শুরুর আগের কথা
--------
ফারনান আরেকবার রনির দিকে তাকালো । দুজনের চোখেই একটা অন্য রকম উত্তেজনা দেখা যাচ্ছে । আজকে রনিকে হারাতেই হবে । গিয়ারটা আরেকবার ঠিক করে নিল ।
গুলশানের ৭৩ নাম্বার সড়কের একবারে শেষ মাথায় দুটো গাড়ি দাড়িয়ে আছে । দুটো গাড়িই একেবরে চলতে প্রস্তুত । পেছনে চাকা দুটো ক্ষনে ক্ষনে নড়ে উঠছে । সিগনাল পাওয়া মাত্রই ছেড়ে যাবে । দুটো গাড়ির ঠিক মাঝে হাট উচু করে দাড়িয়ে আছে জেতিকা । হাত নামানোর মানেই হচ্ছে তোমরা চলতে পারো !
ফারনান অপেক্ষা করছে জেতিকার হাত নামানোর । আজকে যে কোন ভাবেই তাকে জিততেই হবে এই রেসে । খোলা বোতল থেকে আরও দুই চুমুক খেয়ে নিয়ে বোতল টা পাশের সিটে সরিয়ে রাখলো । মুখ বন্ধ করার প্রয়োজন মনে করলো না !
আজকে যে কোন ভাবেই রনিকে হারাতেই হবে ।
----
এক
----
ফারনান আজকে ইউকে থেকে বাসায় এসেছে । বলতে গেলে প্রায় ১০ বছর পরে । এই দশ বছরে সে একটা বারের জন্য দেশের মাটিতে পা দেয় নি । যদিও বাবা মা প্রত্যেক বছরেরই লন্ডনে গেছে দেখা করতে । কিন্তু লন্ডনে গিয়ে ফারনানকে বেশ সমস্যায় পরতে হয়েছে । সেখানে এই দেশের মত যা ইচ্ছা তাই করতে পারে নি । সেখানকার নিয়ন নীতি ঠিক এই দেশের মত নয় । বাবা চাচাদের জোর সেখানে খুব একটা চলে না ।
বাইরে যাওয়ার বাবার নতুন গাড়ি দিকে তাকালো । মনের ভেতরের একটা আনন্দ কাজ করলো । আজকে তাহলে অনেক দিন নিজের পছন্দ মত গাড়ি চালানো যাবে । আর আগের মত পুলিশর ভয়ে লুকিয়ে রেস করা লাগবে ঠিক যেমন টা সে ইউকে থাকতে করতো ! পুরানো কিছু বন্ধুদের সাথে দেখা করা লাগবে । শুনেছে রনি নাকি এখন ঢাকার সব থেকে ফাস্টেস রেসার হয়ে গেছে । কেউ তাকে হারাতে পারে নি এখনও ।
সমস্যা নেই । এখন সে চলে এসেছে এবার সে তাকে হারাবে । তাদের মধ্যকার সেই রেসটা এখনও শেষ হয় নি ।
গাড়ির চাবি নিয়ে বের হতে যাবে তখনই ফারনানের বাবা সামনে এসে দাড়ালো ।
-কোথাও যাও ?
-আব্বু একটু বাইরে যাচ্ছি ।
-রিপন কে নিয়ে যাও !
-রিপন কে ?
-তোমার ড্রাইভার !
ড্রাইভার কথাটা শুনে ফারনান যেন আকাশ থেকে পড়লো , সে বিশ্বাস করতে পারলো না যে তার বাবা তাকে কি কথা বলছে ।
-তুমি কি বলছো আমি কিছু বুঝতেছি না ! আমার ড্রাইভার কেন লাগবে ? আমি গাড়ি চালাতে পারি ।
-আমি জানি তুমি পারো । আর কেমন গাড়ি চালাও সেটা আমি খুব ভাল করেই জানি । এর আগের বার কি করেছিলে মনে নেই ?
