-কটা বাজে ?
-বারোটা প্রায় ।
-কার ঘড়ির না আপনার ?
ছেলেটা আমার দিকে কিছুক্ষন বোকার মত তাকিয়ে রইলো ! আসলে আমি এমন একটা কথা বলব ছেলেটা ভাবতে পারে নি ! আমি হাসতে থাকলাম ! ছেলেটা বলল
-না ! আমার বারোটা কেন বাজবে ?
-বাজতেও পারে ! বলা যায় না ! ছেলেদের অবশ্য বারোটা বেশি বাজে এবং দ্রুত বাজে !! হি হি হি !
এই রকম একটা অপরিচিত ছেলের সামনে এই ভাবে হাসাটা ঠিক না তবে আমার কেন জানি মজা লাগছে ! অবশ্য আজকে দিনটাই একটা অন্য রকম একটা দিন ! কাজ কারবার করছি সব উল্টা পাল্টা ! যা করছি সবই ভাল লাগছে !
বাসে করে নানী বাড়ি যাচ্ছি ! একা ! এবং সেটা বাসার কেউ জানে না ! গত কাল রাতে আম্মু আমাকে বিনা কারনে বকা দিয়েছে তখন থেকেই মেজাজ খারাপ ছিল ! কিছু একটা করতে ইচ্ছে করছিল যাতে আম্মুর একটা শিক্ষা হয় ! আমি না থাকলে ঠিকই বুঝতে পারবে আমি কি !
তাই তো সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে স্বাভাবিক ভাবে নাস্তা খেলাম তার পর বের হয়ে এলাম ! একটু এদিক ওদিক ঘুরলাম ! তারপর এই সিদ্ধান্ত নিলাম ! কেউ জনাবেও না আমি কোথায় যাচ্ছি ! মোবাইল ফোন টা বন্ধ করে রেখেছি ! এখন খুজে বের করুক আমাকে !
বাস ছাড়তে ছাড়তে প্রায় এগারোটা বেজে গেল ! বাসটার নাম "দ্য রয়েল একপ্রেস" ! নানুদের বাসায় যাবার জন্য সব থেকে ভাল বাস ! আমি টিকেট কেটে উঠে পড়লাম বাসে ! বাসে উঠার পর একবার আম্মুর জন্য মন খারাপ লাগছিল ! আব্বুও নিশ্চই অনেক অস্থির হবে !
হোক একটু ! বিকেলে নানুর বাসায় পৌছে একটা ফোন করে দিলেই হবে !
বাসে উঠার পর অবশ্য বেশ মজা লাগছিল ! একা একা ৪/৫ ঘন্টার একটা জার্নি । মজাই লাগছিল ! তবে ভয়ে ছিলাম আমার পাশে কে বসবে এই টা নিয়ে ! যদিও জানলার ধারে সিট পাই নি, আমি জানলার পাশেই বসলাম ! যে আসবে তাকে রিকোয়েস্ট করলে নিশ্চই আমাকে উঠিয়ে দিবে না !
মেয়েদের রিকোয়েস্ট ছেলেরা ফেলতে পারে না ! তবে মেয়ে আসলে ভিন্ন কথা !
কিছুক্ষন পর কালো ব্যাগ কাধে একটা রোগা পাতলা ছেলেকে আসতে দেখলাম, হাতে একটা নিউজ পেপার ধরা ! আমার সামনে এসে প্রথমে নিজের পকেট থেকে টিকেট বের করলো ! সিট নাম্বার দেখলো ! তারপর আমার পাশের সিটে, মানে যেটা আমার সিট, সেটাতে বসে পড়লো । আমি যে তার সিটে বসে আছি একবার বললও না সিট টা আমার ! চুপচাপ আমার সিটে বসে পড়লো !
এমন কি বাস চলতে শুরু করলেও আমার সাথে একটুও কথা বলার চেষ্টা করলো না ! আশ্চার্য !
আমি একটা মেয়ে, ছেলেটির পাশে বসে অথচ আমার দিকে তাকানোর সময় নেই জনাবের কাছে ।
থাপ্পড় দেওয়া দরকার ! তার উপর একটা ইংরেজি পত্রিকা পড়তেছে ! ভাব নিচ্ছে !
