আমি একটা বড় নিঃশ্বাস নিয়ে এগিয়ে চললাম ইভাদের বাড়ির দিকে । এই তো দেখা যাচ্ছে একতলা বাড়িটা । দিনের বেলা হলে লালচে গেটটা দেখা যেত । এখন অন্ধকারে লালচে গেটটা আর একটু গাঢ় কালো দেখা যাচ্ছে । আমি ছোট গেটটা ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করতে গেলাম ।
গেটটা ধাক্কা দেওয়ার সময় টের পেলাম আমার হাত কাঁপছে ।
আরে এখানে কাঁপাকাঁপির কি হল ?
নিজেকে আরো একবার বুঝানোর চেষ্টা করলাম । আমি তো অকাম করতে যাচ্ছি না ।
গার্লফ্রেন্ডের বাড়িতে যাচ্ছি ।
তাও আবার গার্লফ্রেন্ডের মায়ের আমন্ত্রনে । আর প্রথম বার যাচ্ছি তাও কিন্তু না । গত কালকেই আমি এ বাড়িতে এসেছি !
গতকাল স্কুল ছুটির পর ব্যাগ গুছাচ্ছিলাম । আমি এমনিতেও স্কুল ছুটির একটু পরে বের হই । স্কুল তখন মোটামুটি ফাঁকা হয়ে গেছে । আমি দরজা দিয়ে বের হতে যাবো ঠিক তখনই ইভা আমার সামনে এসে দাড়াল ।
আমি একটু অবাক হলাম । একটু চমকালামও বটে ।
এই মেয়ের কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে ?
এতো সাহস কেমনে হইল ?
ইভার সাথে আমার একটা ভালবাসার সম্পর্ক রয়েছে এটা খুব কম মানুষই জানে । আমাদের সরাসরি কথাবার্তাও খুব কম হয় । ওকে চিঠি লিখি ও আমাকে চিঠি লেখে ! এভাবেই চলছিল ।
কিন্তু একেবারে এভাবে দরজা আগলে দাড়ানোর মানে কি ! যে কেউ দেখে ফেলতে পারে । আর স্যারেরাও এখনও যাই নি । যদি রাশেদুল স্যার দেখে ফেলে তাহলে তো আমার খবরই আছে !
আমি চোখ কপালে তুলে বললাম
-এখানে কেন ? কেউ দেখে ফেললে উপায় আছে ?
-একটু সমস্যা হয়েছে ।
-কি সমস্যা ?
মফস্বলের প্রেমে হাজার রকম সমস্যা দেখা দেয় । তাই সারাক্ষন একটু টেনশনে থাকতে হয় । আমি আবার বললাম
-কি সমস্যা হয়েছে ?
-তোমার লেখা চিঠি গুলো সব আম্মুর হাতে পরে গেছে ।
-কি ? কি বললে তুমি ? কিভাবে ?
-আমি চিঠি গুলো আলমারির ভিতরে রেখেছিলাম ।
-আলমারি ! চিঠি কেউ আলমারির ভিতর রাখে ? বেকুব মেয়ে ? ড্রয়ার ছিল না বাসায় ?
-কি বললা তুমি !
-না । কিছু বলি নি তো ! বলেছি ড্রয়ারে রাখতে পারনি সোনা পাখি !
-দ্যটস বেটার ! আমি ভেবেছিলাম আলমারি কমন জায়গা । আম্মু হয়তো দেখবে না ।
আমি বললাম
-এখন ?
-আম্মু তোমাকে বাসায় যেতে বলেছে ।
-কি ?
আমার মনে হল কেউ আমাকে দুইশ বিশ ভোল্টের শক দিল । ইভার মা আমাকে ওদের বাসায় যেতে বলেছে !
এটা কি বিশ্বাস যোগ্য কথা ! আমি বললাম
-কখন যেতে বলেছে ?
-এখনই চল ।
-এখন ?
-হ্যা এখন । চল ।
ইভা আমাকে সাথে করে নিয়ে গেল ।
ইভাদের বাসায় যখন পৌছালাম তখন ওর মা নামাজ পড়ছে । আমি ড্রয়িং রুমে বসে অপেক্ষা করছি । কিছুক্ষন পর ইভার মা এসে হাজির হল ।
আমাকে অনেক কথা বলল ।
অনেক বোঝাল ।
আমরা যেটা করছি সেটা ঠিক করছি না ।
ইত্যাদি ইত্যাদি !
