কথাটা বলেই মনে হল বলা উচিৎ হয় নি । মৃন্ময়ী রেগে যেতে পারে । আমার মনের কথা মনেই রয়ে গেল । মৃন্ময়ী আমার ইনবক্সের লিখলো
-এটা কি ঠিক হবে ?
আমি খানিকটা মাথা নিচু করার ইমুজি দিলাম । তারপর লিখলাম
-না, ঠিক হবে না ।
-তাহলে কেন দেখতে চাচ্ছেন ?
মৃন্ময়ীকে বলতে ইচ্ছে হল আমি তোমার প্রতিটা মুহুর্তেটা দেখতে চাই । সকালে তোমাকে ঘুমন্ত অবস্থায় কেমন দেখায়, থেকে শুরু করে গভীর রাতে ঘুমালে তোমার মুখে চাঁদের আলোতে কেমন লাগে পর্যন্ত । এমন কি ঘুমের ভেতরেও আমি কেবল তোমাকেই দেখতে চাই । একটা সময়ই তোমাকে চোখের আড়াল করতে আমার ইচ্ছে করে না । আমি বললাম
-জানি না । ইচ্ছে হল ।
মৃন্ময়ী বলল
-আচ্ছা, আমি যাই । গোসলের দেরি হয়ে যাচ্ছে ।
মৃন্ময়ীর এই ব্যাপারটা আমার সব থেকে বেশি ভাল লাগে । মেয়েটা রেগে যায় না কিংবা বিরক্ত হয় না । যদিও আমার কথাতে মাঝে মাঝে একটু অস্বস্তি প্রকাশ করে তবুও সেটা সে প্রকাশ করে না ।
ওকে একবার বললাম যে গোসলের পরে মেয়েদেরকে সব থেকে সুন্দর লাগে । একটা অন্য রকম পবিত্রতা তাদের চেহারাতে প্রকাশ পায় । গোসলের পর প্রথম ছবি । সরাসরি তো আমার পক্ষে কোনদিনই সেটা দেখা সম্ভব না । তাই সেলফিতেই ভরশা যদিও সেটা ওর অস্বস্তির কারন হতে পারে । আজকে ও যখন গোসলে যাচ্ছে শুনে গোসলের পরে ওর একটা ছবি দেখতে চাইলাম । কিন্তু তখনই মনে হল ছবিটা চাওয়া ঠিক হয় নি । জীবনে কত কিছুই তো করা ঠিক হয় না । তবুও আমরা ঠিকই করি !
আধা ঘন্টা পরেই আমার ম্যাসেজ টোন বেজে উঠলো । আমি জানিকে পাঠিয়েছে ম্যাসেজ । ওপেন করতেই খানিকটা অবাক হয়ে গেলাম । একটা অন্য রকম আনন্দের অনুভূতি আমার পুরো মন জুড়ে বয়ে গেল । মৃন্ময়ী ওর ছবি পাঠিয়েছে ।
ভেজা চুল ছাড়া অবস্থায় । এখনও সাদা তোয়ালেটা দেখা যাচ্ছে কাধে । চোখে এক অন্য রকম পবিত্রতা লেগে আছে । ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আছে । সেই প্রথম দিনের মত অনুভূতি হল যেদিন ওকে প্রথম দেখেছিলাম । ওকে একবার বলেছিলাম সে আমার কুইন । রানী আজকে ওকে ঠিক রানী নয় বরং আমার দেবীর মত মনে হচ্ছে । এমনই এক দেবী যার সংস্পর্শ যার দেখা পাওয়ার জন্য আমি আজীবন আরাধনা করে যেতে পারবো ।
আমি ছবির দিকেই তাকিয়ে রইলাম, একভাবে । মেয়েটাকে প্রতিটিবার দেখি আমার কাছে মনে হয় যেন আমি ওকে প্রথমবারের মত দেখছি । প্রথম বারের মত প্রেমে পড়ছি আবারও । আমি কোন রিপ্লাই দিচ্ছি না দেখে মৃন্ময়ী লিখলো
-কই হারালেন ?
-এই তো ।
-ছবি পেয়েছেন ?
