-ছেলে কি করে ?
বাবার কথাটা শুনেই মাথায় আগুন ধরে গেল । কেন গেল সেটা আমি নিজেও ঠিক মত বুঝতে পারলাম না । বললাম
-ছেলে কি করে সেটা শুনে কি করবে শুনি ?
সকালবেলা নাস্তা এক সাথে করা হয় বাবা মায়ের সাথে । গত প্রায় এক বছর ধরে এই হচ্ছে আমার রুটিন । সকাল বেলা এক সাথে নাস্তা করি । তারপর হাসপাতালের জন্য বের হয়ে যাই । যেদিন নাইট ডিউটি থাকে সেদিন আর রাতে খাওয়া হয় না এক সাথে । কিন্তু সকালে ডিউটি শেষ করে ঠিক চলে আসতে পারি সময় মত । আজকেও নাস্তা করছিলাম তখনই বাবাকে অপুর কথাটা বলতেই বাবা প্রথম যে কথাটা বলল সেটা হল ছেলে কি করে ! সেটা শুনেই আমার মাথায় আগুন ধরে গেল ।
আমার কন্ঠ স্বরে এমন কিছু ছিল যে বাবা আমার দিকে খানিকটা অবাক হয়ে তাকালো । সেটা সামলে নিয়ে বাবা বলল
-আশ্চর্য তুই রেগে যাচ্ছিস কেন ? ছেলে কি করে শুনতে হবে না ? একটা ভাল ছাড়া ....
আমার নিজেকে নিয়ন্ত্রন করা উচিৎ ছিল কিন্তু কেন জানি রাগটা আরও বেশি বেড়ে গেল । বাবার কথা শেষ করতে না দিয়েই বললাম
-কই তুমি খুজে খুজে নিয়ে এসেছিলেন না তোমার ভাল সভ্য আর প্রতিষ্ঠিত ছেলে ! নিয়ে এসেছিলে না ? খুব তো দেখলাম !
আমি জানি এই কথাটার জবাব বাবা দিতে পারবে না । কোন কথা না বলে আহত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো । আমি বুঝতে পারছি যে আমার এখনই থেমে যাওয়া উচিৎ তবে আমি নিজেকে থামাতে পারলাম না । বাবা এবার কোন কথা বলল না । মা পাশেই বসে ছিলো । সেও আমার এরকম আচরনে বেশ অবাক হয়ে গেছে । বলল
-আরে এমন করে কথা বলছিস কেন ? আমরা কি তোর খারাপ চাই নাকি ? ভালই তো চাই । ভাল মন্দ দেখবো !
-ও মা প্লিজ । তোমরা আমার যথেষ্ঠ ভাল করেছো । সেই ফল তো আমি দেখতেই পাচ্ছি । আর আমার ভাল দেখার তোমাদের দরকার নেই । দয়া করে আমার ভাল আমাকে দেখতে দাও !
আর বসতে মন চাইলো না । বসে থাকলে হয়তো আর মেজাজ খারাপ হয়ে যাবে । হাসপাতালের জন্য বের হয়ে এলাম । নিজের কাছে খানিকটা অবাক লাগছে যে আমি একটু আগে এমন আচরন করলাম । ইদানিং হঠাৎ হঠাৎ আমার মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে । বিশেষ করে আমার পরিবারের সদস্যদের উপর । এর পেছনে অবশ্য কারনও আছে ।
ছোট বেলা থেকেই আমার সব কিছু আমার বাবা আর মা ঠিক করে দিয়েছে । কোনটা পরতে হবে কোন টা খেতে হবে কোথায় যেতে হবে আর কে কে আমার বন্ধু হবে । ইন্টারের পর আমার খুব ইচ্ছে ছিলো ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়বো কিন্তু বাবার এক কথা মেয়েকে ডাক্তার হতেই হবে । মেডিক্যালের পাঁচটা বছর আমার উপর যে কি পরিমান ঝড় বয়ে গেছে সেটা কেবল আমি নিজে জানি । ইন্টার্নী করার মাঝেই আমার বিয়েও হয়ে গেল বাবার পছন্দ মত ছেলের সাথে । আমি টু শব্দটা করতে পারলাম না । কি যে হতাশ আর অসহায় লাগছিলো নিজের কাছে তখন !
