আওয়ামীলীগ সব সময় বলে আসে তারা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি এবং সচেতন ভাবেই জামাতের প্রতি একটা ঘৃণা তৈরি করেছে জনগনের মনে । তারা বলে এসেছে যে যারাই জামাতের সাথে তারাই খারাপ, তারাই দেশ বিরোধী । কিন্তু মজার একটা ব্যাপার হচ্ছে এই খোদ আওমীলীগই কিন্তু এক সময়ে জামাতের সাথে কাধে কাধ মিলিয়ে এক জোট হয়ে মাঠে নেমেছিল। এটা নিয়ে আওয়ামীলীগাররা কথা বলেন না । এমনটা ভাব করেন যেন এমন কিছু ঘটেই নি কোন দিন। তখন কি জামাত দেশবিরোধী ছিল না? ৯৬তে বিএনপির এক তরফা নির্বাচনের বিরুদ্ধে আওয়ামীলীগ জামাতের সাথে মিলে আন্দোলন করেছে। মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। জামাত যে দেশ বিরোধী, স্বাধীনতা বিরোধী, তখন আওয়ামীলীগের মাথায় এই কথাটা সম্ভবত ছিল না। জামাত যখন বিএনপির সাথে যুক্ত হল তখন তাদের এই কথা মনে পড়ল।
আপনারা একটা ব্যাপার খেয়াল করলে দেখবেন, আওয়ামী মুক্তিযুদ্ধের প্রেম ২০০৮ সালের নির্বাচনের প্রচারণার আগে এতোটা প্রবল ছিল না। আমি যখন থেকে বুঝতে শিখলাম তখন থেকে কিন্তু আওয়ামীলীগের মুখে এই মুক্তিযুদ্ধের গল্প এতো ব্যাপক ভাবে প্রচার হতে দেখি নি যতটা এই ২০০৮ সালের পরে এসে দেখেছি। এটা কি আসলেই মুক্তিযুদ্ধের প্রতি প্রেম নাকি নির্বাচনে জেতার এজেন্ডা সেটা বোধকরি আলাদা ভাবে বলে দিতে হবে না। প্রতিটিটা নির্বাচনেই রাজনৈতিক দল কোন না কোন এজেন্ডা সামনে নিয়ে আসে সামনে। আটের নির্বাচনের সময় মোটামুতি ৩৩ শতাংশই ছিল তরুণ ভোটার । তাদের ভোট নিজেদের দলে টানতেই এই মুক্তিযুদ্ধকে সামনে আনা হয়। এই রাজাকারদের বিচার করা হবে এই আশ্বাসেই আওয়ামীলীগ তরুণদের সমর্থন আদায় করে। এই কথা কোন ভাবেই অস্বীকার করা যাবে না যে শেখ হাসিনার সরকারই মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তরুণদের আকৃষ্ঠ করে তোলে।
আমার বলতে দ্বিধা নেই যে আমি নিজেও সেই দলে ছিলাম । কিন্তু হঠাৎ করেই একটা জিনিস আমাদের সামনে এসে হাজির হল যে এই মুক্তিযুদ্ধ, একাত্তর আওয়ামীলীগের নিজেস্ব সম্পত্তি হয়ে উঠেছে। এই মুক্তিযুদ্ধে এবং একাত্তরকে তারা নিজেদের ঢাল হিসাবে ব্যবহার করেছে। নিজেদের সব আকাম কুকাম ঢাকতে ব্যবহার করেছে।
শুরুতে এই মুক্তিযুদ্ধ একাত্তর কেবল মাত্র জামাত এবং পরে বিএনপির বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয় । কিন্তু দিন যতই যেতে লাগল ততই দেখা গেল চারিদিকে সবার বিরুদ্ধেই এই মুক্তিযুদ্ধ আর একাত্তরকে দাড় করিয়ে দেওয়া হতে লাগল । যে কাউকে ধরে মারধোরের শেষে কেবল একটা শিবির ট্যাগ লাগিয়ে দিলেই ব্যাস, আর কোন কথা ছিল না। সব কিছু জায়েজ ! এমন কি খুন করেই যদি বলা যত শিবির ছিল তখনও সব কিছু জায়েজ হয়ে যেত। কেবল একটা ট্যাগই যথেষ্ঠ ছিল।
