জয়ন্তী আবারও ঘুরে ফিরে আমার সামনেই এসে হাজির । হাতে বাটি ভর্তি মাংশ । আমার অস্বস্তিটা আরো একটু বেড়ে গেল । ঠিক মত খেতেও পারছি না এই মেয়েটার জন্য । জয়ন্তী আবার বলল
-দেব আর একটু ?
আমি চাচ্ছিলাম জয়ন্তীর দিকে না তাকাতে কিন্তু এবার ওর দিকে না তাকিয়ে পারলাম না ।
ইস কি গভীর চোখেই না জয়ন্তী আমার দিকে তাকিয়ে আছে ! কত দিন দেখি না এই চোখ তবুও কত পরিচিত ।
আমি আমার চোখ ফিরিয়ে নিলাম । আগে এমনটা করলে জয়ন্তী খুব রাগ করতো ।
ওর কেন জানি আমার চোখের প্রতি খুব আকর্ষন ছিল । চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে ও খুব পছন্দ করতো । কিন্তু আমায় খুব অস্বস্তি লাগতো । চোখ সরিয়ে নিতাম । তখনই ওর অভিমান কে দেখে ?
জয়ন্তী !!
সুমিত এগিয়ে আসল ।
-কি করছো ?
জয়ন্তী বলল
-উনি তো কিছু খাচ্ছেনই না । মনে হয় রান্না পছন্দ হয় নি । আমি বললাম
-না না রান্না ভাল হয়েছে । খুব ভাল হয়েছে ।
আমার কথা শুনে জয়ন্তী বলল
-তাহলে খাচ্ছেন না কেন ? রান্না ভাল হলে কেউ আবার না খায় ?
সুমিত হেসে বলল
-আরে অপু একটু কমই খায় । আর মানুষের বাড়িতে তো খেতেই পারে না । তুমি চেষ্টা করে দেখো আরো খানিকটা খাওয়াতে পারো কি না ।
সুমিত চলে গেল আবার আমাকে অস্বস্তির মধ্যে ফেলে দিয়ে । আমি চাচ্ছিলাম সুমিত যেন না যায় । ও থাকলে আমার অস্বস্তিটা একটু কম হত !
সুমিত আমার কলিগ । চাকরীর সুবাদে ওর সাথে খুব ভাল একটা রিলেশন তৈরি হয়েছে । সেই সুবাদে ওর বাড়িতে আসা । আসলে উপলক্ষ্য আরো একটা আছে । কদিন আগে সুমিত বিয়ে করেছে । বউ নিয়ে স্যাটেল হওয়ার পর পরিচিত মানুষজন দাওয়াত খাওয়াচ্ছে । প্রথমে আমি আসতে চাইনি । কারনটা অবশ্য সুমিত খুব ভাল করেই জানে ।
আসলে মানুষজনের ভীড় আমার একদমই ভাল লাগে না । তবুও সুমিতের অনুরোধ ফেলা গেল না কিছুতেই । আসতেই হল । প্রথমে ভেবেছিলাম কেবল মানুষ জনের ভিড়ই থাকবে কিন্তু এখানে এসে যে এমন একটা পরিস্থিতিতে পরে যাবো ভাবতেও পারি নি ।
এতো দিন পর জয়ন্তীর সাথে দেখা হল তাও কিনা আমার কলিগের বাড়িতে । আর যে জয়ন্তী এক সময় আমার গার্লফ্রেন্ড ছিল সে কি না এখন আমার কলিগের বউ ?
