দরজাটা আর একটু খুলে আমার দিকে ফিরে চাইল ।
ওর চোখ দিয়ে পানি পরছে !
আশ্চর্য এই মেয়েটা এতো কাঁদতে পারে ! আর এর চোখে পানিও আছে মাসাল্লাহ ! আমার মনে হয় নন্দিনীর চোখের পানি দিয়ে একটা লবন ফ্যাক্টারী খুলে ফেলা যাবে ! আয়োডিন যুক্ত লবন !
নাহ ! এই মেয়েটার দিকে আর তাকিয়ে থাকা যাবে না । এর দিকে তাকিয়ে থাকলে ও ক্যাবে উঠতেই পারবেন না । একই ভাবে তাকিয়ে থাকবে আর কাঁদতে থাকবে !
আমি ঘুরে তাকালাম ।
একটু পর অনুভব করলাম নন্দিনী আমাকে জড়িয়ে ধরেছে ! কেন জানি আপনা আপনি আমিও ওকে জড়িয়ে ধরলাম । ওর কান্নার বেগ বাড়ছেই । আমি বললাম
-এভাবে কেন কাঁদছো? আমি কি হারিয়ে গেছি ?
নন্দিনী ফোঁপানো ফলায় বলল
-হারিয়েই তো গেছ ! তুমি তো আমাকে ভালবাসো না ! একটুও বাসো না ।
ইস !! কি অভিমান মাখানো কথা ! নিজেকে ওর বাহু বন্ধন থেকে ছাড়ালাম । আমি নন্দিনীর চোখ মুছে দিতে দিতে বললাম
-এরকম পাগলামো করে না ।
-আমি পাগলামো করছি, না ? হ্যা আমি তো পাগলই । আমি তোমার জন্য পাগল । আমি কিছুতেই তোমাকে ছেড়ে যাবো না । কিছুতেই না ।
আমি কিছু বলতে পারলাম না । কেবল চেয়ে রইলাম মেয়েটার দিকে !!
নন্দিনী বলল
-আচ্ছা আমি যদি মুসলমান ঘরে জন্মাতাম তাহলে কি তুমি আমাকে এভাবে ফিরিয়ে দিতে ? বল, এই ভাবে অন্য কারো সাথে বিয়ে হয়ে যেতে দিতে ?
-আবার সেই একই কথা ? তুমি খুব ভাল করে জানো আমি একজন কে ভালবাসি ! তারপরেও কেন এইকথা টা বারবার বল !
নন্দিনী খুব জোর গলায় বলল
-তুমি আর কাউকে ভালবাসো না । তুমি শুধু আমাকে ভাল বাসো ! আমি খুব ভাল করে জানি !
নন্দিনী আর দাড়ালো না । কাঁদতে কাঁদতেই চলে গেল ।
আচ্ছা মেয়েটা এতো কন্ফিডেন্ট সহকারে কিভাবে বলল যে আমি ওকে ভালবাসি !
সত্যিই কি ভালবাসি ??
কে জানে ?
মানুষের মন বড় কনফিউজিং জিনিস !!
কখন যে কি চায় ?
আচ্ছা নন্দিনী যদি অন্য ধর্মের না হয়ে আমার ধর্মের হত তাহলে কি হত ?
আমি অনেক ভেবেছি এই ব্যপার টা নিয়ে । কিন্তু কোন সদউত্তর পাই নি !!
পাবো কি না জানিও না !!
আমি নন্দিনীর কাছ থেকে সব সময় দুরে থাকতে চাই কিন্তু কেন জানি পারি না । এই মেয়েটা খুব ভাল করেই জানে কিভাবে আমাকে কনভেনস করটে হয় । ঠিক ঠিক আমার সাথে দেখা করবেই ।
আজ সকালে যখন ফোন দিয়ে বলল যা আমার সাথে দেখা করবে আমি সরাসরি না বলে দিলাম । এর সাথে দেখা হওয়া মানেই ঝামেলা । কখন কি করে বসে কে জানে ?
