সমস্যা হচ্ছে সারা দিনে শামীম আর ওর টিমের বাকী দুই জনের উপর খুব ধকল গেছে । ওরা প্রথম বারের মত এই সারভাইভাল ট্রেনিং এ এসেছে । তাই ধকলটা সহ্য হচ্ছে না । তার উপর আজকে সারাদিনে কিছুই পেটে পড়ে নাই । এমন হাড় ভাঙ্গা খাটুনি ওদের তিন জনের কারওি করার অভ্যাস নাই ।
কিন্তু এখন তো আর এই সব বলে লাভ নাই । শামীমের বন্ধু আর টিমমেট ইসতিয়াক বলছিল এবার ফিরে গিয়েই সব কিচু ছেড়ে দিবে । এতো কষ্ট আর ভাল লাগছে না ।
শামীম হাসতে হাসতে বলল
-এই সব বলে আর এখন লাভ নাই । আগে বাসায় গিয়ে দেখা যাবে । কিন্তু এখন কি করবি ?
ইসতিয়াক বলল
-খুব পিপাসা পেয়েছে রে । কিছু একটা না খেলেই না ।
-আচ্ছা । তোরা এখানে থাক । আমি দেখি আশে পাশে কিছু পাওয়া যায় নাকি ?
-এই জঙ্গলে কি পাবি ?
-জঙ্গলে না পাই । আশে পাশে যদি কোন বাড়ি থেকে কিছু পাওয়া যায় !
সাহেল ঠিক ওদের পাশেই শুয়ে ছিল । বেচারা অবস্থা আরো খারাপ । শামীমের কথা শুনে বলল
-ধরা পরলে কি হবে একবার চিন্তা করেছিস ?
-ধরা পরলে তো ! শোন তোরা এখানে থাক । আমি যাচ্ছি । ঠিক আছে ? আর যদি কেউ চলে আছে তাহলে ঠিক ঐ বড় পাথরটার কাছে চলে যাবি । ওকে ?
ইশতিয়াক বলল
-যাবি ? আমি কি আসবো ?
-না থাক । তুই এখানে থাক । সাহেল কে দেখিস । ওর অবস্থা ভাল না । আমি যাচ্ছি !
তখনও শামীম বেরিয়েছে । আসে পাশের বাড়ি থেকে আর কিছু না পাওয়া যাক পানি তো পাওয়া যাবে । পানি না খেলে আর এক মুহুর্ত বাঁচবে না এমন মনে হচ্ছে ওর কাছে !
শামীম যখন জঙ্গলের একাবারে ধারে চলে এসেছে তখন ওর অবস্থা খুবই খারাপ । পুরো দেহটার ভার যেন ওর কাছে সহ্যই হচ্ছে না । যে কোন সময় ও পরে যাবে । ওর মনে হল আর বুঝি ওর পাওয়া হবে না ।
তখনই শামীম টিমটিমে একটা আলো দেখতে পেল ।
মনে হল হ্যারিকেনের আলো । কেউ মনে হচ্ছে প্রাকৃতির ডাকে সাড়া দিতে বের হয়েছে । নাকি ?
শামীম ডাকবে কি বুঝতে পারছে না ।
আবার চোর বলে চিৎকার করে উঠেব না তো !
ফুলির রাতের বেলা গল্প শোনার খুব শখ । বিশেষ করে যখন রাতে ওর দাদী চোখ বন্ধ করে ওকে নানা গল্প করে তখন । ফুলির সব চেয়ে ভাল লাগে ভুতের গল্প । একটু ভয় ভয় অবশ্য করে কিন্তু দাদীর শরীরের সাথে একদম নিজেকে চেপে ধরে গল্প শুনতে ভাল লাগে । কিন্তু সমস্যা হল রাতের খাওয়া না হলে দাদী কিছুতেই গল্প শুরু করে না । আর এখনও রাতের খাওয়া শুরু হয় নি ।
ফুলি ওর মায়ের কাছে গিয়ে বলল
-মা আর কতক্ষন ? ক্ষুদা লাগছে ।
ফুলির মা চোখ গরম করে বলল
-এই তুই না একটু আগে খাইলি ! আবার খিদা লাগছে ?
