মিতু জানতো ওর সাথে কথা বলার জন্য লিলি ঠিকই ওর রুমের বাইরে দাড়িয়ে থাকবে । ক্লাস নেওয়ার সময়ই মিতুর মনে হয়েছিলো মেয়েটা আসবে । লিলির চোখে যেমন বিশ্ময় ছিল তেমনি মিতু নিজেও অবাক হয়েছে । লিলি যে ওর নিজের ইউনিভার্সিটিতেই ভর্তি হবে এটা মিতুর ধারনায় বাইরে ছিল । মেয়েটা কিংবা ওদের পরিবারের সবাইকে ও একেবারে মন থেকে বের করে দিয়েছিলো । যদিও তাকে ভুলতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে মিতুর !
কিন্তু আজকে আবার সব কিছু চুরমার হয়ে গেল । যে দেওয়ারটা সে তৈরি করে ছিল নিজের কাছেই সেটা আবারও আজ ভেঙ্গে যাবে । যেটুকু এখনও বাকি সেটাও নষ্ট হবে !
কাজ শেষ করে বের হতেই দেখলো বারান্দায় দাড়িয়ে আছে লিলি । ওকে দেখে একটু হাসলো । তারপর বলল
-কেমন আছেন ম্যাম ?
লিলির মুখে ম্যাম ডাক শুনে একটু যেন অস্বস্থি লাগলো । মিতুর বলল
-ম্যাম !
-আপনি টিচার ম্যামই তো ডাকা উচিৎ !
-হ্যা তা ঠিক । তবে ক্লাসের বাইরে আগে যা ডাকতে তাই ডেকো । কেমন !
লিলি যেন কথা শুনে খুশি হল । একটা সময় লিলি ওকে আপুই ডেকেছে অনেক ! মিতু বলল
-তোমাকে এখানে দেখবো ভাবি নি ।
-আমিও না !
ওরা হাটতে হাটতে হাটতে ইউনিভার্সিটির ক্যাফেটরিয়ার দিকে এগিয়ে গেল । দুইটা কফির অর্ডার দিয়ে লিলির কথা শুনতে লাগলো । মিতু অনেক সময় ধরেই যে কথাটা জিজ্ঞেস করবে কি না ভাবছিলো শেষ পর্যন্ত বলেই ফেলল ।
-তোমার ভাইয়ার কি খবর ?
প্রশ্নটা শুনতেই লিলির মুখটা খানিকটা মলিন হয়ে গেল । বলল
-জানি না আপু !
মিতু অবাক হয়ে গেল । বলল
-জানো না মানে ?
-ভাইয়া কোথায় আছে আমরা জানি না । ঐ ঘটনার পরে ভাইয়া বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে । বাবা মায়ের সাথে আর কথা বলে নি ।
মিতু আসলেই অবাক হল কথাটা শুনে । ছেলেটা এমন কাজ করবে সেটা বুঝতেই পারে নি । দুই বছর শাহেদ বাসা ছেড়ে চলে গেছে । কারো সাথে যোগাযোগ রাখে নি ।
কেবল ওর জন্য ?
শাহেদের সাথে দুবছর আগে মিতুর পরিচয় হয় । খুব স্বাভাবিক ভাবে । দুই পরিবারের ভেতরে যোগাযোগ হয় দুজনের বিয়ের ব্যাপারে কথা বার্তা বলার জন্য । মিতুর তখন অনার্স শেষ করে মাস্টার্স করছে অন্য দিকে শাহেদ চাকরিতে ঢুকেছে । কথা বার্তা বেশ ভালই চলছিলো । শাহেদকে প্রথম দেখাতেই মিতুর ভাল লেগে গেল । একটু রোগা তবে চেহারার ভেতরে একটা মায়া রয়েছে । সব ছেলের চোখ এতো গভীর হয় না ।
মিতুর এটাও বুঝতে কষ্ট হল না যে শাহেদেরও ওকে খুব পছন্দ হয়েছে । সেই ধারনা আরও বিশ্বাসে পরিনত হত যখন পরদিনই শাহেদকে ওর ক্যাম্পাসের সামনে দেখলো । এদিক ওদিক হাটাহাটি করছে । মিতুর মজা লাগলো । একবার মনে হল কিছু সময় শাহেদ ঘুরানো যাক পরে মনে হল দরকার নেই ।
এমন একটা ভাব করে বের হল যেন শাহেদ কে ও দেখতেই পায় নি । রাস্তায় বের হয়ে দেখা হবে । মিতু জানে শাহেদও ওকে দেখে কি বলবে ! বলবে যে এদিক দিয়েই যাচ্ছিলো একটা অফিসের কাজে ।
শাহেদ ওকে দেখেই হাত নাড়লো । মিতু এগিয়ে গেল ওর দিকে । বলল
-আপনি এখানে ? অফিসের কাজে এসেছিলেন বুঝি ?
