-কবিতা শুনবে বাবু ?
-তোমার লেখা ?
-হুম ।
হৈম আমার গায়ের সাথে হেলান দিয়ে বসে ছিল । আমার ডান হাতটা দুহাত দিয়ে ধরে ছিল । বাচ্চা মেয়েদের মত আদুরে গলায় বলল
-তোমার লেখা হলে শুনবো । অন্য করোটা শুনবো না ।
আমার হৈমর এই বাচ্চাদের মত আদুরে কন্ঠটা শুনতে খুব মজা লাগে ।
আমি কবিতা বলতে শুরু করলাম
তুমি আমি পুরো মন রাজ্য সেই রাজ্যের রানী ।
একটু আগে ঝালমুড়ি খেয়েছি এখন খাওয়া দরকার পানি !
-কি ?
হৈম আমার গায়ের সাথে হেলান দিয়ে বসে ছিল । সোজা হয়ে বসলো । ওর মুখ দেখে মনে হল আমার উপর রাগ করেছে । রাগ মুখেই বলল
-তোমার সাথে কথা নাই । তুমি পচা !
-আরে শুনো না ।
-না শুনবো না । তুমি আমার সাথে কথা বলবা না । আমি তোমার সাথে থাকবো না ।
এই বলে হৈম উঠে চলে যেতে চাইলো !
-আরে আরে যাও কই ! শুনবা তো !
তোমার জন্য সাত সমুদ্দুর আর তের নদী এই করেছি পার !
কখনও চলেছি পালে আর কখনও টেনেছি দাড় !
ছুটে এসেছি ঘোড়ায় চড়ে, হেটেছি খালি পায়ে !
.....
-এই চুপ !
-আরে চুপ কেন ?
-তুমি আবার উল্ট পাল্ট কিছু বলবা !
-না বাবু ! এসব কি বল ?শুনো না ।
ছুটে এসেছি ঘোড়ায় চড়ে হেটেছি খালি পায়ে
কখনও চলেছি শুক্ন ডাঙ্গায় কখনও উঠেছি নায়ে !
তোমার জন্য এই এসেছি, এনেছি আমার মন
হৃদয়ের রানী ধরা দাও তুমি ভালবাসা কর গ্রহন ।
হৈম মুখ ভেঙ্গিয়ে বলল
-ইস ! আমার বয়েই গেছে গ্রহন করতে ! যাও যাও ! এই টুকুতে চিড়ে ভিজবে না ।
-চিড়ে ভেজাতে হলে আয় কি কি করতে হবে ?
-আরো অনেক অনেক কিছু !
তুমি চাইলেই আকাশের চাঁদ আনবো আজকে পেড়ে !
তোমার জন্য লক্ষ টাকার চাকরী দিবো ছেড়ে ।
তুমি যদি বল ঢাকা শহরটা করবো মরুউদ্যান ।
তুমি চাইলেই আরিফিন রুমী গাইবে না আর গান !
-হয়েছে ! তোমার পচা কবিতা আমি শুনবো না ।
কপট রাগ দেখানোর চেষ্টা । আমি যদিও জানি আজকে ও কিছুতেই রাগ করতে পারবে না । মন খারাপ করতে পারবে না ।
একটু একটু করে স্বপ্ন দেখেছি ! একটু একটু করে স্বপ্নটাকে সাজিয়েছি !
শুধু এমন দিনে !
তোমার মুখে একটুকরো হাসি ফোটাবো বলে !
বল তুমি কিভাবে মন খারাপের সাথে সন্ধি করবে ?
সকাল বেলা যখন হৈমকে ফোন দিয়েছি তখন ওর কন্ঠস্বর কেমন ঠান্ডা হয়ে ছিল । ঘুম কাতর কন্ঠে যখন হ্যালো বলল বুঝতে মোটেই কষ্ট হল না ওর মন খারাপ । কেবল খারাপ না । অনেক খারাপ ।
আর কেনই বা হবে না ?
কোন মেয়ের জন্মদিনে যদি তার প্রিয় মানুষটি উইস করতে ভুলে যায় তাহলে তো মন খারাপ হওয়ার কথা ! আমি জেগে জেগে দেখেছি সবাই ওর ফেসবুক ওয়ালে কিভাবে শুভেচ্ছা জানাচ্ছিল । কেবল মাত্র আমি জানাই নি ।
কেন ?
কারন তো অবশ্যই আছে !
হৈম হ্যালো বলেই চুপ করে রইলো । আমি বললাম
-হ্যালো বাবু !
হৈম আরো শীতল কন্ঠে বলল
-বল !
-ঘুমাচ্ছিলা ?
-না ঘুমাবো কেন ? আইফেল টাওয়ার উপর বসে আছি !
-হেহেহে । মন খারাপ ?
কোন উত্তর নাই ।
মুখটি কেন গোমড়া, তোমার মুখটি কেন ভার ?
কার কারনে এমন হল ? এই দোষটি কার ?