ফুলি একটু হাসি দিল ! বলল
-না ! খামু না । গফ শুনমু ! দাদিরে খাইতে দাও ।
-দাদীর খাওয়া নিয়ে তোর চিন্তা করা লাগবে না । তার খাওয়ের এখনও দেরী আছে ।
ফুলি রান্না ঘর থেকে বের হয়ে বারান্দায় দাড়ালো । বাইরের এখন ঘন অন্ধকার । ফুলি জানে একটু আগে তার বাবা বাথরুমে গেছে । এখই চলে আসবে । তখন বাবা কে বলল মা নিশ্চই তাদের কে তাড়াতাড়ি খেতে দিবে । আর যত তাড়াতাড়ি খাওয়া যাবে তত তাড়াতাড়ি দাদীর কাছে গল্প শোনা যাবে ।
ঐ তো বাবা আসছে । অন্ধকারের ভিতরে আব্বা হ্যারিকেন নিয়ে আসতেছে । পরিষ্কার না দেখা গেলেও অওবয়টা ভালই বোঝা যাচ্ছে । কিন্তু সাথে এই কে ?
আব্বার বন্ধ ইস্রাফিল চাচা নাকি ?
নাহ ! এতো রাতে চাচা তো আসবে না ! তাহলে ?
যখন আরো কাছে চলে এল তখন ফুলি দুজন কে ভাল করে দেখতে পেল । একজন অপরিচিত মানুষ । গায়ে কেমন কাদা মাটি লেগে আছে । আর লোকটা কেমন জানি ফুলির বাবার বাবার ঘাড়ে ভর দিয়ে আসতেছে । মনে হয় শরীর ভাল না !
ফুলি কে দেখেই ফুলির আব্বা হুমায়ুন আলী বলল
-এই ফুলি, বারিন্দায় বিছান ডা পাড় দেখি ।
ফুলি ঘর থেকে চট জলদি খেজুরের পাতার পাটিটা এনে বিছিয়ে দেয় । হুমায়ুন আলী ধরে লোকটাকে পাটিতে বসিয়ে দেয় ।
ফুলি দেখলো লোকটার গায়ে কেমন যেন একটা পোষাক ! ওর বাবা চাচা আর যেমন কাপড় পরে সেই রককম না । পায়েও কেমন বড় বড় জুতা ! আর লোকটা কে আসলেই কেমন জানি লাগতেছিল । ফুলির বাবা যখন মাঠ থেকে কাজ করে বাড়িয়ে আছে তখন তার চেহারায় একটা ক্লান্তির ভাব থাকে । ফুলির কাছে মনে হচ্ছে এ লোকটা অনেক দিন থেকেই না খাইয়া কেমল কাজই করে যাচ্ছিল । চেহারায় খুব পরিশ্রমের একটা ছাপ ।
লোকটা হঠাৎ বলল
-একটু পানি খাওয়াবেন ?
ফুলির মনেই হচ্ছিল যে লোকটা এখনই পানি খেতে চাইবে । ফুলি নিজেই দৌড়ে চলে গেল ঘরের ভিতর পানি আনতে । গ্লাস ভর্তি করে পানি নিয়ে এল ।
লোকটা এক ঢোকেই সব টুকু পানি খেয়ে ফেলল। গ্লাস টা আরো একবার এগিয়ে দিল ফুমির দিকে ।
আরো চায় !
ফুলি আর পানি আনতে গেলে হুমায়ুন আলী বলল
-পুরা কলসিটা নিয়া আয় । গ্লাস গ্লাস কইরা কি আনোস ।
ফুলি তাই করলো ।
ফুলি অবাক হয়ে দেখলো লোকটা আসলেই দেখতে দেখতে ছোট কলসটার পুরা পানি খেয়ে ফেলল। মনে হচ্ছিল যেন কত দিন পানি খায় নাই !
যখন কলস খালি শেষ হল ফুলির আব্বা বলল
-আরো খাইবেন ?
-না ! ধন্যবাদ । অনেক ধন্যবাদ । এখন যদি একটা কলস দিতেন, আমার দুজন বন্ধুও পানির তেষ্টাতে কষ্ট পাচ্ছে । আর আমাকে এখনও যেতে হবে ।
-আইচ্ছা যাইবেন ! কিন্তু আপনার শরীর ভালা মনে হতাছে না । রাতে কিছু খাইছেন ?
