-ভাই একটা দেয়াল দেন ?
-আমাকেও একটা দিয়েন !
-একটা দেয়াল এই দিকে !
-একটা হিজিবিজি !! একটা হিজিবিজি দেন !
এতো কষ্টের ভিতরেও আমার হাসি পেয়ে গেল ! ছোট বেলায় মা-বাবার নিউমার্কেটে গেছিলাম । একটা নড় হাওয়াই মিঠা কেনার জন্য বায়বা ধরলাম ! মা কঠিন গলায় বলল
-এই হিজিবিজি খেতে হবে না !
তারপর থেকেই আমি হাওয়াই মিঠা দেখলেই বলতাম
-আম্মু হিজিবিজি খাবো !
যথারীতি মা কঠিন গলায় বলত
-এসব হিজিবিজি খেতে হবে না !
আমি ধরেই নিয়েছিলাম যে ঐ হাওয়াই মিঠার নাম হিজিবিজি ! অনেক দিন লেগেছে আমার আসলে নাম টা জানতে ! যাই হোন যে লোকটা হিজিবিজি চাইল আমি তার দিকে তাকালাম । মাঝ বয়সী হবে !
আচ্ছা আমি যদি এখন কঠিন গলায় বলি "এসব হিজিবিজি কিনতে হবে না" তাহলে কেমন হবে ?
এই বার নিজের অবস্থান পরিষ্কার করি ! আমি এখন একুশের বই মেলায় অন্যপ্রকাশের স্টলের সামনে দাড়িয়ে ! ঠিক দাড়িয়ে না ভিড়ের ভিতর যুদ্ধ করে সামনে এগোচ্ছি !
ইস যদি এখন আমার তারেক স্যার দেখতো যে আমি বই কেনার জন্য এতো কষ্ট করতেছি স্যার কোন কথা বইলা আমাকে এ প্লাস দিয়ে দিতো ! স্যারের যত অভিযোগ আমি মানুষ পড়া শুনার জন্য কত কষ্ট করে আর আমি নাকি তার সিকি ভাগও করি না !
এখন স্যার থাকলে বলতাম স্যার দেখেন বই কেনার জন্য আমি কত কষ্ট করতাছি !
একটু আগে এক ফাজিল পোলা আমার পায়ের উপর পাড়া দিয়ে চলে গেল ! আমার দিকে ফিরে পর্যন্ত চাইলো না ! এমন একটা ভাব যেন আমার পায়ের কোন মূল্যই নাই ! একবার মনে হল বেটার কলার চেপে ধরে বলি %$*&^%#@
থাক আর বললাম না !
-আরে ভাই পায়ের তলায় খরম আছে ?
-ভাই আমার দেয়াল !
-দেয়াল তো দিলেন না ??
-হিজিবিজি !! ভাই হিজিবিজি !
নাহ ! এসব ছোট খাট জিনিস নিয়ে ভালে চলবে না ! আমাকে এখন সামনে এগিয়ে যেতে হবে ! যে করেই হোক একটা দেওয়াল আমাকে কিনতে হবে ! দেয়াল মানে হুমায়ুন আহমেদের শেষ উপন্যাস দেয়াল ! মেয়েটা নিশ্চই অপেক্ষা করছে আমার জন্য !
মেয়েটা !!!!
আমি কিছুক্ষনের জন্য অন্য জগতে চলে গেলাম ! আচ্ছা আমি যখন মেয়েটা বই টা দিবো মেয়েটা তখন মেয়েটার মনের ভাব কেমন হবে ! নিশ্চই আমাকে বলবে
"আপনাকে কি বলে যে ধন্যবাদ দিবো"
আমি একটু বুক ফুলিয়ে বলবো
"না আর এ আর এমন কি"
মেয়েটা হয় আমাকে চা খাওয়ার আমন্ত্রন দিবে ! অথবা একটা আইসক্রিম ! অন্তত মেয়েটা মেলায় যতক্ষন থাকবে ততক্ষন তো মেয়েটার সাথে থাকার কথা বলবে । আহা !!
