নিষাতের নতুন টিউশনীটা ধানমন্ডি ২৭ নম্বরে। হঠাৎ করেই টিউশনীটা পেয়ে গেছে । যদিও টিউশনীটা করা ওর জন্য খুব বেশি জরূরী নয় তবে বাড়তি কিছু আয় হওয়াটা খারাপ কিছু না ।
টিউশনীর প্রথম দিনই নিষাতের বাড়িটা পছন্দ হয়ে গেল । এতো ব্যস্ত একটা এলাকাতে এই বিল্সিংটা কিন্তু ভেতরে ঢুকলেই মনে হয় অন্য জগতে চলে এসেছি । অন্যান্য বাড়ি গুলোর মত এতো কোলাহলময় নয় । বাসার ভেতরে ঢুকলেই একটা শান্তি শান্তি লাগে । আর লিফটটা প্রায় সব সময়ই ফাঁকা থাকে । কখনই লাইন ধরে কিংবা ধাক্কা ধাক্কি করে উঠতে হয় না । নিষাত শুরুর দিন থেকে প্রায় দিনই একা একাই লিফটে উঠেছে। ফাঁকা লিফট পেলেই নিষাতের গুন গুন করে গান গাইতে ইচ্ছে করে । আবার মাঝে মাঝে লিপস্টিক ঠিক করে নিতে ভোলে না । তবে তিন তলা আসার পরপরই মাঝে মাঝে একটা ছেলে লিফটে উঠতো । ছেলেটা যেত একেবারে ছাদ পর্যন্ত । মাঝে মাঝে নিষাতের সাথে চোখাচোখী হত । শান্ত চোখ দুটো দেখে নিষাতের খারাপ লাগতো না ।
কিছু কিছু মানুষ থাকেই যাদের প্রথম দেখাতেই ভাল লাগে । এটা মেয়েদের একটা আলাদা ইন্দ্রীয় । কোন কারন ছাড়াই যে কোন ছেলেকে প্রথম দেখাতেই ভাল লাগে আবার প্রথম দেখা থেকে তাদেরকে তীব্র ভাবে অপছন্দ করা শুরু করে । নিষাতেরও ছেলেটাকে প্রথম দেখাতেই ভালই লাগলো । অন্তত এই টুকু বলতে পারবে যে ছেলেটাকে খারাপ লাগে নি ।
টিউশনীর প্রথম দিকে ছেলেটার সাথে ওর একবারও দেখা হয় নি । কিংবা দেখা হলেও সে ভাল করে লক্ষ্য করে নি কোন দিন । কিন্তু মাস না পেরোতেই একটা সময় লক্ষ্য করলো ওর লিফট টা যখনই তিন তলার কাছে চলে আসবে তখনই লিফট টা থেমে যেত । তারপর একটা ছেলে লিফটে উঠতো । এমনটা সপ্তাহ এক দিন দুদিন তারপর প্রতিদিনই হতে লাগলো । তখন ছেলেটাকে লক্ষ্য করা শুরু করলো । ছেলেটা মাঝে মাঝেই ওর দিকে তাকাতো । চোখে মুখে একটা তীব্র অপ্রস্তুতের ভাব । যেন খুব একটা অন্যায় কাজ করে ফেলেছে ।
প্রতিটা মেয়েই এই চোখের দৃষ্টি চেনে খুব ভাল করেই । ওকে ছেলেটার ভাল লেগেছে ।
তারপর নিষাত নিশ্চিত হল যে ছেলেটা ওর আসার জন্যই অপেক্ষা করতো । জানলা কিংবা বারান্দা দিয়ে দিয়ে তাকিয়ে দেখতো ও কখন আসে। টিউশনীতে আসার একটা নির্দিষ্ট সময় আছে । একটু সময় নিয়ে খেয়াল করলেই সেটা বের করা সম্ভব । ছেলেটার জন্যও সেটা বের করা মোটেই কষ্টের কিছু না । মনে মনে ঠিক করে নিল যে আজকে ছেলেটার সাথে কথা বলবে । জিজ্ঞেস করবে আসলে ছেলেটা এমন প্রতিদিন কেন করে !