বিয়ের ছয় মাসের মাথায় আমার বরের আসল চেহারা দেখতে পেলাম । সে নিজেও ছিল ডাক্তার কিন্তু আমার সাথে তার আচরন ছিলো জানোয়ারের মত । কয়েকবার বাসায় বলার পরেও বাবা মা বলতে লাগলো মানিয়ে নিতে কিন্তু যখন সে মেরে আমার হাত ভেঙ্গে দিল তখনই তখন আমি আর মানিয়ে নিতে পারলাম না ।
বাবাকে খানিকটা বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলো আমি যখন জামিলকে ডিভোর্স দিতে যাচ্ছিলাম । সেদিনই জীবনে প্রথমবারের মত আমি বাবার সাথে উচু গলায় কথা বলেছিলাম । বাবা কেবল অবাক হয়ে আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল । আমাকে যেন ঠিক মত চিনতেও পারছিলো না । আর সে আমার কাজে বাঁধা দেয় নি । আমি কেবল জামিলকে ডিভোর্সই দিলাম না তার নামে নারী নির্যাতন মামলাও দিয়ে দিয়ে দিলাম । সেই কেইস এখনও চলছে । সে আটকানোর চেষ্টায় আছে অনেক । কিন্তু খুব একটা লাভ হবে না ।
তারপর থেকেই আমি বাবা মায়ের সাথেই আছি । তবে সেই ব্যাপারটা আমার মধ্যেই রয়েই গেছে । আমার কেন জানি তাদের উপর হঠাৎ হঠাৎ রাগ উঠে যায় । বারবার মনে হয় তাদের জন্যই আজকে আমার এই অবস্থা !
হাসপাতালের গেট দিয়ে ঢুকতে যাবো তখনই তাকিয়ে দেখি অপু সামনের চায়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছে । আজকে আমাদের দেখা করার কথা ছিল । রাস্তায় জ্যামের কারনে আমি ঠিক সময় আসতে পারি নি । পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম সেদিকে । আমাকে দেখেই হাসলো ও । তারপর বলল
-চা খাবেন নাকি ?
-চেম্বারে চলুন । ওখানে খাওয়াচ্ছি ।
- আরে চেম্বারের চা তো আছে । কিন্তু রাস্তার টঙয়ের দোকানের চায়ের কোন তুলনা হয় না । খেয়েই দেখুন না !
আমি কিছু না বলে অপুর দিকে কিছুটা সময় তাকিয়ে রইলাম । আমার নিজের কাছেই খানিকটা অবাক লাগলো যে এই ছেলেকে বিয়ে করার জন্য আমি একটু আগে বাবার সাথে খারাপ ব্যবহার করে চলে এসেছি ।
অপুর ব্যাপারে আমি প্রথমে জানতে পারি নীলার কাছ থেকে । নীলা যে অফিসে চাকরি করতো ছেলেটাও সেই অফিসেই ছিল । একটা পর্যায়ে পারিবারিক ভাবেই ওদের বিয়ের কথা বার্তা চলছিলো । সব কিছু ঠিকই চলছিল হঠাৎ করেই যেদিন ওদের এঙ্গেইজমেন্ট হওয়ার কথা তার আগের দিন শোনা গেল অপু নাকি চাকরি ছেড়ে দিয়েছে । পরে জানা গেল ছেলেটা নাকি এর আগেও এমন করেছে । চাকরি বাকরি করে আবার ছেড়ে দেয় ।
এমন ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে দিতে চাইলেন না নীলার পরিবার । নীলাও যে অপুর প্রেমে পড়েছিলো সেটা না, পারিবারিক ভাবে বিয়ে হচ্ছিলো বলেও সে রাজি হয়েছিলো । অপুর কথা ছিলো নীলা তো চাকরি করছেই । ও না হয় পরে আবার শুরু করবে যখন দরকার । এমন কথা শুনে আর বিয়েই হয় নি ।
তারপর মাস দুয়েক আগে ওরই একটা বন্ধুর বিয়েতে গিয়ে অপুর সাথে পরিচয় হয় । অপুর কথা আগে থেকেই জানতো তাই তার ব্যাপারে একটু কৌতুহল ঠিকই হয়েছিলো । নিজ থেকে কথা বলেছিলাম । বলতে গেলে ভাল লেগেছিলো কথা বলে । মনে হয়েছিলো আরও কিছুটা সময় ছেলেটার কথা বলা যায় ।
আমি তখনও অপুকে বিয়ের কথা চিন্তাও করি নি । কেবলই মিশছিলাম । ওর চাকরি করছিলো না, ওর হাতে অনেক সময় । মাঝে মাঝে যখন নাইট ডিউটি থাকতো তখন রাতে ওকে ফোন দিতাম । ওর সাথে কেন যেন কথা বলতে ভাল লাগতো । ভাল লাগাটা দিন দিন বাড়ছিলোই । তার কারনটা ছিল যে আমার আর ওর গল্পটা অনেকটাই একই রকম । আমাকে আমার পরিবার যেমন ঠিক মত নিঃশ্বাস নিতে দেয় নি ঠিক তেমনি ভাবে অপুকেও ওর পরিবার ঠিক মত নিঃশ্বাস নিতে দেয় নি নিজের মত করে । সারা জীবন নিজেদের ইচ্ছেটা চাপিয়ে দিয়েছে অপুর উপর । এই জন্যই হয়তো আমাদের কথা বলতে ভাল লাগতো । সেটা কেবলই ভাল লাগা ছিলো । কিন্তু গত সপ্তাহে একটা ঘটনা ঘটে যাওয়ার ফলে আমার বারবাই মনে হচ্ছে অপুকে বিয়ে করা যায় !
