আমি নিশির দিকে ঘুরে তাকালাম । একটু অবাক হতে হল মেয়েটার আচরনে দেখে । মেয়েটা কদিন থেকে আমার উপর এমন ছড়ি ঘুড়াচ্ছে কেন ঠিক বুঝতে পারছি না ।
গতকালকের কথা ।
বাসায় ফিরতে ফিরতে একটু রাত হয়ে গেল । ভেবাছিলাম বাড়ির গেট বন্ধ হয়ে যাবে । অবশ্য খুব বেশি চিন্তিত ছিলাম না । রাতে নিয়ম করে বাড়ি ফেরা , গেটের তালা এসব ভাড়াটিয়াদের জন্য বাড়িয়ালার জন্য নয় ।
কাল যখন বাসায় দেখি রাত মোটামুটি বারটা বেজে গেছে । তবে একটু ও যে চিন্তা লাগছিল না তা কিন্তু না । সমস্যা একটাই তা হল দরজা খুলে দিবে কে ?
আমি যদি কলিংবেল বাজালে আব্বার ঘুম ভেঙ্গে যাবে । আর আব্বার ঘুম ভাঙ্গলে আমার একটু খবর তো আছেই ।
আমি আস্তে আস্তে দারোয়ানকে ডাকতে লাগলাম । কিন্তু শালার দারোয়ান যেন ঘোড়া বিক্রি করে ঘুমিয়েছে ।
দশ পনের মিনিট ধরে ডেকেই চললাম কিন্তু ঘুম ভাঙ্গার নাম পর্যন্তও নাই । কলিংবেল বাজানো ছাড়া আর কোন উপায় রইল না । বেল বাজাতে যাবো ঠিক এই সময়ে দেখলাম নিচতলার ওয়ান বির দরজা খুলে গেল ।
যাক বাঁচা গেল । আব্বা তো আর জাগলো না !
দরজা খুলে নিশি বেড়িয়ে এল । তালা খুলে সরাসরি আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-এতো রাত পর্যন্ত কোথায় ছিলেন আপনি ? ভাল ছেলেরা এতো রাত পর্যন্ত বাইরে থাকে না ।
আমি কেবল মেয়েটার কর্তৃত্বের মত সুর দেখে অবাক হচ্ছিলাম । কদিন আগেও এই মেয়েটা আমার দিকে চোখ তুলে পর্যন্ত তাকাতো না আর এখন এমন কথা বলছে ।
আশ্চর্য !
নিশি আবার বলল
-কই দিন । আমার ক্লাসের দেরি হয়ে যাচ্ছে ।
আমার নিজের ক্লাসে যেতে হবে । ঐ জন্যই দাড়িয়ে ছিলাম । রিক্সা করে যাবো নাকি বাস ধরবো ঠিক বুঝতে পারছিলাম না । আর এই মেয়ে এসে বলে রিক্সা ডেকে দিন ।
আমি নিজেই রিক্সা ঠিক করতে পারছি না । আর এ এসে বলে রিক্সা ঠিক করে দিন !
মামু বাড়ির আবদার !
-আপনি যাবেন না ভার্সিটিতে ?
আমি বললাম
-যেতে হবে ।
-চলুন একসাথে যাই !
সাধারন সুন্দর মেয়েরা ছেলেদেরকে এমন অফার দেয় না । কিন্তু এই মেয়েটা এমন করছে কেন ?
-না ঠিক আছে । তোমার সমস্যা হবে । আমি রাস্তায় একজায়গায় নামবো ।
-কোথায় নামবেন ? কেন নামবেন ? সিগারেট খেতে নামবেন ?
আরে ! এই মেয়ে এতো প্রশ্ন করে কেন ? আর আমি যেখানে নামি যাই করতে নামি না কেন তাতে এই মেয়ের কি ?
নিশির কপাট রাগ দেখিয়ে বলল
-ছেলেদের সিগারেট খাওয়া আমার একদম পছন্দ না । আর বিয়ের পর আমি একদম সহ্য করবো না !
মানে ?
এই মেয়ে কি বলছে !
বিয়ের পর মানে কি !
আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না ।
নিশির সাথে রিক্সায় উঠলাম ।
-আচ্ছা আপনি আপনাদের ফ্লাট রেখে চিলেকোথায় কেন থাকেন বলেন তো ? রবিনসন ক্রুসোর মত একা থাকার প্লান নাকি ! একা একা যারা থাকে কদিন পরে নাকি মাথায় সমস্যা দেখা দেয়, তারা নাকি মানুষকে কদিন পরে সহ্যই করতে পারে না । আপনার এমন সমস্যা আছে নাকি । আপনি .........