-হুম ।
-যদিও ছবিটা দেওয়া উচিৎ হয় নি তবুও দিলাম । আর এমন কিছু চাইবেন না । ঠিক আছে ?
-কথা দিতে পারছি না । উচিৎ না এমন অনেক কাজই তো আমি করি । আপনি না করে দিবেন ।
-এবার কিন্তু দিবো না করে । আমি কাউকে না বলতে পারি না এই কথাটা ঠিক না কিন্তু ।
-জি ।
আমাদের কথা চলতেই থাকে । আমি জানি মৃন্ময়ী আমাকে ভালবাসে না । কোন দিন বাসবেও না হয়তো কিন্তু সে জানে আমি তাকে ভালবাসি । এবং মৃন্ময়ী এটা জনে যে আমার এই ভালবাসার ভেতরে কোন ভেজাল নেই । ওর প্রতি আমার অনুভুতিটা যে আমার মনের ঠিক ভেতর থেকে এটা সে জানে ।
মৃন্ময়ী বলল
-আচ্ছা শুনুন ।
-হুম । আমি আপনার কাছ থেকে শোনার জন্যই বসে আছি ।
-আপনি সেদিন যে কথাটা বলেছিলেন । মানে দেখা করতে চেয়েছিলেন ।
-হ্যা । সম্ভব ?
-অসম্ভব না । আমি ভেবে দেখি । সময় সুযোগ হলে জানাবো ।
তারপর কিছু সময় মৃন্ময়ী কিছু বলল না ।
-আমি জানি না আমি কেন এই সব করছি । তবে .....
-থাকুক কিছু কারন খোজার দরকার নেই ।
-ঠিক তাই । কিছু কারন খোজার দরকার নেই ।
ঠিক তার দুইদিন পরেই মৃন্ময়ী জানালো যে বিকেলে ওর একটা সুযোগ এসেছে । আমি চাইলেই ওর সাথে দেখা করতে পারি । বিকেল বেলাতে আমার টিউশনী থাকে । এই সময় আমি অন্য কাজ কখনই রাখি না কিন্তু আজকে পরিস্থিতি ভিন্ন । অন্য কেউ হলে এড়িয়ে যেতাম কিন্তু মৃন্ময়ীর সাথে দেখা হবে এটার জন্য অন্য সব কাজ বাদ দিয়ে দেওয়া যায় ।
আমাদের মাঝে অনেক কিছু নিয়ে কথা হয় । আমি যা কোন দিন কারো সাথে বলিও নি সেই সব বিষয় নিয়ে । কথায় কথায় ওকে একদিন বলেছিলাম আমার আসলে মেয়েদের কেমন সাজ পছন্দ । তারপর অনেক সংকোচের বাঁধা অতিক্রম করে বলেই ফেললাম যে একদিন সে কি এভাবে আমার সাথে দেখা করতে পারবে কি না । সেদিন মৃন্ময়ী হ্যা না কিছুই বলে নি । আমি অপেক্ষা ছিলাম । হয়তো কোন দিন মৃন্ময়ী দেখা করতে রাজি হয়ে যাবে ।
বিকেলে ঠিক সময় হাজির হয়ে গেলাম । ওর বাসার একটু সামনেই । ফোন দিতেই বলল যে ও রেডি হয়ে আছে । বের হবে । আমি বুকের ভেতরে দুরু দুরু স্পন্দন নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম । এরই মাঝে আমি এই দৃশ্য টা নিয়ে কল্পনা করে ফেলেছি হাজার বার । ওকে কেমন লাগবে কিভাবে হাসবে আরও কত কি কিন্তু আমি জানি আমার সব কল্পনাকে ও ঠিকই ছাড়িয়ে যাবে । আমার ধারনাকে সত্যি করতেই যেন আমি ওকে দেখতে পেলাম যখন মৃন্ময়ীকে আসতে দেখলাম । চারি পাশে লোকজনের ভীড়ে আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে । আমার কাছে মনে হল সব কিছু যেন থেমে গেছে । আমার চোখ কেবল মৃন্ময়ীর দিকেই ফোকাস করে আছে আর কাউকেই আমি পরিস্কার দেখতে পাচ্ছি না । আমার চোখে ও ছাড়া আর কিছুই বাঁধছে না ।
আমার সামনে এসে যখন থাকলো তখনও আমার ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না যে আমি যাকে সব থেকে বেশি পছন্দ করি সেই মানুষটা আমার পছন্দের সাজে আমার সামনে এসে হাজির হয়েছে ।
মৃন্ময়ী বলল
-কি হল ?
