যখন আমরা মাইকোয়া পাড়ায় পৌছালাম তখন প্রায় মধ্যদুপুর। তীব্র রোদ প্রায় মাথার উপরে। একটা খাড়া পাহাড়ে সেই কত সময় ধরে উঠছি তো উঠছি। মনের একটা অংশ বলছিল এখনই একটু বিশ্রাম নিই কিন্তু আরেকটা অংশ বলছিল যে বিশ্রাম নিলেই ক্ষতি! একটু আগেই তো বিশ্রাম নিয়েছি ! যত জলদি পাড়ায় পৌছাবি তত দ্রুত বিশ্রাম নিতে পারবি! তাই উঠছি তো উঠছি! যখন মনে হল যে আর পারছি না, এবার একটু বসতেই হবে তখনই পাড়ার গেটটা চোখে পড়ল । পাহাড়ে প্রতিটা পাড়াতেই এমন করে প্রবেশ মুখে এই রকম গেট থাকে। তার মানে আমার পৌছে গিয়েছি আমার আজকের গন্তব্যে।
গতকালকে আমরা ছিলাম বুলাই পাড়াতে । গতকাল সকালে আলীকদমে এসে পৌছিয়েছি। সকালের নাস্তা শেষ করে বের হতে হতে আমাদের প্রায় বারোটা বেজে গিয়েছিল। একটা দল কোন প্রকার গাইড না নিয়ে বের হয়ে গিয়েছিল। এখানকার নিয়ম যে বাধ্যতামূলক ভাবে গাইড নিয়েই আসতে হবে। সেটা নিয়েই একটু ঝামেলা চলছি। অন্য কোন গ্রুপকে আর বের হতে দিচ্ছিল না। সেই ঝামেলা মেটাতে মেটাতে বারোটা । আলীকদম বাজার থেকে আমরা বারোটার দিকে বাইক নিয়ে বের হলাম। আর্মিক্যাম্প বাইপাস করে পৌছালাম কী যেন একটা বাজারে। বাজারটার নাম ঠিক মনে নেই এখন। সেখান থেকে দেড়টার দিকে আমাদের হাটা শুরু হয়েছিল। সন্ধ্যার একটু আগে আমরা পৌছিয়েছিলাম বুলার পাড়াতে । রাতটা সেখানেই ছিলাম। এরপর সকালে এই মাইকোয়া পাড়ার জন্য রওয়ানা দিয়েছি। সামনের দুটোদিন আমরা এখানেই থাকব।
আমাদের গাইড ফারুক ভাই আমাদের আগেই পাড়াতে পৌছে গিয়েছিল। সে আমাদের ঘর ঠিক করে রেখে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। আমাদেরকে জানালো যে পাড়াতে এখন খুব একটা মানুষ নেই । সবাই গেছে ঝুম কাটতে । আমরা যে ঘরে থাকব সেখানে এক জন মধ্য বয়স্ক মহিলা রয়েছে যে বাংলা তো বলতে পারেই না, বোঝেও না । তবে সেটা অবশ্য কোন সমস্যা হল না খুব একটা ।
এই পাড়াটা আকারে বেশ বড়ই মনে হল । তবে ঘরের সংখ্যা কম । সব মিলিয়ে আট দশটা হবে। আমাদের ঘরটা ছিল একেবারে পাড়ার শেষ মাথায়।
পাড়াতে পানির ব্যবস্থাটা একটু অদ্ভুত । আগের পাড়াটা একটা ঝিরির পাশে ছিল । পানি সেখান থেকেই আসত। তবে এই মাইকোয়া পাড়াটা প্রায় ২২শ ফুট উচুতে । এখানে আশে পাশে কোন ঝিরি নেই। পাড়ার থেকে একটু ঢালে একটা গর্ত করা রয়েছে। গর্তের উপরে ছাউনি। সেখানে পাহাড় চুইয়ে এসে পানি জমা হচ্ছে। কোন ঝিরি না । এই পানি কোথা থেকে যে আসছে সেটা আমি খুজে পেলাম না। তবে এই উৎস হতেই পুরো পাড়ার খাবার পানি সহ অন্য সব পানির চাহিদা মিটছে।
গোসল শেষ করে আবারও ঘরে ফিরে গেলাম। আজকের মত আর কোন কাজ নেই । শুয়ে বসে থাকা আর পাড়া ঘুরে বেড়ানো। আগামীকাল আমাদের বেশ লম্বা একটা হাটা দিতে হবে। বিকেলে দিকে পাড়ার ঘুরতে বের হলাম। দেখলাম পুরো পাড়াতেই আমাদের মত নারিশ্যা ঝিরি দেখতে আসা মানুষে ভরপুর।
সন্ধ্যার দিকে পাড়ার লোকজন ফিরে আসতে শুরু করল । আমরা যে ঘরে ছিলাম সেই ঘরে তিন জন পুরুষ আর দুইজন তরুণী নারী। আর আগেই বলেছিল একজন মাঝ বয়সী নারী। মূলত তিনিই বাড়ির কর্ত্রী। তার দুই মেয়ে। আর দুইজন পুরুষ হচ্ছে তাদের স্বামী। মজার ব্যাপার যেটা খেয়াল করলাম সেটা হচ্ছে, বাসায় আসতেই মেয়ে দুইজন তাদের বোঝা থেকে ধান নামিয়ে সেগুলো মাড়াই করতে শুরু করল । আর ছেলে দুইজনের একজন রান্না করতে বসল। পুরো দিনে যে মাঝে বয়সী নারী ঘরে ছিল সে কিন্তু কোন রান্না করে নি। সে কেবল একটা বাচ্চাকে সামলেছে। আর কোন কাজ সে করে নি। রান্না কাজ এখানে ছেলেরা করে আর বেশি পরিশ্রমের কাজ সব মেয়েরা করে । যে দুইজন ইয়াং ছেলে ছিল ওরা বাড়ির ছেলে না, ওরা বাড়ির জামাই। এখানে ছেলেরা বিয়ের পরে স্ত্রীর ঘরে এসে থাকে।
