বিয়ের একটা আনুষ্ঠানিকতায় নাকি আছে যে, বর এবং কনে কে একে ওপরের হাতের উপর হাত রেখে একই আয়নায় মুখ দেখতে হয় ! এতোদিন সুমনের হাত কতবার ধরেছে অথচ আজকে ওদের বিয়ের দিন সুমনের হাত ধরতে তন্বীর শরীরটা কেমন কেঁপে উঠলো । সাথে সাথে লজ্জায় সারা মুখ টা মুহুর্তেই লাল হয়ে গেল ! হাত ধরে মাথা নিচু হয়ে গেল আপনা আপনি ! কিছুতেই আর তাকাতে পারে না সুমনের দিকে !
-তন্বী আয়নার দিকে তাকা !
কে বলল কথা টা ? ওর আম্মু নাকি ? নাকি অন্য কেউ ! তন্বী কিছু বুঝতে পারছে না ! যেন একটা অজানা ঘোরের ভিতরে রয়েছে ! ভাল লাগার এই আবরন থেকে কিছুতেই বের হতে মন চাইছে না ! বারবার মন বলছে থাকুক না এই লজ্জা মিশ্রিত ভাল লাগার অনুভুতিটুকু আরও কিছুক্ষন !
আচ্ছা সুমনও কি এমন টাই ভাবছে ?
তাকাবে ওর দিকে ? ও নিশচই আয়নার দিকে তাকিয়ে আছে ?
যেমন ভাবে তাকিয়ে থাকতো ওর দিকে আগে !
বদ ছেলে একটা !!
তন্বী আয়নার দিকে চোখ তুলে তাকাতেই সুমনের চোখ দেখতে পেল ! আগের মতই গভীর চোখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে ! হঠাৎ করেই তন্বীর চোখে পানি চলে এল ! তন্বী সেই পানি লুকানোর কোন চেষ্টাই করলো না !
১
-এতো লজ্জা পাচ্ছিলে কেন শুনি ?
সুমনের কথা শুনে তন্বী সুমনের দিকে তাকালো ! এখনও সেই লজ্জা ভাবটা রয়েই গেছে ! যাচ্ছে না কিছুতেই ! সারা দিনে বিয়ের ধকল গেছে দুজনের ওপরেই । দুজনেই ক্লান্ত, একটু ঘুমাতে মন চাইছে দুজনেরই কিন্তু কেউ সেদিকে যাওয়ার কোন ইচ্ছা নেই । এমন একটা রাতের জন্য ওরা কতদিন ধরেই না অপেক্ষা করে আসছে । এই রাত টা কি ঘুমিয়ে নষ্ট করা যায় ?
সুমন আবার বলল কথা টা ?
-তুমি এতো লজ্জা কেন পাচ্ছিলে তখন ?
-জানি না ! তবে....
-তবে কি ?
-জানো তখন লজ্জা পেতে এতো ভাল লাগছিল, তোমাকে বলে বোঝাতে পারবো না !
-তাই ?
-হুম ! মনে হচ্ছিল সময়টা যদি ওখানেই থেমে থাকতো , কতই না ভাল হত !
সুমন অবাক কন্ঠে বলল
-ভাল হত ? সময়টা ওখানে আটকে থাকলে এখন কি হত ? আমাদের বাসর রাতের কি হত ?
তন্বী সুমনের দিকে তাকিয়ে দেখলো সুমনের চোখে কেমন একটা দুষ্টামি দেখা দিয়েছে ! তন্বী সুমনের দিকে চোখ বড় করে বলল
-এই দুষ্টামী করবা না খবরদার !
-দুষ্টামী ! নিজের বউয়ের সাথে একটু দুষ্টামী করতে পারবো না ? বিয়া করলাম কেন ?
-এই এই ! খবরদার.... খবরদার বলছি ! কাছে আসবা না !
২
-তো তুমি কালকে একেবারে আমার বাড়িতে আসবে না ?
-মানে কি ? কি বলতে চাও ?
-না, তুমি বললে না যে কালকে তুমি এ বাড়িতে আসবে ! তারপর আবার যাবে ! আবার আসবে !
-এটাই নিয়ম ! মেয়েদের বিয়ের পরেও তাদের বাপের বাড়িতে আসতে হয় ! এটা কে ফিরানী বলে !
