খুব মেজাজ খারাপ হল রুনুর উপর । মুখে সেই ভাবটা একটু বিরক্ত আনার চেষ্টা করলাম । কিন্তু রুনুর সেই দিকে কোন লক্ষ্যই নেই । ও খিল খিল করে হেসেই চলেছে । আমি বললাম
-তুই এমন করে হাসতেছিস ক্যান ?
রুনু আমার দিকে তাকিয়ে কোন মতে হাসি থামিয়ে বলল
-তা কি করবো আর ? তুই বোকা ছিলি জানতাম তাই বলে এতো বড় বেকুব জানতাম না ।
-মানে কি ? আমি বোকার মত এমন কি করলাম ?
-কি করেছিস ?
বলে রুনু আবারও হাসতে লাগল ।
-দেখ হাসবি না । থাবড়া খাবি কিন্তু ।
আমার কথা শুনে রুনু আরো জোরে হাসতে লাগল ।
-থাবড়া দিতে পারবি ? দে দেখি একটা ?
আমি কিছুক্ষন রুনুর দিকে তাকিয়ে বললাম
-তোর খুব মজা লাগছে । তাই না ?
আমি অন্য দিকে মুখ ঘুড়িয়ে বসলাম ।এই ফাজিল মেয়েটার সাথে কোন কথা বলবো না ।
রুনু আমার দিকে ঘুরে বসলো । বলল
-তুই এমন পাগলামো কেন করছিস ?
-আমি পাগলামীর কি করলাম ?
-কিছু করিস নি । কিন্তু করতে যাচ্ছিস । স্রেফ পাগলামো ।
-কোন পাগলামো না । আমি এটা টিভিতে দেখেছি ।
-তা কি দেখেছেন জনাব একটু শুনি ।
-একবার একটা এনিম্যাশন মুভিতে দেখেছিলাম । একটা ছেলে তার পছন্দের মেয়ে কোথাও খুজে পায় না । তারপর নিজেই একটা পছন্দের মেয়ের ছবি আঁকে তারপর ইউরেটাসের কাছে প্রার্থনা করে সেই মেয়ের মধ্যে প্রান প্রদান করে ।
রুনু আমাকে বলল
-ইউরেটাসকে ?
-ইউরেটাস হল গ্রীক দেবী ।
-শোন তুই গ্রীসে থাকিস না বাংলাদেশে থাকিস । বোকামীর একটা সীমা থাকা দরকার । কোথায় না কোন কার্টুনে কি দেখেছে ! তুই আসলেই একটা গাধা ।
-তোর কি মনে হয় আমি কেবল ঐ এনিম্যাশন মুভি দেখেই এসব বলছি । না । আমি এই নিয়ে পড়াশুনা করেছি । গ্রীক দেবী ইউরেটাসের আসলেই এমন ক্ষমতা আছে । ঠিক কিছু প্রসিডিউর ফলো করলেই চলবে ।
রুনুর মুখটা একটু নমনীও হল ।
-আচ্ছা এসব তুই কেন করতে চাচ্ছিস ।
-তুই জানিস । খুব ভাল করেই জানিস কারনটা তুই ।
রুনু এবার হাতের উপর হাত রাখলো । শরীরের কোন অনুভূতি জাগলো না । জাগার কথাও না । কেবল আমার মনটা বলল যে রুনু আমার হাতের উপর রেখেছে ।
মিসির আলীর মত একজনের ভাষ্য অনুযায়ী রুনু নামের কারোর কোন অস্তিত্ব নাই । ভদ্রলোকের কথা ফেলে দেওয়ার উপায় নাই । কারন কথা যে সত্য এটা আমি নিজেও জানি ।
বাস্তবে রুনু নেই । কিন্তু আমি বিশ্বাস করতে চাই যে রুনু আছে ।
ছোট বেলা থেকেই আমি একা একাই বড় হয়েছি । আসলে বাবা মার কাছে এতো সময় কোথায় আমাকে টাইম দেবার ? তারা তাদের জীবন দিয়ে ব্যস্ত । একদিন বিকেল বেলা আমি আমার ঘরে বসে খেলা করছিলাম । আমার বুয়া যার কিনা আমায় সাথে সাথে থাকার কথা ছিল সে টিভির ঘরে টিভি দেখায় ব্যস্ত । সব সময় যা করে সে !
ঐ দিন বিকেল বেলাতেই আমি রুনুকে আবিস্কার করি । লাল রংয়ের একটা ফ্রগ পরা ।
আমার কাছে এসে বলল
-এই তুই একা একা খেলছিস ক্যান? আমার সাথে খেলবি ?