সেদিন অপুর সাথেই বাইরে বের হয়েছিলাম বিকেলে । একটা কফিশপে বসে কথা বলছিলাম । তখনই আমার প্রাক্তন স্বামী এসে হাজির । অপু তখন ওয়াশরুমে গিয়েছে । জামিল এসে আমাকে বলতে লাগলো যে আমি যেন কেইস তুলে নিই । আমি ওর সাথে কথা বলতে চাইছিলাম না কিন্তু সে নাছর বান্দার । তারপর আমাকে দেখে নেবে বলে হুমকি দিতে লাগলো ।
ঠিক তখনই অপু সেখানে হাজির । আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-কি ব্যাপার সমস্যা কি ?
আমি কোন কথা না বলে বললাম
-এখান থেকে চলুন তো ।
অপু বলল
-কি হয়েছে ? বললেন তো !
জামিল ওকে দেখে বলল
-বাহ এরই মধ্যে নতুন নাগর জুটিয়ে ফেলেছো ?
অপু এবার জামিলের দিকে তাকিয়ে বলল
-ভাই সাহেব আপনার সম্ভবত মাথা ঠিক নাই । আপনি এখানে থেকে চলে যান দয়াকরে !
জামিলের তখনই আসলেই মাথা ঠিক নেই । ও ঠিক মেনে নিতে পারছেনা আমি নতুন কোন ছেলের সাথে ঘুরছি । বিয়ের পরেও তার মনভাব এমন ছিলো । আমাকে বাইরের কারো সাথে মিশতে দিবে না । ছেলে কোন বন্ধু তো থাকতেই পারবে না । এমন কি ডিভোর্সের পরেও এটা সে মেনে নিতে পারে নি যে আমি ওকে ছেড়ে দিয়েছি । কথা বার্তার এক পর্যায়ে জামিল আমার হাতে ধরে টান দিতে চাইলো । আমাকে নিয়ে যাবে এমন একটা ভাব ।
ব্যাস তারপর অপুর চেহারাই বদলে গেল । ঝট করে জামিলের কাছ থেকে আমার হাত সরিয়ে নিল । তারপর কষে এক চড় মারলো তার গালে । এতো জোরেই আওয়াজ হয়েছে যে আমি অবাক হয়েছি জামিল নিজেও অবাক হয়ে গেছে । হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে । কফিশপের অন্যান্য মানুষেরা এতো সময় আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিলো । তারাও অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো । কেউ বুঝতে পারে নি অপু এমন কিছু করবে ।
অপু তারপর চিৎকার করে ম্যানেজারকে ডাক দিলো । ম্যানেজারের দিকে তাকিয়ে বলল
-এই মানুষটা আমার ফিয়ন্সে কে ডিসটার্ব করছে সেই কখন থেকে । আপনারা কি একে বের করবেন নাকি আমরা বের হয়ে যাবো !
আমাদের কথায় সমর্থন দিয়ে পাশ থেকে কয়েকজন বলল যে আসলেই এই জামিল আমাদেরকে ডিসটার্ব করছে । আর কিছু বলতে হল না । কফিশপের সিকিউরিটি চলে এল । জামিলকে নিয়ে গেল !