-কেন ? আমি তোমাকে কালকেই চাই ! আর যেতে দিবো না ! কাল থেকেই আমাদের সংসার শুরু হবে ! এতোদিন অপেক্ষা করেছি আর না !
সুমনের কথা শুনে তন্বী কেবল মনে মনে হাসে ।
পাগল একটা ছেলে ! এমন করলে কেমন করে হবে !
তন্বী বলল
-সুমন ঘুমাও ! কালকে আবার সময় করে আসতে হবে এখানে ! কালকে আমাদের বিয়ে মনে আছে তো ?
-হুম ! খুব ভাল করে মনে আছে !
-ঘুমাও ! কেমন ?
-তোমার ঘুম আসবে আজকে ? বল আসবে ? কালকে আমাদের বিয়ে আর তুমি আজকে আমাকে বলছো ঘুমাতে ?
তন্বী কথাটা জবাব দিতে গিয়েও দিলো না ! আসলেই কি আজকে ওর ঘুম আসবে ? বিয়ের আগের দিন কি কোন মেয়ে কি ঘুমাতে পারে ?
৩
প্রতিটা সকালে এমন একটা দৃশ্য দেখেই তন্বীর এখন ঘুম ভাঙ্গে ! সুমন ওকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে । সকাল বেলা যখন তন্বীর চোখ সুমন কে এতো কাছে দেখে তখন ওর নিঃশ্বাসের প্রতিটা শব্দ যেন ও শুনতে পারে ! কত দিন তন্বী বলেছে ওকে এভাবে জড়িয়ে না ধরতে, সুমন শোনেনি । কি শীত আর কি বা গরম সুমনের কেবল একটাই কথা বলে
-তোমাকে জড়িয়ে না শুলে, তোমার শরীরের গন্ধ না পেলে আমার ঘুম আসে না !
তন্বী কেবল হাসে ! বলে
-যখন আমি ছিলাম না তখন কিভাবে ঘুমাতে শুনি ?
সুমন বলতো
-তখন আর ঘুমাতাম কই ?
প্রতিটা সকাল এখন চোখ মেলে এখন সুমন কে নিজের শরীরের কাছে না পেলেই এমন কেমন জানি লাগে ওর ! কি যেন একটা নেই নেই লাগে !
সকাল টাই যেন ঠিক মত শুরু হল না মনে হয় !
৪
-তুমি এখনও ঘুমিয়ে ?
-কি করবো ?
-আশ্চর্য ? কি করবা মানে ? থাপ্পাড় লাগানো দরকার !
সকাল বেলা করে এমন কথা শুনতে কার ভাল লাগে ! হলের বিছানায় আরাম করে ঘুমিয়ে ছিল তখনই তন্বীর ফোন । মেয়েটা একটু শান্তি মত ঘুমাইতেও দেয় না ! সুমন মুখ কাঁচুমুচু করে বলল
-কেন ? আমি কি করলাম ?
-আশ্চর্য ! আজকে না তোমার ইন কোর্স রয়েছে ?
-হুম ! আছে তো ! তাতে কি হয়েছে ?
-কি হয়েছে মানে ? থাপ্পড় দিয়া দাঁত ফেলে দিবো ! একটু পরে পরীক্ষা আর জনাব এখন পরে পরে ঘুমাইতেছে ! জলদি উঠো ! এক মিনিটও দেরি করবা না বললাম !
-আচ্ছা বাবা উঠতেছি !
-এখনই উঠো !
৫
-এটা কেন বললে তুমি ?
-কেন ? বলা ঠিক হয় নাই ?
-অবশ্যই না ! আমি কার সাথে মিশবো কিংবা মিশবো না সেটা নিশ্চই আমি তোমার কাছ থেকে পারমিশন নিবো না !
-অবশ্যই নিবা ! ভুলে যেও না যে আমি আমি তোমার হাসব্যান্ড !
-তো কি হয়েছে ? দেখো আমি আমার স্বাধীনতার ভাগ কাউকে দিতে রাজি না ! তোমাকেও না ! কথা টা মনে রেখো !
