নিহিন আমার কথার কোন জবাব দিল না । মাথা নিচ করে বইয়ের দিকে তাকিয়ে রইল । আমি খুব ভাল করেই জানি ও কিছু পড়ছে না । আমার কথার জবাব দিবে না বলে এভাবে তাকিয়ে আছে । আমি আবার বললাম কথাটা
-নতুন স্যার ঠিক হয়েছে ?
-জি না ।
-আশ্চর্য ! কেন ? স্যার ঠিক কর নি কেন ?
-অন্য কোন স্যারের কাছে পড়বো না তাই ?
-মানে কি ?
এবার নিশি আমার দিকে তাকালো চোখ তুলে । খানিকটা তীব্র কন্ঠে বলল
-মানে তো আপনার জানা দরকার নাই । আপনি পড়াবেন না ব্যাস ! আমি কার কাছে পড়বো বা না পড়বো সেটা নিয়ে আপনার না ভাবলেও চলবে ।
আমি খানিকটা আহত হলাম ।
এমন তীব্র জবাব না দিলেও পারতো মেয়েটা ! আজকেই নিহিন কে শেষ বারের মত পড়াতে আসছি । কাল থেকে আর আসবো না ।
নিহিন আর আমার সামনে বসলো না । উঠে চলে গেল । আমি ওর ঘরটাতে বসে রইলাম । চুপচাপ ।
নিহিনদের বাসায় পড়াতে শুরু করেছিলাম কয়েক মাস আগেই । আমার বড় ভাইয়ের বন্ধু রফিক ভাইয়ের মাধ্যমে টিউশনিটা পাই আমি । রফিক ভাই টিউশনি দেওয়ার আগে আমাকে বলল
-পড়াতে যাচ্ছ । কেবল পড়াবেই । অন্য কিছু যেন না শুনি ! মনে রেখ আমার রেফারেন্সে যাচ্ছ তুমি !
আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম । কিন্তু ঠিক কি কারনে রফিক ভাই আমাকে এমন একটা কথা বলল বুঝতে পারলাম না । আমাদের এলাকায় আামর যথেষ্ট সুনাম রয়েছে । রফিক ভাই এটা ভাল করেই জানেন , বিশেষ করে নারী ঘটিত কোন সমস্যা আমার কোন দিন হয় নি । সারা জীবন কেবল পড়াশুনা নিয়েই ব্যস্ত থেকেছি , অন্য কিছু করার সময় কোথায় !!
প্রথম যেদিন পরাতে এলাম সেদিনই টের পেলাম যে রফিক ভাই এমন একটা কথা আমাকে কেন বলেছিল ।
আমি নিহিনের ঘরে বসে থাকলাম আরো কিছুক্ষন । মনে হল নিহিন আর একবার হয়তো আসবে । কিন্তু আর এল না । একটু পরে ওর মা এল । আমি বিদায় নিয়ে চলে এলাম । ওদের বাড়ি থেকে বের হবার সময় কেন জানি একটা কষ্ট হচ্ছিল । বার বার মনে হচ্ছিল যে নিহিন কে আমি আর দেখতে পাবো না !
ঐ মিষ্টি হাসিটা আর আমাকে পাগল করবে না !
আর আমি চাইলেও ঐ মেয়েটার সাথে কথা বলতে পারবো না !
একবার মনে হল কি দরকার ছিল এমন টা করা !! চুপচাপ থাকতাম ! বলতে না পরলেও অন্তত সপ্তাহে চারটা দিন আমি নিহিনকে দেখতে তো পারতাম । এটাই বা কম ছিল কি ?
রফিকভাই বলেছিলেন যে একটা মেয়েকে পড়াতে হবে কিন্তু নিহিনকে দেখার পর আমি মোটামুটি আমার ভাষা হারিয়ে ফেললাম কিছুক্ষন । ওর সামনে স্বাভাবিক হতে কিছুটা সময় লাগলোই । প্রথম দিন আমি চুপ চাপ বসে ছিলাম । এদিক ওদিক দেখছিলাম । এক জন চা দিয়ে গেল । আমি চায়ে চুমুক দিবো ঠিক তখনই মেয়েটা ঘরে ঢুকলো মাথা নিচ করে । আমার সামনে বসলো । আমি চায়ে চুমুক দিতে ভুলে গেলাম ।
মিষ্টি স্বরে মেয়েটি বলল
-আপনাকে কি স্যার বলতে হবে নাকি ভাইয়া বলে হবে ?
মেয়েটির প্রশ্নে যেন বাস্তবে ফিরে এলাম । বললাম
-কি বললে ?
-এর আগে যে কয়জন পড়াতে এসেছে তারা সবাই ভাইয়া বলতে বলত । কিন্তু আম্মু স্যার বলতে বলেছে ।
-না ঠিক আছে । স্যারই ঠিক আছে । ভাইয়া বললে কেমন পড়া লেখার সম্পর্ক মনে হয় না । স্যার ই বল !!