নিশি ননস্টপ কথা বলেই চলল । ভার্সিটিতে নামার আগ পর্যন্ত এই মেয়েটা একটা মিনিটের জন্যও তার মুখটা বন্ধ করে নি । রিক্সা ভাড়া দিতে গিয়ে লক্ষ্য করলাম আমার মাথার ভিতর কেমন যেন বনবন করছে ।
এই মেয়ে কেবল কথা বলেই আমার পুরা মাথা হ্যাং করে দিয়েছে । রিক্সা থেকে নেমে নিশি বলল
-আপনি যে সিগারেট খেতে মাঝখানে নামলেন না এই জন্য আপনাকে ধন্যবাদ ।
আমার চমকে উঠলাম ।
হায় হায় !
আমার ঝিকাতলা নামার কথা ছিল । পল্টুর কাছে কিছু টাকা পাওয়া যেত ও বলেছিল যে আজ দিবে । আমার মনেই নাই । এই মেয়ের বকবক শুনতে শুনতে আমার অন্য দিকে লক্ষ্যই করতে পারি নি ।
-আচ্ছা আপনি বাসায় যাবেন কখন ?
-কেন ?
-একসাথে যেতাম !
ন্যাড়া একবারই বেল তলায় যায় । আমি আবার এই মেয়ের সাথে রিক্সায় উঠব ?
মাথা খারাপ !
-আমার যেতে দেরি হবে ! ক্লাস আছে । দুপুর হবে ।
-আচ্ছা সমস্যা নাই । আমি অপেক্ষা করবো !
-কেন অপেক্ষা করবা ?
আশ্চর্য !
মেজাজটা একটু খারাপই এই মেয়ের আচরন এমন মনে হচ্ছে যেন ..........
কি মনে হচ্ছে কি করে বলব !
একটু কঠিন গলায়ই বললাম
-আমার জন্য অপেক্ষা করতে হবে না ।
তারপর আর দাড়ালাম না । আমি আসলেই বুঝতে পারছি মেয়েটা এমন আচরন কেন করছে ।
দুপুর বেলা ভাত খেতে বসেছি মা ভাত বাড়তে বাড়তে বলল
-তুই নিশির সাথে খারাপ ব্যবহার কেন করেছিস ?
আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম । আমি ঐ মেয়ের সাথে খারাপ ব্যবহার করলাম কই ? মা এসব জানলো কোথা থেকে ?
-মা কি বলছ ? আমি ঐ মেয়ের সাথে কোন খারাপ ব্যবহার করি নি তো !
-তাহলে নিশি কাঁদছিল কেন ?
-আরে তার আমি কি জানি ! আশ্চর্য তো ! আর ঐ মেয়ের আচরন যেন কেমন লাগছে ! আমার কাছে কেমন যেন ওড লাগছে আমার কাছে ।
মা কোন কথা বলল না । কেমন চোখে তাকাল আমার দিকে ।
আমি কিছু বলতে যাবো ঠিক তখনই কলিং বল বেজে উঠল । মা দরজা খুলে দেখল নিশি ।
আমি খাবার টেবিল থেকে দেখতে পাচ্ছি নিশির হাতে একটা বাটি । নিশি বলল
-আন্টি আম্মু পাঠাল ।
আন্টি আম্মু পাঠালো ইয়ো ইয়ো !
ঢং !
কিন্তু আমার মা যা করলো তাতে আমি কনফিউজ হয়ে গেলাম ।
এসবের মানে কি ! মা বলল
-যাও সুমন খাচ্ছে । ওকে দিয়ে এসো !
মার কথা শুনে আর একটু হলে আমার গলায় ভাত আটকে যেত ! পানি নিতে যাবো দেখি নিশি ততক্ষনে টেবিলের কাছে পৌছে গেসে । নিজেই হাতে করে পানির গ্লাস এগিয়ে দিল ।
আচ্ছা এসব কি হচ্ছে !
হচ্ছে কি ?
পানির পর নিশি বেশ যত্ন করেই বাটিতে করে আনা মাংশ আমার প্লেটে তুলে দিল । আমি চুপচাপ খেতে লাগলাম ।
নিশি চলে গেলে মাকে খুব ভাল করে জিজ্ঞেস করলাম
-এসব কি হচ্ছে ? এই মেয়ের প্রব্লেম কি ? আর তোমার সমস্যা কি ?
মা চুপ করে রইল ।
-আরে বলবা তো !
আমার মা বলল
-আমি কিছু জানি না । তোর বাবাকে জিজ্ঞেস কর ।
-আরে বাবা আসছে কোথা থেকে ?
-তোর বাবাই তো আসবে !! আর কে আসবে !
-মানে কি ? কি বলছ এসব ?
