(১)
আরিফ অনেক ব্যস্ত । তার এখন দিন কাটে বিভিন্ন মিটিং এ । এই বছরের তরুন ব্যবসায়ী হিসেবে তাকে রিওয়ার্ড দেয়া হবে । এছাড়া কয়েকটা ম্যাগাজিনে তাকে নিয়ে ছোটখাটো ফিচার করেছে । আসলে ছোট একটা কোম্পানি শুরু করেছিল তিন বছর আগে । আজ সেটা বড় হয়ে মাথা উচু করে দাড়িয়েছে । তার হাতে সময় কম থাকে । সে নিজেও জানে না তাকে কখন কোথায় থাকতে হয় । তার মিটিং এর কোন শেষ নেই । তার উপর আবার কর্পোরেট ডিনার দাওয়াত তো আছেই । তাই তার হাতে একদম সময় থাকে না । তবে তার অফিসের সবার খোজ সে ঠিক ই রাখে ।
তার অফিসের যত লোক আছে সবাই শুধু তার ব্যবহার এবং ভালবাসার জন্য ই অফিসে আছে । এটা সবার সেকেন্ড হোম হয়ে গিয়েছে । সবার আন্তরিকতা আর ভালবাসায় এটা আসলে কর্মস্থল বাসা মনে হয়ে । এ জন্য কাজে কোন ভাটা পরতে দেয় না । সবাই তার নিজ নিজ জায়গাতে ডেডিকেটেড । তাদের কাজের প্রসংশা আরিফ সব সময় করে থাকে ।
আজ হঠাত করে এইচআর সুমন ফোন করে বলেছে যে জরুরী ভিত্তিতে তাকে অফিসে আসতে । কি যেন কাজ আছে । এই ছেলেটার মেধা আরিফ কে মুগ্ধ করে । সে সব সময় তার কাজে পারফেক্ট হতে চায় । কোম্পানির এইচআর ডিপার্টমেন্টের পুরো দায়িত্ব তাই সুমনের উপর চাপিয়ে সে নিশ্চত হয়ে গিয়েছে । অথচ আজ জরুরী তলব করেছে । কে জানে কি বলবে ।
অফিসে নিজের রুমে ঢুকে সুমন কে আসতে বলল ।
- আসতে পারি স্যার ।
- সুমন বলছি না আমাকে স্যার বলবা না ।
- ঠিক আছে ভাইয়া ।
এখন বলো কেন ডেকেছো । আমার হাতে অনেক কাজ আছে । তোমার ফোনে আসলাম । অন্য কেউ হলে আসতাম না । বলল আরিফ ।
জানি ভাই । আমিও জরুরী ছাড়া আপনাকে কেন ঢাকব । তবে আপনি প্লিজ কোন কিছু ভাববেন না । আর আপনাকে একটা জিনিস দেখাব । বলে থামল সুমন ।
কি দেখাবে? কৌতুহলি দৃষ্টি নিয়ে আরিফ তাকিয়ে আছে ।
সুমন বলল, ভাই আপনি তো জানেন আপনার জন্য আমরা একজন লোক খুজ্জচ্ছি । যাকে বলে পিএস আরকি । এটা তো জানেন ।
আরিফ বলল, হ্যা । এটা নিয়ে আর ভাবার কি আছে । তোমার উপর আমার ভরসা আছে ।
সুমন তখন বলল, ভাই আমি একটা সিভি পেয়েছি । সেটা দেখাতে চাই । আর আপনার সিদ্ধান্ত চাই । তাহলে এটাই ফাইনাল না হলে ইন্টারভিউ হবে ।
এবার আরিফ ভাবতে লাগল । একটা সিভি দেখাবে । কি আছে সিভিতে । যার জন্য তাকে এত বিজি সিডিউল থেকে ঢেকে এনেছে । এসব ভাবছে । ঠিক তখন সুমন তার ল্যাপটপ থেকে সিভিটা ওপেন করে আরিফের দিকে বাড়িয়ে দেয় ।
আরিফ সিভির দিকে তাকিয়ে ছোট একটা হাসি দেয় । সুমন কে বলে যাও ইন্টারভিউ এর আয়োজন করো । এবার আমিও থাকব ।
(২)
সাত বছর আগে ........
