পিয়ন সলিম চা দেওয়ার পরেও চলে গেল না । দাড়িয়ে রইল ।
-কিছু বলবা ?
সলিমের মুখ দেখেই মনে হচ্ছিল যে কিছু বলবে । কিন্তু ঠিক যেন বলতে ভয় পাচ্ছে ।
সলিম বলল
-কালকের সেই সাহেব এসেছে ?
-কে ?
-ঐ, কাল যে এসেছিল আপনার সাথে দেখা করতে ।
মেজাজটা খানিকটা খারাপ হল । সলিম কে বললাম
-কাল আমি কি বলেছিলাম ?
সলিম খানিকটা কাচুমাচু হয়ে বলল
-আমি ওনাকে বলেছিলাম আপনি ওনার সাথে দেখা করতে চান না । তবুও খুব করে ধরলো !! আমি না করতে পারলাম না । বলল যে একটু কথা বলতে চায় ।
আপনা আপনি আমার মেজাজটা আরো খারাপ হয়েছে গেল ।
এই ছেলেটা পেয়েছে কি ?
নিজেকে কি ভাবে ?
সে যেমন টা ভাবে সব কিছু তেমনই হবে !
বললাম
-কোথায় আছে ?
-ম্যাডাম ওয়েটিং রুমে বসে আছে ।
ওয়েটিং রুমে গিয়ে দেখি ছেলেটা মাথা নিচু করে বসে আছে । আমাকে দেখেই উঠে দাড়াল ।
অপু কিছু বলতেই যাচ্ছিল কিন্তু ওকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বললাম
-কি পেয়েছেন আপনি ? এভাবে আমাকে বিরক্ত করার মানে কি ?
-আমি তো ..
-শুনুন আপনার কোন কথাই আমি শুনতে চাই না । আপনি এখন চলে যাবেন । আর কখনও আসবেন না ।
সলিম পিছনেই ছিল । সলিমকে বললাম
-এই লোকটাকে আর অফিসে ঢুকতে দিবা না । মনে থাকে যেন ।
আমি আর দাড়ালাম না । নিজের ডেস্কে ফিরে এলাম ।
আমার কেন জানি মনে হচ্ছে অপু এখনই চলে যাবে না । অফিসের বাইরে দাড়িয়ে থাকবে । কালকের মত করবে ।
কালকে যখন ওর সাথে দেখা করতে চাইলাম না অপু চলে গেল । ভেবেছিলাম চলে গেছে হয়তো । অফিস ছুটির পর যখন স্টাফ বাসে উঠব তখনই দেখলাম । অফিসের বাইরে যে বড় জারুল গাছটা আছে তার পাশে দাড়িয়ে আছে । তাকিয়ে আছে আমার দিকে ।
অপুর চোখে কেমন একটা বিষন্নতার ভাব, কেমন একটা অপরাধীর মত চোখ করে সে আমার দিকে তকিয়ে আছে ।
ছেলেটা কি সকাল থেকেই এখানে অপক্ষা করছিল ?
একবার মনে হল অপুকে ক্ষমা করে দেই কিন্তু পরক্ষনেই মনের অন্য পাশটা বিদ্রহী উঠল ।
কিছুতেই না !!
কিছুতেই ক্ষমা করা যাবে না ছেলেকে !
এই ছেলেটা ইচ্ছে করে আমাকে কষ্ট দিয়েছে । গত ছয়টা মাস কেবল এই ছেলেটার জন্য আমি মানষিক কষ্ট ভোগ করেছি ! এই ছেলেটাকে আমি কিছুতেই ক্ষমা করবো না ।
কাল তাই ওর দিকে না তাকিয়েই বাসে উঠে পড়েছিলাম ।
আজও কি ছেলেটা বিকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করবে ? করলে করবে না করলে করবে না !
আমার কি ?
আমি কেন ভাবছি এতো ।
কাজে মন দেওয়ার চেষ্টা করলাম । কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার ঘুরে ফিরে কেবল ঐ ফাজিল ছেলেটার কথাই মনে আসছে ।
যখন আগের অফিসে ছিলাম প্রতিটা সময় কেবল এই ছেলেটার কথাই ভাবতাম । ভাবতাম কেন ছেলেটা আমার সাথে এই রকম করে ! সবার সাথে কেমন স্বাভাবিক কেবল আমার সাথেই কেন এমন আচরন ?
আর এখনও একই কথা ভাবছি !!