৬
বিকেল বেলা টা তন্বী সব সময় সুমনের সাথেই কাটায় ! কিন্তু আজকে কোথাও সে সুমন কে খুজে পেল না । কয়েকবার ফোন দেওয়ার চেষ্টা করেছে । ফোন বন্ধ । একটু চিন্তিত হল মনে মনে ! এমন টা তো কোন দিন হয় না ! শরীর কি খারাপ করলো ?
নাহ ! এমন তো হবার কথা না ! ফোন তো বন্ধ রাখার কোন কারন নেই ! কোথাও গেলেও তো একবার ওকে জানিয়ে যাবে নাকি ?
কি করবে ?
আরেকবার ডায়াল করলো সুমনের নাম্বারে !
"দুঃখিত এই মুহুর্তে....."
কোথায় গেল ছেলে টা ? এই কদিনেই ছেলেটার প্রতি এমন একটা টান অনুভব করতে শুরু করেছে ! মাত্র কদিন আগেই ছেলেটার কাছাকাছি আশার সুযোগ হয়েছে এর ভিতরেই কেমন করে কত আপন হয়ে গেল ছেলেটা ! তন্বী অস্থির বোধ করতে লাগলো !
এমন কেন করে ছেলে টা কেন ?
৭
কয়েক মুহুর্ত তন্বী অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে রইলো সুমনের দিকে ! এখনও সে একটু আগের ঘটে যাওয়া ঘটনা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পরছে না ! সুমন তাকিয়ে আছে ওর দিকে ! একটু সে যে অন্যায় টা করেছে তার জন্য তার চোখে বিন্দু মাত্র অনুশোচনা দেখা গেল না ! বরং তন্বীকে চড় মেরে সুমন যেন নিজের মধ্যে একটা শান্তি অনুভব করছিল ! অন্তত তন্বীর তাই মনে হল । তন্বী কেবল
-তুমি ....।
কথাটা শেষ করলো না কিংবা শেষ করতে পারলো না !
সুমন ততক্ষনে ঘর ছেড়ে বাইরে চলে গেছে ! তন্বী নিজের শোবার ঘরের বিছানার উপর বসে পড়লো ! কিছু একটা চিন্তা করছে ! কিছু একটা সিদ্ধান্ত নিচ্ছে !
এভাবে আর চলতে পারে না ! আর চলতে পারে না !
৮
তন্বী কয়েক মুহুর্ত কেবল সুমনের দিকে তাকিয়ে থাকলো ! ছেলেটা এক হাটু মাটিতে রেখে এখনও দাড়িয়ে রয়েছে ওর সামনে ! হাতে ঠিক ঠিক সাত টা গোলাপ ! মুখে একটা আকুল আবেদনের একটা ভাব !
তন্বীর হাসতে গিয়েও হাসলো না ! যেমন টা নাটক সিনেমায় তন্বী দেখেছে ঠিক তেমন করেই সুমন ওকে প্রোপোজ করেছে ! এখনও ওর হ্যা শোনার জন্য অপেক্ষা করে আছে !
এমন পাগলামো কেউ করে ?
এখন মোবাইলের যুগে একটা বার ফোন করে বলে দিলেই হত ! তা না করে একেবারে ফিল্মি কায়দায় !
তন্বীকে কেবল একটু হাসলো !
বলল
-আংটি আনো নি ?
সুমন একটু বিভ্রান্ত দেখালো ! বলল
-আংটি ?
-তুমি যেভাবে প্রোপোজ করলে সেটা কেবল মানুষ যখন বিয়ে করার জন্য প্রোপোজ করে তখন করে !
-তাই নাকি ? আসলে....
সুমনের বিভ্রান্ত মুখ দেখে তন্বী হাসি যেন আর থামেই না ! হাসতেই হাসতেই হ্যা বলল !
৯
কাগজটাতে সই করতে গিয়ে সুমনের হাত একটু একটু কাঁপছিল ! বারবার কেবল মনে হচ্ছিল একটু ভুলই কি হয়ে গেল ! চাইলেই কি মানিয়ে নেও যেত না ! এভাবে সম্পর্কটা শেষ হয়ে যাবে চিরো দিনের মত ! আর কোন দিন কি পাশের মানুষটিকে জড়িয়ে ধরা হবে না !
ভুল কি কেবল তন্বীরই ছিল ?
