আরমানের সকাল বেলা টিউশনীতে যেতে একদম ভাল লাগে না । কিন্তু কিছু করার নাই । তার ছাত্রের টাইট সিডিউলের কারনে বুধবার তাকে সকাল বেলা পড়াতেই হয় । সকাল বেলা গেট থেকে বের হয়েই আরমান পল্টু কে দেখতে পেল । দেখবে জানতো ! একটা ব্যাপার আরমানের ভাবতে খানিকটা অবাক লাগে যে আরমান যখনই বাসা থেকে বের হয় কুকুরটাকে ঠিক গেটের সামনে বসে থাকতে দেখে । এমন না সারাদিন কুকুরটা গেটের সামনে থাকে । আরমানদের বাড়ির সামনের দিকটা আরমানের রুম থেকে স্পষ্টই দেখা যায় । কিন্তু ও পল্টুকে কখনই নিজের রুম থেকে দেখতে পায় না । কিন্তু যখনই ও বাইরে বের হবে দেখবে পল্টু ঠিক সামনে বসে আছে । ওকে বেরুতে দেখলেই উঠে দাড়াবে এবং লেজ নাড়িয়ে একবার বলবে
"ঘেউ"
আসলে আরমানের মনে হয় পল্টু বলে বস আমি আছি । উপস্থিত ।
আরমান হাসল পল্টুকে দেখে ।
আরমান জানে ও যখন হাটা দিবে পল্টু ঠিক ওর পেছন পেছন আসবে । প্রথম প্রথম ব্যাপারটা আরমানের ভাল না লাগলেও এখন খারাপ লাগে না ।
রমিজ মামার দোকানে গিয়ে দুইটা বাটার বন চাইল । একটা তার নিজের জন্য অন্যটা পল্টুর জন্য !!
পল্টুকে কন জানি বাটার বন খুব পছন্দ করে । আরমানের জানাই ছিল না যে কোন কুকুর বাটার বন খেতে পারে । আরমান যতদুর জানে কুকুর মাংশাসী প্রানী, পাউরুটি খাওায়র কথা না ।
প্রথম যেদিন বাটার বন খাচ্ছিল পল্টু ঠিক ওর পাশেই বসে ছিল । কুকুর রা যে ভাবে খাবারের দিকে তাকিয়ে থাকে পল্টু ঠিক ওভাবে তাকিয়ে ছিল না ওর দিকে, কেমন একটা লজ্জা লজ্জা ভাব নিয়ে মাঝে মাঝে তাকাচ্ছিল আরমানের দিকে । আরমান কি মনে হল বলল
-কি রে খাবি ?
পল্টু চেহারার লজ্জা লজ্জা ভাবটা যেন আরো একটু ফুটে উঠল । আরমানের মনে হল হয়তো চোখের ভুল । তা না হলে কোন কুকুর কি এমন ভাবে এক্সপ্রেশন দিতে পারে ।
আরমান ভেবেছিল যে কুকুর টা হয়তো কাবে না । কুকুর তো পাউরুটি খায় না । তবুও একটুকরো ছিড়ে এগিয়ে দিল কুকুরটার দিকে ! এবং অবাক হয়ে দেখলো যে কুকুরটা পাউরুটি টা খেয়ে ফেল এবং খাওয়ার ধরন দেখে মনে হল যে কুকুরটা যথেষ্ঠ ক্ষুদার্থ ! হাতের বাকি টুকুও সে ছুড়ে দিল কুকুর টার দিকে । পিচ্চি কুকুরটা পাউরুটির অংশটুকুমখে নিয়ে চলে গেল ওর সমনে থেকে ! তারপর থেকে নিয়মিত সে আরমানের মানের কাছ থেকে সকালের নাস্তা পায় !!
