আমার কথা শুনে মেয়েটা মনে হল একটু অবাক হল । আমার দিকে একটু অবাক হবার দৃষ্টিতেই তাকিয়ে রইল । আমি আবার বললাম
-তোমার মন কি বেশি খারাপ ? বিরক্ত হলে চলে যাই ?
আমি উঠে পড়তে চাই । একটা মেয়েকে এভাবে বিরক্ত না করাই ভাল আমার মনে হয় । মেয়েটার মন খারাপ থাকতেই পারে । আর মন খারাপ হলে মানুষ একা সময় কাটাতে চায় ।
আর তাছাড়া মেয়েটি কে আমি প্রথম বারেই তুমি করে বলেছি এটা অনেক মেয়েই ঠিক মেনে নিতে পারে না ।
আমি উঠতে যাবে এমন সময় মেয়েটি বলল
-প্লিজ যাবেন না । একটু বসুন ।
যাক মেয়েটা বোধ হয় একটু স্বাভাবিক ভাবে নিয়েছে । মেয়েটার মন খারাপের কারন তাহলে জানা যাবে ।
আসলে আমার খুব বাজে একটা অভ্যাস আছে । কোন মানুষের মন খারাপ দেখলে আমার কেন জানি মন খারাপের কারনটা খুব জানতে ইচ্ছা করে ! জানতে ইচ্ছা করে কেন মানুষটার মন খারাপ !
আগে কোন মানুষের মন খারাপ দেখলেই আমার নিজেরও খুব মন খারাপ হত । মনের ভিতর কেবল একটা প্রশ্নই জাগতো যে কেন মানুষটার মন খারাপ । কিন্তু জিজ্ঞেস করতে পারতাম না সংকচের কারনে ।
রাস্তা ঘাতে যে কাউকে তো আর জিজ্ঞেস করা যায় না যে ভাই আপনার মন খারাপ কেন ?
কিন্তু একটু বড় হবার পর একটু সাহস বেড়ে গেল । তবে প্রথম প্রথম জিজ্ঞেস করতে একটু যে সংকোচ হত না, এমন না কিন্তু জিজ্ঞেস করলেই হয়ে গেল!! এবং একটা ব্যাপার লক্ষ্য করলাম এই যে মানুষকে তার মন খারাপের কারন জিজ্ঞেস করলে সে রাগ করে উঠে না ।
বরং বলে ফেলে !
কারো কাছে বলতে পেরে নিজিকে হালকা করে নেয় । আর আমার মনে হয় পরিচিত মানুষের কাছ থেকে অপরিচিত কারো কাছে বলাটা একটু সহজ । আমার মাঝে মাঝে মন খারাপের কারন গুলো শুনে খুব অবাক লাগতো ! কি অদ্ভুদ সব কারনে মানুষের মন খারাপ হয় ! জানি না এই মেয়েটির কি কারনে মন খারাপ !!
একবার এক ট্রাফিক পুলিশ কে জিজ্ঞেস করেছিলাম কি তার মন খারাপের কারন । ট্রাফিক পুলিশের নেমপ্লেটে নাম লেখা ছিল জসিম । জসিম সাহেব আমার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বলল যে তার ছোট্ট মেয়ের আজ স্কুলে পুরুস্কার বিতরনী অনুষ্ঠান । তার মেয়েটা এবার পরীক্ষায় প্রথম হয়েছে । খুব ইচ্ছা ছিল মেয়েটার অনুষ্ঠানে যাওয়ার কিন্তু ছুটি পান নি ।
আমার নিজের মনটাও খারাপ হল জসিম সাহেবের কথা শুনে । মেয়েটা যখন পুরুষ্কার নিবে নিশ্চই বারবার পরিচিত কারো মুখ খুজবে কিন্তু পাবে না ।
ঠিক তেমনি এই মেয়েটারও নিশ্চই কোন মন খারাপের কারন আছে ।
আমি ছুটির দিন গুলোতে সাধারনত এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াই । আজ বিকেলে কি মনে হল চন্দ্রিমা উদ্দানের ক্রিসেন্ট লেকের দিকে আসলাম । লেকের টলটলা পানি দেখতে বেশ ভালই লাগে ।
গাছের একটা ছায়া দেখে বসতে যাবো ঠিক তথনই মেয়েটার উপর চোখ পড়ল । লেকের পাড়ের উপর পা ঝুলিয়ে বসে আছে । মুখটা ভিষন বিষন্ন । আমার কৌতুহল হল ।
একটু ইতস্তত করে এগিয়ে গেলাম মেয়েটার দিকে । আমার উপস্থিতি টের পেয়ে মেয়েটা আমার দিকে ফিরে তাকাল । মেয়েটার মুখটা গোলগাল । এভারেজ চেহারা । কিন্তু মেয়েটার চোখদুটো অসম্ভব গভীর আর সেখানে একটা গভীর বিষাদের ছায়া ।
মেয়েটার কি এতো দুঃখ ?
