আমি পহেলা বৈশাখে কোনো দিন শখ করে পান্তা ইলিশ খেয়েছি বলে মনে পড়ে না। ইলিশ খেয়েছি, তবে পান্তা দিয়ে নয়। তার মানে কিন্তু এটা না যে আমি পান্তা ভালোবাসি না। বরং উল্টো, পান্তা আমার বেশ পছন্দের একটি খাবার!
একটা সময় পান্তা প্রতিটা ঘরে ঘরে একটি স্বাভাবিক খাবার ছিল। তবে এই খাবারটা বেশিরভাগ বাঙালি এখন আর খায় না। বিশেষ করে যখন থেকে আমাদের সবার বাড়ি বাড়ি ফ্রিজ সহজলভ্য হয়ে উঠেছে, তখন থেকে পান্তা খাওয়ার পরিমাণ কমে গেছে। আগে রাতের অবশিষ্ট ভাতে পানি দিয়ে রাখা হত। সেটাই সকালে লবণ মিশিয়ে খাওয়া হত! তবে যখন থেকে ফ্রিজ এসে হাজির হল, তখন আর ভাত সংরক্ষণের জন্য পানি দেওয়ার দরকার পড়ল না। মানুষ ফ্রিজে ভাত রেখে দিতে পারে, নষ্ট হয় না। পান্তা ভাত তৈরি করার দরকার পড়ে না। বাসায় ফ্রিজ আসার পরেও যে পান্তা খাওয়া হত না, তা না; তবে ধীরে ধীরে সেটা বন্ধ হয়ে গেল।
কোভিডের সময় যখন ঢাকার বাসায় বন্দী অবস্থায় ছিলাম, তখন আমি বেশ কয়েকবার নিয়মিত পান্তা খেতাম সকালে। তখন নিজের রান্না সব নিজেই করতাম। প্রায় দিনই অতিরিক্ত ভাত ফ্রিজে না রেখে পানি দিয়ে রাখতাম। তারপর সকালে সেই পান্তা খেতাম। সারা জীবনের অভ্যাস ছিল যে পান্তায় লবণ আমার মা মিশিয়ে দিতেন। আমি ঠিকমত মেশাতে পারতাম না। তবে ঢাকাতে আর মা পাব কোথায়? নিজেই লবণ মেশাতে হত তখন! অনেক দিন পরে এবার ঈদে গ্রামের বাড়ি গিয়ে পান্তা ভাত খেলাম। রাতের বেলা মা এসে জানতে চাইলেন যে আমি পান্তা ভাত খেতে চাই কিনা। তাহলে ভাতে পানি ঢেলে দেওয়া হবে!
সকালে উঠে দেখি পান্তার সাথে আলু ভর্তা আছে আর আছে ডালের বড়া। একেবারে সেই আগের দিনের মতো। যখন সকালে নিয়মিত পান্তা খাওয়া হত, তখনও এই খাবারটাই আমার সবচেয়ে পছন্দের ছিল। পান্তার সাথে আলু ভর্তা আর ডালের গরম গরম বড়া। একেবারে চুলা থেকেই পাতে এনে দেওয়া হত। কারণ বড়া ঠান্ডা হয়ে গেলে সেটা আর মজা লাগে না। অনেক সময় আমার বাবাকে দেখতাম পান্তার সাথে একটা শুকনা মরিচ ভেঙে নিতেন। এতে নাকি পান্তার স্বাদ আরও বেড়ে যায় যদিও আমি নিজে কখনও চেষ্টা করিনি। বরাবরই আমি ঝাল কম খাই।
পান্তার সাথে আমার আরও একটি পছন্দের খাবার ছিল। সেটা ছিল ইলিশ মাছ। বেশির দিনই এমন হত যে সেই ইলিশ মাছটি আগের দিনের রান্না করা। সেটা গরম করে দেওয়া হত। এছাড়া আরও এক ধরনের ইলিশ মাছ খেতাম পান্তার সাথে। এর প্রচলন সম্ভবত এখন একেবারে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আগে যদি বড় ইলিশ মাছ নিয়ে আসা হত, তখন সবটা তো আর একদিনে রান্না করা হত না। কারণ পরিবারে আমরা মাত্র চারজন। আর তখন ফ্রিজও ছিল না যে ফ্রিজে রেখে দেওয়া যাবে। তাই তখন