বাটার বনটি পল্টুর দিকে ছুড়ে দিতেই পল্টু ওটা মুখে করে নিয়ে দৌড় দিল । প্রতিদিনই দেয় । আগে আরমানে রমনে হত হয়তো আড়ালে গিয়ে খায় হয়তো । কিন্তু একদিন লক্ষ্য করে দেখে পল্টু পাউরুটি টা মুখ নিয়ে একটু দুরে দাড়ালো আরো দুটো বিশাল সাইজের কুকুরের কাছে যায় । আমাদের দেশে এতো বড় কুকুর খুব একটা দেখে যায় না । বিশেষ করে রাস্তার ককুর ! তারপর তিনজন মিলে বাটার বনটা শেষ করে ।
আরমানের কাছে এই ব্যাপারটা আগে অদ্ভুদ লাগতো ! কুকুররা সব সময় খাবার নিয়ে মারামারি করে । কে বেশি খাবে এটা নিয়ে তাদের ভিতর লেগেই থাকে ! কিন্তু এই তিনটি কুকুরের আচরন একদমই আলাদা ।
ওর মনে হয় বড় কুকুর দুটো পল্টুর বড় ভাই । কেমন যত্ন করে দুজনই পল্টুকে খওয়ায় । দেখতে ভালই লাগে !!
আরমান ঐদুইজনের নাম দিয়েছে পল্টু ব্রাদার্স !!
নাহ আরমানের দেরি হয়ে যাচ্ছে । আর একটু দেরি হয়ে গেলে আজ আর পড়ানো হবে না । আরমান রাস্তায় বের হয়ে পড়ল ।
-আরমান ভাই ! আরমান ভাই !
আরমান পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখে বীথি এগিয়ে আসছে ।
-আরমান ভাই কখন থেকে ডাকছি আপনাকে ! শুনেন না নাকি ?
আরমান একটু হাসার চেষ্টা করলো ।
-না মানে ক্ষ্যাল করবেন কেন ? মানুষ যাদের এড়িয়ে চলতে চায় তাদের কথা শুনতে চায় না ।
আরমান আবার হাসার চেষ্টা করল । বলল
-না এমন কোন কথা না !
আরমান খুব জোর দিয়ে কথাটা বলতে পারল না কারন কথাটা আসলেই সত্য । বীথিকে আরমান একটু এড়িয়েই চলে । চলে মানে চলতে বাধ্য হয় ।
আরমান যখন প্রথম এই এলাকায় আসে এখন একদিন সন্ধ্যা বেলা বাসায় আসছিল । গলির ভিতর আসতেই চারপাঁচ জন ছেলে ওকে ঘিরে ধরে । প্রথমে ও ভেবেছিল হয়তো ছিনতাই কিন্তু ছেলেগুলো ওকে আর একজনের কাছে নিয়ে গেল । নেতা গোছের একজন ! আরমানকে জিজ্ঞেস করলো
-কি নাম ?
আরমান ভয়ে ভয়ে উত্তর দিল
-আরমান ।
-আজহার সাহেবের বাসায় ভাড়া এসেছ ?
-জি ।
-বীথিকে চেন ?
-জি না ।
-চিনো না ?
এই কথা শুনে পাশের ছেলেগুলো কেমন হাসতে লাগল । ছেলেটা আবার বলল
-চিনো না ভাল কথা । আর যেন চিনতে না দেখি । যেদিন চিনবা বুঝবা সেদিন তোমার খবর আছে । ১০০ হাত দুরে থাকবা ঐ বীথির কাছ থেকে । মনে থাকবে ?
-জি । যাও ।
আরমান খুবই ভয় পেয়েছিল । পরে জানতে পারল যে ঐটা শরীফ গ্যাং । পাড়ার উঠতি মাস্তান । আর যে বীথির কথা বলল মেয়েটা ওদের পাশের বাসাতেই থাকে ।
পাড়ায় নতুন কোন ছেলে আসলেই শরীফ আগে সেই ছেলেকে সাবধান করে দেয় যাতে বীথির দিকে চোখ তুলে না চায় ।
বিকেলবেলা ছাদে উঠলে আরমান প্রায়ই বীথিকে দেখতে পেত । কি মোলায়েম আর সিগ্ধ্য একটা চেহারা । তাকিয়ে থাকলে কেবল তাকিয় থাকতেই ইচ্ছা করে ।
কিন্তু আরমান চোখ ফিরিয়ে নিত । শরীফ গ্যাংয়ের হাতে প্যাদানী খাওয়ার কোন ইচ্ছাই তার নেই ।
সব কিছু ভালই চলছিল কিন্তু পল্টু মাঝখান দিয়ে সব গড়বড় করে দিল । আরমানের বাসায় আসতে আসতে প্রতিদিনই সন্ধ্যা পার হয়ে যায় । সেদিনও সন্ধ্যা হয়ে গেছিল । আরমান গলির ভিতর ঢুকতেই দেখতে পেল বীথি কেমন দৌড়ে আসছে ওর দিকে । চেহারায় একটা আতংকের ছাপ । আরমানের কাছে আসতেই কোন রকম বলল
-কু-কুকুর!!!!!
