নুহাশ হুমায়ূনের সাইকোলজিক্যাল হরর পেট কাটা ''ষ'' মুক্তি পেয়েছে চরকিতে । বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বাংলা ওয়েব সিরিজের ব্যাপারটা এখনও নতুনই বলা চলে আমাদের দেশে । বাংলা সিনেমা কিংবা বাংলা দেশে তৈরি ওয়েব সিরিজ আমরা টাকা দিয়ে দেখবো এই ধারণাটা এখনও অনেকের ভেতরে পুরোপুরি আসে নি ।
মূলত নূহাশ হুমায়ূের এই ওয়েব সিরিজটা দেখার জন্যই চরকি সাবস্কৃপশন নিয়েছিলাম । পুরো সিরিজ দেখে যদিও মনে হচ্ছে যে পুরোপুরি সন্তুষ্ট নই আমি তবে আবার হতাশও নই । মনে হয়েছে যে বাংলাদেশী সিরিজের মান অনুযায়ী এটা এখনও পর্যন্ত যথেষ্ঠ উন্নত মানের । আর সিরিজটা যখন হরর তখন আমার ভাল লাগার পরিমানটা এমনিতেও একটু বেশি হবে, এটা স্বাভাবিক । তবে সব থেকে বেশি যেই ব্যাপারটা আমার ভাল লেগেছে সেটা হচ্ছে এই সিরিজে আমাদের গ্রাম বাংলার বহু বছর ধরে লোক মুখে চলতে থাকা নানান ভুতের গল্প গুলোর একটা অংশ তুলে আনা হয়েছে । আমরা ছোট বেলাতে আমাদের দাদী নানীদের মুখে যে ভুতের গল্প শুনে বড় হয়েছি এই সিরিজে ঠিক সেই ধরনের গল্প স্থান পেয়েছে । বর্তমান জামানার ছেলে মেয়েরা আসলে এই গল্প গুলো থেকে যোজন যোজন দুরে । সেই হিসাবে এই চেষ্টাটা একটা দারুন শুরু হতে পারে যদি আরও কিছু কাজ হয় এর উপরে ।
সিরিজে মোট চারটা গল্প আছে । প্রথম পর্বটার নাম ''এই বিল্ডিংয়ে মেয়ে নিষেধ'' । যদিও নাম টা এই বিল্ডিংয়ে মেয়ে নিষেধ তবে এটা মূলত একটা মেছো পেতনির গল্প । গল্পের যুবক রাতে কাজ থেকে ফেরার পথে একটা মাছ কিনে নিয়ে রাস্তা দিয়ে ফেরে । ফেরার সময় তার পিছু নেয় মেছো পেতনি । যে মাছ খায় । তারপর সেই পেতনি হাজির হয় তার বাসায় । যুবক তার প্রাণ বাঁচাতে কিভাবে মাছ দিয়ে সেই পেতনিকে সন্তুষ্ট করে সেটা দেখানো হয়েছো পুরো পর্বে । এই রকম কত গল্প আমরা শুনেছি আমাদের দাদী নানীদের কাছে । বাজার থেকে মাছ নিয়ে বাসা ফেরার পথে ভুত নিয়েছে পিছনে । রান্না ঘরে যখন মাছ রান্না করতে গিয়েছে তখন বেড়ার ফাক দিয়ে মাছ চেয়েছে । সেই গল্পটারই যেন আধুনিক রূপ এই পর্ব টা ।
পরের পর্বের নাম হচ্ছে ''মিষ্টি কিছু'' । এই মিথটা আমাদের সবার জানা যে রাতের বেলা কিছু মিষ্টির দোকানে জ্বীন আছে মিষ্টি কেনার জন্য । ঠিক সেই রকম ভাবে এই গল্পেও এক ভুলো মনা মিষ্টির দোকানে একদিন রাতে এক জ্বীন এসে হাজির হয় মিষ্টি খাওয়ার জন্য । মিষ্টির দোকানদারকে সে বলে তাকে অনেক উপর থেকে ফেলা হয়েছে তাই তার এক পা ভাঙ্গা । লাঠিতে ভর দিয়ে চলতে হয় । মিষ্টি খেয়ে সে ভুলো মনা লোকটাকে একটা উপহার দিয়ে যায় । আগে তার কোন কিছু মনে থাকতো না । জ্বীন তাকে সব কিছু মনে রাখার বর দিয়ে যায় । ফলে তার সব কিছু মনে পড়তে থাকে । এমন কি মাতৃগর্ভে সে কেমন ছিল সেটাও । এই যে এতো তীব্র স্মৃতি তার মাথায় এসে জমা হয় এটা দোকানদার সহ্য করতে পারে না ।
