"নেই কাজ তো খই ভাঁজ ।" সারাদিন নেই কাজে এত বেশি খই ভাঁজি যে ব্যস্ততার কারণে নিজের ভাঁজা খইগুলোও চেখে দেখা হয়না । আজকাল আবেগগুলো কেমন যেন মলিন হয়ে যাচ্ছে । দিনের অর্ধেকটা যায় ঘুমিয়েই । বাকি দিনের কাজকর্ম শেষে পেপারটা হাতে নিয়ে চোখ বুলাচ্ছিলাম । একজন মানুষ মারা গেছে শুনে চশমা হাতে নিয়ে বারান্দায় গেলাম । দেখলাম একটা জনাকীর্ণ রাস্তার ধারে কতগুলো মলিন চাদরের বেষ্টনী দিয়ে দুইজন মানুষ একজন মৃত মানুষকে গোসল করাচ্ছেন । পাশে দুটো মানুষ, নির্বিকার । তারও কিছু দূরে দুজন মহিলা কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে,"কি হচ্ছেটা, কি",ভেবে,সম্ভবত !
পাশ দিয়ে সাঁই করে ছুটে যাচ্ছে মাল বোঝাই করা রাতের ট্রাকগুলি,রিকশা,বেবিট্যাক্সি,হিন্দিগান বাজানো প্রাইভেট কার- যে রাস্তার ধারের নারিকেল গাছে নাড়িভুঁড়ি ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাওয়া কতগুলো কাক দেখি রোজ রোজ, যে রাস্তাকে আলোকিত করতে একাকী ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে ল্যাম্পপোস্টটা। যেন অনন্তকালের আরোগ্যহীন একটা ধনুষ্টংকার রোগী । যে রাস্তার ধারের একটা দালানের বারান্দায় মগ হাতে চেয়ে দেখি চোখের অল্প দূরত্বেই অপর একটা দালানে সেলাই মেশিনে জীবন ক্ষয় করে নিজের ছেঁড়া ফাটা ভাগ্য সেলাই করছে কিছু তরুণ-তরুণী । যে রাস্তার ফুটপাতের কোণায় ত্যাগেই মহাসুখ লাভ করে পথচারীরা প্রস্রাবের প্রস্রবণ বানিয়ে রাখে- সেই রাস্তার ধারেই দুজন জিন্দা মানুষ একটি মৃত আদমসন্তানকে গোসলের শেষে পাঠিয়ে দেবে ওই আকাশে ওই জগতে যেখানে কেবল অন্ধকারই সত্য,মহাসত্য । যেখান থেকে ফিরবার অবকাশ আর হবে না - মানুষের জাগতিক নিরন্তর ছুটে চলা আর দেখা হবে না ...
কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকি এক দৃষ্টিতে । যেন মহাকালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়ার পূর্বের একটা নাটকের শেষ অঙ্ক । শরৎ বাবুর দেবদাস মারা গেলে তিনি নিজেই আক্ষেপ করে বলেছেন এমন হতভাগ্য,নিষ্ঠুর পরিণতি যেন কারোরই না হয় । মরবার কালে অন্তত নিদেনপক্ষে একটা অশ্রুবিন্দু বা একটা স্নেহকর স্পর্শেরও সৌভাগ্য ঘটে । এই মানুষটি কি পেয়েছিল এমন সৌভাগ্য, ভাবি ।
কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে নিজের মৃত্যুদৃশ্য অনুভবে নিতে চাইলাম । দেখলাম আমার মা একজন ছেলেকে হারিয়ে দশজন ছেলের মৃত্যুশোকে বিলাপ করছেন আমার নিথর দেহের উপর । অদূরে বাবা মুখে হাত দিয়ে একদলা জীবন্ত কাঠের মূর্তি হয়ে বসে আছেন । হয়তো মূর্তির কালো কালো ডাগর মতন চোখের কোণা দিয়ে দু"ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়বে- কারো দৃষ্টিগোচর হবে না শুধু আমিই দেখব,আর কেউ না, সে অশ্রুবিন্দু দেখার বিরল সৌভাগ্য শুধু আমারই-আমার মৃতদৃষ্টিরই । আরও দেখি আপু আমার গাঁ ঘেঁষে "ভাইয়ারে,ভাইয়ারে" বলে চিৎকার করছে। আমার অ্যাঞ্জেলটি কাছে এসে বলছে, " মামা উঠ, দোকানে যাব, আমার আব্বু ডিসকভার হানড্রেড কিনছে, আমার জন্য নসিলা নিয়ে আসিও,ললিপপ নিয়ে আসিও,ভাল করে পড়িও আচ্ছা ?" ওর অনেক ডাকাডাকিতেও না উঠলে ঠোঁট বাঁকিয়ে "আম পাতা জোড়া জোড়া" কিংবা "সকালে উঠিয়া মনে মনে বলি" আওড়াবে আমাকে ঘুমের রাজ্যপুরী থেকে ফিরিয়ে আনতে- কিন্তু আমি ফিরব না, সে যাত্রা মহাপ্রস্থানের ,চিরবিদায়ের হাজার ডাকাডাকিও আমার ঘুমের দেবতাকে টলাতে পারবে না- চিরঘুমের সে ঘুম,অনন্ত যে ঘুম ...