আর একটু এগিয়ে গিয়ে দেখে পল্টু । আরমান কে দেখেই পল্টু দাড়িয়ে গেল । আরমানের মনে হল পল্টু যেন দাত বের করে হাসতেছে । ওকে যেন বলতেছে "বস !! দেখেন আপনার পথ ক্লিলিয়ার করে দিলাম" ।
আরমানের তাবড়েই পল্টু উল্টো দিকে দৌড় দিল । ততক্ষনে বীথি ওর পাশে চলে এসেছে । হাপাচ্ছে । একটু দম নিয়ে বলল
-আপনাকে কি বলে যে ধন্যবাদ দিবো আরমান ভাই ।
আরমান খানিকটা চমকালো ।
বীথি ওর নাম জানে ?
আশ্চার্য !
নাম কিভাবে জানে ?
আরমান বলল
-না ধন্যবাদ দেওয়ার কি আছে । ঐ কুকুর আপনাকে কামড়াতো না । এমনিতেই লাফালাফি করছিল ।
-না কামরাক ! আমি কুকুর খুব ভয় পাই । আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ ।
আরমান যতই বীথির কাছ থেকে দুরে থাকতে চায় বীথির সাথে ওর ততই দেখা হয়ে যায় । আল্লাহ জানে কবে শরীফ গ্যাংয়ের ছেলেপিলে ওদের একসাথে দেখে ফেলবে , নাকি ইতিমধ্যে দেখে ফেলেছে কে জানে ?
-কোন দিকে যাচ্ছেন ?
-আমি ? এইতো পরীবাগের দিকে ?
-ঐ দিকে কি ?
-টিউশনি !
-চলেন আপনাকে নামিয়ে দেই । আমিও ঐ দিকেই যাবো ।
-না মানে আপনিকেন খামোখা কষ্ট করবেন !
-বুঝেছি আপনি আমার সাথে যেতে চান না ।
-না আসলে ঐরকম না............।
আরমান কোন জুটসই কথা খুজে পেল না । যেতেই হল বীথির সাথে । বীথির সাথে রিক্সায় ওঠার আগে পল্টুর দিকে তাকাল একবার ।
বেটা ফাজিলটা কেমন দাত বের করে হাসছে !
আরমান মনে মনে বলল "দাড়া বেটা আজ ফিরে এসে নি । তোর খবর আছে" ।
কিন্তু ফিরে এসে আরমানের খবর খারাপ হয়ে গেল । গলির ভিতর ঢুকতেই শরীফ গ্যাংয়ের কয়েকজন ওকে বেধড়ক পিটালো । আর সাশিয়ে গেল যেন একমাসের ভিতর এই এলাকা ছেড়ে চলে যায় । আরমানের কিছুই করার থাকলো না । এই সব মাস্তান পোলাপাইনের সাথে লাগতে যাওয়া ওর কর্ম্য নয় । আর ওর এমন কোন বন্ধুবান্ধবও নাই যে ওকে এখানে সাপোর্ট দেবে ।
ভালই চলছিল আবার নতুন জায়গায় যেতে হবে ! মন খারাপ নিয়েই আরমান ঘুমাতে গেল । সকাল বেলা বাইরে কোথাও পল্টুকে দেখতে পেল না ।
আশ্চর্য !