আচ্ছা ছেলেটা কি সত্যি সত্যিই সরি ফিল করছে ?? একটা মানুষ তো ভুল করে ! আবার সেই ভুলের জন্য ক্ষমা চাইলে তাকে ক্ষমা করে দিতে হয় । কথাটা আব্বু বলেছিল ।
গত মাসে ঐ অফিস থেকে রিজাইন করার পর দিনই অপু বাসায় এসে হাজির । একদম সকাল বেলা । সকাল বেলা নাস্তা করতে গিয়ে দেখি আব্বুর সাথে বসে কথা বলছে । মনটা এমনতেই খারাপ ছিল অপুকে সকাল বেলা দেখে আরো খারাপ হয়ে গেল । আব্বুর সামনেই যা ইচ্ছা তাই বলে ছেলেটাকে বের করে দিলাম । আমি কেবল আমার অপমানের প্রতিশোধ নিতে চাইছিলাম । ছেলেটা মাথা নিচ করেই চলে গেল ।
আব্বু সে দিন অনেক অসন্তুষ্ট হয়েছিল আমার উপর । বলল যে
-এমন কেন করলি তুই ছেলেটার সাথে ?
-বাবা যেইটা জানবা না সেইটা নিয়ে কথা বলবা না । তুমি জানো না এই ছেলেটা আমার সাথে কি করেছে । আমাকে কত খানি ইনসাল্ট করেছে
-মানলাম করেছে কিন্তু ছেলেটা তো সরি বলতে এসেছে । ভুল মানুষ করেই । করবেই । কিন্তু কিন্তু সেই ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চাওয়াই হল মানুষের বৈশিষ্ট । আর ক্ষমা করাটাও মানুষ্যের পরিচয় ।
একবার মনেহল আব্বু কথাটা হয়তো ঠিক । কিন্তু নিজের মন কে কিছুতেই বোঝাতে পারছিলমা না । বারবার আমার ঐদিন গুলোর কথা মনে পরছিল । আমার দঃসহ দিন গুলোর কথা !
আচ্ছা ছেলেটা বলল যে আমার দৃষ্টি আকর্ষনের জন্যই নাকি সে এমনটা করেছে । এটা একটা কথা !! কারো দৃষ্টি আকর্ষনের জন্য তাকে পুরোপুরি এভাবে উপেক্ষা করতে হয় !
আমি কিভাবে ভুলে যাবো??
না কিছুতেই ভুলবো না।
ছলেটাকে ক্ষমাও করবো না ।
কিছুতেই করবো না ।
তারপর থেকেই ছেলেটাকেই কেবল দেখতাম । আমার সাথে কথা বলতে চাইতো ! আমি কিছুতেই পাত্তা দিতাম না । এখনও দিবো না ।
কোনদিন দিব না !!
অফিস থেকে বের হতে হতে অন্ধকার হয়ে গেল । বাসে উঠতে যাবো ঠিক তখন আবার ঐ জারুল গাছটার দিকে চোখ গেল । ছেলেটা দাড়িয়ে আছে ! আমি নিশ্চিত ছেলেটা দাড়িয়ে আছে । যদিও খুব স্পষ্ট করে দেখা যাচ্ছে না কিন্তু আমি জানি ছেলেটা দাড়িয়েই আছে ।
আচ্ছা একবার কি শুনে নিবো ছেলেটা কি বলে ?
ছেলেটাতো মেন হয় প্রতিদিনই এখানে দাড়িয়েই থাকবে !!
না কি হবে শুনে ?
কিন্তু না শুনলে ছেলেটা তো আমার পিছু ছাড়বে না !
বাসের ড্রাইভা রকে বললাম যে আমার জন্য অপেক্ষা না করতে ! তারপর ছেলেটার দিকে হাটা দিলাম ।
রেস্টুরেন্টের টিমটিম আলো তে ছেলেটার চেয়ারা টা কেমন যেন লাগছে । বিষন্ন তবে অন্য দিনের তুলনায় কম !
আমি বললাম
-আপনাকে দেখছি আপনি কদিন ধরে কেবল আপনার পেছনে লেগে আছেন ? আপনা রআর কোন কাজ নাই ? অফিস যান না ?
ছেলেটা মাথা তুলে তাকালো !!
-আমি চাকরী ছেড়ে দিয়েছি !
এটা আমাকে খানিকটা অবাক করলো । বললাম
-কেন জানতে পারি ?