-আপনি কোথায় যাবেন ?
-এই বাস যেখানে যাবে সেখানে !
-আরে কি আশ্চর্য আমিও সেখানে যাবো !
ছেলেটি আবারও আমার দিকে তাকালো । কিছুক্ষন তাকিয়েই থাকলো ! ছেলেটির চোখে কিছু একটা আছে । গভীর কিছু একটা ! একবার তাকিয়ে থাকালে আবার তাকাতে মন চায় !
-আচ্ছা আমি না চুয়াডাঙ্গার কিছু চিনি না !
ছেলেটি কিছুটা অবাক হয়ে বলল
-তাহলে যাচ্ছেন কেন ? আপনার সাথে কেউ নেই ?
-জি না !
-কেউ নেই ?
-উহু !
-আপনার তো অনেক সাহস !
-জি ! আমি অনেক সাহসী ! আজকে বাসা থেকে পালিয়ে যাচ্ছি নানুর বাড়ি ! সাহস না থাকলে কি যেতে পারতাম ?
ছেলেটি আরও কিছুক্ষন আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে বলল
-এটা সাহস বলে না ! বলে বোকামী ! একটা মেয়ের এভাবে একা একা এতো দুরে যাওয়া ঠিক না !
-বলেছে আপনাকে !
যাক ছেলেটা কথা বলা শুরু করেছে ! সময় টা ভাল যাবে মনে হচ্ছে । আমি আমার নানার নাম বললাম । ছেলেটা চিন্তে পারলো ! অবশ্য আমার নানা ঐ এলাকর একজন বিখ্যাত মানুষ ! অনেক ব্যবসা বানিজ্য আছে ! চিনতে পারার কথা !
ফেরী ঘাটে এসে বেশ কিছুটা সময় লেগে গেল ! একটু জ্যাম ছিল ! আমার একটু ভয় ভয় করতে শুরু করলো ! রাত হয়ে গেলে আবার কেমন হয়ে যাবে ! ভেবেছিলাম বিকেলের ভিতরেই পৌছে যাবো ! কিন্তু ফেরি ঘাটেই তো একটু দেরি হয়ে গেল ! বাসায় একবার ফোন দিবো কি না বুঝতে পাছি না !
না থাক ! শহরের বুকেই নানুর বাসা ! খুব বেশি সমস্যা হবে না !
কিন্তু ছেলেটার চোখে একটা অন্য রকম অস্থিরতা দেখতে পাচ্ছিলাম ! ছেলেটা এতো অস্থির কেন হচ্ছে ?
বাসায় কি খুব জরুরী কাজ আছে ?
ফেরীতে উঠেই ছেলেটি বাস থেকে নিচে নেমে গেল ! আমি কিছুক্ষন এদিক ওদিক ঘোরাফেরা করলাম ! উপরে যাওয়ার পথে দেখি ভিআইপি কেবিনে ছেলেটা বসে আছে চুপ করে ! সামনে এক কাপ চা কিন্তু ছেলেটার চোখের দৃষ্টি দুরে নদীর দিকে !
আমিও ঢুকে পড়লাম ভিতরে ! বয়কে চা দিতে বলে ছেলেটার মুখোমুখি বসলাম !
-আপনি আচ্ছা মানুষ তো ?
আমার কথা ছেলেটার তন্ময় ভাঙ্গলো ! আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-কেন ?
-বারে এখানে আসবে আমাকে বলবেন না ? আমিও আসতাম !
-ও !
আবারও অন্য দিকে তাকায় ?
পাজি ছেলে ! এদিকে তাকাও ! একটা মেয়ে তোমার দিকে তাকিয়ে অন্য দিকে তাকানো টা অভদ্রতা !
আমি হঠাৎ বললাম
-আপনার মন খারাপ ?
-কেন ?
-আপনার চোখ দেখে মনে হচ্ছে ! মন খারাপ ?
ছেলেটা কিছুক্ষন আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল
-আজকে আমার প্রেমিকার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে !
ছেলেটা কথাটা বলল অন্য দিকে তাকিয়ে ! আমি খানিকটা ধাক্কার মত খেলাম কথাটা শুনে ! অন্তত ছেলেটার কাছ থেকে এই কথা শোনার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না !
-আমি যাচ্ছি ওকে শেষ বারের মত একটু দেখতে !
কথাটার ভিতর কিছু একটা ছিল ! আমার বুকটা কেমন যেন কেঁপে উঠলো ! এতো বিষন্ন কোন কথা হতে পারে আমি ভাবতেও পারি নি !
ছেলেটা অন্য দিকে তাকিয়ে কথা বলছিল ! আমার চোখে চোখ রেখে নয় ! আমার কেন জানি মানে হচ্ছে ছেলেটা নিজের চোখের জল আটকানোর আপ্রান চেষ্টা করছে ! একটা অপরিচিত মেয়ের সামনে কেঁদে ফেলাটা নিশ্চই লজ্জার হবে !
আমি কি বলবো ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না ! বললাম
-আমার নাম স্পর্শীয়া ! তুমি ?
হঠাৎ করে কেন জানি ছেলেটাকে তুমি করে ডাকতে ইচ্ছে হল ! কেন হল আমি বলতে পরবো না !
ছেলেটি বলল
-আমি সুমন !
-কখন জানতে পেরেছো বিয়ের কথা টা !
-আজই ! ওর সাথে অনেক দিন যোগাযোগ ছিল না !
-কেন ?
-কোন কারন নেই ! আসলে আমাদের দুজনেরই জানা ছিল যে আমাদের বিয়ে হবে না কোন দিন ! আমার পড়ালেখা শেষ হয় নি ওদিকে ওর বিয়ের বয়স হয়ে যাচ্ছে ! এসব নিয়ে দুজনেই একটু ডিপ্রেসড ছিলাম ! তবে ...।
-তবে ?
-থাক ! এখন বলতে ভাল লাগছে না !
আমি আর কিছু জানতে চাইলাম না ! কেবল সুমনের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম ! ছেলেটার চোখে গভীরতা দেখেছিলাম এখন সেটা আরও পরিস্কার দেখা যাচ্ছে ! কাছের মানুষটিকে হারানোর কষ্ট ! গভীর কষ্ট !
ফেরি পার হয়ে আবার যাত্রা শুরু হল তবে এবার ছেলেটি অত কথা বলল না ! আমিও কথা বললাম না বেশি ! সুমনের দিকে তাকিয়ে থাকলাম !
কত বড় একটা কষ্ট নিয়ে ছেলেটি ছুটে চলেছে স্বভাবিক ভাবে ! নিশ্চই বুকের ভিতর তোলপাড় চলছে ! বাইরে না দেখা গেলেও ঝড় চলছে ঠিকই !
কিন্তু বাইরে থেকে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না !
চুয়াডাঙ্গায় বাস টা যখন থামলো তখন সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে ! সুমন যখন রিক্সা নেমে তখনই আমি বললাম
-আমি তোমার সাথে আসি ?
-কোথায় ?
-বিয়ে বাড়িতে ! আসবো ?
সুমন কি যেন ভাবলো ! বলল
-আচ্ছা !
দুজনেই রিক্সা চেপে বসলাম ! যতই রিক্সাটা এগোচ্ছিল সুমনের উৎকন্ঠা আমি বুঝতে পারছিলাম ! সাথে সাথে আমি নিজেও যেন কেমন যেন অনুভব করছিলাম ! বোঝাতে পারবো না !
রিক্সাটা কয়েকটা বাক নিয়ে একটা গলির মাথায় এসে থামলো ! সামনে অন্ধকার ! কিছুক্ষন দাড়িয়েই রইলাম ! রিক্সাটার পাশে ! সুমন লম্বা একটা নিঃশ্বাস টেনে সামনে হাটা দিল ! আমি ওর পিছনে ! একটা বাড়ির সামনে এসে দাড়ালাম !