- আরিফ আমার একটা , না না কয়েকটা জিনিশ লাগবে । একটু এনে দিবা ।
- কি যে বলো রিমি । এনে দিবো চিন্তা করো না । কি কি লাগবে সেটা জানিও ।
রিমি আর আরিফ এক সাথে পড়াশুনা করে । দুজনেই একে অপর কে ভালবাসে । তবে আরিফ মনে হয় বেশি বাসে । এটা নিয়ে ওর বন্ধুদের সাথে প্রায় ঝগড়া হয় । রিমি নাকি ওকে ধোকা দেবে । বিয়ে করবে না । আরিফ হেসে উড়িয়ে দেয় ।
রিমি সকল প্রয়োজনে আরিফে পাশে পায় । কোন নোটস, এসাইনমেন্ট এমনকি পরীক্ষাও এক সাথে দেয় । রিমি ও জানে আরিফ ওকে পাগলের মত ভালবাসে । তার যখন যা লাগে আরিফ কে বললেই সব হাজির ।
ছেলেটা যেনো জাদু জানে । মনে হয় উপরওয়ালা আরিফ কে সব কিছু দিয়ে পাঠিয়েছেন । ওর কাছে অসম্ভব বলে কোন কিছু নেই । রিমি আর আরিফ দুজনেই যেন একে অপরকে আয়নার মত করে বোঝে । রিমি মুখ খোলার আগেই আরিফ সব বুঝে যায় । যেন মুখ দেখে পড়তে পারে সব । রিমি নিজেও জানে না ছেলেটা কিভাবে এটা পারে । শুধু ভাবে এতটা ভালবাসা সে কোথায় রাখবে ।
তাদের পরিচয়টাও হুট করে হয় । সেই থেকে চলতে থাকে । বিশ্ব বিদ্যালয়ের দিন গুলো যেন উড়ে চলে । ক্লাস ছাড়া বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা আর ট্যুরে কেটে যেতো দুজনের দিন । তাদের নিয়েও মেতে থাকতো বন্ধুরা । তারা দুজনের একজন মিস হলে যেন সব ঝিমিয়ে পরতো ।
তাদের ঘিরেই সব চলত । কিন্তু কে জানত সব কিছু এক ঝড়ে এক নিমিষে শেষ হয়ে যাবে । শুধু ভেবেছে এটা তো হবার ছিল না । কেই বা বুঝতে পারেছে শেষ পর্যন্ত কিছুই আর থাকবে না । সব কিছু ধুলায় মিশে যাবে । যেন এখানে কিছুই ছিল না । সব যেন নতুন ভাবে গড়তে হবে ।
কেউ বুঝতেও পারল না কি এক অন্ধকারে তলিয়ে গিয়েছে সব কিছু । অথচ একজন ঠিক ই মনে রেখেছে । সে শুধু অপেক্ষা করবে বলে নিজেকে আড়াল করে এগিয়েছে সামনের দিকে ।
তারপর শুধু ই অপেক্ষা ।
(৩)
সুমন কে বলার পর সে কাজে নেমে পরে । যত ভাবে খবর নেয়া যায় সে সব কিছু যোগাড় করে । কিভাবে করেছে সেটা সেই জানে । জানে আরিফ তাকে এই বিষয়ে কিছু বলবে না । কারন এটাও জানে আরিফ নিজে চাইলে খবর নিতে পারত । কিন্তু তার এসবের উপর আর কোন ইন্টারেস্ট নেই । সে সব কিছু অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছে । তবুও সিভিটা আসায় সে একবার একটা চেষ্টা করে দেখতে চায় । তাই সুমনে খবর নিতে বলেছে ।
ইন্টারভিউ হবে দুদিন । এক দিন শুধু স্পেশাল একজনের হবে । সেটার জন্য আরিফ নিজেকে তৈরি করছে । কারন সে সুমন আসার পর আর ইন্টারভিউ নেয়নি । কারন ছেলেটার মানুষ চেনার ক্ষমতা অসাধারন । তাই তাকে এই বিষয় নিয়ে ভাবতে হয়নি । তবে এবারের ইন্টারভিউ একটু ভিন্ন । তাই সে নিজেকে তৈরি করছে । হয়ত তার অপেক্ষার দিন শেষ হয়ে আসছে ।
আজ সেই দিন । আরিফ নিজেকে পরিপাটি করে সময় মত অফিসে ঢুকে অপেক্ষা করছে ।
আসতে পারি? খুব আস্তে ও নিচু স্বরে একজন বলল ।
জ্বী আসুন । আরিফ বলল । আরিফ নিজেকে উলটো দিকে করে রেখেছে । বসুন । আরিফ বলল ।
- স্যার আমার সিভি ।
- আপনার সিভি আমরা দেখেছি ।
- আমার জানা মতে আপনার তো এই জবটা দরকার নেই ।
- না স্যার আমার জবটা খুব দরকার । আমি অনেক বিপদে আছি ।
- এমন কিছু বলুন যা আপনার সিভিতে নেই ।
- আমি যা বলবেন তাই করতে পারব স্যার ।
আমি যা বলব তাই করতে পারবেন । এটা তো আপনার স্বভাবে নেই । মিস রিমি নাকি মিসেস রিমি বলল ।
আপনি আমার ডাক নাম জানলেন কিভাবে স্যার । আমি তো সিভিতে এই নাম দেইনি । রিমি জিজ্ঞেস করল
আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ে খোজ নিয়েছি । আমরা একজন লোক নেবো । তার ব্যাপারে তো খোজ নিতে হয় তাই না । যেন তেনো লোক তো নিতে পারি না । আরিফ বলল । সে তখন ও উলটো দিকে ঘুরে আছে ।
স্যার আপনাকে কেউ ম্যানার শেখায়নি । এত বড় কোম্পানি চালান অথচ উলটো দিকে ঘুরে ইন্টারভিউ নিচ্ছেন । রিমি বলল রাগত্ব স্বরে । তার কেন জানি বিষয়টা পছন্দ হচ্ছে না ।
তখন আরিফ ইন্টারকমে রিসেপশনিস্ট কে বলল, শুনুন আমার জন্য দুধ চা চিনি বেশি দিয়ে আর ম্যাডামের জন্য কড়া লিকাড়ে দু চামচ চিনি দিয়ে রং চা । উনি এটা পছন্দ করেন ।
রিমি প্রচন্ড রকমের ধাক্কা খেলো । এটা উনি কিভাবে জানল । এটা তো কিছুতেই জানা সম্ভব নয় । নাকি তার পরিচিত কেউ ।
তো মিসেস রিমি, আপনি তো আর কিছুই বললেন না । আমি যা বলব তা আপনি করতে পারবেন । এটা তো আপনি বললেন কিন্তু আসলেই কি তাই?