জয়ন্তীর সাথে পরিচয়টা আমার এলাকাতেই । আমি সবসময় সাইকেল চালাতে খুবই পছন্দ করতাম । যখন এলাকায় ছিলাম সারাদিন কেবল সাইকেলই চালিয়ে বেড়াতাম । একদিন সাইকেল চালিয়ে বাড়ির দিকে যাচ্ছি । বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছি ঠিক এমন সময় আমাকে ক্রস করে একটা ভ্যান এগিয়ে গেল ।
ভ্যানটা এগিয়ে যেতেই আমি দেখতে পেলাম ভ্যানের পিছনে একটা মেয়ে বসে আছে । একটা ব্যাপার সব মেয়েদের ভিতরেই দেখা যায় যে যখনই কোন মেয়ে দেখে যে কোন ছেলে তার দিকে তাকিয়ে আছে তখনই মেযেটার চেহারার এক্সপ্রেশন কেমন বদলে যায় । আর মেয়েটার চেহারা যদি একটু ভাল হয় তাহলে তো কোন কথাই নাই ।
ভ্যানের পেছনে মেয়েটাও ঠিক এমনই ভাব নেওয়া শুরু করলো । আর সত্যি বলতে কি মেয়েটা যথেষ্ট সুন্দরীও বটে । কিন্তু আমার এরকম ভাব নেওয়া মোটেও পছন্দ না । আমি এক গাদা থুতু মেয়েটার সামনে ফেললাম । এমন একটা ভাব যেন তোমার মেয়েকে আমি পুছি না । এটা আমি প্রায়ই করি !
এবার দেখলাম মেয়েটার মুখটা একটু যেন কালো হয়ে উঠল । ভ্যান সামনে চলে গেল আমি পেছন পেছন আসতে লাগলাম । একটু পর ভ্যানটা ঠিক আমাদের বাড়ির সামনেই থামল ।
এটা খানিকটা আশ্চর্যের বিষয় ।
আমাদের গ্রামের মোটামুটি সব মেয়েকেই আমি চিনি । তাহলে এই মেয়েটা এল কোথা থেকে ? তাও আবার নামল ঠিক আমাদের বাড়ির সামনেই ।
কে তুমি সুন্দরী ?
বাড়ির সামনে যেতে দেখলাম মেয়েটা আমাদের বাড়ির পাশের রাস্তা দিয়ে চলে যাচ্ছে । আচ্ছা মেয়েটা তাহলে হিন্দু পাড়ার দিকে যাচ্ছে । কিন্তু কে মেয়েটা ?
হিন্দু পাড়ায় এতো সুন্দর মেয়ে কোথা থেকে এল ?
দুদিনের ভিতরেই মেয়েটার নামপরিচয় জেনে ফেললাম । মেয়েটার নাম জয়ন্তী । শ্যামল বাবুর শালী । এখানে এসেছে পড়ালেখা করার জন্য ।
গ্রামে জয়ন্তীকে নিয়ে ভালই চর্চা শুরু হল ।
আসলে মিষ্টি যেখানেই থাকুক না কেন পিপড়া তো আসবেই ।
আমি দেখতাম শুনতাম আর মনে মনে হাসতাম । কিন্তু জয়ন্তীর সাথে আমার দেখা হত প্রায় প্রতিদিনই । কারন ওদের আসা যাওয়ার পথটা ছিল একদম আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে ।
প্রথম প্রথম দেখতাম জয়ন্তী আমাকে দেখে মাথা নিচ করে চলে যেন কিন্তু কয়েকদিন যাবার পর জয়ন্তী আর চোখ নামাতো না । কেমন অদ্ভুদ চোখে তাকাতো আর হাসতো ।
একদিন মেয়েটা খুব অদ্ভুদ একটা কাজ করে বসল । আমি বাড়ির সামনে বসে ছিলাম জয়ন্তী আমার সামনে এসে বলল এই টা নেন । আমি খানিকটা অবাক হয়ে বললাম
-এটা কি ?
-নিন । নিলেই বুঝবেন ।
আমি আশ্চর্য হয়েই নিলাম । কিন্তু তার থেকেও বেশি আশ্চর্য হলাম খামটা খুলে । খালি একটা কাগজ । উল্টেপাল্টে দেখলাম কিছুই নাই ।
আশ্চর্য খালী কাগজ দেওয়ার মানে কি ?
-স্যার আপনার সাথে একজন দেখা করতে এসেছে ! নিয়ে আসবো ?
রিসেপ্টশনের ফোন পেয়ে খানিকটা অবাক হলাম । কেবিনে বসে ছিলাম । খুব বেশি সময় হয় নি । এরই মধ্যে আবার কে এল ? আমি জিজ্ঞেস করলাম
-কে এসেছে ?