সেই থেকে শুরু ! তারপর থেকেই রুনু সব সময় আমার সাথেই আছে । সব জায়গায় সব সময় আমার সাথে ।
রুনু বলল
-আমি তো সব সময় তোমার সাথে আছি । তোমার পাশে । যখন তোমার কথা বলতে ইচ্ছা করে আমি কি আসি না ? তোমার পাশে কি বসি না ? এই যে দেখো তোমার হাত ধরেছি ! এটা অন্য কেউ যাই বলুক না কেন তোমার কাছে তো এটা বাস্তব ? তাই না ? তাহলে কেন আমাকে দরকার ?
আমি কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বললাম
-বাবা মা আমার জন্য মেয়ে দেখছে ।
-তো ভাল তো ।
-না ভাল না ।
-আমি অন্য কোন মেয়ে কে বিয়ে করতে চাই না । আমি তোকে বিয়ে করতে চাই ।
রুনু আমার দিকে একটু বিরক্তিতে তাকিয়ে বলল
-তুই আসলেই একটা গাধারে । তোয় সাথে ফ্যাদা প্যাচাল পেড়ে লাভ নাই । থাক তুই । আমি যাই ।
রুনু চলে গেল । আমি ওর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষন ।
এই মেয়ে গুলো এমন কেন হয় ? একটু আগেই বলল আমাকে ছেড়ে যাবে না । সব সময় আমার পাশে আছে । আবার এখন চলে যাচ্ছে ।
বাস্তবের মেয়ে গুলা বোঝাতো জটিল বিষয়ই শালার এই কল্পনার মেয়েটাকেও দেখি বোঝা যায় না ।
আচ্ছা মেয়েটা কি বোঝে না ?
আমি কেন এসব করি ?
আসলে অন্য কোন মেয়েকে আমি ঠিক মত নিতেই পারবো না । আমি ভাবতেই পারি না অন্য কোন মেয়ে আমার উপর খবরদারী করবে আমাকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোড়াবে ।
আমি জানি রুনুর মত করে কেউ আমাকে কোন দিন বুঝবে না । যদি খবরদারী কেউ করুক যেটা রুনুই করুক । অন্য কেউ না ।
দুদিন গেল কেবল প্রস্তুতি নিতেই । আমার ইউরেটাসকে ডাকার প্রথম শর্তটা হল তাকে ডাকতে হবে পাহাড়ের কোন গুহার ভেতর থেকে । পাহাড়ের গুহার ভেতরে তিনকোনা একটা ত্রিভুজ আকতে হবে । তারপর তিন কোনায় তিনটা গর্ত করে তাজা রক্ত দিয়ে ভর্তি করতে হবে । ত্রিভুজের মাঝখানে রুনুর ছবি রাখতে হবে আর তার চারিপাশে মোমবাতি জ্বালাতে হবে ।
তারপর এক মনে ইউরেটাসের নাম স্বরন করতে হবে । তারপরেই নাকি ইউরেটাসের আবির্ভাব হবে ।
সব জোগার যন্ত করে যখন বান্দরবনের ইলং পাহাড়ের সামনে হাজির হলাম তখন সূর্য মাথার উপর এসে দাড়িয়েছে ।
আমি বনের ভিতর দিয়ে হাটছি সামনে আমার গাইড । পনের ষোল বছরের একটা ছেলে । নাম ইতু মিয়া ।
ব্যাগ পত্র সব আমার কাধে থাকলেও ইতুর হাতে তিনটা মুরগি । ইতুর ধারনা হয়েছে আমি পাহাড়ের উপর উঠে পিকনিক করবো । মুরগি রান্না হবে । এই আনন্দ নিয়ে সে আগে হাটসে ।
-এই বেটা কই যাস ?
পিছনে ঘুরে দেখি রুনু ।
একটু দৌড়ে এসে আমার পাশা পাশি চলে এল ।
-সব প্রস্তুতি শেষ ? হুম । তা বয়লার মুরগি কিনেছিস কেন ? ইউরেটাসের উদ্দেশ্য উত্সর্গ করবি ? এট লিষ্ট দেশি মুরগি কিনতে পারতি ? বয়লার মুরগি দিয়ে উত্সর্গ ?
-তুই কি ফাজরামো করতে এসেছিস ?
-আরে ফাজলামো করবো কেন ? তুই বয়লার মুরগি দিয়া ইউরেটাসকে ডেকে আনলি আর সে বলবে হু হু হা হা ! তুই আমাকে বয়লার মুরগির রক্ত উত্সর্গ করলি যাহ, তোর রুনুর গায়েও আমি বয়লার রক্ত ভরে দিলাম । তাহলে কি অবস্থা হবে একবার ভেবে দেখেছিস ?