মেয়েটি চুপ করে রইলো মাথা নিচ করে । আমি আমার চোখ ফিরিয়ে নিলাম । রফিক ভাইয়ের সতর্কবানী মনে পড়লো ।
আমাকে কেবল পড়াতে হবে এই মেয়েটিকে !
শুধুই পড়াতে হবে !!
ঐদিন বাসায় এসে আমার কেন জানি রাতের বেলা আর ঘুম এলো না । কেবলই এপাশ ওপাশ করতে লাগলাম । কি একটা অস্বস্থিরতা আামকে যেন ঘুমাতে দিচ্ছিল না । রাত তখন তিন কিছু বেশি বাজে । আমি আবিষ্কার করলাম যে আমি নিহিনের প্রেমে পড়েছি । কত সহজেই আমি ওর প্রেমে পরে গেলাম ।
আশ্চর্য !!
নিয়মিত পড়াতে যেতাম । নিহিন প্রথম প্রথম কথা কম বললেও আস্তে আস্তে ও স্বভাবিক হয়ে এল । আমিও মোটামুটি সহজ হয়ে এলাম । পড়া লেখা ছাড়াও মেয়েটা অনেক কথা বলত । আমার কেন জানি মনে হত মেয়েটা কথা বলার জন্য মনের মত মানুষ পেত না । ওর কথা শুনেই বোঝা যেত যেন কত দিন ঠিক মত কারো সাথে কথা বলে না ।
আমি ওর কথা শুনতাম মন দিয়ে !! মাঝে মাঝে আমার কথা বলতাম । তবে কথা ও ই বেশি বলত !!
আমি ভেবেছিলাম নিহিন কেবলই আমার সাথে কথা বলে ! এর বেশ কিছু না ! আমি ওর স্যার ! ওর সাথে আমার একটা সহজ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে এর বেশি কিছু না । কিন্তু একদিন বুঝতে পারলাম যে ব্যাপার গুলো এতো সহজ না যততা না আমি ভেবেছিলাম !
একদিন ওকে পড়াতে পড়াতে বাথরুমে গেছিলাম । হাত মুখ ধোয়ারও দরকার ছিল । মোবাইলটা বাইরেই ছিল । আমি মোবাইলটা আর সাথে করে নিয়ে গেলাম না। টেবিলের উপর রেখেই বাথরুমে ঢুকলাম । ফিয়ে এসে নিহিনকে আবার পড়াতে বসেছি দেখি ওর মুখটা কেমন যেন ভার ভার !!
কি হল ? একটু আগে তো ভালই ছিল ! আমি কারন টা জানতে চাইলাম ও কিছু বলল না । মাথা নিচ করে বইয়ের দিকে তাকিয়ে রইল । আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না । পড়িয়ে বেরিয়া আসার পর মোবাইল চেক করে দেখি সুমনা ফোন দিয়ে ছিল । সুমনা আমার ক্লাস মেইট !! দুবার ফোন দিয়েছে !! সময়টা দেখে মনে আমি যখন বাধরুমে ঢুকেছিলাম তখন !!
আমার কিছু মনে হল না । আবারও ঠিক একই ঘটনা ঘটলো । এবার আমি লক্ষ্য করলাম নিহিনের মুড আবার অফ হয়ে গেল । একদিন নিহিন আমাকে জিজ্ঞেস করেই ফেলল সুমনার কথা !
-স্যার, সুমনা আপু কি আপনার গার্লফ্রেন্ড ?
আমি খানিকটা আশ্চার্য হই ! বললাম
-তুমি সুমনাকে কিভাবে চিনো ?
নিহিন মাথা নিচু করে রইলো কিছুক্ষন । তারপর বলল
-না আপানর মোবাইলে তো প্রায়ই ওনার কল আসে । চিনি না ঠিক নাম দেখেছি !
নিহিনের চোখে মুখে কেমন একটা ভাবছিল সেটা আমার কছে একদম অচেনা । আমি হেসেই বললাম
-না । গার্লফ্রেন্ড না !
-তাহলে আপনাকে এতোবার ফোন দেয় কেন ?
-ফোনতো দিতেই পারে ! একসাথে পড়ি না আমরা ! ক্লাসমেট না আমার !!
-ক্লাসমেট না ছাই !!!
-কি বললে ?
-না কিছু বলি নাই !
আমি ওর মুখ দেখ স্পষ্টই বুঝতে পারলাম যে অন্য মেয়েরা যে আমাকে ফোন দেয় এটা নিহিন পছন্দ করছে না ।
আমি এতোদিন নিজেকে শাসন করে রেখেছিলাম সেটা কেন জানি খুব কঠিন হয়ে পরলো ।
নিহিনকে রাতের বেলা ভাবনা টা আরো যেন বাড়িয়ে দিলাম । কেবলই ওর কথাই মনে হত । অন্য কিছু না ।
তারপর সিদ্ধান্ত নিলাম আর না ।
এই মেয়েটার কাছ থেকে আমাকে দুরে যেতে হবে ! চোখের সামনে ওকে এভাবে দেখতে থাকলে একটা সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রন করা কষ্টকর হয়ে যাবে ।
যেদিন বললাম যে আমি আর তোমাকে পড়াতে আসতে পারবো না, নিহিন কিছুক্ষন আমার দিকে তাকিয়ে রইলো !!