এমনটা তো হয় না । ঐ দিনের পর পল্টু কোনদিন তার উপস্থিতি দিতে ভুল করতো না ।
কিন্তু আজ গেল কোথায় ? আরমান ভেবে পেল না ।
পল্টুকে সে প্র প্রথম রমিজ মামার দোকানটার পাশে দেখতে পেয়েছিল । সেদিন খুব বৃষ্টি হচ্ছিল । রমিজের দোকান থেকে সকালে রুটি বানানোর জন্য ময়দা কিনে বাসায় আসছিল । বৃষ্টির পরিমান এতোই ছিল যে ছাতাতে কিছুতেই কুলাচ্ছিল না ।
আরমান তাড়াতাড়ি পা চালালো তখনই ওর চোখ গেল রাস্তার পাশের ছোট্টা দেওয়ালের পাশে । একটা কুকুর বৃষ্টিতে ভিজে একাকার । কেমন করুন চোখে আরমানের দিকে তাকিয়ে আছে ।
আরমান একবার ভাবল যে এভোয়েদ করে চলে যাবে । কিন্তু চলে যেতে পারলো না । কুকুরটার দিকে এগিয়ে গেল । বৃষ্টিতে কুকুরের কিছু হয় না কিন্তু এই কুকুরটার অবস্থা আসলেই খারাপ । কুকুরটার পায়ের কাছে কেমন একটা ঘাঁ হয়েছে । বৃষ্টিতে ভিজে ঘাঁ টার অবস্থা আরো ভয়াবহ ।
আরমানের কিছুই করার ছিল না কিন্তু কুকুরটাকে ছেড়ে আসতে মন চাইছিল না কিছুতেই । আরমান পকেট থেকে টিস্যু পেপার বের করে কুকুরটার ঘাঁ টা কোন রকম পরিস্কার করে ওখানে ময়দা দিয়ে ঢেকে দিল । এটা অন্তত কুকুরটাকে একটু আরাম দিবে । আরমান তবুও কুকুরটা ছেড়ে চলে আসলো না । কুকুরটাকে কোলে করে এনে ওদের বাড়ির গেটের এক কোনায় রেখে দিল যাতে বৃষ্টিতে আর না ভিজে ।
পরদিন সকাল বেলা আরমান যখন বাসার বাইরে বের হল তখন ছোট্ট কুকুরটাকে দেখলো তখনও গেটের কোনায় শুয়ে আছে । মনটা ভাল হয়ে গেল এই দেখে যে কুকুরটার অবস্থা বেশ ভাল । ময়দা দেওয়ায় ঘাঁ টাও কেমন শুকিয়ে গেছে । তারপর থেকে প্রতিদিন গেট থেকে বের হলেই কুকুরটাকে দেখতে পেত । একদিন মজা করে নামও দিল ।
পল্টু ।
আর অবাক হবার বিষয় পল্টু নাম ধরে ডাক দিলে কুকুরটা সাড়াও দিতে লাগল ।
কিন্তু আজ কোথায় গেল পল্টু ? পল্টু ব্রাদার্সও কোন দেখা নাই । রমিজ মামার দোকানে গিয়ে আসেপাশে দেখা গেল না । বাটার বন একা একাই খেল আরমান ।
গলির মুখে শরীফ গ্যাং কেও দেখা গেল না ।
আজ গেল কোথায় সব ?
গেট দিয়ে ঢুকতে যাবে এমন বীথি এসে হাজির ।
-আরমান ভাই খবর শুনেছেন ?
-কি খবর ?
-আপনি জানেন না ?
-না । কি হয়েছে ?
-আরে গলির মোরে কয়টা ছেলে বসে আড্ডা মারতো না ।
-শরীফ দের কথা বলছেন ?
-আরে আপনি চেনেন দেখছি । কাল রাতে একদল কুকুর ওদের উপর হামলা চালিয়েছি ।
-মানে ?
-আমি খুব ভাল করে জানি না তবে যারা দেখেছে তারা বলল যে দুটো বড় কুকুর আর একটা ছোট কুকুর ওদের উপর আচমকা ঝাপিয়ে পড়ে ।
আরমানের বুকের ভিতরটা কেমন তোলপাড় শুরু হয়ে গেল ।
-কারো কিছু হয় নি তো ?
-শরীফের অবস্থা খুব খারাপ । ওকেই নাকি বেশি কামড়িয়েছে । বীথি আরো কিছু বলছিল কিন্তু আরমানের মনের চলছে অন্য কথা !!
আজকাল মানুষ উপকারে কথা মনে রাখে না কিন্তু একটা কুকুর ঠিকই মনে রাখলো । উপকারের প্রতিদান দিয়ে গেল !!
তারপর থেকে আর কোনদিন আরমান পল্টুর দেখা পায় নি !
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই সেপ্টেম্বর, ২০১২ বিকাল ৩:১৩