-স্যার আসবো ?
আমি আধশোয়া হয়ে একটা বই পড়ছিলাম । নীলু দরজা দিয়ে উকি দিল
দরজাটা খানিকটা নড়বড়ে । টিনের তৈরি । নীলু ডাকার সময় মনে হয় একটু হাত দিয়ে স্পর্শ করেছিল । ক্যাঁচকুচ আওয়াজ করে উঠলো !
নাহ । এই মেয়েটা আমাকে ডুবাবে ।
একে তো বাড়িওয়ালার মেয়ে আর আমি এই চিলেকোঠার একমাত্র ব্যাচেলর ভাড়াটিয়া । যদি এখন কেউ নীলুকে আমার ঘরে দেখে আমার আর এখানে থাকা হয়েছে !
আমি উঠে বসতে বসতে বললাম
-তুমি এখানে কেন ? আমি তো একটু পরেই তোমাদের বাসায় আসতাম ।
নীলু দেখলাম আধ খোলা দরজা ঠেলে ঘরের ভিতর ঢুকে পড়ল । ওর হাতে মাধ্যমিক পদার্থবিজ্ঞান বই আর একটা খাতা ।
আমি খানিকটা অবাক হয়েই বললাম
-তুমি কি এখানেই পড়বা নাকি ?
-হুম । আজকে আপনার এখানে পড়ব । আপনি যেমন গান শুনতে শুনতে পড়াশুনা করেন আজকে গান শুনতে শুনতে আজকে আমাকে পড়াবেন ।
-নীলু তুমি বাসায় যাও আমি আসতেছি ।
-না । যাবো না ।
নীলু কেমন বাচ্চা মেয়েদের মত জিদ ধরে বসে রইলো । আমি এবার নরম গলায় বললাম
-প্লিজ এখন তুমি বাসায় যাও । আমি এখনই আসছি ।
-না আমি যাবো না । ঐ দিন আমি আপনাকে একটা কাগজ দিয়েছিলাম ঐটার জবাব আপনি কেন দেন নি ? আজকে ঐটার জবাব না দিয়ে আমি যাবো না !
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম নীলুর দিকে । নীলু কেমন ঘোলা চোখে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে ।
আমার তখনই মনে হল নীলুর কি শরীর খারাপ ?
এতোক্ষন ভাল করে লক্ষ্য করি নি কিন্তু এখন আসলেই মনে হচ্ছে নীলুর শরীর খারাপ !
চোখটা যেন একটু লাল লাল !
আমি নীলুকে বললাম
-তোমার কি শরীর খারাপ ? জ্বর এসেছে ?
নীলু আর হাত আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল
-নিজে পরীক্ষা করে দেখেন !
এই মেয়েটার মনে কি চলছে ? আমি আবারও অবাক হলে নীলুর দিকে তাকিয়ে রইলাম !
নীলুর বাবা লুত্ফর রহমান আমাকে এই চিলেকোঠা ভাড়া দিয়েছে দুটি শর্ত সাপেক্ষে । প্রথমটা হচ্ছে বাসার কোন প্রকার ইতরামি করা যাবে না । কিন্তু এই ইতরামীর বলতে লুত্ফর রহমান ঠিক কি বোঝাতে চেয়েছেন আমি ঠিক মত বুঝতে পারি নি । আর দ্বিতীয় শর্ত হল তার দুই মেয়েকে পড়াতে হতে । যদি পড়ানো ভাল হয় তাহলে চিলেকোঠায় আমার থাকা পার্মানেন্ট হবে ।
গত ছয় মাস থেকে নীলু আর ওর ইলুকে পড়াচ্ছি । সব কিছু ঠিকই চলছিল তখনই নীলু একটা ঝামেলা বাঁধিয়ে ফেলল ।
চার দিন আগে নীলু আমার হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিল । ওদের দুবোনকে পড়াচ্ছিলাম ইলু কি একটা কাজে অন্য ঘরে যেতেই আমার হাতের ভিতর কাগজটা গুজে দিল । আমি খানিকটা অবাক হয়ে বললাম
-এটা কি ?