ভদ্রমহিলা এমন আস্তে আস্তে কথা বলছিল আর আমার থেকে একটু দুরে বসে ছিলো যে আমি বেশ কিছু লাইন ঠিক মত শুনতে পাইনি ।
ক্লাসে যখন স্যারের কোন কথা শুনতে পাই না তখন তো হাত উচু করে বলি যে স্যার আর একবার বলেন ।
এখানেও কি বলবো আন্টি একটু জোরে বলেন । কিছুশুনতে পাচ্ছি না । তার উপর এক মশা আমার হাতের উপর বসে আরাম করে রক্ত খাচ্ছে । একটু একটু হাত নাড়ালাম কিন্তু মশাটা উড়ে গেল না । আপন মনে রক্ত খেতে লাগল ।
মশাটা মনে হয় পরিস্থিতি বুঝতে পেরেছে । আমি যে ওকে মারবো না সেটা ও বোধহয় খুব ভাল করেই বুঝেছে । কথা শেষ করে ইভার মা বলল
-ঠিক আছে ! আমি কি বললাম মন দিয়ে শুনেছ তো !
আমি অতি ভদ্রভাবে মাথা নাড়িয়ে বললাম
-জি আন্টি । একদম পরিস্কার বুঝেছি ।
-কাল সন্ধ্যার দিকে আবার এসো ! ইভা যেই চিঠি গুলো তোমাকে লিখেছিল ও গুলো নিয়ে এসো । কেমন !
-জি আন্টি ।
এই জন্যই আমার আজ ইভাদের বাসায় আগমন । ইভা আমাকে যত চিঠি লিখেছিল সেই গুলো নিয়ে হাজির হয়েছি ওর মার কাছে জমা দেওয়ার জন্য । আমি কাঁপা হাতেই ইভাদের কলিং বেলে চাপ দিলাম । কাল অবশ্য কলিংবেল বাজাই নি । ইভা সাথে ছিল তো !
তবে একটা ব্যাপার বেশ অবাক লেগেছে যে কালকে ইভা বেশ স্বাভাবিক লাগছিল । একটা মেয়ে তার বয়ফ্রেন্ড কে নিজের মায়ের সাথে পরিচয় করাতে নিয়ে যাচ্ছে অথচ কি শান্ত আর স্বাভাবিক ।
আশ্চার্য ব্যাপার !
ইভা মনে হয় আমার জন্যই অপেক্ষা করছিল । কলিং বেল বাজার প্রায় সাথে সাথেই দরজা খুলে বেরিয়ে এল । আমাকে দেখে একটু হাসল । যদিও বারান্দায় অন্ধকার ছিল তবুও ওর হাসি টা আমি ঠিকই দেখতে পেলাম । আমি একটু যেন ভরসা পেলাম ।
আসলে সত্যি কথা বলতে কি ইভার হাসি আমি যখন দেখি বুকের ভিতর কেমন একটা আনন্দ হয় । সেই আনন্দ সব ভয় ভীতি কে অতিক্রম করে ফেরে ।
আমি বারান্দায় উঠে এলাম । আমার হাতের ব্যাগটা দেখে ইভা চোখ কপালে তুলে বলল
-এতো চিঠি লিখেছি ?
আমি একটু হেসে বললাম
-তাও তো সব আনি নি ।
ইভা কিছুক্ষন ব্যাগটার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল
-যে গুলো রাখতে বলেছিলাম সেগুলো রেখে এসেছো তো ?
কালকের পর থেকে আমি আর ইভা দুজনেই খুব এক্সাইটেড ছিলাম । আমি ছিলাম এই কারনে যে ইভার মা খুব বেশি উচ্চবাচ্চ করে নি । সব কিছু স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিয়েছে । কালকে আবার আমাকে নাস্তাও খাইয়েছে । আর আজকে আবার বাসায় যেতেও বলেছে । সব মিলিয়ে একদম ফাটাফাটি অবস্থা ।
আর ইভা এক্সাইটেড ছিল এই কারনে যে আমার সাথে তার মা কি কথা বলল এটা জানার জন্য ।
সকাল বেলা পড়তে যাচ্ছি । ব্যাচে ঢোকার আগেই ইভা আমার পথ রোধ করে দাড়ালো ।
পুরো দিনের ভিতর এই সকাল বেলা টাই আমরা একসাথে দেখা করতে পারি । এক কথা বলতে পারি । আমাকে প্রথম প্রশ্নই করলো
-আম্মু কি বলল ?
-কি বলবে ? এই একটু বোঝালো । বলল এই বয়সে আমাদের এই কাজ করা ঠিক হয় নি । ইত্যাদি ইত্যাদি ।
-আর কি বলল ?
-বলল তোমার চিঠি গুলো ফেরৎ দিতে ।
ইভা কিছুক্ষন ভাবলো । তারপর বলল
-কবে ফেরৎ দিতে বলেছে ?
-আজকেই ।
-আচ্ছা এসো তাহলে । আর সব কিন্তু ফেরৎ দিও না । প্রথম চিঠিটা কিন্তু রেখে দিবা না ! মনে থাকবে তো ?
-আমি কাল রাতেই কিছু আলাদা করে রেখেছি ।
-আচ্ছা । তাহলে সন্ধ্যার পর পরই চলে এসো । কেমন ?
