-আসলে এই দিক দিয়ে যাচ্ছিলাম তো, ভাবলাম তোমার সাথে একটু দেখা করে যাই !
নীতু এই কথাটা শুনে যেন আরও একটু বিরক্ত হল । বলল
-মিথ্যা কথা বলতে না পারলে না বলাই ভাল ।
আমি আবার অপ্রস্তুত হই । এভাবে নীতু আমার মিথ্যাটা ধরে ফেলবে ঠিক বুঝতে পারি নি । আমার এদিকে কোন কাজ ছিল না । আমি নীতুর সাথে দেখা করার জন্যই ওর ইউনিভার্সিটিতে এসেছি । এখন মনে হচ্ছে ওকে এভাবে বিরক্ত করা মনে হয় ঠিক হল না ।
আমাকে দেখে নিশ্চই বান্ধবীদের সামনে অপ্রস্তুত হয়েছে । ওর বান্ধবীরা কেমন মুখ টিপে হাসছিল । বারবার ধমকেও কিছুতেই যেন ওদের হাসি থামছিল না । শেষে বাধ্য হয়ে নীতু নিজেই ওদের সবার সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিল ।
ওর ক্যাম্পাসেরই ক্যান্টিনে বসলাম । আমি কিছু বলবো কি না ভাবছি এমন সময় নীতু আমাকে বলল
-আপনার অফিস নেই ?
কি বলব ?
-ছিল ।
-ছুটি নিয়ে এসেছেন নাকি মিস দিয়েছেন ?
-মিস দিয়েছি ।
-কেন ?
খুব বলতে ইচ্ছা করলো যে তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছিল তাই । কিন্তু এই কথা বলা যাবে না । এই কথা বললে নীতু আরো বেশি রেগে যাবে । অথবা বিরক্ত হবে । নীতু বলল
-আমাকে দেখতে ইচ্ছা করছিল, এই জন্য এসেছেন ?
দেখেছ অবস্থা ? এই কথা আমি মনে মনে ভেবেছি আর এই মেয়ে ঠিকই বুঝে ফেলেছে । এই মেয়ের সাথে বিয়ে হলে আমার সত্যিই খবর আছে । কোন কথা আমার বলা লাগবে না ! আগে থেকেই সব বুঝে ফেলবে !!
নীতু বলল দেখুন
-আসিফ সাহেব , আমার এসব ছেলে মানুষী ভাল লাগে না । পারিবারিক ভাবে আমাদের বিয়ের কথা বার্তা চলছে ভাল কথা । এখনই আপনি আমার জন্য অফিস করে দেখা করতে আসবেন তারপর আমরা একসাথে বসে চা খাবো । এক সাথে রিক্সায় ঘুরবো ... এসব নাটকীয় দৃশ্য আমার পছন্দ না । গত পরশু দিনও আপনি আমার ভার্সিটির সামনে এসেছিলেন তাই না ?
আমি চুপ করে রইলাম ।
কথা সত্য । পরশু দিন আমি এসেছিলাম । কিন্তু নীতুর সাথে ঠিক দেখা হয় নি । অনেকক্ষন দাড়িয়েও ছিলাম । কিন্তু নীতুর দেখা পাই নি ।
-দেখুন আমাদের হার্ডলি দুবার দেখা হয়েছে প্লিজ এই কথা বলবেন আপনি আমার প্রেমে পড়ে গেছেন ! জীবন বড় কঠিন একটা জায়গা । আজ আমার সাথে একটা দুর্ঘটনা ঘটুক, আপনি তখন আমাকে চিনবেনও না ।
আমি বুঝলাম নীতুর মেজাজটা এতো খারাপ কেন হল ?
ওর সাথে কিছু দিন পরে আমার বিয়ে হতে চলেছে । এখন যদি ওর সাথে দেখা করতে আসি তাহলে কি একটা খুব বেশি অন্যায় হবে ?