কিন্তু পরদিন ছেলেটার সাথে নিষাতের দেখা হল না । ছেলেটা লিফটে উঠলো না । লিফট চলার সময় লিফট টা যখন তিন তলা ক্রস করছিলো তখন বারবার নিষাতের চোখ সেদিকে যাচ্ছিলো কিন্তু যখন লিফট টা থামলো না তখন খানিকটা হতাশই হল । আজকে ভেবেছিলো ছেলেটার সাথে কথা বলবে আর আজকেই ছেলেটা আসলো না ।
এমনই হয় ! অবশ্য আজকে ছেলেটা আসলেও নিষাত কথা বলতে পারতো কি না সেটা একটা চিন্তার বিষয় । অন্যান্য দিন লিফটে কেবল নিষাত আর ছেলেটা থাকতো কিন্তু আজকে লিফটে নিষাতের সাথে এক মহিলা ছিল । নিষাত এই মহিলার সামনে ছেলেটার সাথে কথা বলতে পারতো কি না কে জানে !
হঠাৎ মহিলা নিষাতের দিকে তাকিয়ে বলল
-তুমি কোন ফ্লাটে থাকো ?
নিষাত একটু হেসে বলল
-আমি এখানে থাকি না আন্টি । ছয় তলাতে রিমনকে পড়াই । প্রাইভেট টিউটর !
-ও আচ্ছা । তাই তো তোমাকে কেমন অচেনা লাগছে ।
বলতে বলতেই লিফট টা থেমে গেল । মহিলার নামার সময় চলে এসেছে । মহিলা নামতে নামতে বলল
-আচ্ছা মা যাই । তবে তুমি একটু সাবধানে থেকো । এই লিফটায় মাঝে মাঝে অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটে । তুমি নতুন তাই তোমাকে সাবধান করলাম ।
নিষাত কি বলবে ঠিক খুজে পেলো না । তবে একটা ব্যাপার ওর তখনই মনে পড়লো । ও যখন লিফটের আজকে উঠতে যাবে তখন খেয়াল করেছিলো যে মহিলা সেখানে দাড়িয়ে ছিল । নিষাতের মনে হয়েছিলো যে মহিলা যেন কারো জন্য অপেক্ষা করছিলো । ওর আসার পরই লিফটে উঠে পড়লো ।
নিষাত কি জিজ্ঞেস করবে তার আগেই লিফটের দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল । নিষাত খানিকটা চিন্তিত মনেই রিমনদের বাসায় হাজির হল । পুরো পড়ানোর সময় নিষাতের মনে কেবল মহিলার কথাই ঘুরতে লাগলো । মহিলা কেন ঐ কথাটা বলল । লিফটে কেন অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটে । পড়ানোর শেষ করেই রিমনের কাছেই প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করলো ।
রিমন চোখ সরু করে তারপর গলা নামিয়ে বলল
-আপু আম্মু আপনাকে বলতে মানা করেছে যাতে আপনি ভয় না পান ।
নিষাত বলল
-কি বলতে মানা করেছে ?
রিমন খানিকটা সময় চুপ করে রইলো । এখনও ঠিক বুঝতে পারছে না । তারপর বলল
-আপু আপনি কিন্তু আম্মুর কাছে বলবেন না । তাহলে কিন্তু আম্মু বকবে আমাকে !
-আচ্ছা বলব না । বল ।
-আপনি এই ২৭ নাম্বারের একটা ভুতের ফ্ল্যাটের কথা শুনেন নাই যে ফ্ল্যাটে কেউ থাকতে পারে না ?