আমি প্রথমে কি বলবো খুজেই পেলাম না । কেবল ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম একবাবে । ওর চোখে একটা আলাদার লজ্জা মিশ্রিত হাসি । কেউ একজন আপনার দিকে পৃথিবীর সব আগ্রহ নিয়ে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রয়েছে, আপনার তো একটু লজ্জা লাগতেই পারে ।
মৃন্ময়ী সাদা রংয়ের কামিজ পরেছে সেই সাথে সাদা লেগিংস । সাথে সাথে ওড়না । ওর হাতে মেহেদীর রং আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি । কবে দিয়েছে কে জানে । আমাকে বলে নি তো । চোখে কাজল আর হাত ভর্তি চুড়ি । পায়ের পায়েল আর আংটির আওয়াজ এই কোলাহলের মাঝেও আমি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি । ঠিক আমার স্বপ্ন কন্যার মত ।
চুল খোলা তবে ঠিক অবাধ্য হয়ে নেই সেগুলো । টলটলা চোখের দিকে আমার তাকিয়েই হঠাৎ তীব্রভাবে মনে হল মৃন্ময়ী কোন দিন আমার হবে না ! ওর মেহেদী রাঙ্গা হাত আমি কোন দিন ধরতে পারবো না ।
-কি হল ?
ও কথাটা আবার বলতে আমার ঘোর ভাঙ্গলো । আমি বলল
-আমি আসলে ভাবতেই পারছি না তুমি .... মানে আপনাকে এভাবে কোনদিন দেখতে পাবো ।
-দেখেছেন তো !
-ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না ।
-চিমটি দেব ?
-দিন ।
মৃন্ময়ী হাসলো । আমিও হাসলাম । তারপর পাশাপাশি হাটতে শুরু করে মৃন্ময়ী বলল
-দেখুন বেশি সময় থাকা যাবে না । আমি বই কিনবো বলে বের হয়েছি । বই কিনবো । আপনি ফুচকা খাওয়াবেন । তারপর চলে আসবো । ঠিক আছে ?
আমার আসলে তখন ওর কথার দিকে লক্ষ্য নেই আমি কেবল ওর দিকে তাকিয়ে আছি । হয়তো আর এভাবে ওকে দেখতে পাবো না । হয়তো কেন বলছি আসলেই হয়তো দেখা হবে না ।
-আপনি কি শুনছেন আমার কথা ?
-হ্যা । শুনছি তো । চলুন আগে বই কেনা যাক ।
রিক্সাতে যখন উঠলাম এক সাথে তখনও ব্যাপারটা আমার কাছে অবিশ্বাস্য লাগছে । মৃন্ময়ীর সাথে একই রিক্সাতে । একদম কাছাকাছি । ওর শরীর থেকে একটা মিস্টি গন্ধ আসছে । আমার খুব ইচ্ছে হল আরেকটু কাছে এগিয়ে যেতে কিন্তু নিজেকে সংযত করলাম । চেষ্টা করলাম যাতে করে ওর কাধের কাছে আমার ধাক্কা না লাগে ।
আমি মাঝে মাঝে হাত দিয়ে আমার বুকের দিয়ে অনুভব করার চেষ্টা করলাম যে আমার হৃদপিন্ডটা ঠিক জায়য়া মত আছে কি না । প্রতিবারই বুঝতে পারছি আমার হার্টবীট স্বাভাবিক না । এতো দ্রুত আর উচ্চ স্বরে সেটা দৌড়ে চলেছে ভয় হল মৃন্ময়ী সেটা না আবার বুঝে ফেলে । নিজেকে স্বাভাবিক রাখার যথেষ্ঠ চেষ্টা করে চলেছি জানি না কত টুকু সফল হচ্ছি ।
রিক্সা যেন উড়ে চলছে । অন্যান্য দিন কত জ্যাম থাকে আজকে যেন মনে হচ্ছে রাস্তায় কোন জ্যামই নেই । আর রিক্সাওয়ালা মামাও যেন খুব দ্রুত চালাচ্ছে । আমার একবার মনে হল বেটা কে বলি এতো দ্রুত চালানোর কি আছে ? দরকার হলে ২০ টাকা বেশি কিন্তু আস্তে চালা ।