আমি এবার দাড়িয়ে পড়লাম । রুনু জোরে জোরে হাসতে লাগলো । ইতু বেশ খানিকটা দুরে চলে গিয়েছিল । আমাকে ডাকতে লাগল ।
এই মেয়ের সাথে সময় নষ্ট করে লাভ নাই । আমি আবার হাটা দিলাম । ইতু মিয়া আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে লাগল ।
লতাপাতা ঘেরা পথ । মাঝে মাঝে রাস্তে খুব সংক্রীর্ন হয়ে উঠছে আবার খুব চওড়া হয়ে উঠছে । আরো আধা ঘন্টা খানেক চলার পর আমরা পাহাড়ে উঠতে শুরু করলাম । তখনই টের পেলাম পরিশ্রম কাকে বলে ।
পাহার খুব বেশি খাড়া না তবুও বেশ পরিশ্রম করতে হল । মাঝা মাঝি একটা জায়গায় এসে ইতু বলল যে আর পাহারে ওঠার দরকার নাই । আমি যে রকম গুহা খুজতেছি সেটা নাকি আর একটু সামনেই আছে । আমি বললাম
-এখানে মানুষ জন আসবে না তো ?
-না না কেউ আইবো না ।
আর কিছুদুর হাটার পর গুহাটা পাওয়া গেল । বড় একটা পাথর । তার পরেই বড় গুহাটা ।
চারিপাশের পরিস্থিতি দেখে মনে হল আসলে এখানে কেউ আসে টাসে না । ইতু আমাকে গুহার ভিতরে নিয়ে গেল ।
আমি একটা বড় ত্রিভুজ আকলাম । তারপর তিন কোনায় তিনটা গর্ত করলাম । ইতুর সাহায্যে তিনটা মুরগী জবাই করে রক্ত গর্তের ভিতর ফেললাম । ইতু একটু অদ্ভুদ চোখে তাকালেও কিছু বলল না ।
আমি ইতুকে মুরগী গুলো নিয়ে বাইরে অপেক্ষা করতে বললাম । আর বললাম ঘন্টা খানেক অপেক্ষা করতে ।
ইতু বাইরে গেলে আমি ত্রিভুজের মাঝখানে রুনুর ছবি গুলো রেখে ওর চারিপাশে মোমবাতি জ্বলিয়ে বসে পড়লাম ।
ছোট বেলা থেকে আমার ছবি আকার হাত ভাল ছিল । ছবি গুলো রুনুকে সামনে বসিয়ে রেখে আকা । যদিও রুনু আমার কল্পনার বন্ধু কিন্তু রুনুর মুখটা একদম বাস্তব ।
ঐ মন বিজ্ঞানীও ছবি গুলো দেখে বেশ অবাক হয়েছিল । বিশেষ করে রুনুর বিভিন্ন বয়সের ছবি । এখন শেষ কাজটা । এখন ইউরেটাসকে এক মনে ডাকতে হবে ।
আমি তাই করা শুরু করলাম । মনে মনে বলা শুরু করলাম
ইউরেটাস তুমি এসো !
ইউরেটাস তুমি এসো !
কখন যে চোখ ঘুম চলে এসেছিল । কে যেন আমাকে ধাক্কা দিয়ে ঘুম ভাঙ্গালো ।
-বাবা ওঠ ! বাবা !
আমি আমি চোখ মেলে একটু অবাকই হলাম । বেশ বৃদ্ধ এক মহিলা । বয়স কত হবে কে জানে ! আমি চোখ মুছতে মুছতে বললাম
-আপনি কে ? এখানে কি করছেন ?
-বাবা তুমি আমাকে ডাকলে না ?
-আমি ডাকলাম মানে ? আমি কখন আপনাকে ডাকলাম ?
-তুমি এখানে কেন এসেছ ? এই যে এত আয়োজন ? এসব কার জন্য ?
-আমি তো দেবী ইউরেটাসকে ডাকছি !
বৃদ্ধা মহিলা ফোলকা দাতে হেসে বলল
-আমিই দেবী ইউরেটাস !
-কিন্তু ..
এই মহিলা কি আমার সাথে ফাজলামি করছে নাকি ? আমি ছবিতে ইউরেটাসের কি চমত্কার ছবি দেখলাম !
কি চমক তার !
কি সৌন্দর্য !
আর এই মহিলা কোথা থেকে এসে বলে আমি ইউরেটাস !