-এই যে মিয়া দাড়িয়া আছেন কেন খামোখা ! হয় ভিতরে যান নয়তো বাইরে যান !!
এই সব লোক গুলা এমন বেরশিক !! কত সুন্দর একটা কল্পনা করতেছিলাম !
আমি সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকি !
যখন একবারে টেবিলের সামনে পৌছালাম এখন আমার কপাল দিয়ে ঘাম ছুটে গেছে ! এই ভিড়ের ভিতর কেউ আসে ?
কেউ না আসলেও আমি এসেছি ! একবার না পরপর দুবার !
সবাই জানে অন্য প্রকাশের সামনে এমনিতেই ভিড় লেগেই থাকে ! আসলে আমার মত অদিকাংশ মানুষই কেবল বই মেলেয় আসে হুমায়ুন স্যারের বই কিনতে ! আজকে আমিও এসেছিলাম ! প্রথম বারে অনেক কষ্ট দেয়াল আর হিজিবিজি কিনে বের হলাম !
ভিড় ঠেলে যখন বিজয়ীর বেসে বাইরে বেরিয়ে এলাম তখনই মেয়েটা কে দেখতে পেলাম । ভিড়ের সামনে একটু করুন মুখে দাড়িয়ে আছে । অন্য প্রকাশের সামনে যে পরিমান ভিড় আমাদের মত ছেলেরাই এর ভিতর ঢুকতে কয়েকবার চিন্তা করি । সেই হিসাবে একটা মেয়ের পক্ষে তো এই কাজ করার কথা চিন্তাই করা যয় না ।
মেয়েটির করুন মুখ দেখে আমার একটু মায়াই লাগলো ! আমি জানি এই লাইনটা দেখে অনেকেই ভাবছেন যে এই পোলা এতো ভাল হইলো কবে ?
আসলে আমি কোন দিনই এতো ভাল ছিলাম না । এই মেয়েটির জায়গায় অন্য কেউ হলে আমি মেয়েটির ধারে কাছে যেতাম না !
কিন্তু একে তো মেয়ে বলে কথা ! তার উপর সুন্দরী ! এই মেয়ের উপকার করতে না পারলে জীবনই বৃথা !
আমি মেয়েটির দিকে এগিয়ে গেলাম ! মেয়েটি তখনও ভিড়ের দিকে তাকিয়েই আছে । এমন একটা ভাব যেন ভীড় কমবে আর সে বই কিনতে পারবে !
আমি মেয়েটির পাশে গিয়ে একটু অপেক্ষা করলাম ! তারপর বলল
-ভীড় কমার অপেক্ষা করছেন ?
আমার কথায় যেন মেয়েটি প্রথমে বুঝতে পারলো না ! আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-জি ?
আমি বললাম
-আপনি কি ভিড় কমার অপেক্ষা করছেন ?
-জি !
-তাহলে আমি বলব বৃথা অপেক্ষা করে লাভ নাই ! এই ভীড় কমবে না !
-এখন ?
আপনি বরং বাসায় চলে যান ! মেলার শেষে অন্য প্রকাশ পাবলিক লাইব্রেরীর সামনে মেলার আয়োজন করে । ওখান থেকে কিনে নিবেন !
-এতোদিন অপেক্ষা করবো ?
মেয়েটির মুখ আরো একটু করুন হয়ে গেল ।
আমিও একটু চিন্তিত হবার ভাব নিলাম ! আসলে আমি চাইলেই এখন বলতে পারি যে আমি আপনার জন্য বইটা কিনে দিচ্ছি ! আর আমি বললেই মেয়েটি তা লুফে নিবে । কিন্তু আমি চাচ্ছিলাম মেয়েটি নিজ থেকে এই কথাটা বলুক !
মেয়েটির চোখ তখন গেল আমার কেনা বই দুটির উপর !
