জয়ন্তী সেই গভীর চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে । আমার অস্বস্তিটা যেন আরও একটু বেড়ে গেল ।
তবে বলবো না যে আমার খারাপ লাগছে ! একটু অস্বস্তি লাগলেও সেটা ভাল লাগার অস্বস্তি !
চোখ সরিয়ে নিতে খুব ইচ্ছা করলেও আমি চোখ সরিয়ে নিলাম না । হয়তো আগের মত এখন চিৎকার করে উঠবে এখন ! না তা হয়তো উঠবে না ।
একবার কেবল এই চোখ সরিয়ে নেওয়ার জন্যই জয়ন্তী পুরো তিন দিন আমার সাথে কথা বলে নি । সেদিনকার কথাটা আমার এখনও খুব ভাল করেই মনে আছে ।
সে দিন জয়ন্তী স্কুল ফাঁকি দিয়ে আমার সাথে দেখা করতে এল । আমরা এমনটা প্রায়ই করতাম । স্কুল ফাঁকি দিয়ে দুজনে যে দিক চোখ যায় ঘুরে বেড়াতাম, রিক্সায় চড়তাম, কখনও বা নৌকায় চড়তাম সারাটা দিন । ঐ দিন গিয়েছিলাম ইস্টান লেকের ধারে ।
বিকেল বেলাটাতে ভিড় থাকলেও সকালের দিকে খুব একটা লোকজন আসে না এখানে । জয়ন্তী আমার খুব কাছেই বসল আমার হাতটা ধরে । কিছু সময় আমার কাধে মাথা রেখে আপন মনেই কথা বলতে লাগল ।
কত রকমের কথা !
আমাকে নিয়ে দেখা কত রকমের স্বপ্ন !
একটু পরেই কাধ থেকে মাথা তুলে বলল
-এই তোমার কোন জিনিসটা আমার সব থেকে প্রিয় ?
আমি খানিকটা কনফিউজড গলায় বললাম
-কোনটা ?
-তোমার চোখ । কেবল তোমার চোখ !
এই বলে জয়ন্তী আমার চোখের দিকে এক ভাবেই তাকিয়ে রইল ।
আমি পরলাম বিপাকে !
আসলে জয়ন্তী এমন গভীর চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল যে আমার অস্বস্থি লাগা শুরু করলো । আমি চোখ সরিয়ে নিতেই জয়ন্তী বলল
-কি ব্যাপার তুমি চোখ সরালে কেন ?
-আরে এ ভাবে তাকিয়ে থাকা যায় নাকি ?
-কেন আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে তোমার ভাল লাগে না ?
-আহা ব্যাপারটা তা না । বাংলা সিনেমায় মত নায়ক নায়িকার দিকে এক ভাবে তাকিয়ে থাকবে ! এটা আমার দ্বারা হবে না ।
জয়ন্তীর দিকে তাকিয়ে দেখি ওর মুখ গম্ভীর হয়ে গেছে ।
বলল
-ঠিক আছে আমার দিকে তোমার তাকিয়ে থাকতে হবে না !
এই বলে জয়ন্তী উঠে পড়ল ।
-আরে যাও কই !
জয়ন্তী কোন কথা বলল না । হনহন করে হাটতে লাগল । তারপর পুরো তিনদিন আমাল সাথে কোন যোগাযোগ নাই । অনেক অনুনয় বিনয়ের পর সেই রাগ ভাঙ্গাতে হয়েছিল ।
ইস তখনকার দিন গুলো কি চমৎকারই না ছিল !
চাইলেই কি ভোলা যায় !
অথবা বলা আমি ইচ্ছা করেই ভুলতে চাই না ।
খানিকটা অপরাধ বোধ থেকে হয়তো জয়ন্তীর স্মৃতি আমার কাছে সবসময় উজ্জল ।
হঠাৎ জয়ন্তীর কি হল বলল
-আমি আজকে যাই !
-এখনই যাবে ?
জয়ন্তী হেসে বলল
-তুমি বললে না যে এখানে আসা আমার উচিৎ হয়নি । আবার এখন আমাকে যেতে মানা করছে !
সত্যিই তো !
জয়ন্তীকে দেখে এতোক্ষন অস্বস্তি লাগছিল আর এখন ও চলে যাবে শুনে মনের ভিতরটা কেমন করে উঠল । মনে মনে বললাম আর একটু বস । কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকো আমার দিকে । তোমার তাকিয়ে থাকাটা আমি খুব মিস করি !
খুব বেশি !
বললাম
-কি জন্য এসেছিলে বললে না তো ?
-কোন কারন নেই । একটা কথা জানতে এসেছিলাম কিন্তু এখানে এসে মনে হচ্ছে কথাটা না বলাই ভাল ।
আমি আর কিছু জানতে চাইলাম না । কারন টা হয়তো আমি জানি । তবুও বললাম
-আর একটু বস !
-না যাই ! সুমিত চলে আসবে হয়তো !
