বাংলা একডেমির গেইটে একটা ছেলে অচেতন হয়ে পড়ে থাকে । হাত-পায়ে দগদগে পোড়া ক্ষত অথবা ঘা কিংবা গ্যাংগ্রিন টাইপের কিছু একটা হবে । সারাটাসময় স্বাস্থ্যবান মাছিগুলো ভনভন করে ক্ষতগুলোর উপর...রসালো কাঁঠাল ভেঙে রাখলে যেমন করে মাছির দঙ্গল ছুটে আসে,সেই রকম । মাথার পাশেই স্তূপ স্তূপ মল। বিশ্রী বোটকা গন্ধ ভুস করেই নাসারন্ধ্রে আঘাত করে । পরনের লুঙ্গিটা প্রায়শই বুক-পেটের উপর উঠে থাকে । অসভ্যতার কদর্য প্রদর্শনী না দেখে পথচারীরা দৃষ্টি টান টান করে হাঁটা দেয়...ছেলেটাকে দেখে নাক সিটকিয়ে অবাঞ্চিত উপদ্রপ ভেবে তার অস্তিত্ব অস্বীকার না করার কোনই কারণ নেই ... গত ১ মাসে মুখে চুকচুক শব্দ তুলে ক্লাশে যাওয়া-আসার পথের নিয়মিত দৃশ্য এটি ।
পাশেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাচেলর স্টাফদের আবাসিক কোয়ার্টার । তার ভেতরে মসজিদ । ছেলেটিকে পাশ কাটিয়ে প্রতিদিন কতশত মানুষ সেখানে গিয়ে নামাজ পড়ে তার শেষ নেই ।
“পাঠশালার” আয়োজনে IER এর ইফতারে যাচ্ছি । বাংলা একাডেমির গেইটে এসে দেখি একটা ছোটখাট জটলা । ধবধবে সাদার ভেতর ২-৩ ইঞ্চি গাঢ় নীল পাড়ের পোশাক পড়া দু’জন সিস্টার ছেলেটিকে ধুয়ে পরিষ্কার করে দিচ্ছেন । পাশে অনেক খাবার-দাবার আর ওষুধ । পাশের মানুষগুলো এক মহাকাশ বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে সিস্টারগুলোর দিকে ।
প্রতিদিন রোজা রেখে ইফতারির সময় প্রার্থনা করি,যেন আমি ভালো থাকি,মা-বাবা যেন ভালো থাকে,আমার ভবিষ্যৎ যেন ভালো থাকে ...ইত্যাদি । কিন্তু সিস্টারদের দেখার পর মনে হল গত ১৭ দিনের রোজা-নামাজ,ইবাদত,সংযম কোনটাই কাজে লাগেনি । এসবই ছিল আমার আচার । মুসলমান হবার চিরায়ত নিয়ম,অবশ্যপালনীয় রীতি,জান্নাত লাভের ইহলৌকিক পরাকাষ্ঠা । কিন্তু কোন ঈশ্বরের ইবাদত আমি করেছি ? ভাগ্যসহায়হীন ছেলেটিকে রেখে আমি মদিনায় গিয়ে শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ করি,বারানসি ঘাটে গিয়ে পুণ্যস্নান করি,গির্জায় গিয়ে “কনফেস” করি...
হায়,আমি কোন ঈশ্বরের পূজা করি ? ঈশ্বর তো আমার পূজা চান না,ঈশ্বর চান আমিও তাঁর মতই ঈশ্বর হই ...মানুষের মাঝেই তাঁকে চিনে নেই ...
আমি তো এক বুরবুক,কবন্ধ,বকধার্মিক ।গায়ে পায়জামা-পাঞ্জাবি চাপিয়ে আতর- সুরমা মেখে আমি মসজিদে গিয়ে মাথা ঠুকি,মন্দিরে গিয়ে ঢং ঢং ঘন্টা বাজিয়ে উলু দেই,গির্জায় গিয়ে কপাল-বুক- কাঁধে ক্রস আঁকি আর ওদিকে অসহায় আদমটিকে রেখে আমি স্বার্থপরের মত পরকালের পারাপারে প্রস্তুতি নেই ...
আমি কেন ভন্ড হব না ?
২.
হলে ফেরার পথে দেখি ছেলেটি আর ওখানে নেই । খুব সম্ভবত সিস্টারগুলো তাকে নিয়ে গেছেন । এরপর যদি শুনি ছেলেটি মরে গেছে তারপরেও আমার কষ্ট হবে না । মরার আগে অন্তত ছেলেটি মানুষ দেখে গেছে ... এই ইসরায়েলি যুগেও যে মানুষ থাকতে পারে সেটিই হোক তার ইহলৌকিক সঞ্চয় ।