এই প্রসঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করি একটা। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় কি তৃতীয় বর্ষে পড়ি। আমাদের ক্লাসেরই এক ছেলে পড়ত। লাকসামে বাড়ি। ক্লাসের প্রথম সারির ছাত্র ছিল সে। এই ছেলে ক্লাসের আরেকটি মেয়েকে পছন্দ করত । এই ব্যাপারটা আমরা সবাই জানতাম। ভালছাত্র হওয়ার কারণে সেই মেয়েও প্রশ্রয় দিত। একদিন ক্লাসে এসে শুনি এক আওয়ামীলীগ পাতিনেতা তার সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে তাকে মারধোর করেছে। কারণ হচ্ছে সেই নেতা আমাদের ক্লাসের সেই মেয়ের এলাকার। এবং সেই মেয়ে কোণ দিন তাকে পাত্তা দেয় নি। এই ছেলের সাথে মেলামেশা করতে দেখে তার সহ্য হয় নি। কোন বিচার কিংবা কিছুই হয় নি । কারণ তাকে মারা হয়েছে শিবির ট্যাগ দিয়ে।
সেই সময়ে এই জামাত শিবির ট্যাগে খুব কাজও হত। আস্তে আস্তে আমরা দেখতে লাগলাম যে সবাইকেই এই ট্যাগ দিয়ে দেওয়া হতে লাগল। যারাই সরকারের আকাম কুমাকের কথা বলত তারাই দেশ বিরোধী তারাই স্বাধীনতা বিরোধী তারা জামাত শিবির আর রাজাকার । তুমি সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছে, তুমি রাজাকার, তুমি সরকারের দমন নিপিড়নের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছ তুমি রাজাকার, তুমি ব্যাংক লুট ঋণ খেলার বিরুদ্ধে বল, তুমি রাজাকার, তুমি সরকারী গুমের বিরুদ্ধে কথা বলছ তুমি রাজাকার !
এই ট্যাগ দিতে দিতে এমন একটা অবস্থা দাড়াল যে দেখা গেল কেবল মাত্র সরকারী চামচা বাদ দিয়ে সবাই হয়ে গেল রাজাকার । দেশের সংখ্যা গরিষ্ঠই এখন রাজাকার হয়ে গেছে। আওয়ামীলীগ এই মুক্তিযুদ্ধ, এই চেতনাকে এতো এতো ভার ব্যবহার করেছে যে মানুষের ভেতর থেকে এই ট্যাগের অস্ত্রের ভয় একেবারে চলে গেছে। আওয়ামীলীগের চেতনা ব্যবসায় একেবারে লাল বাত্তি জ্বলে উঠেছে।
একটা ব্যাপার খেয়াল করে দেখুন, সেই ২০১৩ সালে কাউকে যখন রাজাকার জামাত শিবির ট্যাগ দেওয়া আর এই ২০২৪ সালে কাউকে একই ব্যাপারে ট্যাগ দেওয়া, এই দুই ট্যাগের ফল কি এক রকম? এখন এই ট্যাগ কেউ কেয়ারই করছে না। বরং এখন যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে কেউ কাউকে ছাত্রলীগ ট্যাগ দেয় তাহলে বরং অবস্থা ভয়াবহ ! পাশার চাল কিভাবে উল্টে গেল!
এছাড়া আরেকটা ব্যাপার দুঃখজনক যে দশ বছর আগে মুক্তিযোদ্ধাদের দেশের মানুষ যেভাবে সম্মান করত এখন এই ২০২৪ সালে সেই রকম ভাবে কি সম্মান করে? মুক্তিযোদ্ধাদের আওয়ামীলীগ নিজের স্বার্থে এমন ভাবে ব্যবহার করে গত ১৫টা বছর যে মুক্তিযোদ্ধারা আগের সেই ইমেজ ধরে রাখতে পারেন নি। এর পেছনে যে শুধু আওয়ামীলীগ দায়ী সেটাও কিন্তু নয়। মুক্তিযোদ্ধারা নিজেরাও কি দায়ী নয়? আপনারা কী বুঝতে পারেন নি যে আওয়ামীলীগ আপনাদেরকে সামনে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করছে নিজেদের স্বার্থের জন্য? আপনারা এর বিরুদ্ধে কেন কথা বলেন নি?
