এক
ভোর হতে এখনও একটু বাকি আছে । চারিপাশে এখনও আলো ফুটে নাই ভাল করে । এই আবছায়া অন্ধকারের ভিতর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে একটা মাঝারি জটলা দেখা যাচ্ছে ! খুব বেশি মানুষ জন নেই ! দুইটা তিনটা ব্যাক্তিগত মাইক্রবাস আর কয়েকটা সংবাদ মাধ্যমের গাড়ি দেখা যাচ্ছে !
পাঁচটার বাজার অপেক্ষা করছে সবাই । ভোর পাঁচটার সময় লাশ সরবারহ করা হবে জানানো হয়েছে । সেই লাশ নেওয়ার জন্যই অপেক্ষা । সংবাদ মাধ্যমের লোক গুলো মুখে একটা দুঃখি দুঃখি ভাব নিয়ে অপেক্ষা করছে । কিন্তু একটু ভাল করে লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে আসলে কেউ এমন দুঃখি নয় ! সবার চেহারা মাঝে কেমন একটা শান্তি শান্তি ভাব রয়েছে । একটা চাপা আনন্দ কাজ করছে !
কারাগারের চারিপাশে বেশ কিছু পুলিশ আর র্যাব মোতায়েন রয়েছে ! তার থেকেও দুরে দাড়িয়ে রয়েছে আরো কিছু মানুষ ! চারিদিকে অন্ধকার রয়েছে তাই দুর থেকে দেখলে লোক গুলো কেমন একটু কুকুরের মত মনে হচ্ছে । ক্ষনে ক্ষনে কুকুর যেমন করে কেঁদে উঠে ঠিক তেমনি আওয়াজ শোনা যাচ্ছে !
কারাগারের দরজার সামনেই একজন মহিলা দাড়িয়ে আছে । সঙ্গে তার এক যুবক ছেলে ! যার লাশ সরবারহ করা হবে সে এই যুবকের বাবা । যুবক বাবার লাশের জন্য অপেক্ষা করছে । কিন্তু তার মনে অন্য চিন্তা !
বাবার লাশ নাকি এই বাংলার মাটিতে কবর দিতে দিবে না !
একটু আগে সে তাদের গ্রামের বাড়িতে ফোন করেছিল । যেখানে তার বাবাকে দাফন করার কথা ছিল । গ্রামবাসি নাকি কিছুতেই কবর খুড়তে দেয় নি ! তাদের একটাই কথা কোন রাজাকারের কবর এই পবিত্র বাংলায় হবে না ! হতে দেওয়া হবে না !
যুবক চিন্তায় আছে । তার বাবা কবর কোথায় হবে ?
এই গেট খুলছে ! কেউ একজন বেরিয়ে আসছে .......
দুই
১৬ই ডিসেম্বর, ২০১৩
তোয়াজ আলীর দ্রুত পা চালাচ্ছে ! দুই ক্রাচে ভর দিয়ে একটা পা নিয়ে হাটতে তার বেশ কষ্ট হওয়ার কথা । কিন্তু তোয়াজ আলী সেই কষ্ট অনুভব করছেন বলে মনে হয় না । কেবল সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন !
কাটাবন থেকে সোরওয়ার্দী উদ্যান ! বেশ খানিকটা পথ । অন্তত একজন খোড়া মানুষের জন্য তো বটেই । অল্প ক্ষনের মধ্যেই তোয়াজ আলীর ঘাম ছুটে গেল !
কিন্তু কিছু করার নাই ! কাটাবনের পর থেকে রাস্তা বন্ধ ! কোন প্রকার যানবাহন যেতে দেওয়া হচ্ছে না ! বিকেল বেলা শাহবাগ আর সোরওয়ার্দী উদ্যানে বিজয় উৎসব হবে ! তোয়াজ আলী সেই উৎসবে যোগ দেওয়ার জন্যই এসেছেন ! একজন মুক্তিযোদ্ধার বেসে আজকে বিজয় উৎসবে যোগ দিতে এসেছেন !