মা কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলল
-তোর বাবা নিশির সাথে তোর বিয়ে দিতে চান । নিশির বাবার সাথে কথা প্রায় পাকাপাকি করে ফেলেছে
-মানে কি ? আমার বিয়ে আর আমি জানি না ! আর বাবা বিয়ে পাকাপাকি করে ফেলল ! এটা কি মগের মুল্লুক নাকি
আমি এতো উত্তেজিত হয়েগেলাম যে আসলো না আসলো আমি ঠিক মত বুঝতেই পারলাম না ! পেছনে কখন বাবা এসে হাজির আমি টেরই পাই নি । বাবা বলল
-এটা মগের মুল্লিক না হলেও তোমার বাবার মুল্লুক ! আমার বাড়িতে থাকতে হলে ঐ মেয়েকেই তোমাকে বিয়ে করতে হবে ।
সত্যি মাথার ভিতর কেমন যেন ঘুরছিল । আমি এসব কিছুই মেনে নিবো না । আব্বা যা বলবে তাই কি আমি মেনে নিবো ?
কক্ষনও না !
কিন্তু না মেনে নিয়ে করবোও বা কি ?
আমি বাড়ি ছেড়ে যাবো বা কোথায় ??
আর আমার বাবা কে আমি খুব ভাল করে চিনি । উনি যা একবার বলবেন তাই করবেন !!
আমার কি হবে ?
আম্মু !!!!!!!!!!!!!
আচ্ছা নিশির সাথে কথা বললে কেমন হয় ?
মেয়েটা ইদানিং সত্যি খুব বেশি ঘুরঘুর করছে আমার আশে পাশে !
ওকে বুঝালে কি বুঝবে?
আমার মনে হয় না ।
নাকি বুঝবে ?
কে জানে?
গড! প্লিজ সেভ মি !!
বিকেল বেলা ছাদের এক কোনয় বসে সিগারেট টানছিলাম হঠাৎ কোথা থেকে নিশি এসে হাজির । আমি কিছু বোঝার আগেই আমার মুখ থেকে সিগারেট টা টান দিয়ে নিয়ে নিল ।
-মানে কি?
-মানে কিছু না ! আজ থেকে সিগারেট খাওয়া বন্ধ !
আমি সত্যি এতুই অবাক হলাম যে কিছু বলতেই পারলাম না । এই মেয়ের সাহস দেখে সত্যি অবাক না হয়ে পারলাম না ।
নিশি আবার বলল
-আজ থেকে আপনি আর সিগারেট খাবেন না । আর রাত করে বাসায় আসতে যেন না দেখি !! তাহলে কিন্তু আর দরজা খুলবো না । আম্মুকেও বলবো যেন দরজা না খুলে ! তখন সারা রাত দাড়িয়ে থাকবেন বাইরে !!
-তোমার আম্ম কে দরজা না খুলতে বললে আমার কি ?
-আমি আমার আম্মুর কথা বলছি না । আপনার আম্মুর কথা বলছি ।
-আমার আম্মু ?? আমার আম্ম তোমার আম্মু হল কবে থেকে !
নিশির মুখ দেখে মনে হল খুব বিরক্ত হয়েছে । এমন কথা যেন আমার বলাই ঠিক হয় নি ।
সত্যি আব্বার খুব রাগ হল । ঠিক করলাম আজ রাতে বাসায়ই আসবো না । আর থাকবোই না এই বাড়িতে । আমার উপর ভাড়াটিয়ার মেয়ে এভাবে জোড় দেখায় । সত্যিই আর আসবো না ।
দুইদিন বাড়িতে আসলাম না । দুই বন্ধুর বাড়ি ছিলাম । কিন্তু তিন দিনের দিন একটু সমস্যা হয়ে গেল ।
আমার আব্বা মোটামুটি আমার সব বন্ধুদএর বাড়িতর ফোন করে বলে দিল যে আমাকে যেন বাসায় না থাকতে দেয় । দিলে নাকি খবর আছে । বন্ধুদের বললে না হয় একটা কিছু ছিল । কিন্তু ফোন দিয়েছে সব বন্ধুদের বাসায় । সুতরাং তাদের কিছুই করার নাই ।
বাবা এমন একটা কাজ করতে পারলো !
থাকবো না বন্ধুর বাসায় ।
কি হয়েছে । রাস্তায় থাকবো !
কিন্তু রাস্তায় ঠকাবো বললেই তো আর থাকা যায় না !
