-এই দেখো তোমার জন্য ফুল নিয়ে এসেছি ।
আমার কথা শুনেও নীলুর মুখের কোন ভাব পরিবর্তন হল না । গম্ভীর মুখ গম্ভীরই রইলো ।
আমি আবার বললাম
-আরে দেখো ! বেলী ফুল । তোমার পছন্দের ফুল । জনো অফিস থেকে আসছিলাম তখন দেখি একটা পিচ্চি এই ফুল গুলো বিক্রি করছে । বেলী ফুল কেউ এই খোলা বিক্রি করে বল ?
নীলুর মুখের ভাব তবুও পরিবর্তন হল না । এই মেয়েটা হঠাৎ করে এমন গম্ভীর হয়ে উঠল কেন ?
একটা সময় ছিল বাসায় আসার সময় ওর জন্য কিছু না আনলে গাল ফুলিয়ে বসে থাকতো । পিচ্চি মেয়েরা বাবা মার কাছে কিছু আবদার করে না পেয়ে যেমন মুখ করে থাকে ঠিক তেমন ভাবে বসে থাকতো । তখন নীলুর চেহরার একটা আলাদা ভাব থাকতো । একটু অভিমান একটু দুষ্টামী ! আমার দেখতে মজাই লাহতো ।
তবুও আমি প্রতিদিনই কিছু না কিছু নিয়ে আসতাম ।
নীলু সব থেকে বেশি খুশী হত ফুল আনলে । আর বেলী ফুল আনলে তো কথাই নাই ।
কিন্তু এই এখনকার গাম্ভীর্যের কাছে সব কিছু কেমন যেন অন্য রকম লাগছে । কিছুতেই সেই পুরানো নীলুকে খুজে পাওয়া যাচ্ছে না ।
আমি নীলুর হাত ধরতে গেলাম । কিন্তু ও ধরতে দিল না ।
-কি হল এমন কেন করছো ?
হঠাৎই লীনুর চেহারায় কেমন একটা রাগের ভাব দেখতে পেলাম । বেশ কর্কশ গলায় বলল
-জানো না আমি এমন কেন করছি ?
আমি চুপ করে যাই । আসলে আমি জানি নীলুর রাগের কারনটা কি ?
আমি আর কিছু বললাম না । সত্যি বলতে কি আমি আর কিছু বলতে পারলাম না ।
অফিসের কাপড় ছাড়ার জন্য শোবার ঘরের দিকে যাবো ঠিক এমন সময় নীলু পেছন থেকে বলে উঠল
-আমি আর তোমার সাথে থাকবো না !
গত কালকেই নীলু কথাটা বলেছিল ! রাতের খাবার সময় ! আমি প্রথমে ভেবেছিলাম একটু রাগ থেকে কথাটা বলছে কিন্ত ওর মুখ দেখে মনে হল ও বেশ সিরিয়াস !
গত কালকে অনেক বুঝিয়েছি । বলেছিলাম এই রকম হুট হাট করে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক না । আর বিয়ে টা তো কোন প্রাইড থেকে কেনা শাড়ি না যে ইচ্ছে হল আর বদলে ফেললাম । ঘুমনোর সময় ভেবেছিলাম হয়তো আর বলবে না এই কথাটা কিন্তু নীলুর মন থেকে কথাটা যাই নাই ।
আমি বললাম
-দেখো কাল রাতেই আমরা এই নিয়ে কথা বলেছি । আর কয়টা দিন অপেক্ষা করি আমরা । এখনই তো .....।
নীলু খুব শান্ত কন্ঠে বলল
-আমি তোমার ঘর করবো না ! যতদিনই হোক তোমার দ্বারা ....।
নীলু কথাটা শেষ করলো না !
আমি বললাম
-চুপ করলে কেন ? শেষ কর লাইন টা ?
নীলু আমার কথার জবাব না দিয়ে বলল
-আমি ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছি । ভালই ভালই যদি আমাকে ডিভোর্স দেও তাহলে তো কোন সমস্যা নাই কিন্তু যদি আমাকে কোর্টে যেতে হয় তাহলে কিন্তু আমার মুখ বন্ধ থাকবে না । তোমার অক্ষমতার কথা আমি সবাইকে জানিয়ে দেব ।
-নীলু ! প্লিজ ! এতো তাড়াহুড়া কর না । একটু .......
নীলু আমার কথায় বিরক্ত হচ্ছিল বুঝতে পারছিলাম । বলল
-দেখ সুমন ! আমি কোন ইমপোটেন্টের ঘর করবো না । আমি মা হতে চাই ! বুঝছো তুমি ? মা ডাক শুনতে চাই কিন্তু তুমি আমাকে সেই জিনিস দিতে পারবে না । ঠিক আছে ?