নীলু শান্ত কন্ঠে বলল
-কিছু না ।
আমি খুলতে গেলেই নীলু বলল
-এখন না । বাসায় গিয়ে খুলবেন ।
আমি আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলাম কিন্তু ততক্ষনে ইলু চলে এসেছে । আমি আর বলতে পারলাম না ! বাসায় এসে কাগজ খুলে আমার খবর হয়ে গেল ।
সারা কাগজ জুড়ে কেবল লেখা ভালবাসি । আর ভালবাসি । এই টুকু পিচ্চি মেয়ে আবার বলে ভালবাসি ।
নাহ আজকেই ওর বাবার কাছে বিচার দিতে হবে বলে ঠিক করলাম কিন্তু তারপরেই মনে হল বিচার দেওয়া কি ঠিক হবে ? শেষ আমাকেই না আবার বাশ খেতে হয় ! মেয়ের বাপরা এটা কোন ভাবেই বিশ্বাস করবে না যে তা মেয়ে খারাপ হতে পার !
তখন যত দোষ ঋতুপর্না ঘোষ !
নীলু আমার আামর দিকে তাকিয়েই আছে সেই ঘোলা চোখে । আমি আবা রবললাম
-তোমার শরীর ভাল মনে হচ্ছে না । আজকে পড়তে হহবে না যাও !
-ভয় পাচ্ছেন ?
-কেন ? ভয় কেন পাবো ?
-না এই যে যদি কেউ চলে আসে এখন ? েকেউ যদি দেখে ফেলে !
আমি কথা না বলে নীলুর দিকে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষন !
নীলু একটু হেসে বলল
-ভয় নেই ! বাবা এখন বাসায় নেই ! আ রমা উপরে আসবে না ! আপনি যা ইচ্ছা করতে পারেন !
আমি আবারও চমকে উঠলাম নীলুর কথায় ! এই মেয়ের মাথা মেন হয় আসলেই গেছে । কি সব উল্টাপাল্টা বকতেছ !
-দেখো নীলু বাসায় যাও ! এখনও বাসায় যাও !
নীলু আমার দিকে অদ্ভুদ চোখে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে হেসে উঠলো ! তারপর বলল
-আসনি আসলেই ভীতুর ডিম ! ভীতু ছেলেদের মেয়েরা পছন্দ করে না !
এই বলে নীলু আর দাড়ালো না ! টিনের দরজায় ক্যাচকুচ আওয়াজ তুলে চলে গেল ! আমার বুকে রভিতর একটু কেমন যেন করতে লাগলো । মেয়েটা আমাকে ভীতু বল চলে গেল !
মাথা থেকে ঐ সব চিন্তা বাদ দিয়ে দিলাম । গরীব মানুষেরসব কিছু চিন্তা করতে নাই !
সন্ধ্যা বেলা যখন পড়াতে গেলাম গিয়ে দেখি কেবল ইলু পড়তে এল । আমার একবার মনে হল নীলু মনে হয় একতু পরে আসবে । অবশ্য অন্যান্য দিন নীলুই আগে পড়তে আসে । বেশ কিছুক্ষন পরেও যখন নীলু আসলো না আমি ইলুকে জিজ্ঞেস করলাম
-তোমার আপা কই ?
-আপার শরীর খারাপ ! আজকে পড়বে না !
-ও ! কি হয়েছে ? জ্বর ?
দেখলাম ইলুর মুখটা একটু বেজার হয়ে গেলে! মুখ বেজার করেই বলল
-না ! আপার তো লিভারে সমস্যা আছে !
-লিভার ?
-হুম !
-কত দিন থেকে ?
-ছোট বেলা থেকেই !
নীলুর শরীর সত্যি খারাপ ছিল তখন ! মেয়েটা হাত ধরতে বলেছিল । ধরলেই হত !
আমি মন খারাপ নিয়েই রুমে ফিরে এলাম !
-এই অপু !
-হুম !
-হুম কি ? ভাল করে বল ! আর অন্য দিকে তাকিয়ে আছো কেন ? আমার দিকে তাকাও !
আমি নীলুর দিকে তাকালাম !
নীলু আজকে শাড়ি পরেছে । চোখে কাজল দিয়েছে ঘন করে ! আর হাতে মেহেদি দিয়েছে ইচ্ছা মত ।
আজকাল ইনস্ট্যান্ট মেহেদি পাওয়া যায় ! যে কেউ চাইলেই হাতে দিতে পারে !
আর আগে হাতে মেহেদি দিতে গেলে কত ঝামেলা সহ্য করতে হতে ! মেহেদির পাতা আনো, বাটো ! তারপর হাতে লাগিয়ে চুপচাপ বসে থাকো ঘন্টার পর ঘন্টা । আর এখন পাঁচ মিনিটেই রং হয়ে যায় !
আমি বললাম
-বাহ ! সুন্দর করে মেহেদি দিয়েছো তো ?
-হুম ! তোমার জন্য দিয়েছি !
