ছুক। অন্ততপক্ষে জেনে রাখা যাক কিছু কমন লজিক্যাল ফ্যালাসি।
Strawman fallacy:
স্ট্রম্যানের শাব্দিক অর্থ করলে যা দাঁড়ায়, অর্থাৎ খড়-মানব; এই ফ্যালাসিটা সত্যিকার অর্থেই সে রকম। মনে করেন, আপনি একটা যুক্তি দিলেন। কিন্তু যুক্তিখণ্ডনকারী ব্যক্তি আপনার যুক্তি পুরোপুরি অনুধাবন না করেই সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি অর্থ দাঁড় করিয়ে সে সেই নিজস্ব 'অর্থহীন' যুক্তির খণ্ডন করে নিজেকে বিজয়ী প্রমাণ করলো। এই যে হিপোক্রেসি, এইটাই হচ্ছে স্ট্রম্যান ফ্যালাসি। অর্থাৎ সে কাল্পনিক একটা মানুষ দাঁড় করিয়ে তাকেই আঘাত করে যাচ্ছে।
AD hominem:
অপরপক্ষ যুক্তিতে না পেরে যখন বক্তার ব্যক্তিগত ত্রুটির সমালোচনা করতে শুরু করে, তখনই এই ধরণের ফ্যালাসির অবতারণা হয়৷ মনে করা যাক দুজন গসিপ করছে- বিষয় হচ্ছে দৈনন্দিন জীবনে নৈতিকতা। বক্তা-১ এর ভাষ্যমতে পরীক্ষায় নকল করা অনৈতিক।
বক্তা-২ তখন বলে বসলো যে সে নিজেই বক্তা-১ কে গত পরীক্ষায় নকল করার কথা শুনেছে।
লক্ষ্য করলে দেখা যাচ্ছে বক্তা-২, বক্তা-১ এর স্টেটমেন্ট বিশ্লেষণ না করেই বরং তার ত্রুটির দিকে আঙুল তুলছে, যেখানে স্টেটমেন্টের মূল টপিক হচ্ছে পরীক্ষায় নকল করা অনৈতিক (কেন অনৈতিক, কিভাবে অনৈতিক, অথবা কেন, কি কারণে অনৈতিক না- সেটাই মূল টপিক); বক্তাদের মধ্যে কে অনৈতিক কাজটি করেছে সেটি আরো পরে আসবে। বক্তা-২ এখানে ভেবেছে যে বক্তা-১ এর অনৈতিকতার দিকে আঙুল তুললে তার বিবৃতি দূর্বল হয়ে যাবে। কিন্তু বক্তা- ১ এর কাজ বা চারিত্রিক বৈশিষ্টের দিকে আঙুল তুললে 'নকল করা অনৈতিক' এটি কিন্তু মিথ্যা হয়ে যাবে না। এইটা মোটামুটি কমবেশি সবাই ইউজ করি, যা পুরাপুরি ভুল।
AD Hominem (Appeal to motive fallacy):
এইটা বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতা আর বকধার্মিক 'রিলিজিয়াস' লোকগুলার খুব প্রিয় ফ্যালাসি। যুক্তি দেয়ার পিছনে বক্তার স্বার্থ লুকিয়ে আছে, এটি দেখিয়ে স্টেটমেন্টে ভুল আছে প্রমাণ করতে চাওয়া হচ্ছে অ্যাপিল টু মোটিভ। যেমন মনে করেন আমি উমাইয়া এবং আব্বাসীয়, কিংবা অটোম্যান খেলাফতের হিপোক্রেসি এবং শরিয়া আইনের ভুল প্রয়োগ নিয়ে অকাট্য যুক্তি দিলাম, সাথে সাথে আমাকে কাফির নাস্তিকের দালাল প্রমাণ করতে উঠে-পরে লাগলো। এবং তাদের সবচেয়ে প্রিয় প্রশ্ন হচ্ছে 'ইহুদী-নাসারা, নাস্তিকদের থেকে কয় টাকা খাইসেন?'