রিসেপ্টশনিষ্ট বলল
-একজন মেয়ে ! জয়ন্তী নাম বলল । সুমিত স্যারের ওয়াইফ মনে হয় । ওনার কাছেই এসেছিলেন । উনি নেই তাই আপনার সাথে একটু দেখা করতে চাচ্ছে ।
-আচ্ছা নিয়ে এস ।
মনের ভিতর অস্বস্তিতা আবার ফিরে এল ।
জয়ন্তী এখানে কি চায় ? একটু পরেই জয়ন্তী কেবিনে ঢুকলো ।
জয়ন্তীর আসার কথা শুনে আমি খুব একটা অবাক হয়নি । আমি জানতাম ও একদিন না একদিন আসবেই আমার সাথে দেখা করতে । তবে আজকেই চলে আসবে ভাবতে পারি নি ।
কিন্তু জয়ন্তী যখন কেবিনে ঢুকলো আমি সত্যিই অবাক হলাম । বিশেষ করে ওর পরনের পোষাক । জয়ন্তী আজ আকাশী রংয়ের একটা কামিজ পলেছে সাথে সাদা ল্যাগিংস । প্রথম যে দিন ও আমার সাথে দেখা করতে এসেছিল আজকেও ঠিক এই রকম একটা পোষাক পরে এসেছে । আর আমার খুব পছন্দ হয়েছিল পোষাকটা ।
মাই গড ওর এখনও মনে আছে ।
আমাকে সাদা খামটা দেওয়ার পরদিন আমি ও যখন আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছিল আমি ওর পথ রোধ করে দাড়ালাম ।
-কি ব্যাপার তুমি আমাকে সাদা খাম কেন দিয়েছ ?
জয়ন্তী একটু হাসল । হেসে বলল
-সাদা খাম তো দেই নি । না সাদা খাম তো দেই নি ।
-না । সাদাই ছিল । আমি ভাল করে দেখেছি । ইভেন আমি আগুনের উপরেও দিয়ে দেখেছি ।
জয়ন্তী খানিকটা কৌতুহল নিয়ে বলল
-আগুনের উপরে কেন দিয়েছেন ?
-না মানে, এক ধরনের কালি আছে না লিখলে কিছু দেখা যায় না । আগুনের উপরে দিলে কালি ফুটে উঠে ।
জয়ন্তী এবার হেসে উঠল । বলল
-বাববাহ ! কি লেখা আছে জানার জন্য এতো আগ্রহ ?
-না , মানে .........!
সত্যি কথা বলতে কি আমার মনে ব্যাপারটা নিয়ে আসলেই প্রচন্ড কৌতুহল ছিল । বারবার কেবল এই মনে হচ্ছিল যে মেয়েটা আসলে কি লিখেছিল বা কি লিখতে চেয়েছিল । জয়ন্তী বলল
-আজ বিকেলে পুলিশ পার্কে যদি আসেন তাহলে জানতে পারবেন নীল খামে কি লেখা ছিল ।
আমি খানিকটা কনফিউজ হয়ে গেলাম । মেয়েটা কি আমাকে নিয়ে কোন খেলা করছে ?
গ্রামে আমার একটা সুনাম আছে । অন্তত মেয়ে ঘটিত কোন কোন বদনাম আমার ছিল না । আচ্ছা মেয়েটা ঐ দিনের বদলা নিচ্ছে না তো ! আমি বললাম
-আমি পুলিশ পার্কে যাবো না ।
-সেটা আপনি জানেন ? যদি জানতে চান তাহলে আসবেন । না চাইলে না ।
আমি সত্যি সত্যিই গেলাম না ।
চেয়ারে বসতে বসতে জয়ন্তী আর একবার হাসল । হাসিটা দেখে বুকের ভিতর কেমন যেন একটা কষ্ট অনুভব করলাম । একটা সময় ছিল এই হাসি ছাড়া দিন কাটতো না কিছুতেই আর আজ কত দিন পর এই হাসি দেখলাম ।
৭ বছর !
হুম মুটামুটি সাত বছর তো হবেই ।
জয়ন্তী আমার দিকে তাকিয়েই আছে । আমি ইতস্তর করতে করতে বললাম
-সুমিত তো গাজীপুর গেছে ।
জয়ন্তী হেসে বলল
-অপু তুমি খুব ভাল করেই জানো আমি সুমিতের সাথে দেখা করতে আসি নি !!
(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ রাত ১২:০৭