হ্যা এটা ঠিক আমি একটু পাগলামী করছি ! এভাবে হুটহাট করে চলে আসাটা ঠিক মানায় না ।
আমার মনটা একটু খারাপ হল । আজকে সত্যিই নীতুর সাথে রিক্সায় চড়তে চেয়েছিলাম । কিন্তু তা আর হবে বলে মনে হচ্ছে না । নীতু বলল
-আমার একটু পরে ক্লাস আছে । আমি যাই ।
-এক কাপ চা খেয়ে যাও ।
-এখন থাক । আর দয়া করে আজকের কথা গুলো আপনি কাউকে বলবেন না । আমার মা জানতে পারলে বকাবকী করবে ।
-আচ্ছা । সমস্যা নাই । আমি কাউকে বলবো না ।
নীতু উঠে চলে গেল । আমি ওর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়েই রইলাম । ভেবেছিলাম ক্যান্টিনের দরজার কাছে যাওয়ার মধ্যে নীতু একবার হলেও পিছন ফিরে তাকাবে । কিন্তু নীতু দরজার কাছে গিয়ে ফিরে তাকাল না । আমার মনটা খারাপ হয়েই রইল ।
বেশ কিছুক্ষন মাথা নিচু করে বাসে রইলাম !!
নীতুর সাথে পারিবারিক ভাবেই পরিচয় । বাবার কোন এক পরিচিত মানুষের মেয়ে । নীতুর বাবাই প্রথমে বিয়ের কথাটা তুলেছিল । দেখলাম চাকরি করছি বিয়ে তো করতেই হবে ! একে করলেই বা কি ? যেদিন ওকে প্রথম দেখতে গেছিলাম মনের ভিতর সত্যি কেমন একটা অদ্ভুদ অনুভূতি হয়েছিল ।
নীতুকে দেখে মনে হয়েছিল যে এই মেয়েটাকে আমি বিয়ে করবো ?
কি স্নিগ্ধ আর কোমল একটা চেহারা ! দেখলেই মনটা ভাল হয়ে যায় !! বিয়ের কথা মোটামুটি পাকাই হয়ে গেল ।
তারপর থেকে একটা ব্যাপার অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম যে আমি সারাক্ষনই নীতুর কথাই ভাবছি ! মাঝে মাঝে মনে হত আচ্ছা আমি যেমন সারাক্ষনে নীতুর কথাই ভাবছি নীতুও কি আমার কথা ভাবে !
এখন মনে হচ্ছে ভাবে না । সারাটা দিন মন খারাপ হয়েই রইলো । রাতের বেলা ঘুমাতে যাওয়ার আগে নীতু ফোন দিল ।
খানিকটা অপ্রত্যাশিত ভাবেই । নীতু সাধারনত আমাকে ফোন দেয় না । তাহলে কেন ?
-হ্যালো !
-ভাল আছেন ?
-এই তো । তুমি ?
-আমি ভাল নাই । আসলে নিজের কাছে খুব খারাপ লাগছে ।
-কেন ?
-আপনার সাথে আজ খুব খারাপ ব্যবহার করেছি ।
আমি চুপ করে রইলাম । নীতু বলল
-আসলে সকাল থেকে আমার মেজাজ টা এমন খারাপ ছিল ।
-মেজাজ খারাপ ? কেন ?
-আসলে আমাদের এলাকাতে কয়েকটা বকাটে ছেলে আছে । সব সময় মোড়ের মাথা বসে বসে আড্ডা মারে । মাঝে মাঝে এমন ব্যাড কমান্ট করে ।
-তা তোমরা কোন কিছু কর নি ? পুলিলে জিডি কর । আমার বন্ধু RAB এ আছে । ওকে বলবো ?
-না থাক ! কিছু করতে হবে না । ভাইয়াকে বলেছি । এই জন্য আপনার খারাপ ব্যাবহার করেছি । আপনি প্লিজ কিছু মনে করবেন না ।
-না না ঠিক আছে । আমি কিছু মনে করি নি ।
-না আমি জানি আপনার মন খারাপ হয়েছে । আমি ক্যান্টিন থেকে যখন বের হয়ে গেলাম তখন আপনি কেমন মাথা নিচ করে বসে ছিলাম । জানেন এটা দেখে আমার অনেক খারাপ আসছিল । মনে হচ্ছিল তক্ষুনি আপনার কাছে যাই । কিন্তু কি একটা সংকোচের কারনে পারি নি ।
আমি খানিকটা অবাক হয়ে বললাম
-তুমি ফিরে এসেছিল ?
