কম্পিউটার মনিটরের দিকে রেদুয়ান এক ভাবেই তাকিয়ে আছে । প্রথম বার মনে হল হয়তো ভুল দেখছে কিন্তু আর একবার যখন রিফ্রেশ করে দেখলো তখনও গোটা গোটা কালো অক্ষর গুলোর কোন পরিবর্তন হল না । নাহ ঠিকই দেখেছে ।
রেদুয়ান আহমেদ । জিপিয়ে ফাইভ । যাক অবশেষে পাওয়া গেল । কাঙ্খিত রেজাল্টটা হাতের মুঠোও অবশেষে ধরা দিয়েছে ।
-ভাইয়া তুই এ প্লাস পেয়েছিস ?
পেছন থেকে কখন নীলু এসে হাজির হয়ে রেদুয়ান লক্ষ্যই করে নি । ও কিছু বলতে যাবে তার আগেই নীলু জোরে একটা চিতৎকার দিয়ে বাড়ি মাথায় তুলল ।
-আম্মু দেখে যাও ভাইয়া এ প্লাস পেয়েছে । তোমার ছেলে এ প্লাস পাইছে !
রেদুয়ানের রেজাল্ট নিয়ে বাসায় সবাই ই খুব চিন্তিত ছিল । বিশেষ করে রেদুয়ান যখন কলেজে ওঠে তখন থেকেই ওর পড়ালেখায় মন ছিল না একদম । সারা দিন টো টো করে ঘুরে বেড়াতো বন্ধুদের সাথে । এই বয়সে যা হয় সাধারনত ।
ফার্ষ্ট ইয়ারের ইয়ারচেঞ্জ পরীক্ষায় রেদুয়ান ঠিক মত পাশই করতে পারলো না । কলেজের প্রিন্সিপাল রেদুয়ানের বাবার পরিচিত ছিল বিধায় খুব একটা অসুবিধা হয় নি । আর আজকে রেদুয়ানের রেজাল্ট বেরিয়েছে । সে এ প্লাস পেয়েছ !
রেহানা পারভিন রান্না ঘরে ব্যস্ত ছিলেন । মনের ভিতর একটু চিন্তা কাজ করছিল । আজকে তার ছেলের রেজাল্ট দিবে । কদিন থেকেই খবরে শুনছে । দুইটার দিকে রেজাল্ট দেওয়ার কথা কিন্তু তার ছেলে এখনও ঘরেই বসে আছে । কয়েকবার তিনি দরজার সামনে থেকে ঘুরে এসেছেন । ছেলেকে দেখেছেন কম্পিউটারের সামনে ঝুকে বসে থাকতে ।
সারা দিন ঐ কম্পিউটারের সামনে বসা কি যে করে তিনি বোঝেন না । অন্তত এই রেজাল্টের দিন তো একটু এই রেজাল্ট নিয়ে চিন্তা করা উচিত্ । তিনি আর একবার যাবেন কি না বুঝতে পারছেন না । ছেলে বড় হয়েছে । জোর দিয়ে কিছু বলাও যায় না ।
রেহানা যখন ভাবলেন আর একবার ছেলের ঘরের সামনে যাওয়া উচিত্ তখনই মেয়ের চিৎকার শুনতে পেলেন । মেয়ে চিৎকার করে সারা বাড়ি মাথায় তুলছে ।
-মা ভাইয়া এ প্লাস পেয়েছে । ভাইয়া এ প্লাস পেয়েছে ।
রেহানা প্রথমে ভাবলেন হয়তো নীলু ইয়ার্কি মারছে । তিনি রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন । ততক্ষনে নীলু চলে এসেছে ।
-মা । ভাইয়া এ প্লাস পেয়েছে ?
-তুই কিভাবে জানলি । মা । তুমি বারে বার ভুলে যাও কেন ? বাসায় ইন্টারনেট আছে না ? এখন ইন্টারনেটে সব রেজাল্ট দেখা যায় ।
-চল তো আমি একটু দেখি ।
রেহানা তার ছেলের ঘরের দিকে রওনা দিলেন ।মনের ভিতর একটা আনন্দ অনুভব হচ্ছে । মাথার উপর যেন একটা কালো ছায়া সরে গেল !
ঘরে ঢুকে দেখেন রেদুয়ান প্যান্ট শার্ট পরে রেডি ।
-কোথায় যাচ্ছিস ভাইয়া ?