আমি এতোক্ষন পরে লক্ষ্য করলাম নীলু আমাকে তুমি তুমি করে বলছে ! আমি অবাক হয়ে বললাম
-কি ব্যাপার তুমি আমাকে তুমি করে বলছো কেন ?
নীলু আমার থেকেও অবাক হয়ে বলল
-বারে ! তোমাকে তুমি করে বলবো না তো কাকে তুমি করে বলবো ? তুমি আমার হাসবেন্ড না ?
আমি মুখ হা করে বললাম
-আমাদের বিয়ে হল কবে ?
-কি তুমি ভুলে গেছ ? যাও তোমার সাথে কথা নাই ! নিজের ঘরে গিয়ে দেখো ! এখনও আমাদের বাসর রাতের ফুল লাগানো রয়েছে !
-কি বলছো এসব ?
-যাও ! আগে নিজের চোখে দেখে আসো ! দরকার হলে কাবিন নামা আর বিয়ের ভিডিও দেখাবো !
আমি খানিকটা অবিশ্বাস নিয়ে নিজের ঘরের দিকে রওনা দিলাম ! এই মেয়ে কি বলছে তার কিছুই আমি বুঝতে পারছি না ! নীলুর সাথে আমার বিয়ে হল কবে ?
ও তো হাসপাতালে ছিল ! শুনছিলাম ওকে নাকি বাইরে নিয়ে যাবে !
ওর সমস্যাটা একটু খারাপের দিকে চলে গিয়েছিল ! তাই হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল !
আমি তো ওদের টিচার খুব বেশি জানতে পারি না । ইলুর কাছ থেকেই যা শুনি ! লুৎফর সাহেব সারা দিন মেয়েকে নিয়ে ব্যস্ত ! বাসায় ওর মাও মন মরা হয়ে বসে থাকে ! কাকে জিজ্ঞেস করবো !
ইলু ছাড়া আর কোন উপায় নাই !
একদিন ইলুর কাছ থেকে ঠিকানা নিলাম হাসপাতালের । কিন্তু কেন জানি দেখা করতে যেতে পারলাম না ! সারা দিনই কেবল ওর হাসপাতালটার আসে পাশে ঘোরাঘুরি করে চলে এলাম !
দরজা দিয়ে ঘুরে ঢুকতেই কেমন একটা ধাক্কার মত খেলাম ! এতক্ষন তো দিন ছিল ! হঠাৎ করেই রাত হয়ে গেল কেমন করে ! ঘরের লাইট জ্বাললাম !
বাইরে এসেও দেখিই রাতই ! সন্ধ্যা মিলিয়েছে অনেক আগেই ! নীলুকে আশে পাশে খুজতে লাগলাম ! কিন্তু কোথায় কি ?
তাহলে এতোক্ষন ?
স্বপ্নে দেখলাম !
জেগে জেগে ?
কি হচ্ছে এসব ? কি দেখছি ! নীলুকে আমার বউ হিসাবে দেখবো কেন ?
-অপু আছো ?
আমি তাকিয়ে দেখি লুৎফর সাহেব ! এই কদিনে বাড়িয়ালার বয়স অনেক বেড়ে গেছে ! নীলুকে নিয়ে অনেক দৌড়া দৌড়ি করতে হচ্ছে মনে হয় !
আমি বললাম
-জি !
-একটু সময় হবে তোমার !
-বলুন !
-না মানে ! নীলুকে নিয়ে আজকে মাদ্রাজ যাচ্ছি ! ওখানে ওর একটা অপারেশন হবে ! রাত তিনটার দিকে রওনা দিবো !
আমার মনটা খারাপ হল ! মেয়েটার শরীর আসলেই খারাপ ! সেদিন মেয়েটার হাত ধরলেই হত !
লুৎফর সাহেব একটু ইতস্তর করতে করতে বলল
-নীলু তোমার সাথে একটু দেখা করতে চায় ! তুমি যাবে ?
-সে কি বলছেন ? যাবো না কেন ? অবশ্যই যাবো !
-ইলুর কাছ থেকে শুনলাম তুমি হাসপালের ঠিকনা নিয়েছিলে ! গেলে না যে !
-আসলে .....।
আমি বলতে গিয়ে থেমে গেলাম ! মনে মনে বললাম গিয়ে ছিলাম । বেশ কয়েক বার গিয়ে ছিলাম ! কিন্তু ভিতরে যেতে পারি নি সংকোচনের কারনে !
