মোবাইল স্ক্রীনে সময়টা দেখে ইমনের মেজাজটা আরো একটু খারাপ হল । খেলা শেষ হয়েছে প্রায় আধাঘন্টা হয়েছে এখনও কোন শালার দেখা নেই ! সব বেটাকে থাপড়ানো দরকার । থাপড়িয়ে পাগল বানিয়ে দেওয়া উচিৎ !
আরে বেটা বাংলাদেশ খেলায় জিতেছে আজকে তুই কি আনন্দ মিছিল এক সপ্তাহ পরে করবি নাকি ?
ইমন সেই কখন ফোন দিয়েছে এখনও এক বেটারও খোজ নাই ।
বিরক্ত হয়েই ইমন আবার ফোন লাগালো জামিকে ।
-কইরে তুই ?
-আরে দোষ্ত আসতাছি !
-আর কতক্ষন ? কতক্ষন ধরে এখানে বসে আছি !
ইমন চিৎকার দিয়ে উঠে !
-আরে বেটা চিল্লাস ক্যান ! মিছিল করবি তা লোক জন লাগবে না ? আমি আর তুই খালি মিছিল করবো নাকি ? লোক জন নিয়া আইতাছি ! তুই থাক ! বেশি না আর দশ মিনিট ! একটু বইয়া থাক !
জামি ফোন রেখে দেয় !
ইমনের মেজাজটা আরো একটু খারাপ হয় ! আসলে নিজের উত্তেজনকে ইমন কিছুতেই নিজের ভিতর আটকে রাখতে পারছে না !
বারবার চিৎকার করে বলে উঠতে ইচ্ছা করতেছে
দেখো ! আমার দেশ জিতছে ! আমার দেশ খেলায় জিতছে !
আমরা জিতছি !
কিন্তু এভাবে একা একা চিৎকার করতে দেখলে মানুষজন কি বলবে !
কষ্ট একা একা পালন করতে হয় কিন্তু আনন্দ পালন করতে হয় সবার সাথে ! আর যেটা দেশ কেন্দ্রীক সেটা তো একা একা পালন করার উপায় নাই !
এই আনন্দ কে কোন কিছুর সাথে তুলনা করা যায় না ! যখন বিশ্বের বুকে নিজের দেশের পতাকা স্বগৌরবে উঠে তখনকার অনুভুতি প্রকাশ করার মত শব্দ মনে হয় এখনও সৃষ্টি হয় নি । মুশফিক যখন বোলারের প্রতিটা বল ব্যাট দিয়ে বাড়ি মারছিল তখন ইমনের বুকের ভিতর কে যে হাতুরী পেতাচ্ছিল । আগে ইমন ব্যাপারটা ঠিক বুঝতো না ! কিন্তু এখন যত বড় হচ্ছে আস্তে আস্তে বুঝতে পারে ! এখন বাংলাদেশের খেলা হলেই ইমন মনে মনে সেই উত্তেজন অনুভব করে ! এখন সে খানিকটা হলেও বুঝতে পারে কেন এমন উত্তেজনা হয় কেন এমন আনন্দ হয় !!
কত খেলা হয় । কত বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলা দেখেছ ! এর থেকেও টানটান উত্তেজনার খেলা দেখেছে কিন্তু এমন তো মনে হয় না এমন উত্তেজনাও অনুভব হয় না ! এই খেলা দেখে যেমন শরীরের প্রতিটা লোম কুপ দড়িয়ে ওঠে অন্য খেলা গুলো দেখে তেমন টা হয় না ! হবে কেমন করে ?
সেই খেলায় তো আর নিজের দেশ খেলে না ! সেই খেলায় বাংলাদেশ খেলে না ! নিজের দেশের খেলার যে আনন্দ আর উত্তেজনা থাকে অন্য খেলায় কি আর তা থাকে ?
ইমনের বাড়ির পাশের আকবার চাচারা থাকে ! একটা সময় প্রায় তার বাসায় যাওয়া হত ইমনের । আকবার চাচা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন ! যখন তার মুখে মুক্তিযুদ্ধের শুনতো ইমন অবাক হয়ে লক্ষ্য করতো আকবার চাচা কেমন উত্তেজনায় কাঁপছে ! তখন মনে হত তিনি সামনে সব কিছু দেখতে পাচ্ছেন !