পরের দিন অন্ধকার থাকতেই আমরা আমাদের যাত্রা শুরু করলাম। এই যাত্রাটা অন্য যে কোন যাত্রার থেকে একটু অন্যরকম । আমরা যখন কোন পাহাড় সামিট করি তখন আমরা উপরের দিকে যাই আর ফেরার সময়ে নেমে আসি । পাহাড়ে উঠতে বেশি পরিশ্রম লাগে আর নামতে কম । আর ফেরার সময়ে শরীর একদম ক্লান্ত থাকে তবে নামতে হয় বলে তূলনামূলক ভাবে সেটা সহ্য হয়ে যায়। কিন্তু এখানে ব্যাপারটা উল্টো। আমরা উচু পাড়াতে রয়েছি আর ঝিরিটা নিচে । অর্থ্যাৎ আমাদের আগে নামতে হবে আর শরীর যখন ক্লান্ত থাকবে তখন উঠতে হবে।
আমরা নয়টার ভেতরেই আমাদের গন্তব্যে পৌছে গেলাম । সেখানে কিছু সময় কাটিয়ে এগারোটার দিকে আবার ফেরার পথ ধরলাম । সত্যিই বলতে কী এবার বেশ পরিশ্রম হয়ে গেল। এতো পরিশ্রম এর আগে অন্য কোন ভ্রমনে হয় নি। সম্ভবত আর আগের মত বয়স নেই। শরীর সহ্য করছে না।
একটা পাহাড় এতো খাড়া ছিল সেটা উঠতেই আমাদের প্রায় দেড় ঘন্টা লেগে গেল । তবে সব দুঃখের মত এই কষ্টও এক সময়ে শেষ হল। পাড়াতে দুইটার দিকে এসে হাজির হলাম । গোসল শেষ করে খেয়ে দেয়ে ঘুম । একঘুমে সন্ধ্যা ।
আদিবাসিদের এই পাড়ার জীবন দেখে আমার বড় লোভ হয় । মনে হয় যে যদি এদের মত এতো সিম্পল জীবন যাপন করা যেত। যদিও এখনও ওদের জীবনের ভেতরে টুকটাক আধুনিকতা ঢুকে গেছে। প্রতিটা বাড়িতেই এখন একটা সোলার রয়েছে। এই সোলার দিয়েই ওদের ঘরে আলো জ্বলে। ছেলেদের হাতে স্মার্ট ফোন । ওরা গান শোনে । ব্লুটুথ স্পিকার রয়েছে।
প্রতিদিন সকালে ওরা সবাই কাজে বের হয়ে যায়। ফিরে আসে বিকেলে। রান্না করে, খাওয়া দাওয়া করে এরপর রাতে ঘুমিয়ে পড়ে জলদি। ঘুমানোর আগে ওরা কিছু সময়ে আড্ডা দেয়। এইঘর ঐঘরের মেয়েরা এক সাথে বসে কিছু সময় হাহাহিহি করে। তরপর আটটা সাড়ে আটটার ভেতরে শুয়ে পড়ে। পরদিন আবার সকাল থেকে কাজ শুরু।
এই পাড়ার সব থেকে ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে এখানে কোন ওয়াশরুম নেই। সবাইকে জঙ্গলে গিয়ে প্রাকৃতিক কর্ম সারতে হয়। কিন্তু তার থেকেও ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে আপনি যখনই এই কাজ সারতে যাবেন তখন আপনার পেছন পেছন আসবে শুকরের পাল। এরাই ওসব খেয়ে একেবারে খেয়ে পরিস্কার করে ফেলে। এই জন্য এরা কোন ওয়াশরুম তৈরি করে না।
পরের দিন সকাল আমাদের ফেরার সময়। যে পথে গিয়েছিল সেই পথেই আবার ফিরে আসা। দুপুরের খাবার খেলাম বুলাই পাড়ার সুলতান ভাইয়ের দোকানে । কথা ছিল হাঁসের মাংস দিয়ে তবে সেটা পাওয়া গেল না।
এখানে একটা আর্মি ক্যাম্প আছে। এই পাড়াতেই একটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ও আছে।
এবার প্রায় এক বছর পরে এসেছিলাম পাহাড়ে। পাহাড়ের জীবন কঠিন এক জীবন। অনেকে বলে যে এখানে কেবল ঘুরতে এলেই বুঝি ভাল লাগবে, থাকতে ভাল লাগবে না। হয়তো সত্যি আবার হয়তো না। একটা চেষ্টা চলছে। একেবারে লম্বা সময়ে পাহাড়ে থাকার একটা ব্যবস্থা করা যায় কিনা দেখা যাক।
কয়েকটি ছবি দিলাম ট্যুরের । যদিও চোখে দেখা আর ছবিতে দেখা দৃশ্যের ভেতরে আকাশ পাতাল পার্থক্য।
ছবিটা দেখতে যতই চমৎকার মনে হচ্ছে বাস্তবে কঠিন রোদ ছিল
জুমঘর
এতো নির্জন এই জায়গাটা
বিখ্যাত ট্রাভেলার
ভোরের মেঘের নদী
দুইদিনের নাইট-স্টে
চলছে রাতের খাবার
ঝিরি পথ পাড়ি দেওয়া
আজকের ব্লগ এখানেই শেষ ।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ রাত ১১:১১