-কেন স্যার ? আর কেন পড়াতে আসবেন না ?
-আসলে পড়া লেখার খুব চাপ ইদানিং । আমি ঠিক পেরে উঠছি না
ওর মাকেও বললাম কথাটা । বললাম সামনের মাস থেকে নতুন স্যার ঠিক করে নিতে !!
আমি কেবল অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম নিহিনের দিকে । ওদের বাড়িতে পড়ানো ছেড়েছি প্রায় এক মাস । এরই মাঝে মেয়েটার চেহারা কেমন হয়ে গেছে । চোখের নিচে কালী পড়েছে । গাল দুটো কেমন বসে গেছে । আমি নিহিনকে বললাম
-কি হয়েছে তোমার ?
কোন জবাব নাই । মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে মেয়েটা ।
-কথা বল প্লিজ ! কি হয়েছে !
তবুও নিহিন কিছু বলল না । চুপ করে দাড়িয়েই রইলো । আমি জানি এই প্রশ্নের জবাব সে আর দিবে না । তাই জানতে চাইলাম না ।
-এখানে কি কোন কাজে এসেছ?
নিহিন মাথা নাড়লো ।
-কি কাজে ?
আবার চুপ ! এই মেয়েটা কে নিয়ে আমি কি করবো ।
তবে ভার্সিটির ভিতর এভাবে ওর সাথে দাড়িয়ে কথা বলাটা মনে হয় ঠিক হচ্ছে না । কারন হল নিহিনের গায়ে স্কুল ড্রেস । মেয়েটা বোধ হয় স্কুল থেকে সরাসরি চলে এসেছে !!
কিন্তু এখন তো দুপুর বেলা । একটার কিছু বেশি বাজে । এই সময়ে তো স্কুল ছুটি হবার কথা না । তাহলে?
আমি বললাম
-তোমার স্কুল কি ছুটি হয়ে গেছে?
আমি ভেবেছিলাম নিহিন এই প্রশ্নটার জবাবও দিবে না কিন্তু দিল । আমার কথা শুনে ফিক করে হেসে পরলো । এতোক্ষন গম্ভীর ছিল এভাবে হঠাৎ করে হেসে ওঠাটা কেমন যেন লাগলো !!
-হাসলে যে?
নিহিন বলল
-স্কুল পালিয়েছি !
-সেকি কেন ?
-আপনার সাথে দেখা করবো বলে । আপনি তো আর আমার সাথে দেখা করবেন না তাই লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে আমি দেখা করতে এলাম ।
আমি তাজ্জাব হয়ে গেলাম মেয়েটার কথায় । এই টুকু একটা বাচ্চা মেয়ে কি বলছে এসব ?
-তুমি কি বলছো এসব ?
নিহিন গম্ভীর হয়ে গেল । শান্ত গলায় বলল
-আপনি কেন আমাকে পড়ানো বন্ধ করে দিলেন বলেন তো?
-আমি তো আগেই বলেছি আমার পড়া লেখায় সমস্যা হচ্ছিল ।
-যারা মিথ্যা কথা বলতে পারে না তাদের মিথ্যা বলা উচিৎ না । সত্যি করে বলেন । আমি জানি সত্যি কথাটা কি তবুও আপনার মুখ থেকে শুনতে চাই !!
এর চোখ মুখ দেখে আমার আসলেই মনে হল যে আমার মনের কথা টা ও খুব ভাল করে জানে ।
নিহিন ঘাসের উপর বসে পড়লো । আম বসলাম ওর পাশে । অনেকক্ষন চুপ থাকার পর বললাম
-আমি গরিব মানুষ নিহিন । চাঁদের দিকে হাত বাড়ানো আমার সাজে না ।
-তাই না ??
নিহিন আমার দিকে এক ভাবে তাকিয়েই রইল । তারপর আমার হাতে একটা মড়ানো কাগজ দিয়ে বলল
-আমি যাই ।
-একা একা যাবা কিভাবে ? আমি পৌছে দেই । তোমাদের বাসা তো বেশ খানিকটা দুরে ।
নিহিন রাজি হয়ে গেল !! ওকে পৌছে দিলাম ওদের বাসায় । ফিরে আসার সময় মড়ানো কাগজটা খুললাম । ওখানে মাত্র একটা লাইনই লেখা । কিন্তু লাইনটা পড়ে কেন জানি আমার অদ্ভুদ একটা আনন্দ হল ।
নিহিন লিখেছে
আপনাকে ছাড়া আমি মরে যাবো
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই সেপ্টেম্বর, ২০১২ দুপুর ১:১৪