নন্দিনীর সাথে পরিচয়টা হয় খুব সাধারন ভাবেই । একদিন মেইল চেক করতে গিয়ে দেখি একটা মেইল এসেছে ।
নন্দিনী রাই নামে ।
এই নামে কাউকে চিনি বলে মনে পড়লো না !
আর আমার মেইলে সাধারন কেউ মেইল টেইল পাঠায় না । এই মেইলটা কে পাঠাল ?
ওপেন করে দেখলাম একটা মাত্র লাইন
আমার বন্ধু হবেন ?
খানিকটা কৌতুহল হল । আমাকে এভাবে কেউ কোন আমন্ত্রন জানিয়ে বন্ধু হতে চায় নি । এই জন্য কৌতুহলটা আরো বেশি হল ।
রিপ্লেতে হ্যা জানিয়ে দিলাম ।
কারন জানতে চাইলাম যে আমার সাথে বন্ধুত্ব করতে চাওয়ার কারনটা । নন্দিনী মেইলের জবাবে বলল যে আপনার লেখা গল্প গুলো আমার ভাল লাগে ।
খুব বেশি ভাল লাগল এটা শুনে । আমি এমনিতেই খুব হালকা টাইপের গল্প লিখি ! এই গল্প আবার কারো বাল লাগতে পারে জানা ছিল না !আমি তারপর থেকেই মেয়েটির সাথে মেইল চালাচালি শুরু হল । আমরা কত কথা বলতাম মেইলে ।
কোথায় যাই কি করি কি খাই তবুও যেন কারই মন ভরছিল না । মনে হচ্ছিল কেবল মেইল কথা বলে যেন ঠিক মত মনের কথা বলতে পারছি না ।
তাই একদিন মোবাইল নাম্বার দিয়ে দিলাম । তবে প্রথমে বললাম যে আমরা কেবল এসএমএসে কথা বলব তারপর ফোন । কত এসএমএস যে নন্দিনীকে পাঠিয়েছি ।
সকালে ঘুম ভাঙ্গা থেকে রাতে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত প্রতিটা সময়ে আমাদের ম্যাসেজে কথা চলত । দিন গুলো হঠাত্ করেই কেমন করে আরো সুন্দর হয়ে উঠল ।
সব থেকে মজা লাগত একসাথে লাঞ্চ করার বিষয়টাকে । যদিও আমাদের তখনও দেখা হয় নি তবুও আমরা সবসময় একসাথে লাঞ্চ করতাম । দুপুর বেলা খাওয়ার সময় হলেই নন্দিনী আমাকে মেসেজ পাঠাত । একসাথে দুজন খাবারের প্লেট নিয়ে বসতাম ।
তারপর স্টার্ট লিখে এসএমএস আসতো নন্দিনীর কাছ থেকে । তারপর আমরা খাওয়া শুরু করতাম । হাস্যকর ছিল ব্যাপারটা কিন্তু সুইটও ছিল ।
বলা চলে এই একসাথে লাঞ্চ করার বিষয় টা থেকেই নন্দিনীর সাথে আমার প্রথম দেখা হয় । দুপুর বেলা নন্দিনী কখনই আমাকে ছাড়া খেত না । আমি শতবার বলার পরেও না । আমার অবশ্য ভালই লাগত ।
কিন্তু মাঝে মাঝে অবশ্য ক্লাস থেকে বাসায় আসতে দেরি হয়ে যেত । সে সময় ওকে বারবার মেসেজ করে বলতাম খেয়ে নেওয়ার জন্য । কিন্তু নন্দিনী কিছুতেই খেত না ।
বলত তুমি আগে বাসায় আসো তারপর খাবো । একসাথে খাবো । আমি মনে মনে হাসতাম । একদিন এতোই দেরি হয়ে গেল যে বাইরে থেকেই খেয়ে নিতে হল । আর কাজে এতোই বিজি ছিলাম যে নন্দিনীর কথা ঠিক মনে ছিল না ।
ওর মেসেজের রিপ্লেও দিতে পারি নি !