শাহেদ বলল
-না ! তোমার সাথে দেখা করতে এসেছি ।
মিতু একটু অবাকই হয়েছিলো । ছেলেটা যে ওর প্রেমে পড়েছে সেটা সে একটুও লুকানোর চেষ্টা করছে না । সেদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত মিতু সাহেদের সাথেই থাকলো । মিতুর নিজেরও যে সাহেদের সাথে থাকতে ভাল লাগছিলো সেটা সে অস্বীকার করলো না ।
তারপর প্রায়ই দিনই শাহেদ অফিস শেষ করে ওর হলের সামনে এসে হাজির হত । কখনও রেস্টুরেন্টে কিংবা ওদের ক্যাম্পাসেরই কোথাও বসে গল্প করতো । আর ফোনে তো কথা আছেই ।
এভাবেই কখন যে দিন চলে যেতে লাগলো মিতুর ঠিক বুঝতেই পারে নি । মিতুর গায়ের রং ছিল একটু চাপা ধরনের । এই নিয়ে মিতুর কানে নানান কথা আসতো মাঝে মাঝেই । ওর বাবা মাও চিন্তায় ছিল ওর বিয়ে নিয়ে । কিন্তু শাহেদের চোখে ও এমন কিছু দেখে নি কোন দিন । বিশেষ করে এই ব্যাপারটাই ওকে সব থেকে বেশি পছন্দ হল ।
বিয়ের কথা বার্তা একদম প্রায় পাকা হয়ে গেল তখনই মিতু একটা কথা জানতে পারলো । কথাটা ওর বাবা মাও ওর কাছ থেকে লুকিয়েছিলো । শাহেদদের পরিবার থেকে বেশ ভাল পরিমানে যৌতুক চাওয়া হয়েছে এবং সেটা নাকি হয়েছে ওর গায়ের রংয়ের জন্য । এমন মেয়ের বিয়ে নাকি যৌতুক ছাড়া হয় না । ওর বাবা মাও ব্যাপারটা ওর কাছ থেকে গোপনই রাখতে চেয়েছিলো কিন্তু সেটা ও জেনে ফেললো ।
মিতুর কেবল মনে হল ওকে কেউ বিক্রি করে দিচ্ছে । এতো ছোট লাগলো নিজের কাছে । তারপর থেকেই মিতুর বিয়ের জন্য বেঁকে বসলো । কোন ভাবেই সে আর বিয়ে করবে না । ওর বাবা মা প্রথমে ওকে বুঝতে চেষ্টা করলো কিন্তু মিতুর এক কথা সে কোন ভাবেই বিয়ে করবে না । এইখানে করবেই না ।
শাহেদের সাথেও দেখা করা বন্ধ করে দিল । শাহেদ অনেক কয়বার ওকে ফোন দিন মেসেজ করলো এমন কি ওর হলের সামনেও এসে দাড়িয়ে থাকতে লাগলো কিন্তু মিতুর মন গললো না । শাহেদ কে দেখলেই ওর মেজাজ টা আরও গরম হয়ে যেত । একদিন ক্লাসে যেতে গিয়ে শাহেদ ওর সামনে এসে হাজির হল । ওকে বোঝাতে চেষ্টা করলো যে ও এসবে রকিছুই জানতো না কিন্তু মিতুর সেসব কথায় কান দিল না । সাহস করে শাহেদ ওর হাতটা ধরতেই মিতুর মাথায় যেন আরও আগুন চেপে গেল । ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিল শাহেদের গালে ।