মেয়েটির মুখটা একটু যেন উজ্জল হয়ে উঠল ! আমার বইয়ের ব্যগের দিকে তাকিয়ে মেয়েটি বলল
-আপনি কিনেছেন ? দেখি একটু !
আমি দিলাম !
বই দুটি দেখে মেয়েটির আফসোস যেন আর একটু বেড়ে গেল !
মেয়েটির মুখ দিয়ে বেরিয়েই গেল কথাটা
-ইস ! কবে যে পড়তে পারবো ?
আমি আবারও একটু ভাব নেওয়ার চেষ্টা করলাম !
-একটু উপকার করবেন ?
-জি বলুন !
-দেখুন আপনি তো কিনেছেন ! আমার জন্য একটা কিনে আনবেন ! প্লিজ !
আমি তো এটার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম ! একটু ভাব নিয়ে বললাম
-আচ্ছা ! ঠিক আছে !
মেয়েটি খুব খুশি হয়ে গেল ! সঙ্গে সঙ্গেই টাজা বের করে দিল ! আমি আবার যুদ্ধ জয় করতে নেমে পড়লাম !
এবার সবার মত আমি ও বলতে শুরু করলাম
-ভাই একটা দেয়াল ! একটা দেয়াল দেন !
অন্য একজন বলল
-আরে ভাই আমাকে একটা দেয়াল দেন !
-একটা হিজিবিজি দেন !
-আরে ভাই একটা দেয়াল দেন না ?
আবার যখন বের হলাম দেয়াল নিয়ে তখন আমি খানিকটা যুদ্ধ বিদ্ধস্ত সৈনিকের মত ! যুদ্ধে জয় এসেছে কিন্তু ক্ষয়ক্ষতিও কম হয়নি ! আমাকে আসতে দেখে মেয়েটি মুখে একটু হাসি দেখবো আশা কে ছিলাম, মাঠে পরিশ্রমের পর কৃষক ঘরে ফিরলে তাদের বউ যেমন এগিয়ে আসে ! পানি আর গামছা নিয়ে ! কিন্তু মেয়েটি তখন আমার বই পড়তে ব্যস্ত !
আমি মেয়েটির সামনে গিয়ে দাড়ালাম । আমার দিকে মেয়েটা তাকিয়ে বলল
-এনেছেন ?
-এই নিন !
-দেয়াল ? আর একটা কই ? হিজিবিজি ?
এই মেয়ে আমাকে কই একটু ধন্যবাদ দিবে তা না বলে যে হিজিবিজি কই ?
আমি খানিকটা নমনীয় বললাম
-আপনি না বললেন দেয়াল আনতে !
মেয়েটি কিছু না বলে আমার মুখের দিকে আবার তাকালো করুন মুখে ! তারপর বলল
-আচ্ছা ঠিক আছে ! এতেই চলবে !
আর কোথায় যাবো ! সব কিছু এই পৃথবীতে সহ্য করা যায় কিন্তু মেয়েদের করুন মুখ কিছুতেই সহ্য করা যায় না ! আর মেয়ে যদি সুন্দরী হয় তাহলে তো কথাই নাই !
আমি আবার ঢুকে পড়লাম নতুন যদ্ধ জয়ে ! জানি না এবার সফল হব কি না ! আবার সেই ধাক্কা ধাক্কি ! পরান যায় জলিয়া রে !!
আচ্ছা পরিচিত কারো জন্য কি আমি এতো পরিশ্রম করেছি কিনা ঠিক বলতে পারছি না !
করি নি কোন দিন !
এমন কি নিজের জন্যও না !
নিজের জামা কাপড় পর্যন্ত ধুই না ! বাসায় যাই, একবারে সব ধুয়ে নিয়ে আসি । তারপর ময়লা হলে আবার নিয়ে যাই ! সকাল বেলা কষ্ট করে নিচে যেতে হবে দেখে আগের দিন এনে রাখা বাসি ব্রেড আর কলা দিয়ে নাস্তা সারি ! ঘর ঝাড়ু দেওয়ার জন্য তো বুয়া আছেই !