পরে যখন ক্ষ্যাল হল তখন নন্দিনীর সে কি রাগ । না ঠিক রাগ না, অভিমান । আমি যত বারই বলি খেয়ে নিতে সে বলে সে খাবে না ।
এখন যতই না দেখি একজন কে, যদি জানতে পারি যে একজন মানুষ কেবল আমার জন্য না খেয়ে আছে মনের ভিতর কি আর শান্তি লাগে ?
ওকে বলি
-আচ্ছা, কি করলে তুমি খাবে ? যা বলবে তাই করবো ?
-সত্যি ?
-বল তো আগে ?
-আমার সাথে দেখা কর !
-এখন ? দেখো এখন একটু পরেই আমাকে টিউশনিতে যেতে হবে ! কিভবে আসবো বল ?
-থাক আসতে হবে না !
আমি ভেবে পেলাম না কি বলবো !
নন্দিনী আবার বলল
-আমি না থাকলে তোমার কি ?
-আচ্ছা বাবা ! এখন খাও ! কথা দিলাম কাল দেখা করবো !
ওপাশ থেকে কিছুক্ষন নিরবতা । তারপর বলল
-সত্যি তো !
আমি প্রথমে নন্দিনীর সাথে দেখা করতে চাই নি । আসলে আমি আমার ভার্চুয়াল লাইফ আর পার্সোনাল লাইফটাকে আলাদা রাখতে চেয়েছিলাম । কিন্তু তা আর হল কই !
পরদিনই নন্দিনীর সাথে দেখা হল । নন্দিনীর সাথে আমার অনেক কথা । আমার সব রকম পছন্দের কথাই নন্দিনী জানতো ! ঐদিন নন্দিনী সাদা পরে এল । আমি যেমনটা পছন্দ করি ঠিক তেমনটাই !
এই ভাবেই চলছিল । আমরা কাছে আসতে আসতে কখন যে একে ওপরের খুব কাছে এসে পরলাম তার কেউ ই টের পাই নি । যখ টের পেলাম তখন বেশ দেরি হয়ে গেছে । এমন একটা মুহুর্ত নাই যে আমরা একে ওপরের সাথে যোগাযোগ করি নি । ওর কাছ থেকে দুরে কষ্টকর হয়ে গেল ।
কিন্তু কিছু করার নাই । আমাদের ধর্ম আলাদা ! আমাদের এক সাথে থাকাটা মানায় না । এই কথাটাই আজকে নন্দিনী কে বললাম । বললাম আমার কাছ থেকে দুরে থাকতে ! আমাদের এই রকম কাছে আসাটা ঠিক হচ্ছে না মোটেও !!
নন্দিনী কাঁদতে কাঁদতেই চলে গেল । বলা চলে আমি ওকে তাড়িয়েই দিলাম । এই মেয়ের কাছ থেকে দুরে থাকতে হবে !
একমাস পরের কথা !
নন্দিনী আজ নীল রংয়ের একটা সেলোয়ার কামিজ পরেছে । ওকে দেখতে সত্যি একটা নীল পরীর মতই লাগছে । আমরা দুজনে বসে আছি ইষ্টান লেকের পাড়ে । নন্দিনী আমার কাধে মাথা রেখে আপন মনে কথা বলেই চলেছে । কত রকমের কথা । আমাদের কথা, আমাদের দুজনার কথা !
আমি হাজার চেষ্টা করেও নন্দিনীর কাছ থেকে দুরে থাকতে পারি নি । ওর কাছে আমাকে আমাকে আসতেই হয়েছে । কি অজানা বাধনে মেয়েটা আমাকে বেধেছে কে জানে !!
আমরা ভবিষ্যতের কথা ভাবা ছেড়ে দিয়েছি । সামনে কি হবে কে জানে ! আমরা কেবল আজকের কথা ভাববো বলে ঠিক করেছি । আজ যে আমরা দুজন একসাথে আছি এই কথা ভাববো !!
গল্পটা কোন এক নন্দিনী রায়ের জন্য । যে হয়তো আমাকে এভাবে ভালবাসে না কিন্তু আমার লেখা গল্প গুলো কে ভালবাসে ! এটা তার জন্য !!!
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে অক্টোবর, ২০১২ রাত ১২:১৭