-আমার জন্য একটা মানুষ রিজাইন করেছে, আমার ভুলের জন্য । আমি কিছুতেই শান্তি পাচ্ছি না । বশ্বাস করবেন কি না জনি না গত একমাস ধরে আমি ঠিক মত ঘুমাতে পারি নি । কোন কাজ ঠিক মত করতে পারি নি । কি যে একটা পাপ বোধ নিয়ে ঘুরে বেরাচ্ছি আমি !!
আমার কথাটা কেন জানি সত্যই মনে হল । ছেলেটার চোখ কেমন বসে গেছে, চোখের নিচে কালিও পরেছে !
ছেলেটা বলল
-আমি এই অশান্তি থেকে মুক্তি চাই , আর যতদিন না আপনি আমাকে ক্ষমা করছেন ততদিন আমি শান্তি পাবো না । কিছুতেই শান্তি পাবো না ।
আমি বললাম
-আর আমি যে ভাবে দিন গুলো পার করেছি সে টার কি হবে । আমি বিনা কারনে কষ্ট পেলাম সেটার কি হবে ? দেখুন অপু সাহেব আমি ছোট বেলা থেকেই খুব জাদি টাইপের মেয়ে । আমাকে কেউ আঘাত দিলে আমি সহজে ভুলতে পারি না ।
-আপনি কি করতে বলেন আমাকে ? আপনি যা বলবেন তাই আমি করতে প্রস্তুত !!
আমি কিছু বললাম না । ভাবতে লাগলাম কি বলবো ?
কি করলে ছেলেটার উপর আমার রাগ কমবে ?
মাথা টাক করে ঘোল ঢেলে দিবো ?
নাকি সারা রাত বুড়িগঙ্গার পানিতে বসে থাকতে বলব ?
অথবা সবার সামনে কান ধরে উঠবস করটে বলবো
কি বলবো ?????
ছেলেটা তখন বলল
-আমি একটা কথা বলব ?
-বলুন?
-ঠিক খুজে পাচ্ছে না তো আমাকে কি শাস্তি দিবেন ? আমি একটা উপায় বলব?
-বলুন ।
-আপনি আমাকে বিয়ে করে ফেলুন !
-মানে ?
-আগে শুনুন ! বিয়ের পর আমার লাইফটা ভাজা ভাজা করে ফেলবেন আমি কিছু বলতে পারবো না । সব কিছু সহ্য করে নিতে হবে । ভাল বুদ্ধি না একটা । যে আপনাকে কষ্ট দিয়েছে তাকে সারা জীবন যন্ত্রনা দেওয়া পারমিট পেয়ে যাবেন !
-আপনার বক্তব্য শেষ হয়েছে । আমি আসি আমার এখানে আসাটাই ভুল হয়ে গেছে !
আমি উঠতে গেলেই অপু আমার হাত চেপে ধরলো !! বলল
-নিশি, আমি জানি আমি ভুল করেছি কিন্টু বিশ্বাস কর যাই করেছি কেবল মাত্র তোমার এটেনশন পাবার জন্য ! তোমার কাছে........। প্লিজ এভাবে যেও না ! আমাকে আর একটা বার সুযোগ দাও ! দেখ আমি ঠিক যেভাবে তোমাকে কষ্ট দিয়েছি তার থেকেও হাজার গুন ভালবাসা দিয়ে তোমার জীবনটা ভরে দেব ।
কেন জানি আমার দম বন্ধ হয়ে গেল অপু কথাটা শুনে । অপুর চোখ দুটো কেমন আকুল হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে । আর যাই হোক ওখানে কোন ছলনা আমি দেখতে পেলাম না ।
অপুর চোখে কি পানি ?
ও কি কাঁদছে ?
আমি ক্ষ্যাল করলাম আমার চোখে পানি চলে এসেছে !
আমি কি কাঁদছি !
আশ্চর্য !!
বড় অদ্ভুদ মানুষের মন !!
আমি বসে পড়লাম আবার !!
বলল
-খুব জ্বালাবো কিন্তু ! কিছু বলতে পারবে না !
অপুর চোখ দিয়ে তখন পানি গড়িয়ে পড়লো । হেসে বলল
-একটা টু শব্দও কোনদিন করবো না !!
যেভাবে অফিসের আকর্ষনীর মেয়েটির দৃষ্টি আকর্ষন করতে সক্ষম হলাম !!
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১২ রাত ১১:৪২