ইমন খানিকটা অবাক হত ! তখন ঠিক মত বুঝতো না ! কিন্তু এখন তার কিছুটা হলেও বুঝতে পারে ! হয়তো এই উত্তেজনা আকবার চাচার কাছে কিছুই না কিন্তু ইমন ভাল করে বুঝতে পারে তার অনুভতিটা কেমন !!
ইমন আবারও মোবাইলের দিকে তাকালো ! কেবল মাত্র পাঁচ মিনিট পার হয়েছে অথচ মনে হচ্ছে কতটা সময় পার হয়ে গেছে !
উত্তেজনা প্রশমিত করার জন্য এখন সিগারেট দরকার । বড় বড় দুটো টান দিয়ে ধোয়া ভিতরে গেলে একটু হয় তো সময় কাটবে !
শালার জামি !
ইমন আরেক বার জামির গুষ্টি উদ্ধার করে আশে পাশে তাকালো ! সিগারেট দরকার ! বাসা থেকে বের হওয়ার সময় তাড়াহুড়া করে প্যাকেট টা আনতে মনে নেই ! আসে পাশে তাকিয়ে কোন সিগারেট ওয়ালাকে পাওয়া গেল না ! দুরে মাঠের ডান কোনায় একটা ঝালমুড়িওয়ালাকে দেখা যাচ্ছে !
ওখানে যাবনে কি না ইমন কিছুক্ষন ভাবলো ! যদিও ওখানে সিগারেট পাওয়ার সম্ভাবনা কম তবুও একবার খোজ নিতে দোষ নাই ! পাওয়া গেলেও যেতে পারে !
-চাচা সিগারেট পাওয়া যাবে ?
-না বাবা ! সিগারেট বেঁচি না !
ইমন হতাশ হল ! জামিরা কখন আসে কোন ঠিক ঠিকানা নাই ! এতোক্ষন বসে থাকবে এখানে ?
এখানকার স্থানীয় মাঠ ! আসে পাশে অবশ্য কোন দোকানপাট নাই ! বিকেল বেলা এখানে ফুচকা চটপতি দোকান বসে । দুএকটা ভ্রাম্যমান সিগারেটের দোকান বসে । সবই অবশ্য বিকেল আর সন্ধ্যায় ! বিকেল হতে এখনও বেশ খানিকটা সময় বাকি আছে ! এখনও কেউ এসে পৌছায় নাই !
ইমন আবারও খানিকটা ইতস্তত বোধ করলো ! এখানে বসে থাকবে নাকি কাললীর মোড়ে গিয়ে সিগারেট নিয়ে আসবে !
আর হ্যা ! একটা পতাকাও দরকার ! পতাকা জড়িয়ে মিছিল করা গেলে ভাল লাগতো আরও !
অন্যান্য দিন আরো কত টাইপের দোকান বসে ! আজকে তার কিছুই নেই ! এমনটাই হয় ! যেদিন যে জিনিসটা দরকার সেই জিনিসটাই পাওয়া যায় না !
-বাবাজীর খুব চিন্তা মনে হইতাছে ? পাঁচ টেকার চানাচুর দেই ? বাইয়া বাইয়া খান ?
-না চাচা ! চানাচুরে কাজ হবে না ! এখন সিগরেট লাগবে ! বাংলাদেশ আজ ক্রিকেট খেলায় জিতছে ! কি যে আনন্দ লাগছে ! চানাচুরে কাম হবে না !
- দেখেন কাম হয় নাকি ? ভালা মশলা আছে ?
-আরে চাচা বুঝবেন না আপনি ! বাংলাদেশ জিতছে ! আমার দেশ জিতছে ! বুঝছেন ! ক্রিকেট খেলায় জিতছে !
-আমি বাবা বুড়া মানুষ ! ক্রিকেট ফ্রিকেট বুঝি না !
ইমন খানিকক্ষন চানাচুরওয়ালার দিকে তাকিয়ে রইলো ! এই যুগে ক্রিকেট বুঝনা এমন লোক আছে নাকি ?
সেই কবে থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাড়িয়ে আছে এই ক্রিকেটের জন্য আর এই লোক বলে ক্রিকেট বুঝে না !