তৃতীয় পর্বের নাম ''লোকে বলে'' । এটা গল্পে গ্রামের কিছু প্রচলিত কুসংস্কারের কথা বলা হয়েছে । যেমন খোলা চুলে মেয়েদের সন্ধ্যা বেলা বাইরে যেতে নেই কিংবা খাওয়ার সময় হেচকি উঠলে কেউ আপনার কথা মনে করছে ইত্যাদি । লোকে বলে গল্পে এক কাপল ঘুরতে গিয়ে পথ হারিয়ে এক গ্রামে চলে যায় । সেই গ্রামের নাম জানতে চাইলে সেখানকার লোকেরা বলে এটা হচ্ছে সেই গ্রামে যেই গ্রাম থেকে সকল কুসংস্কারের সৃষ্টি হয়েছে । এক সুন্দর মেয়ের গল্প কিংবা একটা ছোট ছেলের গল্প যে কিনা মেয়েদের সাজ সাজতে পছ্দ করতো । শেষ পর্যন্ত কাপলদের ভাগ্য আসলে কি ঘটে সেটা দেখা যায় ।
চতুর্থ পর্বের নাম ''নিশির ডাক'' । আমাদের ছোট বেলায় সব চেয়ে বেশিবার শোনা গল্প বুঝি এটাই । নিশির ডাক । রাতের বেলা ঘরের বাইরে থেকে নাম ধরে ডাক দেয় । কিন্তু তারা কখনই দুই বারের বেশি ডাকে না । যারা এই ডাকে সাড়া দেয় তারা হারিয়ে যায় । এই গল্পটাই এই পর্বে চিত্রায়িত করা হয়েছে । গল্পের নায়ক কক্সবাজরে কাজ নিয়ে থাকে । তার প্রেমিকা সুইসাইড করে মারা গেছে । কক্সবাজারে বেশ কয়েকদিন ধরেই বেশ কিছু ছোট ছোট টোকাই জাতীয় ছেলে মেয়ে হারিয়ে যাচ্ছে । তার সঙ্গি ছেলেদের মতে তাদেরকে নিশির ডাকে নিয়ে গেছে । গল্পের নায়ক এই গল্পের পেছনে সত্যতা খুজতে বের হয় । এবং এক সময় সেই নিশির ডাকের দেখা পায় । শেষ পর্যন্ত কি নায়ক এই সমস্যার সমাধান করতে পারে নাকি সেও অন্য সবার মত হারিয়ে যায় নিশির ডাকে ? এটা জানতে হলে সিরিজটা দেখতে হবে ।
চারটা পর্ব দেখার পর মিশ্র অনুভূতি হলেও হলেও শেষ পর্যন্ত সন্তুষ্টির চাকাটা পজেটিভ দিকেই । এতোদিন কেবল বিদেশী প্লাটফর্মে বিদেশী চরিত্রেই কাহিনী দেখেছি সেখানে নিজের দেশের মানুষের তৈরি জিনিস পত্র দেখতে বেশ ভাল লাগলো । এমন কাজ গুলো সামনে আরও দেখতে পারলে ভাল হত ।
মুভি মেকিং কিংবা অভিনয় নিয়ে আমার আসলে খুব বেশি কিছু বলার নেই । আমার কাছে একটা মুভি কিংবা সিরিজ দেখার সময় কেবল সেটার কাহিনীটা চমৎকার কিনা এবং সেই কাহিনীটাকে সঠিক ভাবে ফুটিয়ে তুলতে অভিনয় শিল্পী, কলা কুশলীরা ঠিকঠাক মত কাজ করেছে কিনা - এই ব্যাপার গুলো ঠিক থাকলেই হল । অভিনয়ে কিংবা মেকিং একটু উনিশ বিষ হলে কিছু যায় আসে না । এই সিরিজের প্রথম পর্বটা একটু ডাউন ফিলিং দিলেও বাকি তিনটা পর্ব আমার বেশ চমৎকার মনে হয়েছে ।
বাংলাদেশীরা টাকা দিয়ে মুভি সিরিজ দেখার পক্ষে না । টাকা দিলেও তারা বড়জোর নেটফ্লিক্স আর এমাজান প্রাইমের বিদেশী প্লাটফর্মের পেছনে টাকা খরচ করবে । দেশী জিনিস তারা টাকা দিয়ে দেখবে না । কারণ জিজ্ঞেস করলেই বলবে যে দেশী কন্টেন্টের মান ভালনা । এগুলো টাকা দিয়ে দেখার কোন মানে নেই । কিন্তু তারা এটা ভুলে যায় যে যদি আমরা না দেখি তারা ভাল ভাল জিনিস তৈরি হবে কিভাবে? দেশী প্লাটফর্মে এদেশের মানুষ যতবেশি সাবস্ক্রাইব করবে ততবেশি ভাল ভাল কন্টেন্ট তৈরি হবে ।
হ্যাপি ওয়াচিং
ছবি সোর্স
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মে, ২০২২ রাত ২:৫৭