কিসের এতো বিষাদ ?
কেন জানি খুব বেশি জানতে ইচ্ছা করল ।
মেয়েটার কথা শুনে আমি মেয়েটার পাশে বসে পড়লাম । মেয়েটি বলল
-আসলে মানুষের কাছ থেকে এমন কথা শুনে অভ্যাস নেই তো তাই একটু অবাক হয়েছিল ।
আমি মেয়েটার কথা ঠিক বুঝলাম না । আমি তো খুব একটা অদ্ভুদ কথা বলি নি ।
মন খারাপের কথা যে কেউ জানতে চাইতেই পারে । বিশেষ করে বন্ধুবান্ধবীরা তো এই রকম প্রশ্ন করেই থাকে ।
মেয়েটার কি কোন বন্ধুবান্ধবী নাই ?
নাকি ওর বন্ধুরা এমন প্রশ্ন করে না ?
কে জানে ?
মেয়েটা আমার দিকে আর কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো । মেয়েটার চোখ দুটো আসলেই খুব বেশি গভীর । কত যুগের কত কথা যেন লুকিয়ে মেয়েটার চোখে ! কত কথা যেন বলার আছে !
আমি বললাম
-তোমার মন খারাপ কেন ?
মেয়েটি কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলল
-আজকে আমার জন্য দিন ।
-তাই নাকি ? তাহলে আমি বার্থডে গার্লের সাথে রয়েছি । তা বার্থডে গার্লের নাম টা কি ?
মেয়েটা হাসল ।
-আমার নাম ঝুমু । ঝুমু ।
নামটা বলেই ঝুমুর মুখটা কেমন মলিন হয়ে গেল ।
-কি হল ?
-না কিছু না । আমার নামটা যে ঝুমু অনেকদিন পর মনে পড়ল । অনেকদিন পর নিজের আসল নামটা বললাম কাউকে ।
-মানে কি ?
এই মেয়েটার কথা গুলো কেমন যেন একটু ঘোলাটে টাইপের ।
-তোমার কেন খারাপ বললা না তো ?
ঝুমু একটু হেসে বলল
-কোন কারন নেই ।
আমার কেন জানি মনে হল মেয়েটা মিথ্যা বলছে । নিশ্চই কোন কারন আছে । আমি চুপ করে তাকিয়ে রইলাম মেয়েটার দিকে । ঝুমু একটু ইতস্তত করে বলল
-আসলে আজ আমার জন্মদিন ।
আমি বললাম
-জন্মদিন ! এই দিনে কেউ মন খারাপ করে থাকে ? আজ তো তোমার দিন । দাড়াও !
বলেই আমি উঠে গেলাম ।
-কোথায় যাচ্ছেন ?
আমি হাটতে হাটতে বললাম
-আমি আসছি এখনি তুমি কিন্তু যাবা না । এখানেই বসে থাকবা ।
আমি কেক খুজতে গেলাম ।
একবার মনে হল কি দরকার এসব করার ? কোথাকার কে না কে ? কিন্তু মেয়েটার মন খারাপ দেখে কেমন জানি লাগলো ! মেয়েটার মন যদি একটু ভাল করা যায় তা হলে খারাপ কি ?