ইমন বলল
-চাচা ! এইটা আপনি একটা কথা কইলেন ? বাংলাদেশের এই একটা ক্রিকেট খেলাই তো আছে ! আর আপনি বলেন ক্রিকেট বুঝেন না ? আপনে তো দেশপ্রেমই বুঝেন না ! বাংলাদেশ যখন খেলে তখন সেইটা খেলা মনে হয় না ! মনে হয় বাংলাদেশ যুদ্ধ করতাছে ! আমার দেশ যুদ্ধ করতাছে !
চাচা কিছু না বলে তাকিয়ে রইলো !
-আর যখন বাংলাদেশ খেলায় জিতে মনে হয় আমরা আবার যুদ্ধে জিতছি !
মুক্তিযুদ্ধে জিতছি !
-আপনার ভিতর অনে দেশপ্রেম বুঝি ? ভালা লাগলো ! আপনার দেশ প্রেম দেখে অনেক ভালা লাগলো !
-চাচা আপনি বুঝবেন না ! শরীরের প্রতিটা লোম দাড়িয়ে যায় যখন বাংলাদেশ খেলে ! বুঝছেন ? শালার আজকে পতাকা গায়ে দিয়ে মিছিল করুম কোথায় একটা পতাকা পাই না !!! আপনে বুঝবেন না চাচা ! আপনি বুঝবেন না !
-বুঝি গো বাবা ! বুঝি ! ৪২ বৎসর আগে আমিও একটা খেলা খেলছিলাম ! দেশের জন্য খেলেছিলাম । সেই খেলার ট্রোফি এখনও মাথায় নিয়া ঘুরতাছি !
ইমন ঠিক বুঝতে পারলো না চাচা আসলে কি বলতে চাচ্ছে ! ইমনকে অবাক করে দিয়ে ঝালমুড়িওয়ালা চাচা নিজের ঝুড়ির এক কোন থেকে একটা পতাকা বের করে ইমনে হাতে দিয়ে বলল
-এই নেন ! পতাকা গায়ে দিয়া মিছিল করেন ! দেশের জন্য মিছিল করেন ! পতাকার গায়ে আঁচড় লাগতে দিয়েন না। দেশ কষ্ট পাবে !
তোয়াজ আলীর চোখে দিয়ে পানি পড়তেছে । তবে এই অশ্রু কষ্টের না আনন্দের ! ৪২ বছর আগে যে দেশের জন্য জন্য যুদ্ধ করেছিলেন সেই দেশের এই নতুন প্রজন্মকে দেখে তার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে । তাদের মত এই নতুন প্রজন্মও দেশ কে ভালবাসতে শিখেতে এটা দেখে তোয়াজ আলীর খুব ভাল লাগছে ! ৪২ বছর আগে যেমন তিনি দেশের জন্য যুদ্ধ করেছিলেন দেশের পতাকার গায়ে আঁচড় লাগতে দেননি আজকে এই ছেলেটার হাতে সেই পতাকা তুলে নিয়ে তোয়াজ আলীর মনে হল এরাও দেশের জন্য যুদ্ধ করবে ! দেশের পতাকার গায়ে আঁচড় লাগতে দেবে না !
তোয়াল আলীর চোখ দিয়ে পানি পড়ছে ! আনন্দ অশ্রু !
গল্পটা যদিও আমি লিখেছি তবে গল্পের মুল থিম টা আমার না ! দুদিন আগে নোমান ভাইয়ের ওয়ালে বিএম ইমনের তৈরি একটা শর্টফ্লিম দেখলাম । নাম সমর্পণ (The Rendition) ! নোমান ভাইয়ের লেখায় ফ্লিমটা বানানো !
তিন মিনিটের একটা ফ্লিম ! কিন্তু তাতে শত বছরের অনুভুতি মেশানো ! দুতিন ঘন্টার একটা মুভি যেখনে মানুষের মন কে নাড়া দিতে পারে না যেখানে এই তিন মিনিটের ফ্লিম টি কিভাবে নিজের অনুভুতিকে নাড়া দিয়ে দিল তা বোঝানো যাবে না !
গল্পটি সেই শর্টফ্লিম অবলম্বনেই লেখা ! যদিও ভাল করে ফুটে ওঠে নাই !
সবার কথা অনুরোধ রইলো শর্টফ্লিমটা একবার হলে দেখার জন্য ! আপনার অনুভুতিকে নাড়া দিবে এই গ্যারান্টি টুকু আমি দিতে পারি !!