-একটু বাইরে যাচ্ছি । একজনের সাথে দেখা করতে হবে ।
-কার সাথে ?
-আছে একজনের সাথে ।
রেদুয়ান আর কথা বাড়ালো না । দরজার দিকে পা বাড়ালো ।
বাসা থেকে বের হতেই রেদুয়ানের মোবাইলটা বেজে উঠলো !
-হ্যালো ?
-স্যার বলেন !
-সুসংবাদ দাও !
-এ প্লাস পাইছি স্যার ।
-আমি জানতাম ! আমি বলেছিলাম না পাবা !
হুম ! রেদুয়ান নিজেও জানে তার এপ্লাস পাওয়ার পেছনে যে কয়জনের হাত আছে তার ভিতর তার এই সুমন স্যার অন্যতম ! আর একজন অসশ্য আছে ! অরিন !
আর সব চেয়ে মজার কথা হল এই দুইজন মানুষই তার জীবনে এক সাথে এসেছে !
ফোন রেখে দিয়ে রেদুয়ান আবা রহাটা দিল !
আজকে সকাল থেকেই রেদুয়ানের খুব অস্থিরতায় কেটেছে । বারবার মনে হচ্ছিল কখন রেজাল্ট হবে আর কখন সে অরিনের সাথে দেখা করবে ।
হুম । অরিন এমন কথাই বলেছিল । বলেছিল যদি এ প্লাস পাও তাহলেই আমাদের দেখা হবে । রেদুয়ান জানতে চেয়েছিল তুমি কিভাবে জানবে যে আমি এ প্লাস পেয়েছি । প্রতি উত্তরে অরিন কেবল একটু হাসির ইমো দিয়েছিল ! । বলেছিল তোমাকে যেভাব খুজে পেয়েছি । ঠিক যেভাবে তোমার খোজ খবর পাই । ঠিক সেভাবে আমি তোমার খোজ পেয়ে যাবো ।
রেদুয়ানের কাছে এখনও ব্যাপারটা খানিকটা ধোঁয়াশাই লাগে । কিভাবে এই মেয়েটার সাথে নিজেকে জড়িয়ে ফেলল ও নিজেকে । ওর স্পষ্ট মনে আছে সেদিন ওর ইয়ারচেঞ্জ পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে । রেজাল্ট খারাপ ছিল । বাসায় ওর বাবা বেশ রাগারাগি করছিল । রেদুয়ানের অবশ্য তাতে খুব একটা যায় আসে না ।
তখন সিগারেট খাওয়াটা বেশ ভাল করেই রপ্ত করেছে ও । নিজের ঘরের দরজা আটকে কম্পিউটার ছেড়ে দিল ও । তারপর ফেসবুকে লগ ইন করেই একটা সিগারেট ধরালো । ফেসবুকের পুরো পেইজ আসতেই দেখলো ওকে মেসেজ পাঠিয়েছে । ওর বন্ধু না । অপরিচিত । একটু অবাক হল কারন বার্তা প্রেরণ কারী একজন মেয়ে । অরিন আহমেদ নাম ! বার্তাটা ও খানিকট অন্য রকম ।
-আপনি এমন কেন ?
রেদুয়ান প্রথমে মনে করলো হয়তো ভুল করেই মেসেজটা চলে এসেছে । রেদুয়ান লিখলো ।
-সরি । ঠিক বুঝলাম না ।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই রিপ্লে এসে হাজির ।
-কেন ? না বোঝার কি আছে । পরিস্কার বাংলায় তো লিখেছি ।
-এই প্রশ্ন আমার কাছে করার মানে কি ? আমি কি আপনাকে চিনি ?