আগে জয়ন্তী এমন টা কখনও করতো না । আমি যদি না বলতাম তাহলে ও কখনও আমাকে ছেড়ে যেত না ।
আমি বললাম
-শোধ নিচ্ছ ?
-শোধ নিচ্ছি মানে ? কি বলছো তুমি ?
কি বললাম ! ছি !!
আমি বললাম
-না কিছু না । সরি ! আর একটু বসলে হয় না ?
-অপু এমন কথা কেন বল ?
-সরি !
জয়ন্তী যাবে বললেও চলে গেল না । বসেই রইলো ।
-আমি কেন এসেছি জানো ?
-কেন ?
-তোমাকে দেখতে ! কাল যখন তোমাকে দেখলাম .......
কিছুক্ষন চুপ থেকে জয়ন্তী বলল
-যখন তোমাকে দেখলাম বিশ্বাস করবা না নিজের ভিতর কি চলছিল । তুমি তো ঐ দিনের পর আর আমার সাথে দেখাই কর নি । তোমাকে দেখতে কি যে মন চাইতো ! নির্লজ্জের মত তোমাদের বাড়ির আশে পাশে কত যে দাড়িয়ে থেকেছি । তুমি নেই এটা জেনেও দাড়িয়ে থেকেছি । কেবল তোমাকে একটু দেখার জন্য !
এই টুকু বলে জয়ন্তী চুপ করে গেল । দেখলাম ওর চোখ দিয়ে পানি পরছে !
এখন এই মেয়েটা আমার জন্য কাঁদে ?
এখনও আমার জন্য চোখের পানি ঝরে ??
আমি কিভাবে থাকবো এখন ?
ওর সাথে দেখা না হওয়াই বোধহয় ভাল ছিল !
তাহলে অন্তত পুরানো কষ্ট টুকু আর মাথা চাড়া দিয়ে উঠত না !
আমাদের দিন কাটছিল খুব ভাল । দেখা হত কথা হত ! আরো কত কিছু !! সারাক্ষন যেন আমরা একটা রঙিন স্বপ্নের ভিতর ছিলাম । কিন্তু স্বপ্ন ভাঙ্গতে খুব বেশি দেরি হল না ।
খুব শীঘ্রই এলাকার সবাই আমাদের সম্পর্কের কথা জেনে গেল । আমাদের বাড়ি পৌছাতেও খুব বেশি সময় লাগলো না ।
ঐদিন আব্বা আমাকে কাঠে চলা দিয়ে এমন ভাবে পিটালো যে আমার মনে আর কিছু ছিল না ।
মিথ্যা কথা বলবো না আমি ঐ দিন বুঝলাম লোকে কেন বলে মাইরের কাছে ভুত পালায় !!
আব্বা তবুও আর রিস্ক নিলো না । আমাকে ঐদিনই মামার বাড়ি পাঠিয়ে দিল । আমি আর আসতেই পারলাম না এলাকাতে !
আর দেখা হল না জয়ন্তীর সাথে !!
-একটা কথা বলবো ?
-বল ?
-এই বার আমাকে ছেড়ে না গেলে হয় না ?
আমি অবাক হয়ে বললাম
-মানে ? কি বলছো তুমি ?
-আমি খুব ভাল করে চিনি তোমাকে । তোমাকে আমি যত দুর চিনি চোখে সামনে আমাকে অন্য কারো সাথে, এটা তোমার সহ্য হবে না ।
মনে আছে তুমি একবা রকি পরিমান রাগ করেছিলে আমি তোমার এক বন্ধুর সাথে একটু হেসে কথা বলেছিলাম বলে !!
আমি এবার সত্যি অবাক না হয়ে পারলাম না । জয়ন্তীর এখনও সব কিছু মনে আছে ! এমন কি আমার মনে কি চলছে এটাও ও ধরে ফেলেছে !
আমিকাল রাতেই ঠিক করেছিলাম যে আমি আর এখানে থাকবো না ।
আমাদের কোম্পানির নতুন ব্রাঞ্চ খুলেছে সাভারে । ওখানে চলে যাবো ভাবছিলাম ।
আসলেই সুমিতের সাথে জয়ন্তীকে দেখলে আমার সহ্যই হবে না । আসলেই সহ্য হবে না !
আমি কিছু না বলে চুপ করে রইলাম ।
-প্লিজ !
-জয়ন্তী ! আমার সহ্য হবে না এটা ! কিছুতেই হবে না !
জয়ন্তী আর বেশিক্ষন দাড়াল না ।
জয়ন্তী চলে যাবার পর কেন জানি বুকের ভিতর পুরানো বিষন্নতা ভর করে রইল । আসলেই দেখাটা না হলেই বোধ হয় ভাল হত !!
জীবন বাবু ঠিকই বলেছিলেন কে হায় হৃদয় খুড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে !!
সমাপ্ত
১ম পর্ব । ২য় পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ রাত ১২:০৭