মানুষটা কোন কথা বলল না ।
হুমায়ুন আলী বলল
-যখন এই গরীবের বাড়ি চইলাই আইছেন তখন দুইটা খাইয়া যান ।
-না ! না ! ঠিক আছে । আমার বন্ধুরা অপেক্ষা করছে ।
ততক্ষনে বাড়ির সবাই ই চলে এসেছে । হুমায়ুন আলী ফুলর মা কে ডেকে ভাত বাড়তে বলল । হুমায়ুন আলী নিজেই ভাত বেড়ে দিল ! মুখে না বললেও মানুষটা গোগ্রাসে খেল সব টুকু ভাত । মনে হচ্ছি যেন কত দিন খাই নাই কিছু !
যখন খাওয়া শেষ হল লোকটা বলল
-আপনাদের কি বলে যে ধন্যবাদ দিবো ?
-কুনো ব্যাপার না । আপনে আমাদের বাড়ির মেহমান । তবুও তো কিছু করতেই পারলাম না ।
-এই অনেক করেছেন । এইবার আর একটু কষ্ট যদি করতেন । কিছু খাবার পানির ব্যাবস্থা করতেন । আমার বন্ধু দুইটা কষ্টে পাচ্ছে ।
-হেরাও তো কিছু খায় নাই ?
-হুম !
হুমায়ুন আলী মানুষটা কে কেবল পানিই দিলেন না সাথে দুজনজের জন্য ভাত বেধে দিলেন ! কিছু দুর এগিয়েও দিয়ে আসলেন !
মানুষটা চলে গেলে যখন বাসায় আসলেন তখন দেখলেন বাসায় খাওয়ার মত আর কিছু নাই ।
বউকে বলল
-কিছু কি নাই ? আমার খাওন লাবো না । ঘরে মুড়ি আছে না ? ফুলি আর মাইরে দাও ! তুমিও খাইয়া লও !
ফুলির মা বলল
-একদিন না খাইলে কিছু হইবো না !
তখন ফুলি এসে বলল
-আমারও খিদা নাই বাবা ! আমিতো একটু আগেই খাইছি !
হুমায়ুন আলী একটু হাসলো কেবল । ফুলিরে কাছে নিয়ে বলল
-এই তো আমার মাইয়া !
দুই বছর পরের কথা !
হুমায়ুন আলীর অবস্থা বেশ খারাপ হয়ে গেছে । কয়েকদিন আগে এই এলাকার উপর দিয়ে বিশাল ঝড় বয়ে গেছে । ফুলিদের বাড়ি উড়ে গেছে, ফসল নষ্ট হয়ে গেছে । হুমায়ুন আলীর হাতে ঠিক মত কাজও নাই । দুই তিন ধরে ঠিক মত চুলা জ্বলে নাই ।
হুমায়ুন বাড়ির উঠনে চুপ করে বসে আছে । একটু আগে কাজের সন্ধানে গিয়েছিল কিন্তু পাই নাই ! এলাকার অনেকেই নাকি দুর দেশে পাড়ি দিতেছে কাজের জন্য । হুমায়ুন আলীও যাবে কি ভাবছে । এই ভাবে আর কয় দিন !
-মা খুদা লাগছে !
ফুলির মা হুমায়ুন আলির দিকে করুন চোখে তাকালো । চোখের ইশারায় বুঝে গেল যে আজকেও কিছু হয় নাই ! আজকেও চুলা জ্বলবে না । আজকেও না খেয়ে থাকতে হবে । গত কাল কেবল হুমায়ুন আলী আর সে কেবল পানি খেয়ে ছিল । কোন মতে ফুলি কে কিছু খাইয়েছে ।
ভাগ্য ভাল যে ফুলির দাদী ওর ছোট চাচার বাড়িতে গেছে তা না হলে তার খাওয়ার ব্যাবস্থা কিভাবে হট তা ফুলির মা জানে না !
হুমায়ুন আলী বলল
-দেহি কিছু করা যায় নাকি ?
-কি করবা ?
-দেহি !
যদিও বলল যে দেখি কিন্তু হুমায়ুন আলী জানে না কি করবে !
উঠানে পা দিয়েছে ঠিক তখন হুমায়ুন আলী দেখতে পেল একটা ভদ্রলোক মতন লোক একটা ভ্যান নিয়ে ওদের বাড়ির ভিতর এস ঢুকলো । লোকটার মুখ কেমন হাসি হাসি !