-বাবা তুমি আবারও সেই একটা কথা বারবার বলছো ? সেটা ১০ বছর আগের ঘটনা ! এখনও মনে আছে কারো !
-মনে নেই এই প্রশ্ন করার আগে মনে রেখো যে মানুষকে সেটা ভুলানোর জন্য আমাকে আর তোমার চাচাকে কি করতে হয়েছে কত ঝামেলা পোহাতে হয়েছে । আর এটা ইউকে নয় । এখানে তুমি সেখানকার মত রাস্তা পাবে গাড়ি চালানো জন্য ! রিপন কে নিয়ে যাও ও খুব ভাল গাড়ি চালায় ! স্পীড চাও সে তুলতে পারবে ।
-বাবা আমার ড্রাইভার লাগবে না !
-তাহলে গাড়িও নিতে হবে না ! হেটে যাও । রিক্সায় যাও । কিন্তু গাড়ি নিতে হলে রিপন কে নিতে হবে !
এই বলে ফারনানের ব্যবসায়ী বাবা রিপন কে ডাক দিলো ! ফারনান দেখলো ২৩/২৪ বছরের ছেলে এসে দাড়ালো । শান্ত চেহারার একটা ছেলে । বাবা বলল
-একে সাথে নিয়ে যাও ।
তারপর রিপনের দিকে তাকিয়ে বলল
-ওকে নিয়ে যাও । যেখানে নিয়ে যেতে চায় নিয়ে যাবে । আর সাবধানে গাড়ি চালবে ।
রিপন কেবল মাথা কাত করে সম্মতি জানালো ।
যদিও ফারনানের মেজাজ একটু খারাপ হল তবুও সে জানে তার কিছু করার নেই । সে ছোট থেকেই অনেক আদর যত্নে মানুষ হয়েছে এটা সত্যি তবে সে তার বাবাকে খুব ভাল করেই চিনে । তার না মানে সেটা কোন ভাবেই হ্যা করা যাবে না !
ড্রাইভারের সিটের পাশে বসে ফারনান বিরক্ত হয়ে বসে রইলো । রিপন গাড়ি চালিয়ে যখন ওদের বাসা থেকে একটু দুরে গিয়েছে তখনই ফারনান বলল
-এই গাড়ি থামাও !
-জে স্যার !
কোন বাক্য না ব্যয় না করে রিপন গাড়ি থামালো । তারপর ফারনান বলল
-গাড়ি থেকে নামো !
এবারও রিপন কোন কথা বলল না । গাড়ি থেকে নেমে গেল ! তারপর রিপন একটা ঠিকানা দিল । বলল এখানে তুমি ঠিক রাত ১১ টার সময় পৌছাসাবা । এখানে ঠিকানা দেওয়া আছে ।
-আচ্ছা !
-আর বাবা যদি ফোন করে বলবে যে তুমি আমার সাথে আছো !
-আচ্ছা ! যাও তোমার ছুটি !
রিপন কেবল সাদা রংয়ের গাড়িটা চলে যেতে দেখলো ! মনের ভেতরে একটা আনন্দ কাজ করলো কিন্তু সেই আনন্দটার কারন কেউ জানে না !
-----
দুই
-----
ব্যবসায়ী আহসান ইকলাবের প্রথমে মনে হল তিনি ঠিক মত কথাটা শুনতে পারেন নাই । মাথাটা তার ঘুরে উঠলো । ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো সেখানে রাত তিনটে বাজে । ফোনের ওপাশে ওসির সাহেব রয়েছে । কোন এলাকার ওসি সেটা সে জানেও না !
-স্যার আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন ?
-হ্যা !
-গাড়ি টা কি আপনার ?
-জি !
আপনি দেরি না করে চলে আসুন ! বডি আইডেন্টিফাই করতে হবে ।
আহসান ইকবাল পাশে ঘুমন্ত স্ত্রীর দিকে তাকালো । তাকে জাগালো না ! জাগিয়ে কি বলবে ? কি বলার আছে তার !