এর ফলে কি হবে জানেন? আমিও তখন স্বভাবতই উঠে-পরে লাগব নিজেকে খাঁটি মুসলমান প্রমাণ করতে আর আমার ঈমানের হিসাব তার কাছে দিতে। নীট রেজাল্টঃ মূল টপিক থেকে সরে গিয়ে আমি ভালো না মন্দ সেদিকে আলোচনা চলে আসা।
[তবে কিছু ক্ষেত্রে এড হোমিনেম খাটবে না। যেমন প্রথম উদাহরণে দ্বিতীয় বক্তা যদি বলতেন তিনি বক্তা-১ কে দেখেছেন নকল করতে, তাহলে সেটি ফ্যালাসির পর্যায়ে পড়তো না। অথবা যদি এটি প্রমাণ হতো যে বক্তা-১ নকলের সাথে জড়িত। তবে প্রথমে তার স্টেটমেন্টটি সমর্থন করাই শ্রেয়। কারণ নকল করা যে অনৈতিক, এটি সবসময়ই সত্য। সুতরাং বক্তা-২ এভাবে বলতে পারতেন যে 'হ্যা, তোমার সাথে আমি একমত, নকল করা অবশ্যই অসমর্থনযোগ্য। তবে, তোমাকে আমিও দেখেছি সেটি করতে। সেটি আর করো না।'
অর্থাৎ আলোচনাটির যুক্তিখণ্ডন বা সমর্থন করে এরপর ইন্টেনশনের দিকে তাকানো শ্রেয়]
Genetic:
এই ফ্যালাসির মূল ঘটনাটা হচ্ছে, স্পিকারের বক্তব্য তার জীবনচর্চার উপর নির্ভর করলেও বক্তব্যের সত্যতা কিন্তু তার জীবনচর্চার উপর নির্ভর করে না। বরং যেকোন বক্তব্যের সত্যতা হচ্ছে কনস্ট্যান্ট। স্বতন্ত্র। এর ফলে স্পিকারের বক্তব্যের দিকে ফোকাস না থেকে ফোকাস চলে আসে অন্যদিকে। যেমনঃ খবরে বলা হলো অমুক রাজনৈতিক নেতা দূর্নীতিবাজ, আবার সেই নেতাই প্রেস ব্রিফিং করলেন যে মিডিয়ার সব খবর চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করা যাবে না, কাজেই এই খবর ভুল। এখানে লক্ষ্যনীয় যে মিডিয়া যে সবসময় সত্য খবর তুলে ধরে না, এটা সবাই জানে। কিন্তু তাতে সেই নেতার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ কিন্তু ভুল প্রমাণিত হচ্ছে না।
এই ফ্যালাসিটি অ্যাড হোমিনেমের কাছাকাছি।
Appeal to emotion:
এটা হচ্ছে আমার কাছে মনে হওয়া ভয়ঙ্করতম ফ্যালাসি। কারণ এটার মূল ভিত্তিই হচ্ছে ইমোশন। ধরা যাক সেই রাজনৈতিক নেতা যিনি জেনেটিক ফ্যালাসি করেছিলেন তিনি এবার বললেন যে তার সততার পরীক্ষার জন্য এলাকাবাসীর ব্যক্তব্য নেওয়া হোক। এটাই হচ্ছে অ্যাপিল টু ইমোশন।
অথবা মনে করেন- কেউ একজন ইসলামের কিংবা তার ভুল প্রয়োগের বিরুদ্ধে বিবৃতি দিলো। তাতে ক্ষেপে গিয়ে তৌহিদি জনতাদের পক্ষ থেকে এক নেতা পাল্টা বিবৃতি দিয়ে উঠলেন যে বাংলাদেশের আঠারো কোটি মুসলমানের কলিজায় গিয়ে লেগেছে সেটি। কাজেই এর শাস্তি চান তিনি।
এইখানে লক্ষণীয় যে, ইসলামের বিরুদ্ধে যে যুক্তি সে দিয়েছিল তা ব্রেক করার দিকে কিন্তু কেউ নজর দিচ্ছে না। বরং শাস্তি চাওয়ার মতো ভিত্তিহীন দাবী তিনি করেছেন মানুষের আবেগকে পুঁজি করে। এই ঘটনা একই সাথে অ্যাপিল টু ইমোশন, অ্যাপিল টু মোটিভের কাছাকাছি এবং একই সাথে আর্গুমেন্ট ফ্রম পপুলারিটি।
Argument from Popularity:
জনপ্রিয়তার উপর সবসময় সত্যতা নির্ভর করবে না। সত্যতা সবসময়ই স্বতন্ত্র।
উপরের উদাহরণ দু'টিই আর্গুমেন্ট ফ্রম পপুলারিটি।
Tu Quoque or Appeal to Hypocrisy:
এটা হচ্ছে অনেকটা 'তুমিও তো করেছ' টাইপের কুযুক্তি। অর্থাৎ স্টেটমেন্ট যে দিচ্ছে তার স্টেটমেন্টের পাল্টা যুক্তি দিতে না পারলে বা ভুল বুঝে সেই স্পিকারের আগের করা কোন ফ্যালাসিকে টেনে আনা। এইটা অনেকটা অ্যাড হোমিনেমের মতো। এবং এই ফ্যালাসি আমাদের প্রায় সব রাজনৈতিক নেতাদের অত্যধিক পছন্দের। যে মানুষগুলা পাকিস্তানের সমালোচনা করলে অথবা ইন্ডিয়ার সমালোচনা করলেই তুলনা দিতে অপর দেশের উদাহরণ টানে; কিংবা মুসলিমদের সমালোচনা করলে হিন্দুদের তুলনা দেয় (বা ভাইস ভার্সা), তাদের কথা আর না বললাম।
Appeal to Authority:
কেউ বিশেষজ্ঞ হলেই যে তার সব বক্তব্য সঠিক এইটা পুরাপুরি ভুল। এই সঠিক মনে করাই হচ্ছে অ্যাপিল টু অথোরিটি।
উদাহরণঃ ধর্মের কথা নিয়ে প্রচলিত রীতিনীতি এবং হাবিজাবি বিষয় নিয়ে কিংবা কোন স্কলারের সমালোচনা করলেই প্রশ্ন উঠে 'আপনি কি আলেম উলামাদের থেকে বেশি জানেন?'