আর কেমন জানি চেনা চেনা লাগছে তার কাছে । মানুষটা যে ভ্যানে করে এসেছে সেখানে দেখলো বেশ কিছু বাজার সদাই !
মানুষটা আর একটু কাছে এসে বলল
-ভাল আছেন ?
-ঠিক তখনই হুমায়ুম আলি তাকে চিনে ফেলল । আরে এ তো সেই লোকটা ! কিন্তু কেমন জানি একটু বয়স বয়স কম কম মনে হচ্ছে । সেদিন অবশ্য রাতের বেলা ছিল আর তখন মানুষটার গায়ে ইউনিফর্ম ছিল তাই বয়স একটু বেশ মনে হচ্ছিল । কিন্তু আজকে কেমন পোলাপাইন মনে হচ্ছে ।
হুমায়ুন আলী একটু হাসার চেষ্টা করে বলল
-আছি ! আপনে কেমন আছেন ?
-আমি ভাল আছি ।
তারপর লোকটা ভ্যানয়ালাকে ভ্যান থেকে সব কিছু নামাতে বলল !
ভ্যানয়ালা সব কিছু বাড়ির ভিতর নিয়ে যাচ্ছিল তখন হুমায়ুন আলী অবাক হয়ে বলল
-আরে কি করেন ? কি করেন ?
-কিছু না । সেদিন আপনারা আমার উপর যে সহানুভুতি দেখিয়েছিলেন তার অল্প একটু প্রতিদান । আর কিছু না ।
-না ! না ! তা কি করে হয় ?
-দয়া করে মানা করবেন না । এখানে কেবল আমার না সেদিন আমি আর আমার সেই দুই বন্ধুকে আপনারা বাঁচিয়েছিলেন আমরা ঠিক করেই রেখেছিল যে আমাদের তিনজনের বেতনের টাকা দিয়ে কিছু টা হলেও আপনাদের জন্য কিছু করবো ! দয়া করে মানা করবেন না ! এটা আমরা করছি আমার মন থেকে !
কেন জানি হুমায়ুন আলীর চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে আসে । আজ কদিন থেকে তারা কি কষ্ট করতাছে ! কেউ তাদের দিকে এগিয়ে আসে নাই । কিন্তু সেই কত দিন একটু ডালভাত খাইয়ে এই লোকটা ঠিকই মনে রেখেছে ।
হুমায়ুন আলী কেবল ঐ বাজার সদাইয়ের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো । যা যা আনা হয়েছে মোটামুটি মাস খানেক তাদের খুব ভাল করেই চলে যাবে ।
হুমায়ুন আলী বলল
-ভাই সাহেব আপনার নামটা কইবেন ? সেদিনও মনে আছিল না !
-আরে আমাকে আপনি করে বলবেন না ! আমাকে তুমি করে ডাকবেন । আট আমার নাম শামীম !
হুমায়ুন আলী ফুলি কে জোরে জোরে ডাকতে লাগলো !
ফুলি দৌড়ে এল ।
-এই দেখ ! চিনতে পারোস ?
ফুলি কিছুক্ষন তাকয়ে থেকে বলল
-হুম ! হেই সেদিন রাতে আইছিল আমাগো বাড়ি ।
শামীম বলল
-তাই । আমাকে চিনতে পেরেছ ?
ফুমি মিষ্টি করে হাসলো । শামীম বাজারের প্যাকেট থেকে কয়েক প্যাকেট চকলেট বের করে দিল ফুলি কে ।
-এই নাও ! তোমার জন্য নিয়ে এসেছি ! আর আজকে কিন্তু তোমাদের বাড়ি থেকে দুপুরে খেয়ে তারপর যাবো ।
হুমায়ন আলী বলল
-আরে তা কয়ন লাগবো না । এই ফুলির মা ! কই গেলা । মেহমান আইছে । ফুলির মা !
মনে হচ্ছে কেবল গল্পেই এমন হয় ! কিন্তু এটা কোন গল্প না । একদম বাস্তব জীবন থেকে নেওয়া । Shamim Shorif Susom নামের একজন Air Force অফিসারের জীবন থেকে নেওয়া আসলেই এমন কিছু মানুষের জন্য মনে হয় বলা হয় মানুষ সৃষ্টির সর্ব সেরা জীব !
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ সকাল ১১:০১