-এখনই জমা দিবেন ?
ফারজানার আমার দিকে তাকিয়ে কথাটা বলল । যদিও কন্ঠস্বর শুনেই মনে হচ্ছিল যে ওর ঠিক ইচ্ছা নাই । আমি একটু হেসে বললাম
-না ঠিক আছে । এখন না হলে সমস্যা নাই । আগামিকাল কেও দেওয়া যাবে ।
আমার কথা শুনে ফারজানার মুখটাতে একটু হাসি ফুটে উঠল । বলল
-থ্যাঙ্কস ! আজকে আমি খুব ট্যায়ার্ড ! এখন বাসায় যেতে চাচ্ছিলাম ।
এই কথাটা শুনে আমার মনটা একটু খারাপ হল । যাহ এখনই চলে যাবে ? আর একটু বসলে কি এমন ক্ষতি হত !
আজকে সারা দিন আমি নিজেও ব্যস্ত ছিলাম । ভাবলাম একটু গল্প করে যাই টাকা জমা দেওয়া ছলে কিন্তু এই মেয়েযে চলে যাচ্ছে । আমি বললাম
চলে যাচ্ছেন ?
হুম ।
ফারজানা একটু হাসলো । ব্যাগটা আগে থেকেই গোছানো ছিল । ব্যাগ নিয়ে আমার সামনে দিয়েই বের হয়ে গেল ফারজানা । আমি বসে রইলাম ব্রাক ব্যাংকের এই আপন সময়ের ভিতর ।
জায়গাটা এই কয় দিনেই খুব বেশি পরিচিত হয়ে গেস । আসলে কারনে অকারনে দিনের ভিতর যখনই সুযোগ পাই এখানে আসি । টাকা তুলি । কয় টাকা আছে দেখি । আবার টাকা জমাও দেই । এই কাজ করেই দিনে কয়েকবার আসি সুযোগ পেলেই ।
আসলে আসি কেবল ফারজানাকে একটু দেখার জন্য । ওর সাথে একটু কথা বলার জন্য ।
আচ্ছা । ফারজানা কি একটু বুঝতে পারে না ?
বেকুব মেয়ে !
ব্রাক ব্যাংকের এই আপন সময়টা আমার বাড়ির খুব কাছেই । ফ্ল্যাট থেকে নেমে কয়েক পা আসলেই আপন সময় । নতুন হয়েছে এটা । আগে কেবল একটা এটিএম ছিল । তখন খুব একটা আসতাম না ।
আসার দরকার ই বা ছিল কি ! তখন তো আমার ব্রাক ব্যাংকে কোন একাউন্টই ছিল না । আর আমি কেমন যেন এটিএম থেকে টাকা তুলতে কেমন ভয় লাগতো । মনে হয় আমি টাকা তুলতে যাবো আর হয়তো আমার কার্ড আটকে যাবে অথবা টাকা আসবে না । কদিন শুনলাম নাকি এটিএম থেকে নকল টাকা বের হয় । তাই এটিএম কার্ডের উপর খুব একটা আগ্রহ ছিল না । একাউন্ট ছিল কিন্তু খুব একটা ব্যবহৃত হত না । আমার আবার টাকা ব্যাংকে রাখার চেয়ে নিজের পকেটে রাখতে বেশি ভাল লাগে ।
কিন্তু সেদিন এক বন্ধু সুমনের সাথে এই ব্রাক ব্যাংকের আপন সময়ে ঢুকেই সব কিছু কেমন যেন ওলট পালট হয়ে গেল । আমি প্রথমে মেয়েটাকে লক্ষ্য করি নি । আবিরের সাথেই কথা বলছিলাম । যখন টাকা তুলে ফেরত্ যাবো তখন মেয়েটার দিকে চোখ পড়লো । কেমন চোখে একটা কালো ফ্রেমের চশমা লাগিয়ে একটু গম্ভীর মুখে একটা ফাইল দেখছে । চুল গুলো খোলা আর সামনে রেখেছে । মাঝে মাঝে চুলে হাত দিচ্ছে । আমি কিছুক্ষন কেবল তাকিয়ে রইলাম ।
সুমন যখন হাত দিয়ে ধাক্কা দিল তখন বাস্তবে ফিরে এলাল ।
-চল । দাড়িয়ে পড়লি কেন ?