-হুম । বিশ্বাস করেন আমি ঐ রকম ব্যাবহার কারতে চাই নি কিন্তু ..
-আচ্ছা ঠিক আছে । আমি কিছু মনে করি নি ।
মন খারাপ হয়েছিল কিন্তু এখন ঠিক হয়ে গেছে । ওপাশ থেকে খানিকটা নিরবতা । আমি বললাম
-তোমার কার পরশু কোন কাজ আছে ?
-কাল ?
নীতু কিছু যেন ভাবল । বলল
-সামনের সপ্তাহে আমাদের ভ্যাকেশন শুরু হচ্ছে । আমরা কজন মিলে ঠিক করেছি যে গাজীপুর আনসার ক্যাম্পে যাবে । যারা কাপল তারা । আপনি কি আসতে পারবেন ?
-পারবো না মানে ?
একটু যেন জোরেই বলে ফেললাম । তারপর একটু লজ্জাও পেলাম । নীতুর হাসির শব্দ শুনতে পেলাম । নীতু বলল
-আচ্ছা । আর মন খারাপ করবেন না । আমি এই সপ্তাহটা একটু বিজি থাকবো । পরীক্ষা আছে । কেমন ?
-আচ্ছা । একটা কথা বলবো ?
-বলুন ।
-তুমি ঐ দিন সাদা কিছু পরো কেমন । আর চোখে কাজল দিও ।
-আচ্ছা ।
মনটা যেমন খারাপ ছিল ঠিক তার চেয়েও হাজার গুন ভাল হয়ে গেল ।
দিন কাটতে লাগলো বড় আনন্দে । নীতুর সাথে কথা বলতে ইচ্ছা করলেও ওকে ফোন দিলাম না পাছে ও আবার বিরক্ত হয় । ও বলেছিল যে ও পরীক্ষা নিয়ে বিজি থাকবে । তাই আগ্রহ নিয়েই অপেক্ষা করতে লাগলাম নীতুর আমন্ত্রনের জন্য ।
ফোনের নীতু বলেছিল কাপলরা নাকি যাচ্ছে সবাই গাজীপুর । নীতু যাবে আমার সাথে । ও আমাকে কাপল ভাবছে এটা ভাবতেই একটা অনুভূতি বয়ে যাচ্ছে ।
সপ্তাহের শেষে এসে আমাকে আবার ঢাকাকর বাইরে যেতে হল । অফিসের কাজে । যদিও জলদিই চলে আসবো তবুও যেতে ইচ্ছা করছিল না । কিন্তু কিছু করার নাই ।
ঢাকায় ফিরতে ফিরতে তিন দিন লেগে গেল । আমার কেবল ভয় লাগছিল আমি ঢাকার আগে নীতু আবার ফোন না দিয়ে ফেলে । যদি ফোন দিয়ে বলতে কালকে আমরা যাচ্ছি তাহলেই তো হয়েছিল ।
কিন্তু নীতু ফোন দিল না ।
বাসায় এসে একটা লম্বা ঘুম দিলাম । বিকালে উঠে চা খাচ্ছি এমন সময় মা এসে গম্ভীর মুখে আমাকে বলল
-নীতু কি তোকে ফোন দিয়েছিল ?
বুকের ভিতর একটা উত্তেজনা সৃষ্টি হল । নীতু তো আমাকে ফোন দেই নি তাহলে কি মাকে ফোন দিল ?
আমি বললাম
-না ।
-ওদের বাসার কেউ দিয়েছে ?
আমি এবার একটু চিন্তিত হলাম । ওদের বাসার কেউ কেন আমাকে ফোন দিবে ? বললাম
-কেন মা এই কথা কেন বলছো ?
মা বলল
-শোন আর নীতুর সাথে যোগাযোগ করার দরকার নাই !
-কেন ? মানে কি ??
-কোন মানে নাই !! মানা করেছি তাই । ঐ মেয়ের সাথে তোর বিয়ে হবে না ।
আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম । কি বলছে ??
মা বলল
-তুই যে দিন ঢাকার বাইরে গেলি তার পরদিনই নীতুকে কয়েকটা ছেলে জোর করে মাইক্রবাসে তুলে নেয় !