মন খারাপের ইস্যুতে তাই হরতাল দিবো আজ ।
বন্ধ সকল কারখানা বন্ধ সরকারি কাজ ।
আমি আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলাম হৈম আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল
-কি বলবা বল ? আমার খুব ঘুম আসছে ।
-হুম । সারা রাত জেগে থাকলে তো এখন ঘুম আসবেই । যাক একটু জানলার কাছে আসো । দেখো বাইরের সকালটা কি চমত্কার ?
-আমি এখন বিছানা থেকে উঠতে পারবো না ।
-আহা ! উঠো না ! প্লিজ । আমিও জানলা দিয়ে সকাল দেখছি । দেখো প্লিজ ।
বুঝলাম অনিচ্ছা সত্তেও হৈম বিছানা থেকে উঠছে । আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম । একটু পরে মোবাইলে হৈম একটু শব্দ করে উঠল । মানুষ হঠাত্ করেই কিছু দেখে বিশ্মিত হলে যেমন শব্দ মুখ থেকে আপনা আপনি বের হয়ে যায় ঠিক তেমন শব্দ ।
এই মেয়ে কি ভেবেছে ?
ভুলে গেছি আমি সব ।
ভুলে গেছি বলে ভুল বুঝে তুমি দিয়ে ছিলে আড়ি !
কি মনে হয় ? এই দিনটির কথা আমি কি ভুলতে পারি ?
হৈমর ঘরটা দুই তলায় । ঘরটার পাসের একটা ছোট সজনে গাছ আছে । কিন্তু হৈম ঐটাকে বলে কড়ুই গাছ । যাক সেই কড়ুই গাছের ডাল চলে গেছে একেবারে ওর জানালার কাছে । ঐ ডালেই একটা ঝুড়ি ঝুলছে । তার ভিতর থেকে একটু ছোট্ট ম্যাও বার বার উকি দিচ্ছি । বাইরে বের হতে চাচ্ছে কিন্তু আবার একটু ভয়ও পাচ্ছে ।
আমি এখান থেকেই হৈর মুখটা দেখতে পাচ্ছি । চোখ জুরে আনন্দময় বিশ্ময় । আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু কন্ঠে বলল
-থ্যাঙ্কিউ ।
শুভ জন্মদিন বাবু ! তোমার টিংকুর গার্লফ্রেন্ড দিয়ে গেলাম । উপহার পছন্দ হইছে ?
-খুউব ।
-আচ্ছা শুনো । এখন আমি কেটে পড়ি । তোমার আম্মা যে কোন সময় চলে আসবে ।
-দাড়াও প্লিজ !
আরে না না । দেখে ফেললে উপায় আছে ! শুনো ঠিক তিনটার সময় বাইরে বের হবা ! তোমাকে এক জায়গায় নিযে যাবো । ঠিক আছে ?
-আচ্ছা ।
-আর এখন একটা ঘুম দাও । সারা রাত ঘুমাও নি । তোমার ঘুমের দরকার আছে ।
তোমার কি মনে আছে সেই লাইনটার কথা !
আঙ্গুল আর কিবোর্ডের চাপে লেখা !
পিসি মনিটরে কালো গোটা গোটা অক্ষরে,
তোমার কারনে বুকের পা পাশটা কাঁপতে শুরু করেছিল আবার !
জানো কি মেয়ে এখন কাঁপে সেটা !
কখনও মৃদু অথবা প্রবল ভাবে ।
যখন তুমি কাছে আসো,
হৃদয়ের খুব কাছে !
এপাশ ওপাশ প্রবল বেগে কেঁপে ওঠে ।
অথবা যখন দুরে যেতে চাও আমায় ফেলে !
তখন কাঁপে খুব জোরে !
মেয়ে শুনতে কি পাও সেই কাঁপন ?
মেয়ে একটু দেখ স্পর্শ করে বুকের বাঁ পাশ টাতে !
এখনও !
হৈম আমার হাতে রেখে হাটছে ! আর চোখ বন্ধ করে কবিতা শুনছে ।
-এই চুপ করলে কেন ?
-কবিতা শেষ !
-শেষ ? না হবে না । আরেক টা শোনাও !
-জীবন বাবুর কবিতা শুনবে ?
-না । আমি জীবন বাবুর কবিতা শুনবো না । আমি আমার বাবুর কবিতা শুনবো ! বল বল । জলদি বল ।
-আহা বলছি । দেখো একটু সামনে তাকিয়ে !
হৈম সামনের ইটের রাস্তাটার দিকে তাকালো । কিছু অবশ্য বুঝতে পারলো না । বোঝার কথাও না অবশ্য !
