গতকাল আমি বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে কিশোরগঞ্জ শহর ও শহরতলীর পাচঁটি ইউনিয়নের একাধিক গ্রামে একটি অটোরক্সিা নিয়ে বেরিয়েছি। অন্তত ৩০০ জনকে রেনডমলি জিজ্ঞাসা করেছি তারা এই জেলার বীর সন্তান শহীদ সিরাজুল ইসলাম বীরবিক্রমকে জানে কিনা? মাত্র ৫ জন ছাড়া কেউ বলতে পারেনি। এই সংখ্যার মধ্যে ৩ জন গুরুদয়াল সরকারী কলেজের শিক্ষার্থী হওয়ায় তাদের চিনতেই হতো। বাকী ২ জন প্রাইমারী শিক্ষক হওয়ায় তাদের জানা সম্ভব হয়েছে কোনো একটি প্রশিক্ষণে। এটা কি সারাদেশের বাস্তবতা,আমি এটি বিশ্বাস করতে চাইনা? আমরা কি ভুলে যাইনি আমাদের দায়বোধ? ভুলে গিয়েছে আমাদের জনদরদী প্রশাসন, ভুলে গিয়েছে আমাদের নতুন প্রজন্ম, ভুলে গিয়েছে আমাদের র্পূব পুরুষরাও কি? গতকাল ছিলো শহীদ সিরাজের মৃত্যুবার্ষিকী। আমি জানিনা শহীদ সিরাজকে নিয়ে কোনো কর্মসূচী কারও ছিলো কিনা। হতবাক হয়ে যাই, নিজেকে জিজ্ঞাসা করি রাজনীতি ছাড়া কি আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ কি কোনোদিনও স্মরণ করবেনা? দলীয় স্বার্থছাড়া একজন বীর বিক্রমও কি অবহেলিত হবে? আমি জানিনা সিরাজের পিতামাতা কেউ বেচেঁ আছেন কিনা। কারণ এই তথ্য আমি কারও কাছে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারিনি। এটা লজ্জার নাকি গর্বের জানিনা। প্রিয় সিরাজ আপনি জীবন দিয়ে বাঁচিয়া গিয়েছেন। তা না হলে আজকে এই অঞ্চলের মহান দলীয়নেতা কিংবা স্বাধীনতা বিরোধীদের গণসংবর্ধনা দেখে এমনিতেই জীবম্মৃতই হয়ে যেতেন। কোনো দায় আপনার নেই, কিন্তু দেশবাসী হিসাবে আমার যে দায় আপনার কাছে আছে সে দায় থেকেই আপনাকে স্মরণ করার চেষ্টা করেছি মাত্র। সারা বাংলার বুকে আজ নষ্টদের নৃত্য চলছে, পুলিশের হাতে চাপাতি, বর্বর জনতা কোলাহল করে হত্যা করছে আমাদের নতুন প্রজন্মকে, চিহ্নিত করছে ডাকাত হিসাবে। খেটে খাওয়া মানুষকে সন্ধ্যায় বাজার থেকে ধরে এনে হত্যা করে ডাকাত বানায় অসীম ক্ষমতাবান সন্ত্রাসীপ্রধাণরা। দাঁত কেলিয়ে টিভিতে সাক্ষাতকার দেয় দায়িত্বপ্রাপ্ত আমাদের পুলিশ অফিসার। বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলতে বলতে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া আমাদের রাষ্ট্রমন্ত্রীর তারপরও হুশ হয়না, দায়িত্ব হিসাবে তার কারণীয় বিবেচনা করে দলীয় দৃষ্টিতে যদিও তিনি রাষ্ট্রের মন্ত্রী। শিক্ষকের যৌন লালসার নীচে চাপা পড়ছে নিষ্পাপ ছাত্রীর ইজ্জত তবুও আরা মাসিদের আস্ফালনে কোপোকাত হওয়া আমাদের শিক্ষামন্ত্রী খুজেঁ ফিরেন দলীয় ষড়যন্ত্র।