-আচ্ছা । আর একটা কথা !
ইভা বলল
-কি ?
-তোমরা কি মিষ্টি কম খাও ?
ইভা আমার কথা শুনে খানিকটা অবাক হল ।
-কেন এই কথা কেন বলছো ?
-না মানে কাল যে পিঠা খেতে দিছিলে মিষ্টি কম ছিল ।
ইভা কিছুক্ষন আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল
-শ্বশুর বাড়ির মিষ্টি পেয়েছ ? এতো মিষ্টি খেতে হবে না বুঝেছ !
-বুঝলাম ।
ইভা আবার আমাকে প্রশ্নটা করলো ।
-রেখে এসেছো তো ?
-হুম !
-আচ্ছা এসো ।
-তোমার আম্মু কোথায় ?
-আছে । এসো তো ।
ইভা আমার হাত ধরে ঘরের ভিতর নিয়ে এল । বারান্দায় খুব বেশি আলো ছিল না । ঘরের ভিতর এসে ইভাকে ভাল করে দেখলাম । বেশ ভালই প্রস্তুতি নিয়েছে তো ।
বেশ সুন্দর করেই সেজেছে । আমি বললাম
-তোমাকে সুন্দর লাগছে ।
-বলেছে তোমাকে ? বস চুপ করে ।
ইভার মুখে কেমন একটা লজ্জা মিশ্রিত হাসি । ওর এই লজ্জা মাখা মুখটা ওর চেহায়ার সৌন্দর্য যেন আরো বাড়িয়ে দিয়েছে ।
-সত্যি বলছি !
ওর মুখের লালিমা আর একটু যেন বাড়ল ।
-হয়েছে । চুপ । আম্মু এখনই চলে আসবে ।
বলতে বলতেই ইভার মা ঘরে ঢুকে পড়ল ।
ইস ! বড় বাঁচা বেচে গেছি । আর একটু হলে আমি ইভার হাত ধরতে যাচ্ছিলাম ।
ধরলে উপায় ছিল ?
ইভাও একটু দুরে গিয়ে বসল । ইভার মা বলল
-এসেছ ?
-জি আন্টি ।
-কোথায় চিঠি গুলো !
-এই তো ।
আমি শপিংব্যাগটা আন্টির হাতে তুলে দিলাম । ব্যাগটার সাইজ দেখে আন্টি একটু অবাকই হলেন । একবার ইভার দিকে তাকাল আর একবার আমার দিকে !
-তোমরা কি এই কাজই করতে পড়াশুনা না করে !
আমি ইভার দিকে তাকিয়ে দেখি ও মিসমিস করে হাসছে । ইভার মা ইভার দিকে তাকিয়ে বলল
-হাসবি না । থাপ্পর দিয়ে দাঁত ফেলে দিবো ।
তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-তোমার চিঠি গুলো দেখে মনে করেছিলাম কেবল তুমিই চিঠি লিখতে কিন্তু এখন দেখছি আমার মেয়েও কম যায় না ।
-জি আন্টি ।
ইভার দিকে তাকিয়ে দেখি ও অন্য দিকে তাকিয়ে হাসি আটকানোর চেষ্টা করছে ।
আমি মনে মনে বললাম শ্বাশুড়ী আম্মা সব চিঠিতো দেই ই নি । দিলে বুঝতেন ! তারপর খুব বিনয়ের সাথে বললাম
-আন্টি আমি যাই তাহলে !
-না একটু বোস !
আন্টি চলে গেল । আমি ইভার দিকে তাকালাম ! চোখে জিজ্ঞাসা !
ইভা বলল
-বস ! তোমাকে তোমার শ্বশুরবাড়ির মিষ্টি খাওয়াব !
-তাই নাকি !!
ইভা চলে গেল । ফিরে এল একটু পরেই ! হাতে একটা ট্রে !
ইভা যখন ট্রে টা নিচে নামিয়ে রাখলো তখন দেখি ওখানে প্রার ৫/৬ রকমের মিষ্টি !! দই !
ইভা একটু হাসলো ! বলল
-এবার খাও তোমার শ্বশুর বাড়ির মিষ্টি !
-আসল মিষ্টি কই ?
ইভা ভুরু কুচকে বলল
-আসল মিষ্টি মানে ?
আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষন । তারপর বলল
-তোমাকে না একটা থাপ্পড় লাগাবো !
-লাগাও !
শ্বশুর বাড়ির মিষ্টি খেয়ে যখন বাইরে বের হয়ে এলাম মনের ভিতর একটা আনন্দ বয়ে যাচ্ছিল । মনে হল জীবনটা নেহত মন্দ না !!
বিঃদ্রঃ গল্পটা খানিকটা সত্য ঘটনা নিয়েই লেখা ! অনেকদিন পর ইভার কথা মনে পড়ল !
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে নভেম্বর, ২০১২ রাত ১০:২৯