আর পারি না, আমি কেঁপে কেঁপে চোখ খুলি । চারদিকে খুঁজতে থাকি অজ্ঞাত পরিচয়হীন লাশটির স্বজনদের । কেন জানি হঠাৎ ওই লাশটির প্রতি ভীষণ মায়া হতে থাকে । আমি খুঁজতে থাকি তাঁর স্নেহময়ি মাকে- খাওয়া শেষ হলে যিনি শাড়ির আঁচল পেতে দিতেন ছেলের হাত মোছার জন্য, খুঁজতে থাকি সেই অ্যাঞ্জেলকে যার মুখখানা কল্পনা করে সারাদিনের ক্লান্তিকে ভুলে থাকা যেত, দেখা হলে যে বাবা বাবা বলে চিৎকার করে পুরে যেতে চাইত বুকের খাঁচাটাতে । একজন পুতুলের মত বউ যার একটুখানি মধুমাখা হাসি জগতের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ মনে হত- কেউই নেই-আশপাশে, শুধু ট্রাকে মাল উঠানো কয়েকজন কুলি ছাড়া। যাঁদের কাছে বেঁচে থাকাটাই সত্যের,বাকিসবই অর্থহীন। কে মরে বেঁচে গেল কি মরে গেল তাঁতে কিচ্ছু আসবে যাবে না তাঁদের- জীবন সাগরে নিত্য পাড়ি দেওয়া এক একজন দক্ষ মহাতেজী সাঁতারু তাঁরা, কিইবা এসে যায় যদি কেউ পাশে মরে পরে থাকে !
না দেখা, না চেনা সেই মানুষটার প্রতি মায়াটা বেয়াড়া হতে থাকে । গলার কাছে দলা দলা যন্ত্রণা পাঁক খেতে শুরু করেছে । কৈ? সেই মানুষটা তো আমার বিস্তীর্ণ পাকাধানে মই দেয়নি , আমার প্রকাণ্ড শুন্য গোলাও ধানে ভরে দেয়নি, তবুও !
আমি সম্মোহিতের মতন তাকিয়ে আছি কুলিগুলোর দিকে, দুই দলা মাংসপিণ্ডের নড়নচড়নে, সাঁই সাঁই করে ছুটে চলা গাড়িগুলোর দিকে - যেন খর মৃতদৃষ্টি শেষবারের মত দৃষ্টিপ্রদীপ ফিরে পেয়েছে আর আকণ্ঠ মোহাচ্ছিন্ন হয়ে সজল দৃষ্টিতে চেয়ে আছে নিরতিশয় । বহুকালের সঞ্চয় করা জ্বালাধরা বেদনার হল্লাটাকে মহাবীর্যবান হয়ে এক দীর্ঘশ্বাসের সাথে বের করে দাঁড়িয়ে রইলাম ।
প্রতিদিন প্রদোষের নিরন্ধ্র আধ-অন্ধকারের অন্তরাল হতে মনটা বের হয়ে আসুক ; বাইরের সুবিশাল উদারতায় অভিযোজিত হতে শিখুক; জীবনটা বেঁচে থাকুক হৈ চৈ করে, জীবনের সবগুলো ঘরকে শুধু ঘুমিয়েই যেন ঘুম পাড়িয়ে না রাখা হয়। তবুও ভাবি কাল আবার দীর্ঘশ্বাসটা মিলিয়ে যাবে । কাকগুলো আবারো এসে ভিড় জমাবে নারিকেল গাছে নাড়িভুঁড়ি ছিঁড়তে ; আলো ফুটলে ল্যাম্পপোস্টটা নিভে যাবে, অন্ধকারে আবার জ্বলে উঠবে , নতুন কুলি সেই পুরনো ট্রাকে আবার মাল বোঝাই করে খালাস দেবে- লাশটাকে ধুয়ে দেওয়া পানি কংক্রিটের ছিদ্র গলে ওয়াসার পানির সাথে মিলিয়ে যাবে- বুড়িগঙ্গা বুড়ি হতেই থাকবে, মরবে না । কারণ কিছু মৃত্যু,মৃত্যু নয়, মুক্তিও নয় বেঁচে থাকার শাস্তি !
জীবনের নিরপেক্ষ দেবতা ক্ষমা করুক তাঁকে- গোরস্থানের নিরন্ধ্র নিস্তব্ধ নীরবতায় নিশ্চিত যার শয়ন... মহাশয়ন ...!