তাহলে এতো পরিশ্রম কেন করছি ?
মেয়েটার হাসির জন্য ?
নাকি মেয়েটার করুন মুখটা দেখে ?
আগেই বলেছি সুন্দরী মেয়েদের করুন মুখ কিছুতেই সহ্য যায় না !
আবার যখন আমি হিজিবিজি নিয়ে বের হলাম তখন আমি পরাজিত সৈনিক ! একই দিনে তিন তিন বার যুদ্ধ করার কোন মানে আছে ?
এবার দেখলাম মেয়েটা আর বইয়ের দিকে তাকিয়ে নেই ! আমার দিকেই তাকিয়ে আছে ।
আমাকে দেখে একটা মিষ্টি হাসি দিল !
আহা !!
আমি মেয়েটির দিকে এগিয়ে গেলাম !
আহা ! আবার একটা আনন্দের বাতাস বয়ে গেল মন জুড়ে !
আচ্ছা মেয়েটি এখন আমাকে নিশ্চই আমাকে ধন্যবাদ দিবে ! তারপর আমার নাম জানতে চাইবে !
নিজের নাম বলবে !
তারপর বলবে চলুন একটু হাটি !
আপনার সাথে একটু কথা বলি !
আহা ! আহা !
মেয়েটির মুখের হাসি আসলেই বিস্তৃত হল ! আমাকে বলল
-আপনাকে কি বলে যে ধন্যবাদ দিবো ! আপনি ....
মেয়েটির কথা শেষ হল না ! তার আগেই মেয়েটির ফোন বেজে উঠল !
আমার মনটা আবার আনন্দের ভরে উঠল ।
আরে আমি তো মোবাইলের কথা চিন্তাই করি নি ! মেয়েটি কথা বলার এক ফাঁকে আমাকে আমার কাছে মোবাইল নাম্বার চাইবে ! নিজের টা দিবে !
তারপর আমরা রাতের কথা বলব !
অনেক কথা বলব !
আচ্ছা কি নিয়ে কথা বলা যায় !
লেট মি থিঙ্ক !!!
-আচ্ছা ! শুনুন !
আমি গদগদ হয়ে বললাম
-জি বলুন !
-আমার বয়ফ্রেন্ড গেটের কাছে দাড়িয়ে আছে । আমি যাই কেমন ?
আমার মাথার উপর যেন বট গাছের একটা ডাল ভেঙ্গে পরলো !
আরে বেটা মাথার উপর গাছের ডাল ভেঙ্গে পড়ে নাকি ? মাথার উপর তো আকাশ ভেঙ্গে পড়ে !
আরে দুর !
কি ভাবলাম আর কি হল !
এই মেয়ের জন্য এতো পরিশ্রম কেন করলাম ? বেকুব হয়ে গেলাম !
এবার থেকে কোন সুন্দর মেয়ের উপকার করার আগে অবশ্যই জেনে নেব যে তার কোন বয়ফ্রেন্ড আছে কিনা ?
এখন এমন মনে হচ্ছে মেয়েটার সামনে বসার জন্য চেয়ার আমি টান দিলাম আর সেখানে গিয়ে বসলো অন্য কেউ !
আমি মেয়েটার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়েই রইলাম ! ফাজিল মেয়েটা একটা বা পিছন ফিরে তাকিয়েও দেখলো না !
আমি দাড়িয়েই রইলাম অন্যপ্রকাশের সামনে ! আর শুনতে লাগলাম
-ভাই একটা দেয়াল দেন ?
-আমাকেও একটা দিয়েন !
-একটা দেয়াল এই দিকে !
-একটা হিজিবিজি !! একটা হিজিবিজি দেন !
ফেবু লিংক
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা মার্চ, ২০১৩ রাত ১০:৩১