সারাটা সন্ধ্যা বাইরে বাইরে ঘুটলাম । বাসায় আশে পাশে ঘুরাঘুরি করলেও আসলাম না বাসায় । কিন্তু ১২ যখন বেজে গেল তখন আর বাইরে থাকার উপায় রইলো না। চারিদিকে কেমন চুপচাপ । একটু ভয় ভয় লাগছিল । বাড়ির দিকে রওনা হতেই হল । যাই হোক পরে ভাবা যাবে । আর একটু খিদেও লেগেছে !! পেকেটে যে টাকা নিয়ে বের হয়েছিলাম সব শেষ ।
বাসা ছাড়া কোন উপায় নাই !
কিন্তু বাসায় সামনে এসে আবার আর এক ঝামেলায় পরতে হল । দারোয়ান কে ডাকতেই দারোয়ান বলল
-স্যার আপনাকে ঢুকতে দিতে নিষেদ করছে !
-তুই দরজা খোল ।
-ভাইজান আমারে মাফ করেন !
দারোয়ান চলে গেল ।
আমি এখন যাই কই ?
নিশির উপর সত্যি মেজাজ খারাপ হল । সব দোষ ঐ ফাজিল মেয়েটার ! ঐ মেয়েটার জন্যই আমি আজ এখানে ! একবার হাতের কাছে পেলে হয় !
-আসুন !
দেখলাম নিশি আবার আমার সামনে । চাবি দিয়ে দরজা খুলছে !
কিছু না বলে চুপচাপ দরজা দিয়ে ঢুকে পরলাম ।
চিলেকোঠায় ঘরে যাওায় রেকটু পরেই দেখি নিশি । হাতে একটা বোল ।
-খাওয়া দাওয়া তো হয় নি ? হাত ধুয়ে নিন !
আমি চুপচাপ হাত ধুয়ে নিলাম । আসলে খুব খিদে লেগেছে । আগে ভাত খেয়ে নিই তারপর এর খবর নিচ্ছি !!
খাওয়া শেষে নিশি আমার দিকে সিগারেটের একটা প্যাকেট বাড়িয়ে দিয়ে বলল
-এই নিন । যত ইচ্ছা খান ।
নিশিকে ক্ষমা করে দিালম কেবল এই সিগারেটের প্যাকেট টা দেওয়ার জন্য !
হাত বাড়িয়র প্যাকেট না নিতে নিতে নিশি আবার বলল
-আপনি যতবার সিগারেট খাবেন আমি ততবার আমি এই ম্যাচ দিয়ে আমার হাত পুড়াবো !
নিশি আর দাড়ালো না । এক প্রকার দৌড়েই চলে গেল ।
এই মেয়ের মাথায় কি সমস্যা আছে নাকি ?
কি বলে গেল !
যা বলে বলুক !!
আমার কি ?
কেউ যদি ইচ্ছা করে আগুন দেয় গায়ে আমার কি !! কিছুই না !!
আমি সিগারেট ঠোটে নিলাম । কিন্তু আগুন ধরাতে পারলাম না !
আপনি যতবার সিগারেট খাবেন আমি ততবার আমি এই ম্যাচ দিয়ে আমার হাত পুড়াবো !
বারবার কেবল নিশির এই লাইনটা মনে পড়তে লাগলো !
আশ্চর্য !!
এমন কেন মনে হচ্ছে !!
সত্যি সত্যি একটা সিগারেটও ধরাতে পারলাম না !
নিশির হাতটা বারবার সামনে চলে আসছিল !!
সারাটা রাত কেবল পায়চারি করতে লাগলাম ছাদএর এপাশ থেকে ওপাশ পর্যন্ত ! মুখে আগুন শুন্য সিগারেট নিয়ে !
কখন সকাল হয়েছে টেরই পাইনি !!
-সিগারেট খেতেম পারেন নি, তাই না ?
তাকিয়ে দেখি ফাজিল মেয়েটা এসে হাগির । সকালে সিগ্ধ আলো তে মেয়েটাকে কেমন যেন অদ্ভুদ সুন্দর লাগছিল । এতোদিন পর আমি লক্ষ্য করলাম নিশি আসলেই দেখতে খুব সুন্দর !
আর এই সকাল বেলাটায় ওকে যেন আরো সুন্দর লাগছিল !
নিশি আমার মুখ থেকে সিগারেট টা নিয়ে বলল
-আমি জানতাম আপনি পারবেন না !
-কিভাবে জানতে ?
নিশি হেসে বলল
-পরে বলবো ! দেখেন না কি সুন্দর সকাল ! আপনার সাথে এমন একটা সকাল দেখার জন্য আমি কতদিন অপেক্ষা করেছি !!
নিশি যেন আরও একটু আমার কাছে সরে এল ।
আমি তাকিয়ে দেখলাম চারিদিকে !
আসলেই সকালটা যেন খুব বেশি সুন্দর লাগছে !!
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই অক্টোবর, ২০১২ দুপুর ১২:৪২