নিষাত কিছু টা সময় বোকার মত তাকিয়ে রইলো তার ছাত্রের দিকে । ধানমন্ড ২৭ নাম্বারের ভুতুরে ফ্ল্যাটের বাড়িটার কথা সবাই জানে । আধুনিক একটা ফ্ল্যাট কিন্তু এই ফ্ল্যাটে কেউ থাকতে পারে না । যে এই ফ্ল্যাট টার মালিক সে অনেক চেষ্টা করেছে, নিজে থাকার চেষ্টা করেছে আবার ভাড়া দেওয়ার চেষ্টা করেছে কিন্তু কোন লাভ হয় নি । এখানে কেউ থাকতে পারে নি । শেষে আর না পেরে ফ্ল্যাট টা খালিই ফেলে রেখেছে । রিমন বলল
-আমাদের এই বিল্ডিংয়ের তিন তলাটার ফ্ল্যাটটা হচ্ছে সেই ফ্ল্যাট টা !
নিষাত কেবল চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো রিমনের দিকে ।
রিমন আবারও বলল
-এমনিতে কোন সমস্যা নেই । আমাদের কোন সমস্যা হয় না । কিন্তু ঐ ফ্ল্যাটে থাকতে গেলেই যত সমস্যা । আর .....
-আর ?
-আর মাঝে মাঝে তিন তলায় লিফট টা থেমে যায় । ওখান থেকে কেউ ওঠে ।
এবার সত্যিই সত্যিই চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো নিষাত । এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না । রিমন বলল
-আপু আপনার চেহরা এমন কেন লাগছে ?
নিষাত কি বলবে খুজে পেল না । কি বলা উচিৎ তাও বুঝতে পারছে না । রিমন বলল
-আপু আপনি একদম ভয় পাবেন না । লিফটে অনেকেই ছেলেটাকে দেখেছে । তবে ছেলেটা কোন দিন কারো ক্ষতি করে নি ।
ক্ষতি না করুক যদি কেউ জানতে পারে ওর সাথে একজন অশরীরী লিফটে উঠেছে তাহলে কারো পক্ষেই স্থির থাকাটা সম্ভব না । নিষাতও স্থির থাকতে পারলো না । আজকে লিফটে উঠতে গিয়ে ইতস্তত করতে লাগলো । লিফট দিয়ে যাবে নাকি সিড়ি দিয়ে যাবে সেটা সিদ্ধান্ত নিতে পারলো না । তারপর ভয়ে ভয়ে লিফটের সুইট টিপ দিল । এতো দিনে একবারও লিফট নামার সময় ছেলেটার সাথে দেখা হয় নি । প্রতিবার ও যখন লিফটে উঠেছে তখনই ছেলেটা লিফটে উঠেছে । এখন নামাটা সম্ভবত নিরাপদ ।
লিফট টা যখন এসে থামলো তখনও নিজের কাছেই খানিকটা ভয়ভয় করছিলো । যদি আজকেও তার সাথে দেখা হয়ে যায় ? তখন ?
লিফট টা নামতে শুরু করলো । নিষাতের বুকটা একটু একটু দুরুদুরু করতে লাগলো । যতই নিচে নামতে লাগলো ততই নিষাতের ভয়ের পরিমানটা বাড়তে লাগলো । ৫, ৪, ৩... যাক পার হয়ে যাচ্ছে । নিষার একটু নিশ্চিত হতে পারছে এখন । ঠিক সেইসময় লিফট টা ঝাকি খেল । আর সাথে সাথেই অন্ধকার হয়ে এল । বিদ্যুৎ চলে গেছে !
নিষাত চিৎকার দিয়ে উঠলো । নিষাত কেবল অনুভব করলো তীব্র একটা ভয় চেপে বসেছে । বুকের ভেতরে লাফাতে শুরু করলো প্রবল ভাবে । যেন বুকের খাঁচার ভেতর থেকে হৃদপিন্ডটা বের হয়ে আসবে ?
কি করবে এখন ?
এই অন্ধকারের ভেতরে ও কি করবে ?