যখনই আওয়ামীলীগ কোন অন্যায়ের ঢাল হিসাবে মুক্তিযোদ্ধাদের দাড় করিয়েছে আপনারা কিন্তু সেখানে ঢাল হিসাবে দাড়িয়েও গেছেন । আওয়ামীলী অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবার করা মানেই কিন্তু একাত্তরের বিরুদ্ধে যাওয়া নয় । কিন্তু দিনের পর দিন এই কথাটাই প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা হয়েছে আওয়ামীলীগের বিরুদ্ধে যাওয়া মানেই মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে যাওয়া, স্বাধীনতার বিরুদ্ধে যাওয়া ! এই চেষ্টা সফল হয় নি।
আমার নিজ এলাকার পলায়নকৃত এমপি সাহেব একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন । আট সালে তিনি নির্বাচত হয়ে এমপি হলেন। তারপরে তার ভাইকে জেলার মেয়র বানান তিনি । এরপর এই চব্বিশ পর্যন্ত দুইজন একই অবস্থায় ছিলেন। এই দুইজন জেলার এমন কোন অকাম নেই যে করেন নি। প্রতিটা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা নেওয়া, সরকারী প্রকল্পে টাকা মারা, ভয় ভীতি দেখিয়ে জায়গা জমি দখল এমন হেন অপকর্ম নেই যে এই দুই ভাই মিলে করে নাই। আর বিরোধীদের নেতাকর্মীদের উপরে যে অকথ্য নরক নেমে এসেছে তারও কোন হিসাব নেই। ২০১৪ এর পরে কোন বিএনপির নেতা কর্মী রাতে তাদের বাসায় ঘুমাতে পারে নাই। যখন সরকার পতন হলে এই দুই ভাইয়ের বিশাল দুই বিল্ডিং সবার প্রথমে আগুণে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তারা পলাতক । এখন প্রশ্ন হচ্ছে আপনারা এই হামলাকে কি একজন মুক্তিযুদ্ধার উপরে হামলা হিসাবে প্রচার করবেন? নাকি তার কর্মের ফল বলবেন একজন চরম দুর্নীতিবাজ নিপীড়কের উপরে হামলা বলবেন?
সামনে আওয়ামীলীগ আবার ফিরে আসবে আশা করি। নির্বাচনের প্রচারের জন্য তাদের কোন না কোন এজেন্ডার দরকার হবে। আওয়ামীলীগের এবার বুঝতে হবে যে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তারা গত ১৫ বছর যে ব্যবসা করে এসেছে, সেটা আপাতত বন্ধ হয়ে গেছে । পাব্লিক এক সময়ে এই চেতনা খুব খেয়েছে । এখন এই খাদ্যের প্রতি তাদের অনিহা চলে এসেছে। বিশেষ বর্তমান তরুন প্রজন্ম এতে একেবারেই ধরা দিবে না। বরং এখন যদি এটা ব্যবহার করে পাব্লিকের সিম্প্যাথি আর তাদের দিকে আর আসবে না । এবার তাদের নতুন কোন টপিক নিয়ে মাথে নামতে হবে। নতুন করে তাদের ভোট আদায় করতে হলে আওয়ামীলীগকে নতুন কিছু ভাবতে হবে। এই সামনের নির্বাচনে জেন-জিদের একটা বড় অংশ ভোটার । এই ভোটে তো আওয়ামীলীগের আশা একেবারে বাদ দিতে হবে। পরের ভোটে আওয়ামীলীগের বেশ আশা রয়েছে। কিন্তু তাদেরএমন কোন এজেন্ডা বেঁছে নিতে যেটা পাব্লিক খাবে। কী হতে পারে সেই এজেন্ডা ?
একটা সম্ভবনা দিয়ে শেষ করি লেখা।
এই সরকার সংস্কার শেষে যে নির্বাচন দিবে সেই নির্বাচনে অবধারিত ভাবেই বিএনপি ক্ষমতায় আসবে। সম্ভবনা হচ্ছে বর্তমানে বিএনপির মাঝে এই আত্মবিশ্বাস চলে এসেছে যে তারা জামাত ছাড়াই ক্ষমতায় যেতে পারবে। এবং এটা সত্যও বটে। তারা পারবে। বিগত কয়েক বছরের বিএনপির আচরণ দেখে সেটাই মনে হয়েছে বিএনপি জামাতের সাথে থাকবে না। সেই হিসাবে বিএনপি একাই সরকার গঠন করবে। জামাত নির্বাচন নিবন্ধন এখনও বাতিল অবস্থায় আছে। ইউনুচ সরকার সেটা প্রত্যাহার করবে কিনা সেটা নিয়ে এখনও সন্দেহ আছে। যদি করেও জামাত একা একা কিংবা অন্য ইসলামী দলের সাথে নির্বাচনে যাবে। এমন একটা সম্ভবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না সেই টার্মে জামায়েতের সাথে আওয়ামীলীগ জোট বাঁধবে সেই ৯৬ এর মত করে। এটা যদি হয় তাহলে ব্যাপারটা দেখার মত হবে। চেতনার একমাত্র সোল এজেন্ট জামাতের সাথে জোট করে বিএনপির বিরুদ্ধে দাড়িয়েছে। ব্যাপারটা দেখার মত হবে। যদি মরে না যাই তাহলে আগামী চার/পাঁচ বছরের ভেতরেই এই ঘটনা ঘটার সম্ভবনা রয়েছে।
(ছবিটা ফেসবুক থেকে নেওয়া আর লেখাটা নিজের ব্লগে প্রকাশিত।)
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে আগস্ট, ২০২৪ রাত ৮:১২