তখনই মেয়েটা আমাদের দিকে তাকাল ।
হায় !
আমি যেন শেষ হয়ে গেলাম ।
এই না হলে চোখ !
এভাবে একটা মেয়ের সামনে বেশিক্ষন দাড়িয়ে থাকাটা কেমন অশোভন দেখায় । মেয়েটার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে বের হয়ে এলাম । যদিও খুব ইচ্ছা করছিল মেয়েটার দিকে তাকাতে কিন্তু যখন দরজা দিয়ে বাইরে বের হয়ে এলাম কেন জানি মনে হল মেয়েটাকে আর একবার দেখতেই হবে । না দেখলে হবে না ।
সুমনকে ফেলেই আবার আপন সময়ের ভিতরে ঢুকে পড়লাম । গিয়ে দাড়ালাম মেয়েটার সামনে । কয়েক মুহুর্ত মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে রইর । আমিও তাকিয়ে রইলাম ।
কি বলব ?
মেয়েটি বলল
কিছু বলবেন ?
-না ... হ্যা মানে ।
-বলুন ।
-মানে আপনাদের এখান থেকে কি ডেভিট কার্ড ইস্যু করেন ।
মেয়েটি একটু হেসে বলল
-জি না । কার্ড ইস্যু করি না । টাকা জমা দিতে পারবেন তুলতে পারবেন । একাউন্টের জন্য এপ্লাই করতে পারবেন ।
-আর ?
-আর ট্রেনের টিকিট কাটতে পারবেন ।
-ও আচ্ছা ।
আর কোন প্রশ্ন খুজে পেলাম না । বিদায় নিয়ে চলে আসতে হল ।পরদিন হাজির হলাম আবার ।
-জি বলুন ।
-আমার একটু চট্টগ্রাম যাওয়া লাগবে । এখান থেকে কি টিকিট কাটা যাবে ?
-হ্যা হ্যা । যাবে ।
আমি একটু হাসলাম ।
-যাক বাঁচালেন । আমি তো স্টেশনে গিয়েও টিকিট পাই নি । এতো লম্বা লাইন ধরে দাড়িয়ে শেষ গিয়ে শুনি টিকিট নাই । বলুন তো কেমন লাগে ।
-তাই নাকি ? এতো চাহিদা নাকি টিকিটের ?
-তাইতো মনে হচ্ছে ।
এবার মেয়েটি কম্পিউটায় স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে বলল
-আজকে যাবেন ?
-জি আজকে ।
-রাতের ট্রেনে ?
-জি ।
মেয়েটা কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো পিসি মনিটরের দিকে ।
-কই ? টিকিট তো সবই ফাঁকা রয়েছে ।
-তাই নাকি ? কিন্তু আমাকে যে বলল । যাই হোক । আপনার এখানে পাওয়া গেল । দিন একটা ।
মেয়েটা টিকিট প্রিন্ট করে দিল । আমি বললাম
আপনার নামটা জানতে পারি ? মেয়েটা বলল
-আমার নাম ?
-জি । যদি সমস্যা না হয় ?
-না না সমস্যা কেন হবে । আমার নাম ফারজানা । ফারজানা করিম ।
-আচ্ছা । আচ্ছা । আপনার বিয়ে হয়ে গেছে ?
-জি ??
ফারজানার মুখ দেখেই মনে হল ও এই প্রশ্নটা আশা করে নাই আমার কাছ থেকে ।
-কি বললেন ?
-না এমনি আর কি । আচ্ছা আমি আসি কেমন ?