কয়েক সেকেন্ড পার হল । নিষাতের কাছে কেবল মনে হল যেন অনন্ত কাল ধরে সে অন্ধকারের ভেতরে দাড়িয়ে আছে । তারপরই লাল আলো জ্বলে উঠলো । ইমার্জেন্সী আলো ।
কিন্তু নিষাতের মনে হল আলোটা না জ্বললেই ভাল হত । অন্ধকারে কাউকে দেখা যাচ্ছিলো না । তবে লাল আলো জ্বলে ওঠার সাথে সাথেই নিষাত দেখতে পেল লিফটের ভেতরে সে একা নেই । সেই ছেলেটা রয়েছে । ওর দিকে তাকিয়ে আছে ! লাল আলোতে ছেলেটার জ্বলতে থাকা চোখ দেখতে পেল সে । নিষাতের মনে হল ও এখনই মারা যাবে । আজকেই এই দুনিয়াতে ওর শেষ দিন !
এখনই এই অশরীরীটা ওর উপর ঝাপিয়ে পড়বে । ওর রক্ত চিবিয়ে খাবে ! নিষাত আবারও চিৎকার করতে গেল কিন্তু ওর মুখ দিয়ে কোন আওয়াজ বের হল না । ও যেন ঠিক মত নিঃশ্বাস নিতে পারছে না ।
আর তখনই মোলায়েন কন্ঠ শুনতে পেল ।
-নিষাত পেও না !
নিষাত চোখ বড় বড় করে সামনে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে রইলো । কিন্তু কোন কথা বলতে পারলো না । ছেলেটা আবার বলল
-আমি চাই নি তুমি আমাকে এভাবে আবিস্কার কর !
নিষাত ছেলেটার চোখে একটা বিষাধের ছায়া দেখতে পেল । ছেলেটা আবার বলল
-আমি কারো কোন ক্ষতি করি নি । আর তোমার ক্ষতি তো করতেই পারবো না কোন দিন । তুমি ভয় পেও না । আমাদের আর কোনদিন দেখা হবে না ।
বলে ছেলেটা একভাবেই নিষাতের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো । নিষাত অনুভব করলো ওর মন থেকে হঠাৎ করেই যেন ভয়ের অনুভূতিটা চলে যাচ্ছে । ছেলেটার চোখে একটা তীব্র বিষাদের ছায়া দেখতে পাচ্ছে ।
কত সময় তাকিয়ে ছিল নিষাত বলতে পারবে না দেখলো লাল ইমার্জেন্সী আলো নিভে গিয়ে আবারও স্বাভাবিক আলো জ্বলে উঠলো । সাথে সাথেই লিফট চালু হয়ে গেল । নিষাত দেখতে পেল লিফটে ও ছাড়া আর কেউ নেই । অবাক হয়ে কেবল তাকিয়ে রইলো । এতো সময় ওর সাথে কি হল ও বুঝতে পারলো না ।
লিফট থেকে বের হয়ে দেখতে পেল বিল্ডিংয়ের দায়োয়ান দাড়িয়ে আছে । ওর দিকে তাকিয়ে বলল
-আফা মনি ভয় পাইছেন ?
নিষাত বলল
-না । অন্ধকার হয়ে গিয়েছিলো তাই ?
-এই বাড়ির জেনারেটরে একটু সমস্যা আছে । তাই চালু হইতে এক দুই মিনিট সময় লাগে !
-আচ্ছা সমস্যা নেই !
নিষাত হাটতে শুরু করলো । বাইরে বেরিয়েও ছেলেটার বিষাদভরা চোখ দুটো নিষার কিছুতেই ভুলতে পারলো না । আসলেই তো ছেলেটা তো ওর কিংবা অন্য কারো কোন ক্ষতি করে নি । তাকে ভয় পাওয়ার এতো কারন ছিল না ।
তারপর আরও দুই বছর নিষাত টিউশনীটা করেছিলো কিন্তু কোন দিন সেই অশরীরী ছেলেটার সাথে ওর দেখা হয় নি । ছেলেটা তার কথা রেখেছে না দেখা দিয়ে !
(সমাপ্ত)
থিম ফ্রম দিস স্টাটাস
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা মে, ২০১৮ রাত ৯:৩৫