জ্বী স্যার পারব । দৃঢ়তা নিয়ে উত্তর দিল রিমি ।
এর মধ্যে পিয়ন চা দিয়ে গেল । রিমি দুধ চায়ের দিকে তাকিয়ে আছে । বেশি করে দুধ আর চিনি দিয়ে আরিফ চা খেতো । সেটা মনে পরে গেল । ছেলেটার সাথে সে যা করেছে তার ক্ষমা নেই । সে জানে আরিফ এখন ব্যবসায়ী তবে তার প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে জানে না । কারন এটাও তার স্বভাবে নেই । বিপদে পরেছে বলেই সে এপ্লাই করেছে । কারন তার স্বামীর ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে । তাই সে ইন্টারভিউ দিতে এসেছে ।
মিসেস রিমি আরিফ ডাক দিল, কোথায় হারিয়ে গেলেন । অতীত নিয়ে কে পরে থাকে বলেন । আপনার মত স্মার্ট মেয়েরা তো পায়ে মাড়িয়ে সামনে এগিয়ে যান । আমার মনে হয় আপনি তাদের একজন ।
স্যার আপনি এখনো আমার দিকে ফিরলেন না । এটা তো ইন্টারভিউ না । আর আপনি কি প্রশ্ন করছেন । রিমি বেশ ঝাজ নিয়ে বলল ।
আরিফ মুচকি হেসে বলল, ম্যাম আপনি জব এর জন্য এসেছেন । আমি না । এটা আমার ইচ্ছে আমি কিভাবে প্রশ্ন করব । আপনার কাজ উত্তর দেয়া । তাই নয় কি ?
রিমি ভেবে দেখলো । আসলে সে চাকরিটা দরকার । তাই যেকোন ভাবে হোক একটা জব এ ঢুকতে হবে । তার জন্য যদি এর সাথে থাকতে হয় তবে তাই । স্যালারি নেহায়েত কম দেবে না । সব দিক থেকে ভাল ।
আরিফ আবার বলল, কি ভাবছেন আমার সাথে থাকতে হবে । বিভিন্ন ট্যুরে যেতে হবে । তাই ।
স্যার আপনি কিভাবে বুঝলেন । আমি এটাই ভাবছি । রিমি সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে ।
চেয়ার ঘুরিয়ে এবার আরিফ নিজেকে উপস্থাপন করল । রিমি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল । সে ভাবেনি কোন দিন আরিফের সামনে এভাবে এসে দাঁড়াবে । ছেলেটার সাথে সে যা করেছে তার ক্ষমা নেই ।
রিমি উঠে দাড়ালো । বলল ইন্টারভিউ নেয়ার জন্য ধন্যবাদ স্যার । আপনার অনেক সময় নষ্ট করেছি ক্ষমা করবেন । আরিফ উত্তর দিল, ক্ষমা সে চার বছর আগেই করে দিয়েছি । তবে একটা কথা বলি আপনাকে মিসেস রিমি আপনি উচ্চ ভিলাষী তবে সেটা যদি আপনি আমাকে বলতেন আমার খারাপ লাগত না ।
ভাল থাকবেন স্যার । বলে রিমি চলে গেল ।
আপনি ভাল থাকবেন মিসেস রিমি । চেষ্টা করুন মানুষ কে ভালবাসার ।
চায়ের কাপ হাতে কাচের অফিসে কিনারায় গিয়ে যেখান থেকে পুরো শহর দেখা যায় । চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে আরিফ ভাবছে । আজ পুরো শহর তার পায়ের নিচে । এটাকেই বোধহয় বলে সুইট রিভেঞ্জ ।
(রাত তিনটায় ও যখন ঘুম আসছিল না তখন এটা লিখেছি । জানি না কেমন হয়েছে । তবে গল্প লেখার চেষ্টা করছি ।)
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে ডিসেম্বর, ২০১৮ সকাল ১০:৩৯