আমি নীলুর কথাটা শুনে একেবারে চুপসে গেলাম । এতো বড় একটা কথা নীলু কিভাবে বলল ?
প্রায় দুই বছর ধরে ওর সাথে আছি । আর কদিন পরেই আমার দ্বিতীয় বিবাহ বার্ষিকী । এবার ভেবেছিলাম ওকে নিয়ে কাঠমান্ডু যাবো । সব ব্যবস্থা করে রেখেছিলাম কিন্তু মাঝ খান দিয়ে এই ঝামেলা ।
প্রথম বছর থেকেই নীলু খানিকটা অস্থির হয়ে উঠছিল বাচ্চা নেওয়ার জন্য ! আমিই ওকে একটু মানা করছিলাম ।
আরে এতো জলদি বাচ্চা নিয়ে কি হবে ? সবে তো মাত্র আমাদের বিয়ে হল ? একটু আমরা সাথে থাকি ?
নীলু গাল ফুলিয়ে বলত
-একটা বাবু থাকলে কি আমাদের এক সাথে থাকা বন্ধ হয়ে যাবে । তখন আমাদের সংসারটা আরো কত সুন্দর হবে না বল ?
-আচ্ছা ঠিক আছে ! সামনের বছর ! ওকে ?
নীলু না হু না হু করলেো রাজি হয়েছিল !
দিন আসলেই খুব ভাল যাচ্ছিল আমাদের । বলতে গেলে একেবারে পার্ফেক্ট কাপোল ছিলাম ! আমরা যেন দুজনই দুজনকে বুঝতাম । আমি কখন কি চাই নীলু ঠিক বুঝে ফেলতো ! আবার ওর চাহিদা গুলোও আমি বুঝে নিতাম সহজে !
কিন্তু এই আজকের নীলুকে কেমন জানি খুব অচেনা লাগছে !
এতো বেশি অচেনা !
নীলু ব্যাগ নিয়ে বের হয়েই গেল । আমি কেবল অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষন ! নীলু যাবে বলেছিল কিন্তু এতো জলদি যাবে ভাবতে পারি নি । দরজা দিয়ে বের হওয়ার সময় কেবল বলে গেল যেন আমি ওর সাথে যেন কোন রকম যোগাযোগ করার চেষ্টা না করি !
আমি কেবল বসে রইলাম কিছুক্ষন চুপ করে ! একবার মনে হল কাজটা কি ঠিক হল ?
নীলু কি কাজটা ঠিক করলো ?
এই ভাবে আমাকে একা ফেলে চলে গেল কেন ? এই ছিল ওর ভালবাসা ?
ভালবাসা ?
আমাদের বিয়েটা কি ভালবেসে হয়েছিল ?
কে জানে ?
আমার এখনও সেদিনের কথা ঠিক মনে পড়ে । বাসার গেট দিয়ে ঢুকতে যাবো এমন সময় একটা আকাশী রংয়ের শাড়ি পরা মেয়ে হঠাৎ আমাকে বলল
-বিশটা টাকা দিন তো ?
-জি ?
আমি আসলে ঠিক বুঝতে পারছিলাম না মেয়েটা কি বলছে ? ২০ টাকা দিয়ে কি হবে ?
আর সব চেয়ে বড় কথা এই ভাবে অপরিচিত কারো কাছ থেকে কোন মেয়ে এভাবে টাকা চাইতে পারে আমার ধারনার বাইরে ছিল !
আমি মেয়েটিকে বললাম
-কি বললেন ? বিশ টাকা ?
মেয়েটি একটু মিষ্টি হেসে বলল
-জি বিশ টাকা । রিক্সা ভাড়া দিতে হবে । রিক্সাওয়ালা দাড়িয়ে আছে । আমার কাছে ভাংতি নাই ! আপনি তো এই বিল্ডিংয়েই থাকেন তাই না ?
-জি !
-কয় তলায় ?
-ছয় তলা !
-আচ্ছা ! আমি দিয়ে আসবো !
আমি মানিব্যাগ খুলে টাকা দিলাম ! মেয়েটা টাকা নিয়ে চলে গেল । রিক্সাওয়ালা কোথায় দাড়িয়ে আছে কে জানে ?
আর একটু সময় অপেক্ষা করার ইচ্ছা ছিল কিন্তু দাড়ানোটা কেমন একটা অশোভন মনে হল ! আমি ফ্ল্যাটে ফিরে এলাম ।
মেয়েটাকে নতুন মনে হল ! এই বাসাতে প্রায় দুই বছর আছি মেয়েটাকে একবারও দেখি নি ! নতুন এসেছে মনে হয় !