তারপর থেকেই আমার কেন সারাটা সময় অপুর কথাই মনে হচ্ছে । গত কালকে ওকে বলেছিলো যে আমি ওকে বিয়ে করতে চাই । আমার সব ব্যাপারে ও সব জানতোই ! ওর কাছে সব কিছুই শেয়ার করেছিলাম আমি । আমাকে বলল
-বেকার ছেলেকে বিয়ে করবেন ?
-হ্যা করবো ।
-সত্যি !
-আমার কোন সমস্যা নেই ।
তারপর বলল যে ও আমার কথা ও বাসায় বলবে । কালকেই জানাবে । আজকে তাই আমাকে জানাতে এসেছে । আমিও এদিকে বাসায় বললাম অপুর কথা । বললাম আর কই জানালাম কেবল । তবে ওর চেহারা দেখেই আমার মনে হল ওর বাসা থেকে হয়তো আমার ব্যাপারে রাজি হবে না । ডিভোর্সী একটা মেয়েকে সহজে কেউ কি বিয়ে করতে চায় এই দেশে !
চেম্বারে নিয়ে গিয়ে যখন জানতে চাইলাম তখন আমার ধারনাই সত্যিই হল । অপু জানালো যে ওর পরিবার থেকে মানা করে দিয়েছে । কোন ভাবেই তারা একটা ডিভোর্সী মেয়েকে বউ হিসাবে মেনে নিবে না । খানিকটা মন খারাপ হল । কিন্তু কিছু করার নেই । ওকে বললাম এসব বাদ দিতে । তবে আমার সাথে কথা বলতে মানা নেই নাকি ! অপু হেসে বলল যে সেটা তো মানা নেই ।
আমরা বাদ দিয়েও আমাদের পরিবার এসব বাদ দিলো না । সপ্তাহখানেক পরেই অপু আবারও এসে হাজির ! আমার দিকে তাকিয়ে যা বলল আমার চোখ কপালে উঠলো । অপুর ভাষ্যমতে আজকে দুপুরে নাকি আমার বাবা ওদের বাসায় গিয়েছিলো । কিভাবে জানি অপুর খোজ খবোর বের করেছে । অপু তখনও বাসাতেই । ছুটির দিন বলে তার বাবারও বাসাতে রয়েছে । সেখানে গিয়ে গিয়ে বাবা নাকি অনেক চিৎকার চেঁচামিচি করে এসেছে । অপুর মত বেকার ছেলের সাথে তিনি মেয়ের বিয়ে দেবে না ওরা যেন ছেলেকে সাবধানে রাখে । অপুর বাবা কম যান না সেও বেশ কয়েক কথা শুনিয়ে দিয়েছে ।
এসব অপু ঘরের ভেতর থেকেই চুপচাপ শুনেছে । কোন কথা বলে নি । বাবা চলে আসার পর আমার এখানে এসেছে । আমার মেজাজটা আসলেই খারাপ হয়ে গেল । তখনই বাবাকে ফোন করতে গেলাম । অপু বাধা দিল । তারপর আমাকে অবাক করে একটা কথা বলল যা শোনার জন্য আমি মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না । ও পকেট থেকে দুটো টিকেট বের করে আমার সামনে রাখলো । ইউএস বাংলার ঢাকা টু কক্সবাজারের টিকেট ! আমি জিজ্ঞাসু চোখ ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম । অপু বলল
-আজেক আমার আর আপনার বাবাদের মনভাব শুনে আমার মনে হয়েছে যে এসের টাইট দেওয়ার জন্য হলেও আমাদের বিয়ে করা দরকার !
-মানে ?
-মানে টানে কিছু না ! চলুন আগে মগবাজার কাজী অফিসে যাই । ওখান তেকে সোজা কক্সবাজার । আপনি একটু ছুটির এপ্লিকেশন লিখুন !
-আপনি কি সিরিয়াস ?
-আমাকে দেখে কি মনে হচ্ছে আমি ফান করছি ?
আমার আসলেই মনে হল না যে অপু ফান করছে ! আমি একটা ছোট করে ছুটির দরখাস্ত টাইপ করছি তখনও আমার হাত কাঁপছিলো । বিশ্বাস হচ্ছিলো না যে আমি বিয়ে করতে যাচ্ছি । জীবনের এতো বড় একটা কাজ নিজের ইচ্ছে মত করতে যাচ্ছি ।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:২১