পুরো বাড়ি লাইটিং করা ।আলো জ্বলছে নিভছে ! তবে ভেতর থেকে খুব বেশি আওয়াজ আসছে না। কেমন একটা নিরব নিরব ভাব !
তবে কি বর যাত্রী বউ নিয়ে চলে গেছে ?
সুমন শেষ দেখা করতে পারলো না !
আমি অন্ধকারের ভিতরেও সুমনের মুখের অস্থিরতা ঠিকই বুঝতে পারছিলাম ! সুমন অস্থির ভাবে কাকে যেন ফোন দিল ! ওর হাত কাঁপছিল !
কিছুক্ষন পরেই একজন বের হয়ে এল !
কিছুক্ষন কেউ কোন কথা বলল না !
আমি কেবল অন্ধকারে দুটি ছায়া মুর্তি দেখতে পাচ্ছিলাম ! সুমন কেবল একটা কথা জানতে চাইলো
-কখন গেছে ?
-এই তো ঘন্টা খানেক !
সুমন আর কিছু না বলে পিছন ফিরে হাটা দিল ! আমি এলাম ওর পিছন পিছন ! কেন জানি আমার নিজের খুব কান্না আসছিল !
কান্না আসার কোন কারন নেই তবুও !
ল্যাম্প পোস্টটার নিচে আমাদের রিক্সাটা দাড় করানো ছিল ! আমি ওখানে গিয়ে সুমনের চেহারা দিকে তাকালাম !
ছেলেটা এখনও চোখের পানি আটকানোর চেষ্টা করছে !
বোকা ছেলে !
একটু কাঁদো !
কেউ যদি কান্না দেখেই ফেলে ক্ষতি কি !
কান্না চেপে রেখো না !
কান্না চেপে রাখতে নেই !
সুমন রিক্সায় উঠতে উঠতে বলল
-চল তোমাকে পৌছে দিয়ে আসি ! রাত হয়ে গেছে !
আমি চুপ করে উঠে বসলাম ওর পাশে ! রিক্সা আবারও চলতে শুরু করলো ! পুরো রিক্সা ভ্রমনে ও কেবল একটা কথা বলল
-জানো স্পর্শীয়া, আমার জীবনের একটা একটা খুব বড় ইচ্ছে ছিল ওকে বউয়ের সাজে দেখবো ! লাল বেনারশি হাত মেহেদী....
সুমন কথাটা শেষ করলো না ! দেখলাম হাত দিয়ে চোখ মুছলো !
কাঁদলো কি একটু ?
আমার আবারও কান্না আসতে লাগলো !
আশ্চার্য আমার কান্না কেন আসছে ?
একটা অচেনা ছেলের জন্য কান্না কেন আসছে ?
নানুর বাড়ির গেটের সামনে নেমে পরলাম ! সুমনও নামলো ! একটু হাসার চেষ্টা করে বলল
-আচ্ছা তাহলে আসি ?
সুমনের কন্ঠে কিছু একটা ছিল ! আমি সুমন কে জড়িয়ে ধরে হুহু করে কেঁদে ফেললাম !
কেন ফেললাম জানি না ! কেবল সুমনের কষ্টটা নিজের কষ্ট মনে হচ্ছিল !
খুব বেশি কষ্ট লাগছিল !
সুমন ঐ রিক্সা নিয়েই চলে গেল ! আমার চোখ দিয়ে তখনও পানি পড়েই চলেছে ! গেট বেল বাড়িয়ে যখন নানু বেরিয়ে এল তখনও আমার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে !
নামু আমাকে দেখে না যত টা না অবাক হয়েছে তার চেয়েও বেশি অবাক হল আমার চোখের পানি দেখে ! বলল
-এই কি হয়েছে তোর ? কাঁদছিস কেন ? আমার নানু ভাই টা কাঁদছে কেন ? এই কে আসিস তোরা ? এদিকে আয় ! আমার নানু ভাই কাঁদছে কেন ?
আমি কোন কথা বললাম না ! কেবল নানু জড়িয়ে ধরে কেঁদেই চললাম !
এই কান্না কার জন্য আমি জানি না ! কান্নার কারনও আমার অজানা !
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ বিকাল ৩:৪৫