মেয়েটার নামও তো জানি না !
কয়তলাট থাকে তাও জানা হল না !
যাক আবার নিশ্চই আসবে !
তখন জেনে নিবো !
কিন্তু মেয়েটি আর এল না ! একবার মনে হল বিশ টাকা গলে গেল মনে হয় ! কিন্তু বিশ টাকা হারানোর থেকে মেয়েটার সাথে আর একবার দেখা হল না এই দুঃখ আমাকে বেশি দুঃখিত করছিল !
প্রায় একমাস পরে মেয়েটির সাথে আবার আমার দেখা ! অফিস থেকে ফিরছিলাম । মেয়েটির রিক্সা আর আমার রিক্সা পাশাপাশি চলে এল ?
মেয়েটি প্রথমে আমাকে দেখ নি । আমিই কথা বললাম !
-আরে আপনি ?
প্রথমে আমাকে চিনতে না পরলেও একটু পরেই আমাকে চিনে ফেলল
-আরে আপনি ? এই খানে ?
-বাসায় যাচ্ছি !
-আমিও তো বাসায় যাচ্ছি !
-আজকে রিক্সা ভাড়া আছে মানে আজকে টাকা ভাংতি আছে তো ? আমার কাছে কিন্তু অনেক ভাংতি আছে ! লাগলে বলবনে ! কেমন ?
মেয়েটি হেসে ফেলল !
আমি বললাম
-আপনি আমাদের বাসায় ঐ বাসাটাতে থাকেন না তাই না ?
একটু হেসে মেয়েটি আবার বলল
-জি ! ঐ দিন আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে বাজি ধরেছিলাম যে পথে যাকে পাবো তার কাছে থেকে টাকা নিবো ! এমনি মজা !
-আচ্ছা !
-আপনার ২০ টাকা আমি ফেরৎ দিয়ে দিচ্ছি !
-না ! না ! ঠিক আছে ! কোন দরকার নাই ! আপনার নাম টা জানতে পারি ?
-আমি নীলু ! আপনি ?
আমি কিছু বলতে যাবো এমন সময় সিগলাম ছেড়ে দিল ! আমি মোটামুটি চিৎকার করেই বললাম নিজের নাম টা !
ভেবছিলাম হয়তো এটাই নীলুর সাথে আমার শেষ দেখা ! কিন্তু আমাদের আবার দেখা হল !!
রাতে ঘুমুবার আগে নীলুর বড় দুলা ভাই ফোন দিল ! কোন ভুমিকা না করেই আমাকে কেবল বলল
-আমি তোমাকে আগেই বলেছিলাম কাজটা তুমি ঠিক করছো না ! এখন ?
আমি কি বলবো ঠিক বুঝতে পারছিলাম না !
দুলাভাই সব সময় খুব রসিক মানুষ ! সাবার সাথেই হাসি ঠাট্টা করেন ! পেশায় ডাক্তার । কিন্তু আজকে তার কন্ঠস্বর আসলেই খুব গম্ভীর শোনাচ্ছিল !
কি রে ভাই সবাই এমন গম্ভীর হয়ে গেলে কিভাবে হবে !
বলতে গেলে নীলুর এই বড় দুলাভাইয়ের জন্যই আবার আমার সাথে নীলু দেখা হয়েছিল । মোটামুটি আমাদের বিয়ের ঘটকালীও তিনিই করেছিলেন !
আমি বললাম
-ভাইয়া থাক ! ও রাগ হয়েছে ! চলে আসবে !
-শুনো সুমন মিয়া বেশি ভাল মানুষী ভাল না ! আমি আগেই তোমাকে বলেছিলাম ! এখনও বলছি !
-আচ্ছা ভাইয়া ! আপনি মাথা ঠান্ডা করুন ! আমি নিজেই বলবো ওকে ! সব ঠিক হয়ে যাবে !
যদিও বললাম সব ঠিক হয়ে যাবে কিন্তু আমি নিজেও খানিকটা কনফিউজ যে সব কিভাবে ঠিক হবে ? নীলুকে কিভাবে বলবো !