আমার নিজেরও ভাল লাগবে । কিন্তু কেক পেলাম না কোথাও ! হাওয়াই মিঠা নিয়ে ফিরে আসতে হল । আমাকে আসতে দেখে ঝুমু বলল
-কোথায় গিয়েছিলেন ?
-কেক খুজতে গেছিলাম । কিন্তু আসেপাশে কোথাও কেক নাই । এই হাওয়াই মিঠা দিয়ে কাজ চালাতে হবে । নাও । আর শুভ জন্মদিন ।
ঝুমু আমার দিকে তাকিয়ে রইল ।
কিছুক্ষনের মধ্যেই দেখলাম মেয়েটার চোখ দিয়ে পানি পরছে ।
-আরে আরে সমস্যা কি ? কান্না কাটির কি হল ?
-না । কিছু না । আসলে ...
ঝুমু আরো কিছুক্ষন সময় নিল । নিজেকে সামলে নিয়ে ঝুমু বলল
-আসলে অনেক দিন পর আমার এই দিনটার কথা মনে পড়ল । কাউকে অনেক দিন পর এই দিনটার কথা বললাম । আমার খুব ভাল লাগছে । খুব বেশি । আনন্দে কাঁদছি ।
ও । আচ্ছা । ঝুমু একটু হাওয়াই মিঠে মুখে দিয়ে বলল
-আপনাকে ধন্যবাদ । আসলে আমাদের মত মানুষদের জীবনে এই রকম দিন থাকতে নেই ।
-মানে কি ? এটা কি ধরনের কথা হল ?
ঝুমু হাসল । ঝুমুর সাথে আরো কিছু কথা হল । ঝুমুর সাথে কথা বলতে ভালই লাগছিল ।
প্রথম প্রথম মেয়েটার মনটা যেমন বিষন্ন ছিল আস্তে আস্তে তা কেটে যাচ্ছিল দেখতে পাচ্ছিলাম । আমরা কথা বলছিলাম একটু পর দেখলাম একটা লোক কেমন যেন আমাদের চারিপাশে ঘোরাফেরা করছে । ঝুমুর দিকেও তাকাল বেশ কয়েকবার ।
ঝুমু যখন লোকটা কে দেখল মুখের হাসিটা কেমন যেন মুছে গেল । আমাকে বলল
-আপনি একটু বসেন । আমি আসছি ।
ঝুমু ঐ লোকটার সাথেই কিছুক্ষন কথা বলল । তারপর আমার কাছে এসে বলল
-আমার এখন যেতে হচ্ছে । আপনার সাথে কথা বলে ভাল লাগল । অনেক ভাল লাগল । ভাব থাকবেন ।
ঝুমু এই বলেই পেছনে হাটা দিল । একটু দুরে গিয়ে ঝুমু থামলো । তারপর আবার ঘুরে আমার দিকে এগিয়ে এল । আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-আপনার কথা আমার মনে থাকবে । কিন্তু আপনি আমার কথা মনে রাখবেন না । ঠিক আছে ?
-মানে কি ?
-কোন মানে নেই । কোন মানে থাকতে নেই । ভাল থাকবেন ।
ঝুমু আর দাড়াল না । লোকটির সাথে হাটতে লাগল । আমি ঝুমু আর লোকটির চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়েই রইলাম । ঝুমুর কথা গুলো কেমন যেন একটু ঘোলাতে লাগল ।
ও ওর কথা মনে রাখতে মানা করলো কেন ?
ঝুমুকে এখনও দেখা যাচ্ছে । একটা কালো রংয়ের গাড়ীর পাশে দাড়িয়ে আছে । সাথের লোকটা কি যেন বলছে গাড়ির ভিতরকার কাউকে ।
আমি বসেই রইলাম । লেকের টলটলা পানিতে নিজের ভাসমান প্রতিচ্ছবি দেখতে লাগলাম ।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই নভেম্বর, ২০১২ রাত ১০:০৫