দীর্ঘ ৪১ বছর তিনি বাসায় বসে বিজয় উৎসব পালন করেছেন ! তোয়াজ আলী স্ত্রী কিছুতেই তাকে বাইরে আসতে দেন নি পায়ের কারনে ! যুদ্ধ তার একটা পা নিয়ে গেছে । তিনি আফসোস করেননি ! দেশের জন্য প্রান দিতে প্রস্তুত ছিলেন সেখানে একটা পা কিছুই না ! কিন্তু যুদ্ধের পরে যখন রাজাকার গুলো নিজের আসে পাশে দেখতেন একটা অন্ধ আক্রসে ফেটে পরতেন ! কাটা পা নিয়ে অবশ্য তার কিছুই করার ছিল না ! কিছু করার ক্ষমতা ছিল না তাদের প্রভাব পতিপত্তির কারনে ! বুকের ভেতরে কেবল একটা চাপা কষ্ট কাজ করতো ! বারবার ভাবতেন এই কারনেই দেশ স্বাধীন করেছিলেন তারা !
কিন্তু আজকের উৎসবে তাকে যে যোগ দিতেই হবে ! আজকে সেই চাপা কষ্টের কিছুটা তো লাঘব হয়েছে ! কিছুটা শান্তি সে পাচ্ছে ! তার সাথে শান্তি পাচ্ছে ৩০ লক্ষ শহীদ !
আজকের এই দিনে ঘরে কি বসে থাকা যায় ? এক বিজয়ের পর আরেক বিজয় পেয়েছে তারা ! এই দিনে কি ঘরে বসে থাকা যায় ?
তোয়াজ আলী আরো জোরে পা বাড়ালেন ! উত্তজনা আর আনন্দের কারনেই হয়তো সামনে পরে থাকা ইট টা আর চোখ এড়িয়ে গেল ! হোঁচট খেলেন ! ঠিক পাকা রাস্তার উপর পড়তে যাবেন তখনই কেউ একজন তাকে ধরে ফেলল ! না ধরে ফেলল হয়তো সোজা পিচের রাস্তার উপরই পড়ে যেতেন !
-আরে চাচা আস্তে ! এতো তাড়াহুড়ার কি আছে ? আরেকটু হলেই তো পড়তেন !
তোয়াজ আলী হাসলেন ! যে তাকে পরার হাত থেকে বাঁচিয়েছে তার দিকে তাকিয়ে দেখলেন ! বয়সে যুবক । গায়ে রং ফর্সা ! চোখে চশমা ! যুবক বলল
-হাসছেন কেন ?
-এমনি হাসি ! আজকা পড়লেও কোন ব্যাথা পাইতাম না বাবাজি !
-কেন ?
তোয়াজ আলী কথা না বলে কেবল হাসলেন ! আনন্দের হাসি !
-কোথায় যাচ্ছেন ?
-ঐ খানে উৎসব হইতাছে না ?
-সোরওয়ার্দী উদ্যানে ?
-হ ! ঐ খানে !
-চলেন আমিও যাচ্ছি ওখানে ! আমার সাথে সাথে চলেন ! আর এতো তাড়াহুড়া করার দরকার নেই ! এখনও অনেক সময় আছে উৎসব শুরু হওয়ার !
তোয়াজ আলী আস্তে আস্তে হাটতে থাকে ! তার পাশে যুবকও হাটতে থাকে ! আজকে যুবকের মনেও অনেক আনন্দ ! আর কত বছর পরে তার মুক্তিযোদ্ধা বাবার আত্মা যেন একটু শান্তি পেয়েছে । একজন রাজাকারের ফাঁসি এই বাংলার মাটিতে হয়েছে !
ঐতো বিজয় ধ্বনি কানে আসছে ! মাইকে গান শোনা যাচ্ছে !
জয় বাংলা !
বাংলার জয় !
হবে হবে হবে ......হবে নিশ্চয়..।
কালকের গল্পটি এডিট করে দিলাম আজকে ! জয় বাংলা !