তিনি আর দেরি না করে তখনই রওনা দিলেন ডাকা মেডিক্যালের দিকে । সেখানেই নাকি আছে বডিটা !
যখন ঢামেক পৌছালো তখন প্রায় চার টা বেজে গেছে । ওসি সাহেব তখন সেখানেই ছিল । তাকে নিয়ে গেল মর্গ রুমে , একটা স্ট্রেচারের কাছে নিয়ে সাদা চাদর টা চেনে সরালো । আহসান সাহেব তখনও নিজের চোখ কে বিশ্বাস করতে পারছেন না স্ট্রেচারের শোয়া মৃত মানুষটা তার নিজের ছেলে । এক মাত্র ছেলে । চোখ ফেলে কান্না এল তার । তার স্ত্রীকে তিনি কি জবাব দেবেন সেট তিনি ভেবে পেল না । কদিন আগেই ছেলেটা বাইরে থেকে দেশে এসেছে । আর এসেই এই অবস্থা !
ওসি সাহেব বলল
-চেহারা একদমই চেনা যাচ্ছে না ।
-হ্যা ! ও ফারনানই !
-আচ্ছা আপনি ময়না তদন্ত শেষে বডি নিয়ে যেতে পারেন !
-এর সাথে আরেকজন ছিল । ড্রাইভার । রিপন ! সে কোথায় ?
-সে আছে ! তার অবস্থাও বেশ খারাপ ! চলন্ত গাড়ি থেকে লাফ দিয়েছিল প্রান বাচাতে নয়তো সেও আপনার ছেলের সাথেই যেত !
-কি হয়েছিল বলুন আমাকে !
-দেখুন আমরা প্রত্যেক্ষ দর্শীর কাছ থেকে শুনেছি ! তারা দেখে যে রাড় ১ টার দিকে বাবা বাজার ব্রীজের রাস্তার উপর দিয়ে একটা গাড়ি তীব্র গতিতে ছুটে চলছিল । গাড়িতে একজন সামনে ছিল আর এক চালচ্ছিলো ! গাড়িটা নাকি শুরু থেকেই খানিকটা বেপরোয়া ছিল । একবার এদিক যাচ্ছিলো একবার ওদিক যাচ্ছিলো । পরে সেটা নিয়ন্ত্রন হারিয়ে পরে যায় ব্রীজের রেলিং ভেঙ্গে ! ঠিক পড়ে যাওয়ার আগে একজন লাফিয়ে পরে পেছনের দরজা খুলে ! আপনার ছেলে সম্ভবত নিজে চালাচ্ছিলো গাড়ি । ড্রাইভার কে পেছনে বসিয়ে রেখে ! এবং সে ড্রাঙ্ক ছিল !
ব্যাপার টা সে নিজেও জানে ! রিপনকে তাকে প্রতিদিনই ফোন করে বলতো যে ছোট সাহেব তাকে গাড়ি থেকে হয় নামিয়ে দিয়েছে নয়তো তাকে পেছনের সিটে বসিয়ে গাড়ি চালিয়েছে । আহসান সাহেব কিছু বলতে গিয়েও বলেন নি । তার কেবল ভয় ছিল ছেলে যদি কোন দুর্ঘনা ঘটিয়ে ফেলে সেটা যাতে ড্রাইভারের উপর দিকে চালানো যায় ! ঠিক আগের বারের মত যাতে খুব একটা ঝামেলা যেন না হয় ! তিনি কোন দিন ভাবতেও পারেন নি তার ছেলে অন্যকে মারার বদলে নিজেই মারা পরবে !