বললেই হল ।
এসব নিশ্চই ইতু মিয়ার শয়তানী ।
কিন্তু আমি এখানে কি করতে এসেছে একথা তো আমি ইতু মিয়া কে বলি নি । ইতু মিয়াকে কেন আমি কাউকেই তো বলি নি ।
তাহলে ?
বৃদ্ধা বলল
-বাবা তুমি আমার যে ছবি দেখেছ সেটা আমার বয়স কালের ছবি । তাও সে কয়েক হাজার বছর আগের কথা । তুমি তো জানোই গ্রীক সভ্যতা কত পুরানো ! আর কেউ ই আমাকে তোমার কথা বলে নি ।
দেব দেবীদের তো তাহলে বয়স বাড়ে ?
বৃদ্ধা আবার ফোকলা দাঁতে হাসল । আমি একটু দ্বিধায় পরে গেলাম । মহিলা আমার মনের কথা কিভাবে বুঝে ফেলছে ?
তাহলে কি সত্যি সত্যি মহিলা ইউরেটাস ?
আমার ইচ্ছা কি তাহলে সত্যি সত্যি পুরন হতে যাচ্ছে ? বৃদ্ধা বলল
-তা বাবা দেশী মুরগি পাইলা না ?
-মানে ?
-বয়লায় মুরগিতে আজকাল ঘরে কামলারাও খুশি হয় না আর আমি তো দেবী । তাও আবার গ্রীক দেবী ।
এই মহিলার সমস্যা কি ? উনি যেই আমলের সেই আমলে তো বয়লার মুরগি আর দেশী মুরগির ভিতর পার্থক্য থাকার কথা না ?
কি আশ্চার্য কথা !
তাহলে ?
এই সব কি হচ্ছে ?
এই মহিলার সমস্যা কোথায় ?
এসব ভাবতে ভাবতে এবার সত্যি সত্যিই আমি জেগে উঠলাম । আমি বসে বসেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম ।
এপাশ ওপাশ তাকিয়ে দেখলাম কোথায় কি ? চারিপাশে কেবলই অন্ধকার । মোমবাতি জ্বলছিল এখন নিভে গেছে ।
আমি টর্চ জ্বালিয়ে দেখলাম গর্তের রক্তও শুকিয়ে গেছে ।
ধুর সব ভূয়া !
আমি রুনুর ছবি গুলো নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম । গুহার মুখ থেকেই দেখলাম বড় পাথরটার ওপাশে ধোয়া উড়ছে ।
নিশ্চই ইতু মিয়া আগুন জ্বালিয়েছে । আমি পাথরটা পার হতেই একটা ধাক্কার মত খেলাম ।
ইতু মিয়া বারবি কিউ স্টাইলে মুরগি গুলো পোড়াচ্ছে । আর ইতুর ঠিক পাশের রুনু বসে আছে । কালো জিন্স সাথে কালো টিশার্ট । পাশে রাখা একটা ট্রাভেল ব্যাগ । ট্রাকার রা যেরকম ব্যাগ ব্যাবহার করে সেই রকম ।
কিন্তু রুনুকে যেন একটু মোটা লাগছে । সব থেকে আশ্চর্যের কথা হল রুনু পানির বোতল হাতে ইতু মিয়ার সাথে গল্প করছে ।
রুনুকে আমি ছাড়া আর কেউ দেখতে পায় না তাহলে ইতু মিয়ার সাথে কথা বলছে কিভাবে ?
ইউটেরাস কি সত্যি খেল দেখালো নাকি ?
আমার কথাঃ
যারা আমার লেখা পড়েন মোটামুটি সবার কাছেই গল্পটি পরিচিত মনে হবে । শায়মা আপু এই রকম একটা গল্প লিখেছিলেন কয়েকদিন আগে ! শায়মা আপুর লেখাটা পড়েই আমার গল্পটা লিখতে ইচ্ছা হয় । আপু গল্প গুলো কেবল দুঃখের হয় ! গল্প,পড়ে কেবল মন খারাপ হয় ! এই জন্য আমি কিছুটা আনন্দের গল্প লিখতে চেয়েছি ।
ভেবেছিলাম আরো কিছুটা লিখবো !
কিভাবে রুনু সত্যি সত্যি বাস্তবে এল খোলাসা করবো, কিন্তু পরে মনে হল থাক ! পাঠক যেভাবে ভেবে মজা পায় পাক ! এটুকু তাদের উপর ছেড়ে দিলাম ।
আর একটা কথা, গল্পে যা বলেছি তার সব কিছুই আমার বানানো, এর কোন ভিত্তি নাই ! সবাই ভাল থাকবেন !
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই নভেম্বর, ২০১২ রাত ১০:৩৪