-জানো । খুব ছোট বেলা থেকে আমার একটা দারুন স্বন্ন আছে । এই যে ইটে বাঁধানো রাস্তা । দুপাশে গাছের সারি । আমি তোমার পাশে হাটছি প্রিয় মানুষটির হাত ধরে । সারা জীবন এমন দিনের জন্য । জানো কতবার কল্পনায় হেটেছি এমন রাস্তায় ! চল সামনে । দেখি সামনে কি আছে ।
আমি হাটতে থাকি হৈমের হাতটা ধরে ।
-এই ঐ দিকে কেমন গ্রাম মত দেখা যাচ্ছে ।
-আরে তাই তো ! চল অনেকক্ষন ধরে হাটছি । ঐ দোকানটার একটু বসি ।
ইট বিছানো গ্রামের রাস্তা দিয়ে আমরা সামনের দোকানটার দিকে হাটতে লাগলাম ।
ইট বাঁধানো হেড়িং আর গাছের ঘেরা এই পথে,
হাটছি দুজন তুমি আর আমি হাত রেখেছি হাতে ।
-কি খাবা বল ?
দোকানটার অবস্থা অবশ্য খুব বেশি ভাল মনে হল না । মাটির একটা ঘর । সামনের দিকটা খোলা । ভিতরে অল্প কিছু জিনিস পত্র । দোকানের সামনে একটা বাঁশের মাচা রয়েছে । হৈম ঐ মাচার উপর গিয়ে বসেছে । দোকানের আশেপাশে কয়েকটা পোলাপাইন খেলা করছিল । এখন আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে । আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-এখানে আর কি থাকবে ? দেখো তো প্যাকেট জাতীয় কিছু পাও নাকি ?
-আরে এমন বলা ঠিক না । এসব দোকানে মাঝে মাঝে ভাল ভাল জিনিস পাওয়া যায় ?
-তাই ?
-হুম ।
দোকানের ভিতর একজন মহিলা বসে ছিল ।
-চাচী ভাল আছেন । কিছু পাওয়া যাবে ?
-হ ! কি লাগবো ?
আমি হৈমর দিকে তাকিয়ে বললাম
-দেখলে তো ? কি খাবা বল ?
হৈম কিছুক্ষন ভেবে বলল
-তুমি তো জন্মদিনে গিফট সেই সকাল বেলা দিয়েছ । কিন্তু কেক তো খাওয়াও নি । কেক খাব ।
-গিফটও আমি দেব আবার কেকও আমি খাওয়াবো । যাও । তুমিও মনে রাখবে ।
আমি চাচীর দিকে তাকিয়ে বললাম
-চাচী কেক পাওয়া যাবে ?
চাচী একটু ফিক করে হেসে দিয়ে বলল
-হ যাইবো । বাড্ডে কেখ পাউয়া যাইবো !
এই বলে চাচী একটা কেকের প্যাকেট আমার দিকে বাড়িয়ে দিল ।
আমি যখন কেকের প্যাকেট নিয়ে হৈমর দিকে ফিরলাম ও খানিকটা অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল । তারপর বলল
-আমার সাথে ফাজলামী কর না ? এই জায়গায় তোমার বার্থডে কেক থাকবে ?
-আরে থাকতে পারে না ।
-হুম খুব পারে । আমার তো মনে হচ্ছে কেকের উপর আমার নামও লেখা আছে ।
হৈময চেহারাটা আনন্দে ঝলমল করছে । ওর আনন্দ মাখা মুখটা দেখে আমার নিজেরই খুব আনন্দ হচ্ছে ।
হঠাত্ করেই হৈম আমার দিকে একভাবে তাকিয়ে রইলো । ওর চোখে পানি জমতে শুরু করেছে ।
-এই খবরদার । চোখে পানি যেন না আছে । চোখে কাজল দিয়েছ । চোখ দিয় পানি বেরুলে কিন্তু পেত্নীর মত লাগবে । বাচ্চারা পাবে !
হৈম হেসে ফেলল ।
-একটা মাইর খাবা !
একসাথে কেক কাটলাম । কোথা থেকে অনেক গুলো ছেলেপিলে এসে হাজির ।
কেক খাওয়ার পর সেই গাছে ঘেরা রাস্তাটায় আবার ফিরে এলাম । দুজন মিলে সুর্য অস্ত যাওয়া দেখলাম পাশাপাশি বসে । সারাটা সময় ও আমার হাত ধরে ছিল । একটু সময়ের জন্যেও আমার হাত ছেড়ে দেয় নি ।
হাতটা ধরে আছি, তুমিও হাতটা ধরে রেখো ।
শত ঝঞ্ঝাট ঝড় আসুক তবু একটু হাসি একো ।
সবাই যদি ছেড়ে চলে যায় আমি পাশে থেকো ।
আমি ছিলাম, আছি, থাকবো যেন কভু যাবো ছেড়ে যাবো নাকো !
ওকে বাসায় পৌছে দিতে দিতে রাত হয়ে গেল । বাসায় যখন পৌছালাম একটা মেসেজ এসে হাজির । সেখানে কেবল একটা লাইন লেখা
"এমন একটা দিনের জন্য আমার কত অপেক্ষা ছিল । আই লাভ ইউ ।"
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই অক্টোবর, ২০১৩ রাত ১২:১৪