বিচার হওয়ার চাইতেও রাজনতৈকি সুবিধার কথা আগে বিবেচনা করে বক্তব্য রাখে আমাদের বিরোধীদল, নিজ জমি রক্ষায় সীমান্তে রাত্রি পাহারায় সময় কাটায় র্অধহারী আতংকতি মানুষ, কাটাতারে ঝুলে থাকে কিশোরীর লাশ-ঢাকায় তখন ইলিশ দিয়ে বিদেশী আপ্যায়নের মহড়া চলে-এই জন্য সিরাজের যুদ্ধ কলংকতি হয়না, কিন্তু আমাদের র্বতমান নেতৃত্ব কলংকিত হয়েও দেশপ্রেমিক সাজে, মুক্তযোদ্ধের চেতনার বড়ি বানিয়ে ফেরি করে আমাদের আদর্শহীন অতীত নস্ট কলংকিত বুদ্ধীজীবীরা, বিদেশভ্রমনের ফ্রি টিকেটের কাঙ্গাল এনজিও কিংবা পেশাজীবীরা স্বাধীনতার কোরাস গায় বিশেষমাসে বিশেষদিনের কয়েক ঘন্টার সভা-সেমিনারে-এইসব কীর্তিকলাপ মুক্তিযোদ্ধের চেতনার পরিপন্থি কিনা তা-জিজ্ঞাসা করাও অপরাধ হিসাবে বিবেচিত হয়। এই বাংলায় একজন মানুষও যদি মুক্তিযোদ্ধাদের মনে রাখে তবুও আমাদের সিরাজরা যুগে যুগে জীবন দিবে দেশের প্রয়োজনে, মানুষের প্রয়োজনে এই বিশ্বাস আছে বলেই এখনো পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখি, সমৃদ্ধ বাংলাদেশের প্রত্যাশা করি। জাতির শ্রেষ্টসন্তান হবার ভাগ্য সবার হয়না, কারণ সবাই সিরাজ হতে পারেনা। এটুকুই র্গববোধ করি মহান সিরাজরা এই বাংলার সন্তান, যে বাংলা এখনো আমার ঠাটবাটের ব্যবস্থা করেছে, হাতে হাতে মোবাইল ফোন রাখার সুযোগ দিয়েছে, লক্ষ-কোটি দরিদ্রের ট্যাক্সের টাকায় মেডিক্যাল কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল গুলোতে আমাদের নতুন প্রজন্ম নুন্যতম লেখাপড়া করার সুযোগ পাচ্ছে-সেই বাংলা ছেড়ে, সিরাজদের কবর মাড়িয়ে আমি কোথায় যাবো? পৃথিবীর কয়টি দেশে সিরাজদের কবর ধারণ করার পবিত্র মাটি আছে?
আসুন একটি দিনের অন্তত ৩০ মিনিটের জন্য হলেও আমাদের সিরাজদের জন্য ব্যয় করি, স্মরণ করি প্লিজ।
শহীদ সিরাজুল ইসলাম ১৯৭১ সালে গুরুদয়াল সরকারী কলেজের ৪র্থ বর্ষ কলা বিভাগের ছাত্র থাকাকালীন সময়ে মহান মুক্তিযোদ্ধে যোগদান করেন। ভারতে আসামের ইকোয়ানে প্রশিক্ষণ শেষে ৫ নং সেক্টরের অধীনে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। সর্বশেষ অভিযানে কমান্ডার হিসাবে তার নেতৃত্বে এক রক্তক্ষয়ী ও ভয়াবহ যুদ্ধের মাধ্যমে পাকবাহিনীর শক্ত ঘাটি ও গুরুত্বর্পূণ নদীবন্দর সাচনা(বর্তমান সুনামগঞ্জ জেলা) মুক্ত হয়। উক্তযুদ্ধে পাকবাহিনীর ৩৬ জন জানুয়ার সেনা নিহত হওয়ার পাশাপাশি বিপুল পরিমান ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়। ৮ ই আগস্ট সাচনা জয়ের পর মূর্হুতে পলায়নরত শত্রুসেনাদের কাভারিং ফায়ারে স্বাধীনতার স্লোগানরত শহীদ সিরাজ অকষ্মাৎ গুলবিদ্ধ হয়ে শাহাদাৎ বরণ করেন । শহীদ সিরাজকে সীমান্তবর্তী গারো পাহাড়ের পাদদেশে টেকেরঘাটে পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় সমাহিত করা হয়। স্বাধীনতা