পরের এক সপ্তাহ আমার দিন খুব খারাপ গেল ! কোন কিছুই ভাল লাগে না । আসলে এই দুই বছরে প্রতিটা দিন নীলুর মুখ দেখে আমার ঘুম ভেঙ্গেছে । যখনই চোখ মেলে তাকিয়েছি তখনই নীলুকে দেখেছি ! কিন্তু এই সপ্তাহ টা ওকে একটা বারও দেখতে পাই নি ! এমন কি আমার ফোন পর্যন্ত ও ধরে নাই ।
শ্বশুর মশাইকে ফোন দিলাম ! দেখি উনিও ধরে না ! একবার ওদের বাসার গেলাম । নীলু সামনেই এল না । অনেকক্ষন বসে থেকের পর শ্বশুর মশাই নিজেই এল হাতে একটা কাগজ নিয়ে ! আমার দিকে এগিয়ে বলল
-এটা নাও বাবা !
-কি এটা ?
কিছুক্ষন ইতস্তত করেলেন । আসলে ঠিক বলতে পারছেন না । আমি বুঝে গেলাম এর ভিতরে কি আছে । আমি বললাম
-ডিভোর্স পেপার ?
আমার মুখ থেকে কথাটা শুনে যেন একটু হালকা হলেন । কোন রকমে বললেন
-আসলে আমরা কিছুই জানি না । ওর এক বন্ধু আছে এডভোকেট । তার কাছ থেকেই নাকি ও মেনেজ করেছে । ও চাচ্ছে কোন ঝামেলা ছাড়াই যেন সব কিছু হয়ে যায় !
আমি শ্বশুর মশাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম
-আপনি কি চান ? আমার মেয়ের কার্যকলাপে আপনার সমর্থন আছে ?
এই কথার জবাবেও দেখি তার অস্বস্থি হচ্ছে । বলল
-আসলে জীবনটা তো ওর । ওর উপর তো আমরা কোন কথা চাপিয়ে দিতে পারি না ।
-হুম ! ঠিক আছে । আমি কিছু বলছি না । কিন্তু এই কথা গুলো মনে রেখেন আব্বা !
আমি আর দাড়ালাম না ! আমার কাছে মনে হয়েছিল নীলু আমার কাছে ঠিক ফিরে আসবে ! এতো দিনের চেনা আমি কে এই ভাবে হঠাৎ করেই অচেনা করে দিবে না ! কিন্তু অবাক হয়ে দেখলাম কেবল নীলুই না ওর পরিবারের সবারই মনভাব আমার বিপক্ষে ! যেন আমি গেলেই ওরা সবাই বাঁচে !
অফিস থেকে ছুটি নিলাম এক মাসের ! ঢাকা শহরে আর থাকতে ইচ্ছা করছে না । মোবাইল ফোনটাও বন্ধ করে রাখলাম ! কারো সাথে যোগাযোগ রাখতেও ইচ্ছা করছে না আর । আসলেই রাখতে ইচ্ছা করছে না ।
এতো দিনের পরিচিত মানুষটা যখন অপরিচিত হয়ে গেল তখন কি লাভ এই সম্পর্ক রেখে ?
আসলেই মানুষ কে চেনা বড় দায় !
কে যে কখন কি কারনে তোমাকে ছেড়ে চলে যাবে তুমি বুঝতেও পারবে না ! কোন মানুষই পার্ফেক্ট না ! দোষ ত্রুটি সবার ভিতর থাকে ! তাই বলে কি এই ভাবে মাঝ পথে একজন কে ছেড়ে চলে যেতে হবে ?
সবাই কি তাই যায় ?
কিন্তু আমি তো ছেড়ে যাই নি ! নীলুর ভিতর ত্রুটি ছিল সেটা জানার পরেও তো আমি ওকে ছেড়ে যাই নি ।
যখন অনেক চেষ্টার পরেও কোন লাভ হচ্ছিল না তখন বাধ্য হয়েই ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম টেষ্টের জন্য । সমস্যা টা কোথায় ?
নীলুর বড় দুলাভাই ই সব কিছু দেখছিল ।
রিপোর্টে যখন ধরা পরলো যে নীলুর মা হওয়ার ক্ষমতা নাই তখন তো আমি ওকে ছেড়ে যাই নি । বরং দুলাভাই কে বলেছিলাম ব্যাপার টা চেপে যেতে । আসলে আমার বউ কে কেউ আঙ্গুল তুলে কিছু বলবে সেটা আমার সহ্য হচ্ছিল না ।
সব দোষ নিজের ঘারে নিয়ে নিলাম । দুলাভাইকে অনুরোধ করে বললাম এমন করে রিপোর্ট বানাতে যেন নীলুর মনে কষ্ট না লাগে !
ও যেন নিজেকে ছোট না ভাবে !
কিন্তু ! ও এই রকম ভাবে আমাকে ছেড়ে চলে যাবে ভাবতে পারি নাই । আসলেই ভাবতে পারি নি । আসলেই মানুষ চেনা বড় দায় !
Click This Link