আমি তাড়াতাড়ি বের হয়ে এলাম ।
আসলে ফারজানার উপর এমন ভাবেই মন এসেছিল যে স্বাভাবিক বুদ্ধিও হারিয়ে গিয়েছিল । পরের দিন আবার গিয়ে হাজির হলাম । এটাও মনে ছিল না যে গতকাল রাতেই আমার চট্টগ্রাম পাওয়ার কথা ছিল । অন্তত ফারজানার কাছে তো তাই বলেছিলাম ।
আমি যখন আপন সময়ে ঢুকি দেখি আরও কয়েক জন রয়েছে । কোন কাজে এসেছে মনে হয় । আমার দিকে চোখ পড়তেই ফারজানার চোখটা যেন একটু অবাক হল । আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম ।
সবাই যখন বিদায় হল আমার দিকে ফারজানা খানিকটা হেসে বলল
-আপনার না এখন চট্টগ্রামে থাকার কথা ?
-তাই নাকি ? কে বলল ?
-আরে কালকে না টিকিট কাটলেন ।
-ও আচ্ছা । না ওটা আমার জন্য না । আমার এক বন্ধুর যাওয়ার কথা ছিল ।
-তাই , না ?
ফারজানা কেবল একটু হালস ।
তারপর থেকেই আসতাম প্রায় । টাকা তুলতাম আবায় জমা দিতাম । ফারজার সাথে টুকটাক কথা বলতাম । সময় খারাপ যাচ্ছিল না । কৌশলে ওর বাসা বাড়ির কথাও জানতে চাইতাম । প্রথম প্রথম না বললেও আস্তে আস্তে ও বলতো লাগলো । আলাপ চারিতা বাড়তে লাগলো ।
কিন্তু আজকে এ কি হল ? ফারজানার সাথে তো কথাই হল না ।
এই ব্যস্ততা !! আমি চুপচাপ আরো কিছুক্ষন বসে রইলাম ।
-তানভীর সাহেব ?
তাকিয়ে দেখি ফারজানা ।
-জি বলুন ।
-একটু আসবেন ? আসলে কয়েকটা বখাটে ছেলে দাড়িয়ে আছে । এর আগেও ওরা বেশ ব্যাড কমান্ট করেছে । আপনি আমাকে একটু এগিয়ে দেবেন ?
-কি ? আমার এলাকায় আমার নায়িকাকে টিজ করা ! খানিকযা হুংকার ছেড়ে বললাম
-কোথায় ? চলেন তো দেখি ।
আমি বেরিয়ে এলাম । কিন্তু চারিপাশে তো কাউকে দেখলাম না ।
-কোথায় ?
-মনে হয় হাটতে হাটতে সামনে গেছে । আপনি আমাকে একটু এগিয়ে দিবেন ।
-হুম দিবো না কেন ?
আমার কাছে এই টা যেন মেঘ না চাইতেই বজ্র সহ বৃষ্টি পাত ।
ফারজানার সাথে রিক্সায় উঠলাম । যতদুর জানি ফারজানা নুরজাহান রোডে থাকে । খুব বেশি দুরে না । যাক তবুও তো ।
-কি ভাবছেন ?
না তেমন কিছু না । আপনাকে কে ডিস্টার্ব করে বলুন তো ? আগে তো বলেন নি ।
দেখলাম ফারজানা হেসে উঠল ।
-হাসছেন কেন ?
-এমনি । আসলে আমাকে কেউ টিজ করে নি ।
-তাহলে ?
-না মানে আজকে সারা দিন আপনার সাথে কথা হয় নি । আর শরীরটাও ভাল লাগছে না । তাই ভাবলাম এই যাওয়া টুকু আপনার সাথে যাই । আপনার ভাল লাগবে ।
কিছুক্ষন চুপ থেকে ফারজানা বলল
-আমারও ভাল লাগবে ।
আমি সত্যি কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলাম । কি বলছে এই মেয়ে ? আমি ঠিক শুনছি তো । দেখলাম ফারজানা অন্য দিকে তাকিয়ে আছে ।
আমি বুকে অনেক সাহস নিয়ে ফারজানার হাত ধরলাম । আহা কি চমত্কার নরম ওর হাতটা !
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা মে, ২০১৩ রাত ১০:০৫