আমার মনে হল আমি ঠিক শুনছি না । মা এসব কি বলছে ??
-সন্ধ্যার সময় পুলিশ গ্যান্ডারিয়ার একটা বাসা থেকে ওকে উদ্ধার করে । আর এই কথা ওরা আমাদের বলে নি ! এখন বল এই মেয়েকে আমি কিভাবে....
মা আর কি বলছিল আমার কানে গেল না । আমি তখনই বাইরে বের হলাম । আমার কেবল মনে হতে লাগলো আমার যে কোন ভাবেই নীতুর কাছে যাওয়া লাগবে !! যেতেই হবে !!
যখন ওদের বাসায় পৌছালাম তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে !! কলিং বেল বাজাতেই দরজা খুলে গেল । নীতুর মা । আমাকে দেখে যেন খানিকটা অবাক হল । মা নিশ্চই এদের সাথে কথা বলেছে । মানে বিয়ে নিশ্চই ভেঙ্গে দিয়েছে ! আমাকে এখানে দেখার কথা না !
আমি বললাম
-নীতু কোথায় ?
-ঘরে আছে ।
-আমি ওর সাথে দেখা করবো !!
আমি তখনও জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছি ! আর আমার কন্ঠে কিছু একটা ছিল যে নীতুর মা কেবল হাতের ইশারায় নীতু ঘরটা দেখিয়ে দিল ।
আমি ঘরে ঢুকে দেখি নীতু শুয়ে আছে । আমাকে দেখে একটু যেন অবাক হল ! আমি কেবল ওর পাশে গিয়ে বসলাম । ও ততক্ষনে উঠে বসেছে । আমার দিকে না তাকিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে আছে !!
আমিও কেবল তাকিয়ে রইলাম ওর দিকে ! অপেক্ষায় আছি কখন ও আমার দিকে তাকায় !!
কখন আমাকে কিছু বলে !!
হঠাৎ নীতু আমাকে বলল
-ওরা আমার কোন ক্ষতি করতে পারে নি ! তুমি বিশ্বাস কর !!
-কারা ??
নীতু এবার আমার দিকে তাকাল । তাকিয়ে রইলো একভাবে । লক্ষ্য করছিলাম ওর চোখে পানি জমতে শুরু করেছে !!
আমি বললাম
-আমি তোমার কাছে কিছু জানতে চেয়েছি ?
নীতু কেবল তাকিয়ে রইলো !!
-কিন্তু তোমার মা যে .....
আমি বললাম
-তুমি কেবল আমাকে কষ্টই দেও ! এক বার আমাকে ফোন দিতে পারতে না ?? আমার মা যা বলে বলুক আমার কথাটা কি তোমার শোনার দরকার ছিল না ??
নীতু এবারও চুপ করে রইলো !!
আমি বললাম
-তুমি সেদিন একটা কথা বলেছিলে মনে আছে যে আমি তোমাকে ভালবেসে ফেলেছি কিনা ?? সেদিন বলতে পারি নি আজকে বলছি আমার কাছে তুমি ইম্পর্টেন্ট !! আর কিছু না ! আর কোন কিছু না । আর অন্য কোন কিছু তোমার আমার আমার ফিলিংস, আমার অনুভুতি বদলাতে পারবে না !!
এবার নীতুর চোখ দিয়ে পানি বের হয়েই গেল !!
আমি বললাম
-আর তুমি কিভাবে ভাবলে যে দূর্ঘটনায় তোমার কোন দোষ নাই সেটাতে আমি তোমাকে দোষারোপ করবো ??
আমি আর একটু কাছে গিয়ে বসলাম । একটু যেন সংকোচ হচ্ছিল তবুও ওর হাত টা ধরলাম । বললাম
-আমারদের কাপোল ট্যুরের কি হল ? আমাকে নিবা তো ?
অশ্রু ভারা চোখেও নীতু হেসে ফেলল ।
আমি কেবল তাকিয়েই রইলাম সেই চোখের দিকে !!
(গল্পের নামটি হুমায়ুন আহমেদের একটা গল্পের নাম থেকে নেওয়া)
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জানুয়ারি, ২০১৩ রাত ১:৩৯