মাছ সংরক্ষণের জন্য ইলিশ মাছকে হলুদ দিয়ে সিদ্ধ করে সংরক্ষণ করে রাখা হত। সেটার নাম যে কী, এখন আর মনে নেই। এভাবে মাছ দুই-চার দিনেও নষ্ট হত না। তখন ফ্রিজ থাকত কেবলমাত্র অভিজাতদের বাসাতেই। সাধারণ মধ্যবিত্তরাও ফ্রিজ কেনার কথা চিন্তাও করতে পারত না। তাই মাছ সংরক্ষণের এই পদ্ধতি অবলম্বন করা হত। সেই মাছ দিয়ে পান্তা খেয়ে দারুণ লাগত আমার কাছে। এই খাবার সম্ভবত আর কখনও খাওয়া হবে না।
এবার বাসায় গিয়ে এমন কিছু খাবার খাওয়া হল যা অনেক দিন খাইনি। তার ভেতরে একটি হচ্ছে ঝোল খিচুড়ি বা সবজি খিচুড়ি। এই খিচুড়িটা আমার বিশেষ পছন্দ। কিন্তু ঢাকাতে আমার পরিচিত কোনো স্থানেই এই খিচুড়ি পাওয়া যায় না। এখানে সব স্থানেই ভুনা খিচুড়ি। আর সবই পোলাওয়ের চাল দিয়ে তৈরি। ভুনা খিচুড়ি যে ভালো লাগে না, সেটা বলব না, তবে সবজি খিচুড়ির সামনে সেটা কিছু না। আমাদের জেলাতে বড়বাজার পুলিশ মসজিদের পাশে এক লোক এই সবজি খিচুড়ি বিক্রি করতেন। সাথে থাকত ভুনা গরুর মাংস। তিনি সেটা বিক্রি করতেন কেবল সকাল বেলা। এমনও দিন আছে যে খেতে গিয়ে দেখি সব শেষ হয়ে গেছে। এত বিক্রি হত, তবুও তিনি নির্দিষ্ট এক ডেকচির বেশি রান্না করতেন না। সেটা শেষ হয়ে গেলেই চলে যেতেন। আবার পরের দিন। সেই খিচুড়ির স্বাদ যেন এখনও মুখে লেগে রয়েছে। তিনি মারা যাওয়া পরে তার ছেলে চেষ্টা করেছিলেন তবে সেই স্বাদ আর পাওয়া যেত না।
আরেকটা পছন্দের খাবার হচ্ছে শিং মাছের ঝোল। মাছের ভেতরে আমার ইলিশ আর চিংড়ি মাছই সবচেয়ে বেশি পছন্দ। এই দুই মাছ বাদ দিলে অন্য সব মাছ আমার কাছে একই রকম লাগে। তবে শিং মাছের প্রতি আমার আলাদা একটি ভালোবাসা রয়েছে। আমাদের বাসায় যখনই শিং মাছ রান্না করা হয়, তখন কেবল সেটা ঝোল করা হয়। সাথে অন্য কোনো প্রকার তরকারি দেওয়া হয় না। ঢাকাতে বিভিন্ন হোটেলে আমি শিং মাছ খেয়ে দেখেছি। সেখানে নানান ধরনের সবজি দেওয়া থাকে। স্বাদটাই কেন জানি আমার কাছে নষ্ট হয়ে যায় মনে হয়। এবার অনেক দিন পরে বাসায় শিং মাছের ঝোল খেলাম।
প্রতিবার বাসায় গেলে আর কিছু না হোক, এই খাওয়া দাওয়াটা হয় সব মনের মতো। এমন না যে ঢাকাতে আমি না খেয়ে থাকি। সবই হোটেলের রান্না। বাসায় মায়ের হাতের রান্নার সাথে কি সেসবের কোনো তুলনা হয়! এবারও তাই হয়েছে ।
যাই হোক, আজকের এই ফ্যাদা প্যাঁচাল এখানেই শেষ। সবাইকে লেট ঈদ মোবারক!
এই লেখার একটা বিশেষ ব্যাপার হল লেখার বানান গুলো আমি চ্যাটজিপিটি দিয়ে সংশোধন করিয়েছি। আমার লেখায় টুকটাক বানান ভুল থাকে। সম্ভবত এই লেখায় কোন বানান ভুল নেই।
pic source
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জুন, ২০২৪ সকাল ১০:০২