-হুম । আপনি আমাকে না চিনলেও আমি আপনাকে চিনি ভাল করেই । এরপর মেয়েটি আস্তে আস্তে অনেক কথাই বলা শুরু করলো । রেদুয়ানের আসলেই মনে হল যে মেয়েটি ওকে চিনে ।
সেই থেকে মেয়েটির সাথে কথা বার্তা হতে থাকে রেদুয়ানের । আস্তে আস্তে মেয়েটা রেদুয়ানের উপর খবরদারী শুরু করে । বন্ধুদের সাথে বেশি বেশি আড্ডা দিতে দেখলেই মেয়েটি রাগ করা শুরু করে । রেদুয়ান প্রথম প্রথম পাত্তা না দিলেও আস্তে আস্তে পাত্তা দিতে শুরু করে । আস্তে আস্তে রেদুয়ানের সব খারাপ অভ্যাস ছুটে যেতে থাকে । পড়াশুনায় মনোযোগী হতে শুরু করে । অরিনই বলতে গেলে রেদুয়ানকে এই পর্যন্ত নিয়ে এসেছে । প্রতিদিন নিয়ম করে ওর সাথে আধা ঘন্টা ফেসবুকে চ্যাটিং হত । চ্যাটিং তো না অরিন ওকে দিক নির্দেশনা দিত । এই কাজ কর । এইটা করতে হবে । ঐ কাজটা কেন করলে । ইত্যাদি ইত্যাদি ।
মাঝখানে একবার রেদুয়ান খুব জেদ ধরেছিল অরিনের সাথে দেখা করার জন্য । কারন ততদিন রেদুয়ান অরিনের উপর বেশ ভাল ভাবেই ক্রাশ খেয়ে । কিন্তু অরিন রাজি হয় নি । অরিনের কেবল এক কথা । আগে ইন্টারে এ প্লাস পাও তারপর দেখা হবে ।
আজকে সেই সময় চলে এসেছে । রেদুয়ান আর একটু জোরে পা চালায় । অরিন বলেছিল রেজাল্টের দিন ওদের কলেজ মাঠেই ওর জন্য ফুল নিয়ে দাড়িয়ে থাকবে ও । আজকে অরিনের সাথে দেখা হবে এটা ভাবতেই রেদুয়ানের মনে একটা অদ্ভুদ আলোড়ল সৃষ্টি হচ্ছে । আজ কে তাহলে দেখা হবে !
কলেজ মাঠে গিয়ে দেখে অনেকেই সেখানে হাজির । এখনও নাকি নোটিশ টাঙ্গায় নি । কিন্তু প্রায় সবাই জানে তাদের রেজাল্ট কি ! কেউ কেউ রেদুয়ানকে জিজ্ঞেস করছে ওর রেজাল্ট কি । এ প্লাস পেয়েছে শুনে অনেকে একটু অবাক হচ্ছে । রেদুয়ানের মজাই লাগছে । শত মানুষের ভিড়ে রেদুয়ান কাঙ্খিত চোখটা খুজে বেড়াচ্ছে ।
-এই রেদু !
হঠাৎই একটা রেদুয়ান ওর কাধে একটা হাত অনুভব করলো ! পিছনে তাকিয়ে দেখে সাবিহা আর মলি ! ওর সাথেই পড়ে ।
সাবিহা বলল
-তুই এ প্লাস পেলি কিভাবে ?
-কেন ?
-তোকে কোন দিন ঠিক মত পড়াশুনা করতে দেখি নি ! কিভাবে পেলি বলতো !
রেদুয়ান কিছু বলতে যাবে তখনই মলির হাতে একটা লাল গোলাপ দেখতে পেল ! রেদুয়ানের মনে হল এই মলিই অরিন নয় তো ? হতে পারে নাম বদলে ওর সাথে এসব করেছে !
-কি রে বললি না ?
-না তেমন কিছু না !
মলি বলল
-কোন মেয়ে ঘটিত ব্যাপার না তো ?
রেদুয়ানের সন্দেহ টা আরো জোরদার হল । কিন্তু কিছু বলতে পারলো না ! শেষে আবার কি বলতে গিয়ে বেঈজ্জত হবে !
অবশ্য রেদুয়ানের অনেক আগে থেকেই সন্দেহ যে ওদের ক্লাসেরই কেউ এমন টা করছে । তা হলে ওর এতো খবর কিভাবে কেউ জানতে পারবে ! মলি হওয়ার সম্ভাবনা আছে !
রেদুয়ান মলিকে উদ্দেশ্য করে বলল
-এই ফুল কার জন্য !
-কেন ?
-না এমনি !
মলি কিছু বলার আগেই সাবিহা বলল
-ওর বয়ফ্রেন্ড ওকে দিয়েছে ! এ প্লাস পেয়েছে তো । এই জন্য !
যাহ ! রেদুয়ানের আশায় গুড়ে বালি ! যা আশা করে ছিল তার কিছুই হয় নাই !
ওরা আরো কিছুক্ষন কথা বলে চলে গেল !
রেদুয়ান অরিন কে কোথাও খুজে পেল না ! দেখতে দেখতে সন্ধ্যা হয়ে গেল ! রেদুয়ান চুপ করেই কলেজ মাঠে বসেই রইলো !