যাওয়ার পথে হঠাৎই বাড়িওয়ালা আমার হাত ধরে বলল
-বাবা, নীলু যদি তোমাকে এমন কিছু বলে তুমি কিছু মনে কর না । কেমন ?
-কি বলছেন ? কেন মনে করবো ?
নীলু শুয়ে ছিল কেবিনে ! আমাকে আসতে দেখেই উঠে বসলো ! আমার দিকে খানিকটা তাকিয়ে রইলো অভিমানের চোখে !
-আপনি এখন এলেন ! আমি মরলে তারপর আসতেন আমাকে দেখতে ?
আমি কোন কথা বলতে পারলাম না ! লুৎফর সাহেব আমার পাশেই দাড়িয়ে ছিল ! দেখলাম একটু পরে তিনি নিজেই চলে গেলেন ! আমি নীলুর বেডের কাছে গিয়ে বসলাম !
নীলুর চেহারা কেমন যেন একটু শুকিয়ে গেছে !
নীলু আবার বলল
-কি কথা বলছেন না কেন ?
-কি বলবো ?
-কিছু বলার নাই !
আমি কথা না বলে হাসলাম একটু !
-হাসছেন কেন ?
-এমনি !
এরপরপ কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলল
-আপনি এসে ছিলেন তাই না ? আমি বুঝতে পেরেছি !
-হুম !
-তাহলে আসেন নি কেন ?
-আসতে পারি নি !
-কেন ?
-জানি না !
-কদিন এসেছেন ?
-সব কয়দিন !
আমি আসলেই প্রতিদিনই এই হাসপাতালের আসেপাশে এসে বসে থাকতাম । কেন থাকতাম জানি না !
আমি নীলুর দিকে তাকিয়ে দেখি ওর চোখে পানি !
আজকে আমি খানিকটা সাহসী হলাম । নিজের হাত দিয়ে ওর চোখের পানি মুছে দিলাম !
নীলু বলল
-সেদিন আপনাকে একটা কথা বলেছিলাম মনে আছে ?
-কোন কথাটা ?
-ঐ যে আপনি ভীতু ?
-হুম !
-আপনি আসলেই অনেক ভীতু !
আমি হাসলাম ।
-আরো একটা কথা বলেছিলাম !
-হুম !
-মেয়েরা ভীতু ছেলে পছন্দ করে না !
-হুম !
-কথাটা ঠিক না !
-আমি জানি !
কিছুক্ষন চুপ করে থেকে নীলু বলল
-জানেন আমি না আজকে একটা স্বপ্ন দেখেছি !
-স্বপ্ন ?
-হুম ! খুব সুন্দর স্বপ্ন !
-তুমি শাড়ি পরে আমার সাথে ছাদের দাড়িয়ে ! তোমার হাতে মেহেদি ...
আমি পুরো বাক্যটা শেষ করলাম না ! দেখলাম নীলু অবাক হওয়ার চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে !
একটু পর নীলু বলল
-তুমিও দেখেছো ?
-হুম ! তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছিল শাড়িতে ! কোন দিন পর নি শাড়ি !
আবার দেখলাম ওর চোখ দিয়ে পান পরছে ! আমি এবার ওর চোখ মুছিয়ে না দিয়ে ওর হাতটা একটু ধরলাম ! হাতের মুঠোর মাঝে একটা ছোট্ট চিরকুট দিয়ে বললাম
-তোমার চিঠির জবাব ! অনেক দিন আগেই লিখেছিলাম ! দিতে পারিনি !
নীলু চিঠি হাতে নিয়ে আবারও হু হু করে কেঁদে উঠল ! আমার খানিকটা জড়িয়ে ধরার মত করে ধরে বলল
-আজকে কেন জানি খুব বাঁচতে ইচ্ছা করছে । অপু ! খুব বেশি বাঁচতে ইচ্ছা করছে ! আমি বাঁচবো না বল ?
-হুম ! তুমি অবশ্যই বাঁচবে ! এবার ফিরে আসলো তুমি শাড়ি পরবে কেমন ! চোখে কাজর দিবা ! আর টিউবের মেহেদি দিবা না কিন্তু !
-তাহলে ?
-আমি তোমাকে মেহেদি পাতা এনে দিবো ! ঐ বেটে তারপর দিবা !
-আচ্ছা !
আমি যখন ওকে বিমান বন্দরে রেখে এলাম কেন জানি আমার মনে হল নীলুর কে হয়তো শাড়িতে আর কোন দিন দেখতে পাবো না ! মেহেদি পাতাও হয়তো আনা হবে না ওর জন্য !
Click This Link