পরবর্তী সরকার মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তাকে ‘‘বীরবিক্রম’’ খেতাবে ভূষিত করেন এবং এবং সাচনার নামকরণ করা হয় ‘‘সিরাজনগর’’। মরহুম মুকতুল হোসেনের পুত্র শহীদ সিরাজের বাড়ী কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলার ছিলনী গ্রামে। তথ্য সুত্র ঃ শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতি পরিষদ, জিডিজি কলেজ, কিশোরগঞ্জ।
----------------১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে যে সমস্ত বাঙালী বীর যুদ্ধরত অবস্থায় শহীদ হয়েছিলেন তাদের মধ্যে গুরুদয়াল সরকারী কলেজের ছাত্র সিরাজুল ইসলাম অন্যতম ছিলেন। যুদ্ধরত অবস্থায় যে সমস্ত মুক্তিযোদ্ধা তাদের মা ও বাবার কাছে রনাঙ্গণ থেকে যে চিঠি লেখেন সে সমস্ত চিঠি‘একাত্তরের চিঠি’ নামক পুস্তকে প্রকাশিত হয়। সে সমস্ত চিঠির মধ্যে শহীদ সিরাজুল ইসলামের চিঠিটি ২য় স্থান অধিকার করে। উক্ত চিঠিটি ব্লগারদের দৃষ্টি আকর্ষনের জন্য হুবুহু শহীদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে প্রকাশ করা হলোঃ
প্রিয় আব্বাজান,
আমার সালাম নিবেন। আশা করি খোদার কৃপায় ভালোই আছেন। বাড়ির সকলের কাছে আমার শ্রেনী মতো সালাম ও স্নেহ রইলো। বর্তমানে যুদ্ধে আছি আলী রাজা, রওশন, সাত্তার, রেনু, ইব্রাহীম, ফুলমিয়া সকলেই একত্রে আছি। দেশের জন্য আমরা সকলেই জান কোরবান করছি। আমাদের জন্য ও দেশ স্বাধীন হওয়ার জন্য দোয়া করবেন। আমি যৌবনকে তুচ্ছ মনে করি। কারণ দেশ স্বাধীন না হলে জীবনের কোন মূল্য থাকবেনা। তাই যুদ্ধকেই জীবনের পাথেয় হিসাবে নিলাম। আমার অনুপস্থিতিতে মাকে কষ্ট দিলে আমি আপনাদেরকে ক্ষমা করব না। পাগলের সব জ্বালা সহ্য করতে হবে। চাচা-মামাদের ও বড় ভাইদের নিকট আমার সালাম। বড় ভাইকে চাকুরীতে যোগ দিতে নিষেধ করবেন। জীবনের চেয়ে চাকুরী বড় নয়। দাদুকে দোয়া করতে বলবেন। মৃত্যুর মুখে আছি। যেকোন সময় মৃত্যু হতে পারে এবং মৃত্যুর জন্য সর্বদা প্রস্তুত। দোয়া করবেন মৃত্যু হলেও যেন দেশ স্বাধীন হয়। তখন দেখবেন লাখ লাখ ছেলে বাংলার বুকে পুত্রহারাকে বাবা বলে ডাকবে। এই ডাকের অপেক্ষায় থাকুন। আর আমার জন্য চিন্তার কোন কারণ নাই। আপনার দুই মেয়েকে পুরুষের মতো শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলবেন। তবেই আপনার সকল সাধ মিটে যাবে। দেশবাসী, স্বাধীন বাংলা কায়েমের জন্য দোয়া কর, মীরজাফরী করো না। কারণ মুক্তিফৌজ তোমাদের ক্ষমা করবেনা এবং বাংলায় তোমাদের জায়গা দেবেনা। সালাম দেশবাসী সালাম।
ইতি-মোঃ সিরাজুল ইসলাম।
আমাদের সামু, সামুর সকল ব্লগার এবং সামুর শুভাকাংখিদের পক্ষ থেকে,-‘‘জাস্ট স্যালুট ইউ সিরাজ, জাস্ট স্যালুট।’’