রাতে বাসায় ফিরে দেখে বাসায় একটা উৎসব উৎসব ভাব ! চারিদিকে মিষ্টির ছড়াছড়ি ! নীলুর বেশ কয়েক জন বান্ধবী চলে এসেছে । সারা বাড়ি জুড়ে হিহিহি হাহাহা করে বেরাচ্ছে । রান্না ঘর থেকে পোলায়ের সুগন্ধ ভেসে আসছে ! রেদুয়ানের বাবা বাড়িয়ালার সাথে ড্রয়িং রুমে বসে হেসে কথা বলছে !
কিন্তু এসবের কিছুই যেন রেদুয়ান কে স্পর্শ করছে না । রেদুয়ান আবার ঘরে গিয়ে পিসি চালু করলো !
ফেসবুকের ওপেন করে অরিন কে খুজলো কিন্তু পেল না কোথাও । মেসেজ অপশন গিয়ে দেখল অরিন আহমেদ নাম টা কালো অক্ষরে লেখা ! একটুও বুঝতে কষ্ট হল না যে অরিন তার একাউন্ট ডিএকটিভেট করেছে ।
কাল রাতেই ওর সাথে কথা হয়েছিল । আর আজকে একাউন্ট ডিএকটিভ !
তবে রেদুয়ান মেসেজে শেষ একটা মেসেজ দেখতে পেল সময়টা ঘন্টা খানেক আগের !
সেখানে লেখা
রেদু, আমার উপর অনেক রাগ হচ্ছে না ? রাগ কর না । এটা দরকার ছিল । তোমার জন্য । তোমার পরিবারের জন্য ! আমার কথা চিন্তা কর না কেবল নিজের বাবা মা আর বোনে রদিকে একটু তাকাও । দেখো তারা আজ কত খুশি ! কেব তোমার জন্য !
ভাল থেকে আর জেনে রেখো কোন এক অরিন সত্যি সত্যি তোমার জন্য অপেক্ষা করছে !
মেসেজটার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়েই রইলো !
-এই ভাইয়া ! এই !
-কি হল !
-তুই এখানে বসে আছিস কেন ! সবাই তোর জন্য বসে আছে আর তুই এখানে ! চল চল !
-আমার ভাল লাগছে না !
-ভাইয়া চল না !
রেদুয়ান কিছু বলতে যাবে এই ভিতর নীলুর এক বান্ধবী বলে উঠলো
-নীল তোর ভাইয়ের ভাব হয়েছে বেশি ! এ প্লাশ পেয়েছে না ! ভাব নিচ্ছে !
রেদু কিছুক্ষনের জন্য কিছু বলতে পারলো না । কেবল মেয়েটার দিকে তাকিয় রইলো !
এই টুকু পিচ্চি ! কেমন করে তাকাচ্ছে ! আর কথা বলার ধরন কি !
মাই গড !
রেদুয়ান নিজের ঘর থেকে বাইরে বের হল । ড্রয়িংরুমে এখন রেদুর বাবা হাসি মুখে গল্প করেই যাচ্ছে । অন্যান্য দিনের চেয়ে আজকে তার চেহারায় একটা আলো বেরিয়েছে । থাকবে না কেন ?
ছেলে ভাল রেজাল্ট করেছে ।
রান্না ঘরের দিকে সেখানেও তার মা আনন্দ নিয়ে রান্নায় ব্যস্ত ! হাসি মুখে !
রেদুয়ানের কেন জানি মনে এই সব আনন্দ কেবল তার জন্য ! মুহুর্তের ভিতরেই রেদুয়ানের মন ভাল হয়ে গেল !
যে সন্তানের কারনে বাবা মায়ের মন ভাল হয় তার থেকে সৌভাগ্যবান আর কে আছে !
পরিশিষ্টঃ বড পোলাপাইনদের লাইনের আনার জন্য টিচারদের মাঝে মাঝে অনেক কিছু করা লাগে ! সুমন কেবল সে রকম একটা ট্রিকস কাজে লাগিয়েছিল ! কোন ভাবেই যখন আর রেদু কে পথে আনতে পারে নি তখনই অরিন আহমেদ কে সামনে আসনে হয়েছে ! এতেই যে এমন ফল হবে ভাবতে পারে নি !
Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা আগস্ট, ২০১৩ রাত ৮:৫২