-----
তিন
-----
বেশ কদিন থেকেই রিপন এই সুযোগ টার অপেক্ষায় ছিল । ফারনান ছিল আজকে খুব বেশি ড্রাঙ্ক ! সময় মত সে পৌছে গেল নির্দিষ্ট ঠিকানায় ! গাড়িটার কাছে দাড়ানোর প্রায় ঘন্টা ২ পরে ফারনান বেরিয়ে এল । একে বারে টালতে টালতে । ওকে নিয়ে রিপন রওনা দিল । গাড়ির পেছনে তখন সে বেহুস হয়ে পরে আছে । বাড়ির দিকে না গিয়ে রিপন গাড়িটাকে গেল বাবু বাজারের দিকে । একটা নির্জন স্থান দেখে গাড়ি থামালো ! এরপর নিজে ড্রাইভিং সিট থেকে বেরিয়ে এসে কোন মতে ফারনান কে বসালো ড্রাইভিং সিটে । সিট বেল্ট বেধে দিল যাতে পালাতে কিংবা টলে পড়ে না যায় ! পা দুটো রাখলো accelerator আর ব্রেকের উপর এবার রিপন বসলো পাশের সিটে । গাড়ি চলতে শুরু করলো । পাশে বসেও রিপন খুব স্বাভাবিক ভাবেই গাড়ি নিয়ন্ত্রন করতে পারছিল ! গাড়ির গতি আস্তে বাড়ছিল আস্তে আস্তে রিপনের পক্ষে নিয়ন্ত্রন রাখাও কষ্টকর হয়ে যাচ্ছিলো !
পাশের সিটের সিট আগে থেকে রিপন একদম শুইয়ে রেখেছিল যাতে করে সে পিছনের সিটে যেতে পারে । পেছনে সিটে গিয়েও সে হুইল টা আস্তে করে ধরে রাখলো আরও কিছুক্ষন । নির্দিষ্ট সময়ের অপেক্ষা । এদিকে হু হু করে বেড়ে চলেছে গাড়ির গতি ! সামনের দিকে চোখ রেখে গাড়ির হুইল টা ঘুড়িয়ে দিল । ততক্ষনে গাড়ি বাবু বাজার ব্রীজের উপরে উঠে পড়েছে । ঠিক যখন গাড়িটা একেবারে ঘুরে রেলিংয়ের দিকে ছুটে চলে ছেল তখনও রিপন গাড়ির পেছনের দরজা খুলে লাফ দিলো ! গড়িয়ে পড়লো শক্ত পিচ ঢালাই করা রাস্তায় ! মাথা ঠুকে গেল । কেবল অজ্ঞান হওয়ার আগে দেখতে পেল যে গাড়িটা রেলিং ভেঙ্গে নিচে পড়ে যাচ্ছে । একটা সুক্ষ হাসির রেখা বয়ে গেল রিপনের চেহারা দিয়ে !
পরিশিষ্টঃ
রিপন কিছু বুঝতে পারছে না । তার ১৩ বছরের জীবনে এরকম ঘটনা আর ঘটে নি । বুঝতে পারার পর থেকে তার বাবাকে ছাড়া একটা দিনও সে থাকে নি । সেই বাবা নাকি আর আসবে না ! তার বাবাকে কে গাড়ি চাপা দিয়েছে । সবার কাছ থেকে শুনতে পাচ্ছে কেবল সখের গাড়ি চালতে গিয়ে একজন তারই মত বয়স্ক ছেলে নাকি তার বাাবকে চাপা দিয়ে চলে গেছে ।
রিপন কিছুতেই বুঝতে পারছে এরকম কেন হবে ?
এরকম তো কোব ভাবেই হওয়ার কথা নয় তাহলে কেন হবে !
-------
কোন অন্যায়ের প্রতিবাদ এখন আর করি না । আগে করতাম তবে এখন আর না ! করে কিছু হয় না ! একটা সময় মনে হত হয়তো প্রতিবাদ করেই অনেক কিছু হয় কিন্তু এখন সেটা বদলে গেছে । মনে হয় কিছুই হয় না ! তাই কেবল সময় অতিক্রম করি ! ইংরেজিতে সেটাকে টাইম পাস বলে ! গল্পে কিছু বানান ভুল থাকবে সেই জন্য ক্ষমা প্রার্থী
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই অক্টোবর, ২০১৫ বিকাল ৩:৪৮