চড়টা মারার পরে মিতু নিজেই খানিকটা অবাক হল । শাহেদ কেবল বিশ্ময় নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুটা সময় । সেদিন মিতু শাহেদের চোখে কি নিদারুন অভিমান দেখেছিলো যা এখনও মাঝে মাঝে মিতুর চোখের সামনে ভাসে ।
ঐ দিনের পরে শাহেদ আর কোন দিন মিতুর সামনে আসে নি । আজকে লিলির কাছ থেকে শুনতে পেল ঐদিনই শাহেদ বাসা ছেড়ে চলে গিয়েছিলো । যে চাকরিটা করতো সেটাও ছেড়ে দিয়েছিলো । সে কোথায় আছে কেউ বলতে পারে না । কারো সাথেই যে কোন যোগাযোগ রাখে নি ।
লিলি উঠে যাওয়ার সময় বলল
-আপু একটা কথা আপনাকে বলি । আপনি বিশ্বাস করবেন কি না জানি তবুও বলি । ভাইয়া আপনাকে অনেক পছন্দ করতো । অনেক বেশি । এখনও করে । আর ঐ যৌতুকের ব্যাপারে আমি কিংবা ভাইয়া আমরা কেউ জানতামই না । আমি জানলেও ভাইয়াকে বলতাম । ভাইয়া কোন দিন এটা হতে দিত না !
মিতু কি বলবে ঠিক খুজে পেল না । কথাটা মিতু নিজেও এতো দিন জানতো । কেবল সেই সময় তীব্র রাগের কারনে সেটা ঊপলব্ধি করতে পারে নি । শাহেদ যে তীব্র চোখে ওর দিকে তাকাতো সেই চোখ কোনদিনও ওর কাছে মিথ্যা বলতে পারে না এটা মিতু নিজেও জানতো ।
এতো দিন সব কিছু জোর করে মন থেকে দুর করে রেখেছিলো কিন্তু আজ থেকে আবার সেই কষ্ট টা মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো । রাতে কিছুতেই ঘুম এলো না । বারবার কেবল সেই শাহেদের গভীর চোখে তাকিয়ে থাকাটা ওর চোখের সামনে ভেসে উঠছিলো । কি ঘোর লাগা চোখেই না ছেলেটা ওর দিকে তাকাতো !
সেদিন যদি মিতু ছেলেটার কথা শুনতো তাহলে আজকে হয়তো শাহেদ সব কিছু ছেড়ে যেত না । সেদিন ওর শোনা উচিৎ ছিল হয়তো । সেদিন ওর একটু বোঝার দরকার ছিল যে ছেলে ওর দিকে ওমন ঘোর লাগা চোখে তাকাতে পারে সেই ওমন কাজ করতে পারে না । তাহলে হয়তো ওদের দুজনের কারোরই জীবনই এমন থাকতো না । ওর মতই শাহেদও নিশ্চয়ই রাত জেগে ওর কথা ভাবছে ।
জীবন এমনই । মাঝে মাঝে মানুষ এমন কাজের শাস্তি ভোগ করে যেটা সে করে নি । মিতুর গায়ের রংয়ের ব্যাপারে ওর নিজের হাত ছিল না তবুও ওকে কত কথাই শুনতে হয়েছে জীবন ভয় । আর শাহেদকে সেই শাস্তিই ভোগ করতে হচ্ছে যেটার ব্যাপার তার কোন ধারনাই ছিল না । জীবন হয়তো এমনই ! কারো গল্প গুলো অসমাপ্তই রয়ে যায় !
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে ডিসেম্বর, ২০১৭ রাত ১০:২৯