পুরোটা সময় মৃন্ময়ী কথা বলেই চলল । আমি ওর কথা শুনবো নাকি ওর দিকে তাকিয়ে থাকবো সেটা ঠিক বুঝতে পারছিলাম না । বারবার মনে হচ্ছিলো এমন ভাবে সারাটা সময় মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকতে পারতাম । এই পুরো সময় মৃন্ময়ী আমাকে কত কথা যে বলল । আমি কেবল শুনেই গেলাম । আর মাঝে মাঝে অবাক হতে লাগলাম এই ভেবে যে দুজন মানুষের মাঝে এতো মিল থাকে কিভাবে । আমার প্রায় প্রতিটা পছন্দ এক রকম । ও ঠিক যা যা পছন্দ করে আমি যা যা পছন্দ করি সব একে অন্যের সাথে কত চমৎকার ভাবেই না মিশে যায় ।
আবার যখন যখন রিক্সা নিয়ে আগের জায়গাতে ফিরে এলাম তখন মোটামুটি তিন ঘন্টা সময় পার হয়ে গেছে কিন্তু আমার কাছে মনে হল যেন কয়েক মিনিটই হয়েছে । ও যখন বলল যে ওকে এখন যেতে হবে তখন আমার আবারও সেই অনুভূতিটা ফিরে আসতে শুরু করলো । ওকে হারানোর অনুভূতি । পরক্ষনেই নিজেকে সামলে নিলাম । সে কোন দিন আমার হবেই না তাকে আমি কিভাবে হারাবো ।
যাওয়ার সময় মৃন্ময়ী বলল
-সময় ভাল কেটেছে আমার ।
আমি হেসে বললাম
-আমার কেমন লেগেছে সেটা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না ।
-বুঝলাম । নিজেকে সামলান । আর আপনি চোখ বলছিলো আপনি আমার হাত ধরতে চাইছিলেন । এটা আমাকে মাফ করবেন ।
-না না একদম ঠিক আছে । আমার মন তো কত কিছুই চায় । সব কিছু কেন শুনতে হবে ?
-আচ্ছা আমি গেলাম ।
-যাবেন না । বলেন আসুন ।
-আচ্ছা আসি ।
মৃন্ময়ী আবারও হাসলো । তারপর পেছন ফিরে হাটা দিল । আমি দাড়িয়েই রইলাম আগের জাগয়াতে যতটা সময় দেখা যাক তত সময় তাকিয়ে রইলাম । আমার কাছে মনে হতে লাগলো আমার বুকের এক পাশটা ছিড়ে আমার কাছ থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছে ।
একবার মনে হল মৃন্ময়ীর কাছে দৌড়ে যাই । পেছন থেকে ওর হাত ধরে বলি আমি তোমার সাথে থাকার জন্য যে কোন কিছু করতে পারি, তুমি যা বলবে যেভাবে বলবে । তোমার যেমনটা পছন্দ আমাদের ঘরের প্রত্যেকটা দেওয়ালের রং সেই রকম হবে । তুমি আমার যতটা সময় সময় চাও একটু যা যা বলেছো ঠিক সেই সেই সাজাবো আমাদের জীবনটা । জীবনে যা চাওয়া যায় তার সব কিছু পাওয়া যায় না, জীবন যেমন হয় না - এই কথা গুলো তোমার মনে আসতে দিবো না কোন দিন ।
আমার আর যাওয়া হল না । চাইলেই সব কিছু করা যায় না ।
ওর জীবনটা এমনিতেই পরিপূর্ন হয়ে আছে । সেখানে আমার কোন স্থান নেই । সহজ সত্য কথা । কিন্তু মাঝে মাঝে সহজ সত্য কথা গুলো মন মেনে নিতে চায় না । কিছুতেই মেনে নিতে চায় না ।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জুলাই, ২০১৭ রাত ৮:৫৯