(এর অর্থ অনেকটা এরকম দাঁড়ায় যে, ধর্মকর্ম পালনের জন্য আমার আলেম হওয়া বাধ্যতামূলক। অথচ সমালোচনা অথবা প্রশ্ন তোলা যে ধর্মে বৈধ, এটা এরা জানে না)
Appeal to Normality:
'ভাই, ওই সময় তো সিচুয়েশনই এইরকম ছিল, এইখানে তো তার কোন দোষ নাই।'
অথবা,
'অমুক দেশের অবস্থা খারাপ ছিল, তমুক নেতা সেটা বন্ধ করার জন্যই এমন হয়েছেন। ভুল তো হতেই পারে'
এটা হচ্ছে অ্যাপিল টু নর্মালিটি। অর্থাৎ সিচুয়েশন এরকমই ছিল, কাজেই কেউ যদি সেই একই ভুল করেও থাকে, সেটা জায়েজ। অর্থাৎ প্রচলিত প্রিজুডিসকে অথবা সিচুয়েশনের দোহাই দিয়ে সবকিছুকে জায়েজকরণ।
Black or White fallacy or fallacy of false dilemma:
এই ক্ষেত্রে ফ্যালাসিটা ছদ্মবেশে থাকে। যেমন বক্তা আপনার সামনে যেকোন বিষয়ের শুধুমাত্র দুটি/ কয়েকটি দিক তুলে ধরবেন এবং বাধ্য করা হবে এই কয়েকটি থেকে একটাকে বেছে নিতে।
এখানে আপনাকে ভাবার সুযোগই দেয়া হবে না যে স্পিকারের অপশনের বাইরেও বিকল্প অপশন থাকতে পারে।
Appeal to Heaven Fallacy:
এটা হল একেবারে খাঁটি বাংলায় যাকে বলে ইশ্বরের দোহাই দিয়ে যেকোন নিকৃষ্ট কাজকেও জায়েজ বানিয়ে ফেলা।
উদাহরণঃ আইসিস। অথবা ধর্মবিরোধীদের কল্লা চাওয়া।
Not True Scotsman Fallacy:
এই ফ্যালাসিটা বাংলাদেশের সব মানুষের সবচে' প্রিয় ফ্যালাসি। নামের সাথে মিল আছে। এর অর্থ করলে দাঁড়ায় খাঁটি স্কটম্যান নয়। অর্থাৎ মনে করেন একজন স্কটম্যান কোন অপরাধ করলো, তখন অন্য স্কটম্যানরা বলবে সে তো সত্যিকার স্কটম্যান নয়। সত্যিকার স্কটম্যান এমন কাজ করতেই পারে না।
এখন দেশীয় স্টাইলে ব্যাখ্যা করি। কোন একজন রাজনৈতিক কর্মী কোন অপরাধ করলে তার দায়ভার না নিয়ে বলা হলো তিনি এই দলের সহিহ কর্মী নন, তিনি হাইব্রিড। অথবা কোন ধার্মিক ব্যক্তি অপরাধ করলে সুন্দর করে বলে দেয়া হয় তিনি উক্ত ধর্মের সহিহ সদস্য নন।
এইটাই হচ্ছে not true scotsman fallacy.
.
আরো অসংখ্য লজিক্যাল ফ্যালাসি আছে। এগুলো মোটামুটি বাংলাদেশের মানুষের কাছে কমন। আমরা যারা অন্ততপক্ষে প্রোগ্রেসিভ হতে চাই, অর্থাৎ নিজের চিন্তাচেতনায় পরিষ্কার থাকতে চাই তাদের এগুলো নিয়ে সতর্ক থাকা জরুরি, কারণ আমরাও আমাদের কথার মাঝে নিজের অজান্তে এই ফ্যালাসিগুলোর চর্চা করি। এমন অনেককেই দেখেছি। তাছাড়া ছোট তর্ক থেকে বড় ঘটনার জন্ম হয়। তাই লজিক্যাল ফ্যালাসি সম্পর্কে একটু সতর্ক থাকলে সেটি এড়ানো সম্ভব। তবে, কেউ যদি এসব মানতে না চায়, তাকেও জোর করতে পারি না। সেটা আমার এবং আমাদের এখতিয়ারে নাই।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে আগস্ট, ২০২০ দুপুর ২:৫৫