তার কিছু ছিল না ! সে তো নিজেও নিজেকে সামলে নেয় নি ! সঠিক সময়ে তন্বীর দিকে নজর দেয় নি । যেমন টা ওর আচরন হওয়া দরকার ছিল তেমন টা সে করে নি !
তাহলে এখন আর আফসোস করে কি লাভ ?
সই করা শেষে সুমন কাগজ টা তন্বির দিকে বাড়িয়ে দিল ! তন্বী খুব শান্ত ভাবেই কাগজে সই করলো ! সুমনের কেবল মনে হল ওর নিজের অস্থিরতা থেকে তন্বী নিজে বেশ শান্তই আছে !
সই করা শেষ হয়ে কাগজটা সামনে বসা কালো কোর্ট পরা লোকটার দিকে বাড়িয়ে দিল !
লোকটা বলল
-ওকে ! ইট ইউল বি ডান ! আপনাদের কে নোটিস করে জানানো হবে !
ওরা দুজনেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালো ! তাকালো একে অপরের দিকে ! সুমন একটু হাসার চেষ্টা করলো কিন্তু মুখ দিয়ে হাসি বের হল না ! কেবল বলল
-ভাল থেকো !
-তুমিও !
আর দাড়ালো না কেউ ! একে অপর থেকে উল্টো দিকে হাটা দিল ! আর কোন দিন হয় দুজনের পথে হয়তো এক হবে না !
১০
নীল রংয়ের একটা সালোয়ার কামিজ পরে মেয়েটির দাড়িয়ে থাকার কথা বড় কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে ! হাতে থাকবে নীল চুড়ি ! চোখে কাজল ! চুল গুলো খোলা থাকবে !
সুমন কেবল এইটুকুই জানে ! আর কিছু না ! মেয়েটিকে সে এর আগে দেখে নি । কেবল অনলাইনেই কথা হয়েছে । যদিও ওরা একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে কিন্তু ওদের পরিচয় অনলাইনেই ! টুকটুক কথা থেকে নিয়মিত কথা হতে শুরু করে ইনবক্সে ! তারপরেই দেখা করার আহবান ! মেয়েটিও বারণ করে নি ! কাল রাতেই অনেকক্ষন কথা বলার পর আজকে দেখা হবে দুজনার ! সুমন জানে মেয়েটির নাম তন্বী আহসান ! সমাজ বিজ্ঞানে পড়ে । কবিতা পড়তে পছন্দ করে । সুমন কবিতা লিখতে পারে বেশ ভালই । সেখান থেকে কথার শুরু !
সময় মত সুমন কৃষ্ণচূড়ার তলে এসে এদিক ওদিক তাকিয়েও কাউকে দেখতে পেল না । ঘড়ি দেখলো । বিকাল পাঁচটার সময় দেখা করার কথা । পাঁচটাই বাজে কিন্তু মেয়েটির আসার কোন নাম নেই !
সাড়ে পাঁচ টা বাজে ! হাতে এক গুচ্ছ রজনী গন্ধা নিয়ে সুমন অপেক্ষা করতেই লাগলো !
যখন মনে হল মেয়েটি আর আসবে ঠিক তখনই পাশ থেকে মিষ্টি একটা কন্ঠ বলে উঠলো
-এই যে কবি সাহেব ! খুব রাগ করেছেন ?
সুমন তাকিয়ে দেখলো নীল রংয়ের সেলোয়ার কামিজ পরা মিষ্টি চেহারার একজন ওর সামনে দাড়িয়ে আছে খানিকটা অপরাধীর মুখে ! দেরি করে এসেছে, সুমন কে অনেক্ষন দাড় করিয়ে রেখেছে এই জন্য মুখে অপরাধীর একটা ভাব !
গতকাল প্রিয় ব্লগার প্রোফেসর শঙ্কু ১১ টি গল্পের থিম নিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিল, যেগুলো আর গল্পে রূপ নেয় নি । কেবল তার চিন্তার ভেতরেই রয়ে গেছে ! থিম গুলো পড়েই ভাল লেগে গেল ! আজকেই শুরু করে দিলাম ! যদিও প্রোফেসর শঙ্কু লিখলে গল্প গুলো অন্য রকম হত, এবং আরও ভাল হত ! কিন্তু সে যেহেতু লিখছে না তাই আমি লিখলাম !